সাহিত্য জগতে এক নবদিগন্তের পথিক কবি সুকুমার রায়

মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
সুকুমার রায় ছিলেন একজন বাঙালি শিশুসাহিত্যিক ও ভারতীয় সাহিত্যে ‘ননসেন্স ছড়া’র প্রবর্তক। তিনি একাধারে লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক,রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও সম্পাদক। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকশোর রায় চৌধুরীর সন্তান এবং তাঁর পুত্র খ্যাতিমান ভারতীয় চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তাঁর লেখা কবিতার বই আবোল তাবোল, গল্প হ-য-ব-র-ল, গল্প সংকলন পাগলা দাশু এবং নাটক চলচ্চিত্তচঞ্চরী বিশ্বসাহিত্যে সর্বযুগের সেরা “ননসেন্স” ধরনের ব্যঙ্গাত্মক শিশুসাহিত্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়, কেবল অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড ইত্যাদি কয়েকটি মুষ্টিমেয় ধ্রুপদী সাহিত্যই যাদের সমকক্ষ। মৃত্যুর বহু বছর পরেও তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়ম শিশুসাহিত্যিকদের একজন।

রায়পরিবারের ইতিহাস থেকে জানা যায় তাঁদের পূর্বপুরুষ শ্রী রামসুন্দর দেও (দেব) অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়াজেলার চাকদহ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। ভাগ্যাণে¦ষণে তিনি পৈতৃক গ্রাম ত্যাগ করে পূর্ববঙ্গের শেরপুরে গমন করেন। সেখানে শেরপুরের জমিদার বাড়িতে তাঁর সাক্ষাৎ হয় যশোদলের জমিদার রাজা গুণীচন্দ্রে সাথে। রাজা গুণীচন্দ্র রামসুন্দরের সুন্দর চেহারা ও তীক্ষè বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ হন এবং রামসুন্দরকে তাঁর সাথে তাঁর জমিদারিতে নিয়ে যান যশোদলে জমিজমা, ঘরবাড়ি দিয়ে তিনি রামসুন্দরকে তাঁর জামাতা বানান। সেই থেকে রামসুন্দর যশোদলে বসবাস শুরু করেন। তাঁর বংশধররা সেখান থেকে সরে গিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলায় সূয়া গ্রামে বসবাস শুরু করেন।

সুকুমার রায় ১৮৮৭ সালের ৩০শে অক্টোবর কলকাতার এক দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থ বংশীয় ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। সুকুমার ছিলেন বাংলা শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকশোর রায় চৌধুরীর পুত্র। সুকুমারের মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে তার আদিনিবাস বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার (বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলা) কটিয়াদি উপজেলার মসূয়া গ্রামে। মসূয়াতে বসবাসের আগে তাঁর পূর্বপুরুষের আদিনিবাস ছিলো অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার অন্তর্গত চাকদহে। সুবিনয় রায় ও সুবিমল রায় তাঁর দুই ভাই। এ ছাড়াও তার তিন বোন ছিলো,তারা হলেন সুখলতা,পুণ্যলতা ও শান্তিলতা।

সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। তার পারিবারিক পরিবেশ ছিলো সাহিত্যানুরাগী, যা তাঁর মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়। পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্প ও জনপ্রিয়-বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ। উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি সুকুমারকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিলেন। এছাড়াও রায় পরিবারের সাথে জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখের সম্পর্ক ছিলো। উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন, এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং মানসম্পন্ন ব্লক তৈরির একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মেসার্স ইউ. রয় এন্ড সন্স নামে ঐ প্রতিষ্ঠানের সাথে সুকুমার যুক্ত ছিলেন।

সুকুমার রায় গ্রামের প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর কলকাতার সিটি স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বি.এস.সি. (অনার্স) করার পর সুকুমার মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলেতে যান। সেখানে তিনি আলোকচিত্র ও মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর পড়াশোনা করেন এবং কালক্রমে তিনি ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯১৩ সালে সুকুমার কলকাতাতে ফিরে আসেন।

সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কার্য ছাড়াও সুকুমার ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠির এক তরুণ নেতা। ব্রাহ্ম সমাজ, রাজা রামমোহন রায় বর্তিত একেশ্বরবাদী,অদ্বৈতে বিশ্বাসী হিন্দুধমের এক শাখা যারা ৭ম শতকের অদ্বৈতবাদী হিন্দু পুরান ঈশ-উপনিষদ মতাদর্শে বিশ্বাসী। সুকুমার রায় ‘অতীতের কথা’ নামক একটি কাব্য রচনা করেছিলেন, যা ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাসকে সরল ভাষায় ব্যক্ত করে – ছোটদের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজের মতাদর্শের উপস্থপনা করার লক্ষে এই কাব্যটি একটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি ওই সময়ের সবথেকে প্রসিদ্ধ ব্রাহ্ম ছিলেন, তাঁর ব্রাহ্মসমাজের সভাপতিত্বের প্রস্তাবের পৃষ্ঠপোষকতা সুকুমার করেছিলেন।

সুকুমার রায় একজন বাঙালি শিশুসাহিত্যিক ও ভারতীয় সাহিত্যে “ননসেন্স্ রাইমের” প্রবর্তক। সুকুমার রায়ের স্বল্পস্থায়ী জীবনে তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। সুকুমার রায়ের স্বল্পস্থায়ী জীবনে তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ লক্ষ করা যায়। সন্দেশের সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে তাঁর লেখা ছড়া,গল্প ও প্রবন্ধ আজও বাংলা শিশুসাহিত্যে মাইলফলক হয়ে আছে। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার অনন্য প্রকাশ তাঁর অসাধারণ ননসেন্স ছড়াগুলোতে। তাঁর প্রথম ও একমাত্র ননসেন্স ছড়ার বই আবোল তাবোল শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে নিজস্ব জায়গার দাবিদার।

সুকুমার ইংল্যান্ডে পড়াকালীন, উপেন্দ্রকিশোর জমি ক্রয় করে, উন্নত-মানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি ও মুদ্রণক্ষম একটি ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন। তিনি ছোটদের একটি মাসিক পত্রিকা, ‘সন্দেশ’, এই সময় প্রকাশনা শুরু করেন। সুকুমারের বিলেত থেকে ফেরার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। উপেন্দ্রকিশোর জীবিত থাকতে সুকুমার লেখার সংখ্যা কম থাকলেও উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সন্দেশ পত্রিকা সম্পাদনার দায়ত্ব সুুকুমার নিজের কাঁধে তুলে নেন। শুরু হয় বাংলা শিশুসাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়। পিতার মৃত্যুর পর আট বছর ধরে তিনি সন্দেশ ও পারিবারিক ছাপাখানা পরিচালনার দায়ত্ব পালন করেন। প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়বার সময় তিনি ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংঘ গড়ে তুলেছিলেন। এর মুখপাত্র ছিলো সাড়ে বত্রিশ ভাজা নামের একটি পত্রিকা। সেখানেই তার আবোল-তাবোল ছড়ার চর্চা শুরু। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর মানডে ক্লাব ইংরেজি ভাষা- মনডে ক্লাব নামে একই ধরনের আরেকটি ক্লাব খুলেছিলেন তিনি। মনডে ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশে সদস্যরা ‘জুতো সেলাই থেকে চডীপাঠ’ পর্যন্ত সব বিষয়েই আলোচনা করতেন। বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায় হলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যার লেখা অসাধারণ কিছু সাহিত্যকর্ম আজও প্রত্যেক বাঙালীর মনে অমর হয়ে আছে।

বিংশ শতাব্দীর ভারত তথা বাংলা সাহিত্য জগতে তিনি হয়ে ওঠেন এক নবদিগন্তের পথিক। কবি, গল্পকার ও সাহিত্যিক সুকুমার রায় ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম সার্থকভাবে; অদ্ভুত এক সাহিত্য রীতির প্রবর্তন করেন যা প্রত্যেক বয়সের পাঠকদের মন কাড়তে সমানভাবে সক্ষম হয়। যদিও সুকুমার রায় অল্প সময়ের জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি আজও তাঁর মহান সব সাহিত্যকর্মগুলোর মধ্য দিয়ে প্রত্যেক বাঙালীর মনে অমর হয়ে আছেন সমানভাবে। সাহিত্য শিল্পে তাঁর অবদানকে সত্যিই কেউ কোনোদিনই ভুলতে পারবেনা। তিনি সর্বদা আমাদের মতো প্রত্যেক বাঙালী পাঠকদের কাছে চিরদিনই আদর্শ হয়েই থাকবেন।

বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায়ের তুলনা কেবল সুকুমার রায়ই। শিশুসাহিত্য, হাস্যরসে তো বটেই,বিদ্রুপের সুরে সমাজের নানা অসঙ্গতির কথা বলতে পারাতেও তিনি অনন্য ও অসাধারণ। সুকুমার রায় মূলত শিশুসাহিত্যিক ছিলেন; কিংবা বলা যায় সুকুমার রায় কেবল শিশুসাহিত্যিকই ছিলেন। শিশুদের জন্য তিনি লিখেছেন ছড়া, গল্প, নাটক, জীবনীসহ আরও অনেক কিছু। এর বাইরেও লিখেছেন ‘বিবিধ বিষয়’, যা মূলত শিশু-কিশোরদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা জানা-অজানা তথ্য গল্পাকারে বলার প্রয়াস, এবং বলা বাহুল্য, এই প্রয়াসেও তিনি সফল।

গুরুজনদের উপদেশ শুনতে কারোই ভালো লাগে না। কিন্তু উপদেশ যদি দেন সুকুমার রায়, তবে না শুনে উপায় কী! শিশুদের শেখাতে গিয়ে সুকুমার রায় গল্প বলেছেন, ছড়া বলেছেন। গুরুজনদের কাঠখোট্টা উপদেশের বাইরে এসে গল্প-কবিতার ছলে শিখিয়েছেন কী করা উচিত এবং কী অনুচিত। পেন্সিল কামড়ানো কিংবা সিঁড়ি দিয়ে ধুপধাপ করে নেমে জুতা ছিঁড়ে ফেলা একদম ভালো কাজ নয়- এ উপদেশ দিতে গিয়ে সুকুমার রায় লিখে ফেলেছেন একটা আস্ত গল্প ; নাম ‘যতীনের জুতো’। কাউকে হিংসে না করার উপদেশ দিতে গিয়ে লিখেছেন ‘হিংসুটি’। এসব গল্প পড়ে শিশুরা আনন্দ পাবে, হেসে লুটোপুটি খাবে। কিন্তু তারা শিখবে, নিজেরাই বুঝে নেবে তাদের কী করতে হবে।

সুকুমার রায়ের সবচেয়ে মজার দিক হচ্ছে তাঁর ছড়া। শিশুদের জন্য লিখলেও তাঁর ছড়া এতটাই প্রাণবন্ত যে সেসব ছড়া বড়দের মুখে মুখেও ঘোরে। সুকুমার রায় তাঁর ছড়ায় শব্দ নিয়ে খেলেছেন, যেমন খুশি তেমন গড়েছেন। তাঁর ছড়া বা কবিতা যেমন বড়দের পড়ার বা বোঝার মতো ভারিক্কি নয়, তেমনি আবার কেবল ছোটদের জন্য লেখা হালকা চালেরও নয়। সুকুমার রায়ের ছড়া-কবিতার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য এটিই।

সুকুমার রায়ের গল্প পড়ার মাঝে আনন্দ আছে। তবে তাঁর কবিতা বা ছড়া যেমন সব বয়সের মানুষের কাছেই উপভোগ্য,গল্পের ব্যাপারে কিন্তু তা বলা যায় না। সুকুমার রায় খুবই সচেতনভাবে গল্পগুলো শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন। আর সেজন্যই গল্পগুলো আকারে ছোট এবং ভাষাও সহজ। সুকুমার রায় গল্পে গল্পে শিশুদেরকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখানোর চেষ্টা করেছেন। তবে তা ঈশপের গল্পের মতো করে নয়,গল্প বলার ভান করে উপদেশ দিয়েছেন।

পৃথিবীতে রয়েছে হরেক রকমের জীবজন্তু। কিছু জীবজন্তু আমাদের পরিচিত আর কিছু জীবজন্তু আমাদের অপরিচিত। এসব জীবজন্তুর সাথে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য সুকুমার রায় ‘জীবজন্তু’ সিরিজের নিবন্ধগুলো লেখেন। এর মধ্যে কয়েকটি হলো ‘সিন্ধু ঈগল’, ‘সেকালের বাঘ’,’তিমির খেয়াল’,’সমুদ্রের ঘোড়া’, ‘অদ্ভুত কাঁকড়া’, ‘পেকারি’, ‘ফড়িং’ ইত্যাদি। পরিযায়ী প্রাণীদের নিয়ে লিখেছেন ‘জানোয়ারের প্রবাস যাত্রা’। কেবল জীবজন্তু বা প্রাণী তো নয়, এর বাইরেও পৃথিবীজুড়ে রয়েছে ছড়িয়ে রয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কত জানা-অজানা জিনিস। সেসব নিয়ে লিখেছেন ‘বিবিধ বিষয়’। বিবিধ বিষয়ে রয়েছে ‘ছাপাখানার কথা’, ‘কাপড়ের কথা’, ‘নীহারিকা’, ‘বুমেরাং’, ‘সূর্যের রাজ্য’, পিরামিড’, ‘বেগের কথা’ ইত্যাদি। চীনের প্রাচীর নিয়ে লিখেছেন ‘চীনের পাঁচিল’। এসব কঠিন কঠিন বিষয় সুকুমার রায়ের ছোঁয়ায় অত্যন্ত সহজ হয়ে উঠেছে।

সুকুমার রায় ছিলেন একাধারে লেখক,ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার,প্রাবন্ধিক,গায়ক, সু-অভিনেতা, নাট্যকার ও সম্পাদক। তাঁর পরিবারিক পরিবেশ ছিলো সাহিত্যানুরাগী,যা তাঁর মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়।সুকুমার রায় এর জীবনী এবং সাহিত্যকর্ম সুকুমার রায়ের স্বল্পস্থায়ী জীবনে তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। মৃত্যুর বহু বছর পরেও তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম শিশুসাহিত্যিকদের একজন।
সুকুমার রায়ের লেখায় রসবোধ ছিলো প্রবল। তিনি বাংলা ননসেন্স কবিতার জনক হলেও কেবল কবিতা নয়, তাঁর সব লেখা পড়েই মনে হয় তা ননসেন্স শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। তাঁর আগে বাংলা সাহিত্যে এই ঘরানার কবিতা কেউ তো লেখেননি, এমনকি সুকুমার রায়ের পরেও এই ধরনের কবিতা কেউ খুব একটা লেখেননি।

ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায় যা কিছু ভালো, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানব সভ্যতার আশীর্বাদ-অভিশাপ। ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সবসময় গুরুত্ব বহন করে। বাংলা সাহিত্যে শিশু ও কিশোর সাহিত্যিক বলতে স্বতঃই মনে পড়ে সুকুমার রায়ের নাম। শুধু কি তিনি শিশুমনের শিল্পী ? তাঁর অবিমিশ্র হাস্যরসের ধারার সমগ্র বাংলা সাহিত্য অভিষিক্ত, সঞ্জীবিত। তাঁর সৃষ্টভাব সমাবেশের অভাবনীয় সংলগ্নতা চমৎকৃতি আনে। তাঁর হাস্যরসের জোয়ারে সমভাবে আবালবৃদ্ধ হাবুডুবু খায়। তাঁর লেখায় ছেলেদের সঙ্গে বড়রাও দেই ছেলেবেলার স্বপ্নিল কল্পরাজ্যের সন্ধান পান। তাঁর স্বকীয় ও উৎকৃষ্ট ব্যঙ্গ রসিকতা তাঁকে বাংলা সাহিত্যের একটা গৌরবের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
কোরক পত্রিকা ২০০৩ সালে সুকুমার রায় সংখ্যা প্রকাশ করেছিলো, নানা সুকুমার সেই সংখ্যাটিরই পরিমার্জিত, সংযোজিত রূপ। সুকুমার রায়-কে নিয়ে সিরিয়াস লেখালিখির চর্চা খুব বেশি নেই, এই বইটিকে সুকুমারের সামগ্রিক কাজের এক পূর্ণাঙ্গ নির্দেশক বলা যেতে পারে। সুকুমার রায় কেবল শিশুসাহিত্যিক নন, তাঁর জ্ঞান ও চিন্তার বিস্তার অনেকদূর প্রসারিত। সুকুমার রায়ের প্রবন্ধ, চিঠি সেসবের স্বচ্ছ ইঙ্গিত দেয়। তবু সব কিছু ছাপিয়ে তাঁর ছোটদের জন্য লেখাগুলিই আমাদের প্রাণের আরাম আবোলতাবোল বা হযবরল ব্যতীত বাংলা সাহিত্য কল্পনা করাও অসম্ভব। স্বল্পায়ু জীবনে সুকুমার যে কতরকম কাজ করেছেন, তার হিসেব আমাদের একেবারে অজানা নয়, যেটা লক্ষ করার, কোনও কিছুই তাঁর জীবনযাপন থেকে রসবোধ মুছে ফেলতে পারেনি।

সুকুমার রায়ের প্রতিভা ছিলো বহুমুখী। শুধু ছড়ায় নয়, সাহিত্যের আরো নানা শাখায় তাঁর প্রতিভা এমন-কিছু ফুল ফুটিয়েছিলো,গন্ধের গরিমায় আর বর্ণের বৈভবে যা আজো আমাদের মন কেড়ে নেয়। তিনি লিখেছিলেন ‘ অতীতের ছবি’, পদ্যবন্ধে যেখানে অনতি-অতীত কালের স্মরণীয় কয়েকজন বাঙালি মনস্বীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়েছে। লিখেছিলেন হাস্যরসে টইটুম্বর প্রচুর গল্প। লিখেছিলেন বৈচিত্র্যে ভরপুর আটটি নাটক, যার কয়েকটিতে তিনি ছোটদের জগতের নানা মজার ঘটনা দিয়ে তৈরি করে তুলেছেন বিস্ফোরক সব নাটকীয় মুহূর্ত, আবার কয়েকটিতে খুবই সরাসরিভাবে বড়দের জগতের নানা ভন্ডামির ওপরেও আঘাত হানতে ছাড়েননি। লিখেছিলেন ‘আজব দেশে অ্যালিস’-এর আদলে তাঁর অবিস্মরণীয় ‘হযবরল’ এবং সেইসঙ্গে এমন আরো অনেক রচনা, যার কিছু-বা কৌতুকের বারুদে ঠাসা, কিছু-বা স্পষ্টতই শিক্ষামূলক, এবং কিছু-বা নানা ব্যাপারে ছোটদের কৌতূহলকে যথাসম্ভব উসকে দিতে চায়।

বাংলা ভাষার এক অসম্ভব প্রতিভাধর সাহিত্যিক হলেন সুকুমার রায়।মূলত শিশুসাহিত্যিক হিসেবেই তাঁর খ্যাতি-পরিচিতি। একাধারে তিনি লিখেছেন ছড়া,নাটক এবং রম্যরচনাও।সুকুমার রায়ের কর্মজীবন আসলে তাঁর সাহিত্যসাধনা এবং বাংলা ছাপাখানার উন্নতিসাধন, মুদ্রণশিল্পের চর্চা ও উন্নতিকে ঘিরেই আবর্তিত ছিলো। মাত্র আট বছর বয়সে শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পাদিত ‘মুকুল’ পত্রিকায় ‘নদী’ নামে একটি কবিতা লেখেন সুকুমার রায়। তারপর ১৩০৪ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যাতে লিখেছিলেন ‘টিক্ টিক্ টং’ নামে আরেকটি কবিতা। সৃজন-মননে, অনন্য সাহিত্য বুননে তিনি গেঁথেছিলেন দুর্লভ শিশুতোষ সাহিত্যসম্ভার। ‘রামগরুড়ের ছানা’ অথবা ‘পাগলা দাশু’, ‘আবোল তাবোল’ অথবা ‘ট্যাশ গরু’-এর মতো হৃদয়গ্রাহী শিশুসাহিত্যে আমাদের সাহিত্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। ঋদ্ধ করেছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের।

সত্যজিৎ রায় জন্মগ্রহণ করার কিছু মাস পর থেকেই সুকুমার রায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়া শুররু হয় । পরে চিকিৎসা শুরু করার পর জানা যায়, তিনি কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন এবং সেটাকে ঠিক করা একদম অসম্ভব। কারণ তখন সেইযুগে কালাজ্বরের উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধের আবিষ্কার হয়ে ওঠেনি কিন্তু মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত জেনেও তিনি শেষসময়ে অসাধারণ মানসিক স্থিতির পরিচয় দিয়েছিলেন। কারণ এত বড় একটা রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরও তিনি নিজের কাজকে একটা দিনের জন্যও বন্ধ করেননি বরং আরো উদ্যমের সাথে সেটাকে করে গেছিলেন।

সত্যজিৎ রায়ের একটা লেখায় দেখা যায় যেখানে তিনি তাঁর বাবার শেষের দিনগুলো সম্পর্কে লিখেছিলেন এই কথাগুলো: “রুগ্ন অবস্থাতেও বাবার কাজের পরিমাণ ও উৎকর্ষ দেখলে অবাক হতাম। শুধু লেখা বা আঁকার কাজেই নয়,ছাপার কাজেও যে তিনি অসুখের মধ্যে অনেক চিন্তা ব্যয় করেছেন তারও প্রমাণ রয়েছে। একটি নোটবুকে তাঁর আবিষ্কৃত কয়েকটা মুদ্রণ পদ্ধতির তালিকা রয়েছে। এইগুলো পেটেন্ট নেবার পরিকল্পনা তাঁর মনে ছিলো কিন্তু কাজে হয়ে ওঠেনি” ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে কালাজ্বরে (লেইশ্মানিয়াসিস) আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে সুকুমার রায় মৃত্যুবরণ করেন, সেই সময় এই রোগের কোনো চিকিৎসা ছিলো না।

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম