খাঁটি তওবার সামনে শয়তানের সকল কুটচাল ও ষড়যন্ত্র দুর্বল ও ভঙ্গুর

মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। সবার ওপরে মানুষ সত্য তার ওপরে নেই। আলোকিত ও পরহেযগার মানুষের কাছে শয়তান খুবই দুর্বল ও অসহায়। শয়তানকে এতো ক্ষমতা দেওয়া সত্তেও সে আলোকিত ও পরহেযগার মানুষের কাছে খুবই দুর্বল ও অসহায়। এত দুর্বল যে, সে সহজেই তাদের সামনে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। অনায়েশেই তাঁরা শয়তানকে কুপোকাত করতে পারে।

কোরআন মাজীদে এরশাদ হয়েছে,‘নিশ্চয়ই শয়তানের চক্রান্ত খুবই দুর্বল’ (নিসা:৭৬) মূলত শয়তান তাদের ওপরই বিরত্ব ও কর্তৃত্ব দেখায়, যাদের হৃদয় আলোকিত নয়, ঈমান কমজোর ও গুণাহের ব্যাপারে বেপরোয়া। তবে আশার কথা হলো এই বুযদিল, কমজোর ঈমানদারদারাও যদি খালিছভাবে তাওবা করে, তাহলেও শয়তান কুপোকাত হয়ে যায়। তাওবার সামনে সে টিকতে পারে না। মোটকথা খাটি তাওবার সামনে শয়তানের সকল কুটচাল ও ষড়যন্ত্র দুর্বল ও ভঙ্গুর।
তাওবা-ইস্তিগফার গুণাহ মাফের মহৌষধ। তবে যে পাপের প্রবণতাকে দমন করবে বা পাপ করে ফেললে তাওবা-ইস্তিগফার করবে, সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ। আল্লাহর প্রিয় বান্দা। তার জন্যই জান্নাত। এই তাওবা-ইস্তিগফারই গুনাহ মাফের মহৌষধ। মানুষ যতো গুণাহই করুক না কেনো, সঠিক পন্থায় তওবা করলে তার গুণাহ মাফ হবেই।

মানুষ ভুল ও পদস্খলনের শিকার। গুণাহ করা তার স্বভাবগত অভ্যাস। কিন্তু উত্তম গুণাহগার ওই ব্যক্তি যে গুনাহর কারণে লজ্জিত হয়। আল্লাহর কাছে অশ্রু বিসর্জন দেয়। তাঁরই দিকে ফিরে আসে। করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে। ভবিষ্যতে গুণাহ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
গুণাহ একটি মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক আত্মিক ব্যাধি। গুণাহ এমন একটি ক্ষতিকর জিনিস, যার দ্বারা মানুষের অন্তরে জং ধরে যায়। অন্তর কালো হয়ে যায়। তবে গুনাহের উত্তম চিকিৎসা হলো তাওবা। শুধু কঠিন সময় সামনে আসলেই তওবা নয় বরং সবসময় তওবা করা আমাদের সকলের প্রয়োজন। যেমন করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমান বিশ্ব আজ স্তব্ধ। সবখানে বয়ে চলছে রিক্ততার বাতাস। ঠিক এ মুহূর্তে আমাদের দরকার আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ তাওবা। মহান রবের কাছে আত্মসমর্পণ করা।
তাওবার দ্বারা মু’মিন হয় নিষ্পাপ এবং প্রবেশ করে অনাবিল শান্তির নিবাস জান্নাতে। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, ‘গুনাহ থেকে তাওবাকারী নিষ্পাপ ব্যক্তির মতো হয়ে যায়।’ (সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস:৪২৫০; শুআবুল ঈমান, হাদীস: ৬৭৮০; আসসুনানুল কুবরা, হাদীস:২০৫৬১)

নবী-রাসূলগণ নিষ্পাপ । আর মানুষ এমন এক সৃষ্টি, যাদের মধ্যে পাপ-পূণ্য উভয়টা করার যোগ্যতাই আছে। কোনো মানুষই এর বাইরে নয়। এ জন্যই দেখা যায়, যে নবী-রাসূলগণ সৃষ্টির সেরা ও উম্মাহর হেদায়াতের কান্ডারী হওয়া সত্তেও তাঁরা এর বাইরে ছিলেন না। তবে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁদেরকে স্বীয় রহমতে হিফাযত করেছেন। ফলে তাঁরা ছিলেন নিষ্পাপ।

পাপ মোচনের মহৌষধ হচ্ছে তাওবা। তওবা অর্থ প্রত্যাবর্তন, অনুশোচনা, অনুতাপ। পাপ করার পর আল্লাহর ভয়ে তা থেকে ফিরে আসা এবং অন্তরে অনুতাপ ও অনুশোচনা পোষণ করাই হচ্ছে তওবা। তওবা শব্দটি যখন আল্লাহর দিকে সম্বন্ধিত করা হয়, তখন এর অর্থ হয় ক্ষমা করা। অন্যদিকে ইস্তিগফার শব্দের অর্থ ক্ষমা প্রার্থনা করা। তওবা ও ইস্তিগফার সমার্থক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। মূলত মানব মাত্রই ভুলের শিকার হয়। পাপে হয় পঙ্কিল। মানুষকে সৃষ্টিই করা হয়েছে পাপ-পূণ্যের ক্ষমতা দিয়ে। কোরআন মাজীদে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তা’য়ালা মানবের ভিতরে অসৎকর্ম ও সৎকর্ম উভয়ের প্রেরণা জাগ্রত করেছেন।’কাজেই মানবের ভূল হবেই। মানবের দ্বারা গুণাহ প্রকাশ পাবেই। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

গুণাহের তাড়না সবার অন্তরেই হিসহিস করে উঠতে পারে। যে নবী (সা.) এর মাকাম ও মর্যাদা সকল মাখলুকের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। এতো বেশি যে, যে পর্যন্ত পৌঁছা কোনো মাখলুকের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। এ মাকাম ও মর্যদার অধিকারী হওয়া কারো পক্ষেই কোনো কালেই সম্ভব নয়। তা সত্তেও তিনি কেন এতো বেশি ইস্তিগফার করতেন। কোরআন মাজীদে এরশাদ হয়েছে,‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে খালিছভাবে তাওবা করো। এতে আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপরাশিকে মোচন করে দিবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নহর।’ (তাহরীম-৮)

হাদিস দ্বারা বুঝা যায় যে, আমাদের দ্বারা গুণাহ প্রকাশ না পেলে, আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে ধ্বংস করে অন্য জাতিকে সৃষ্টি করবেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি নবী করিম (সা.) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘ঐ সত্তার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ, যদি তোমরা মোটেও গুণাহ না করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ধ্বংস করে দিবেন এবং এমন জাতি সৃষ্টি করবেন, যারা গুণাহও করবে, তাওবা-ইস্তিগফারও করবে। তারপর আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন।’ (মুসলিম, হাদীস:২৭৪৯; আহমাদ, হাদীস:৪০৪২; মুসনাদে ইবনে আবী শয়বা, হাদীস: ৮)

হাদীসে ইঙ্গিত রয়েছে যে, যদি গুণাহ করার যোগ্যতা মানুষের মাঝে না থাকতো, তাহলে মানব সৃষ্টির কোনো প্রয়োজনই ছিলো না। শুধুমাত্র ইবাদতের জন্য ফেরেশতারাই যথেষ্ট ছিলো। ফেরেশতাদের মাঝে গুণাহ করার কোনো যোগ্যতাই নেই। কারণ ফেরেশতারা আল্লাহর এমন এক সৃষ্টি, যাঁরা সার্বক্ষণিক তাসবীহ-তাহলীল, যিকর-আযকার ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগী ও আল্লাহর হুকুম পালনেই মশগুল। তাঁদের মাঝে গুণাহ করার কোনো যোগ্যতাই নেই। চাইলেও তাঁরা গুনাহ করতে পারবে না। কোরআন মাজীদে এরশাদ হয়েছে, ‘ফেরেশতাগণ দিবা-রাত্রি আল্লাহ তা’য়ালার তাসবীহ পাঠ করেন। তাঁরা কোনো সময় অলসতাও করে না, ক্লান্তও হয় না।’ (আম্বীয়া: ২০)অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, ফেরেশতাগণ আল্লাহর কোনো আদেশ অমান্য করে না এবং তাঁদেরকে যা নির্দেশ দেওয়া হয়, তাঁরা তাই করে। (তাহরীম: ৬)
সাহাবী আগার আল মুযানী (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মাঝে-মধ্যে আমার অন্তর মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যায়, তাই প্রতিদিন আমি একশ’ বার পর্যন্ত ইস্তিগফার করি।’ (মুসলিম, হাদীস:২৭০২) কথাটি কে বলেছেন? সেই সুমহান ব্যক্তি, যিনি ছিলেন নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ, পবিত্র, গুণাহ করার কল্পনা থেকেও যিনি ছিলেন নিরাপদ। ভূল-ত্রুটির সঙ্গে যার জীবন পরিচিত নয়। যার অগ্র-পশ্চাতের সকল গুনাহ মাফ। এমন নিষ্কলুষ, মার্জিত, পরিশীলিত ও পবিত্র জীবন যাঁর, তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ‘আমি প্রতিদিন একশ’ বার পর্যন্ত ইস্তিগফার করি। আল্লাহর দরবারে গুণাহের জন্য মাফ চাই’। প্রকৃতপক্ষে তাঁর ইস্তিগফার ও ক্ষমা প্রার্থনা ছিলো আরো বেশি যা অন্যান্য হাদীস থেকে জানা যায়।

কোরআন মাজীদে এরশাদ হয়েছে,‘নিশ্চয়ই যুলাইখা ইউসুফ (আ.)এর ব্যাপারে পাপ কর্মের কল্পনা করেছিলো। ইউসুফ (আ.)ও যুলাইখার ব্যাপারে পাপ কর্মের কল্পনা করতেন যদি না স্বীয় রবের প্রমাণ অবলোকন করতেন (অর্থাৎ স্বীয় রবের প্রমাণ অবলোকন করার কারণে তিনি সেই পাপ কর্মের কল্পনা থেকে বেঁচে গেলেন) এমনিভাবে হয়েছে। যাতে আমি তাঁর থেকে মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয় দুরে সরিয়ে দেই। তিনি ছিলেন আমার মুখলিছ বান্দাদের একজন।’ (ইউসুফ: ২৪) সাইয়ীদুল মুরসালীন (সা.)ও এর বাইরে ছিলেন না।
বারবার তাওবাকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন।এক আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা অধিকহারে তওবাকারী ও উত্তমভাবে পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে ভালোবাসেন।’ (বাকারা: ২২২) হযরত আনাস (রা.) এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,‘প্রত্যেক আদম সন্তানই বারবার ভুল করে। আর ভুলকারীদের মধ্যে সর্বোত্তম হলো সেই ব্যক্তি, যে ভুলের পর তাওবা করে।’ (ইবনে মাজা, হাদীস:৪২৫১; তিরমিযী, হাদীস:২৪৯৯; আহমাদ, হাদীস:১৩০৪৯; মুসনাদে বায্যার, হাদীস:৭২৩৬) এর মাঝেই ইঙ্গিত রয়েছে, মোহের এই দুনিয়াতে মানুষের গুণাহের প্রতি আকর্ষিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার দ্বারা গুনাহ প্রকাশ হতেই পারে। তবে মু’মিনের কাজ হচ্ছে গুনাহ হওয়ার সাথে সাথেই তাওবা করে নিবে। তাহলে সে সর্বোত্তম ও আল্লাহর মাহবুব বান্দায় পরিণত হবে।
হাদীসে শরীফে বর্ণিত আছে, আবূ কালাবাহ (রহ.) বলেন, আল্লাহ তা’য়ালা যখন ইবলিসকে অভিসম্পাত করে তাড়িয়ে দিচ্ছিলেন, তখন সে কিয়ামত পর্যন্ত অবকাশ তথা হায়াত প্রার্থনা করেছিলো। তার প্রার্থনা কবূল করে আল্লাহ তা’য়ালা তাকে কিয়ামত পর্যন্ত অবকাশ তথা হায়াত দান করলেন। তখন সে বলেছিলো, আপনার ইজ্জতের কসম! আমি মানুষের হৃদয়কে আচ্ছন্ন (গুনাহ করতে প্ররোচিত করবো) করে রাখবো, যতক্ষণ তার দেহে প্রাণ থাকবে। আল্লাহ তা’য়ালা তখন তাকে উত্তর দিয়েছিলেন, আমার ইজ্জতের কসম! আমিও তার থেকে তাওবার পর্দা উঠাবো না, যতক্ষণ তার দেহে প্রাণ থাকবে। অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত বনী আদমের তাওবা আমি কবূল করবো। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস:৩৪২১৭)

তাওবা ও ইস্তিগফার তিন প্রকার। ১. গুণাহসমূহ থেকে তাওবা ও ইস্তিগফার করা। ২. ইবাদত-বন্দেগী বা আল্লাহর হুকুম পালনে ত্রুটি হলে তা থেকে তাওবা ও ইস্তিগফার করা। ৩. ইস্তিগফার থেকে ইস্তিগফার। অর্থাৎ ইস্তিগফার যেভাবে করতে বলা হয়েছে, সেভাবে করতে পারিনি, এ জন্য ইস্তিগফার করছি। প্রথম প্রকার তথা গুণাহসমূহ থেকে তাওবা করা প্রত্যেক মানুষের ওপর ফরযে আইন। এটা না করার সুযোগ কোনো মানুষের নেই। এই তাওবার দুটি স্তর রয়েছে। ১. ইজমালী বা সংক্ষিপ্ত তাওবা। ২.তাফসীলী বা বিস্তারিত তাওবা। ইজমালী বা সংক্ষিপ্ত তাওবার নিয়ম হলো, স্থিরতার সঙ্গে বসে জীবনের সকল গুনাহের কথা স্মরণ করে আল্লাহর দরবারে তাওবা করা। এর জন্য উত্তম পদ্ধতি হলো, প্রথমে তাওবার নিয়তে দু’ রাকআত নামায পড়ে নিবে। এরপর অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে, লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে একেকটি গুণাহের কথা স্মরণ করবে এবং আল্লাহর দরবারে এ দুআ করবে, হে আল্লাহ! প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, আল্লাহর কিংবা বান্দার হকের সাথে সংশ্লিষ্ট ছগীরা-কবীরা গুণাহ- মোটকথা জীবনে যতো গুণাহ করেছি, সবগুলো থেকে তাওবা করছি। ইজমালী বা সংক্ষিপ্ত তাওবা করার পর নিশ্চন্ত মনে বসে থাকলে হবে না; বরং এরপর তাফসীলী বা বিস্তারিত তাওবা করতে হবে। (ইসলাহী খুতুবাত:৬/৪৮০-৪৮১)

কোরআনে কারিমে আরো বলা হয়েছে, ‘আপনি বলুন, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের সত্তার প্রতি সীমাহীন জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুণাহ মাফ করে দেবেন; নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৫৩)

হাদিসে এসেছে, ‘সব আদম সন্তানই গুণাহগার, গুনাহগারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো তাওবাকারীরা।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৯৯; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২৫১) কোরআন ও হাদিসে তাওবাকারীদের জন্য সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহপাক তাওবাকারীদের পছন্দ করেন। ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখেন। আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২২২)

তাওবা মানুষকে সফলতার উচ্চমার্গে পৌঁছে দিতে পারে। এর মাধ্যমেই অন্তরের কালো জং দূর হয়। এই তাওবার মাধ্যমেই বড় বড় গুণাহগার এবং নিরাশ লোক পৌঁছতে পারে মানজিলে মাকসুদে। আসতে পারে ইসলামের ছায়ায়। কত বড় গুণাহগার আল্লাহর নবীর কাছে তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করলে নবীজি (সা.) তাদের নৈরাশ্যতা দূর করেছেন। দিয়েছেন তাদের সুসংবাদের বাণী।

একবার এক ব্যক্তি নবীজি (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি জীবনে সব রকমের গুণাহ এতো পরিমাণ করেছি, যদি ওই সব গুণাহগুলোকে দুনিয়ার সব মানুষের ওপর বণ্টন করে দেওয়া হয়, তবে সব মানুষ জাহান্নামি হয়ে যাবে। আল্লাহর রাসূল এতসব গুণাহের ক্ষতিপূরণের কি কোনো পথ আছে? আল্লাহর নবী (সা.) তাকে নিরাশ করেননি। বরং ওই ব্যক্তিকে তিনি ঈমান তাজাকরণ এবং আল্লাহ অভিমুখী হতে নির্দেশনা দিয়েছেন। আল্লাহর নবীর এই দরদমাখা নির্দেশনা শুনে ওই ব্যক্তির খুশির অন্ত রইল না।
হাদিসগুলোতে এ ধরনের অনেক ঘটনা রয়েছে যে গুনাহে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ব্যক্তি আলোর দিশা পেয়েছে। যারা পরবর্তী সময় অন্য মানুষের সঠিক পথপ্রদর্শন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, যখন বান্দা গুণাহ করে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। এরপর সে যদি ওই গুণাহ থেকে ফিরে আসে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে তখন এই কালো দাগ নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু যদি সে আবার ওই গুনাহ করে, তখন ওই কালো দাগ আরো বৃদ্ধি ঘটে। শেষ পর্যন্ত তার সম্পূর্ণ অন্তর কালো দাগে ছেয়ে যায়। এটাই ওই ‘রাইন’ শব্দের অবস্থা, যার আলোচনা আল্লাহ তা’য়ালা এভাবে করেছেন, ‘না, কখনো এরূপ নয়, বরং তাদের অন্তরগুলো তাদের (গর্হিত) কার্যকলাপের মরিচা ধরেছে।’ (সুরা : তাতফিফ, আয়াত : ১৪)
আল্লাহপাক বলেন, ‘যে গুণাহ করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১১০)

তাওবার দরজা খোলা। বেশি বেশি তাওবা ও ইস্তিগফার করে নিজেদের অন্তর থেকে গুণাহের জং দূরীভূত করতে থাকা উচিত। সাওয়াবের প্রত্যাশায় হিসাব-নিকাশ করতে থাকা। যাতে দুনিয়া আখিরাতের সফলতা ও কামিয়াবি দ্বারা সাফল্য অর্জন করা যায়। কেননা তাওবার দ্বার সব সময় উন্মুক্ত। আল্লাহ তা’য়ালার কুদরতি হাত আমাদের মাফ দেওয়ার জন্য সব সময়ই অগ্রসরমাণ। এ মর্মে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তাওবা করো; তবেই তোমরা নিঃসন্দেহে সফলতা লাভ করবে।’ (সুরা : নূর,আয়াত : ৩১)

কিয়ামত পর্যন্ত তাওবা কবুল হবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, আবু মুসা আশআরি (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ রাতে তাঁর হাত মুবারক সম্প্রসারণ করেন, যাতে দিনের পাপীরা তাওবা করতে পারে। আবার দিনে তাঁর হাত মুবারক প্রসারিত করেন, যাতে রাতের পাপীরা তাওবা করতে পারে। এ অবস্থা সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হওয়া (কিয়ামত) পর্যন্ত চলতে থাকবে।’(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৭৫৯) তাওবা ও ইস্তিগফারে লেগে থাকলে দুনিয়ায় সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা, শারীরিক সুস্থতা ও আত্মতৃপ্তি লাভ করা যায়। আর আখিরাতের ফায়দা ও বরকত তো আছেই।

নূহ (আ.)-এর ভাষায় পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘অতঃপর বলেছি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর অজস্র বৃষ্টিধারা ছেড়ে দেবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্য উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্য নদী-নালা প্রবাহিত করবেন।’ (সুরা : নূহ, আয়াত : ১০-১২)

তাওবা-ইস্তিগফারই গুণাহ মাফের মহৌষধ। সায়্যিদুল ইস্তিগফার ক্ষমা প্রার্থনার সর্বশ্রেষ্ঠ বর্ণনা করা হয়েছে । মূলত মানব মাত্রই ভুলের শিকার হয়। কোরআন মাজীদে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তা’য়ালা মানবের ভিতরে অসৎকর্ম ও সৎকর্ম উভয়ের প্রেরণা জাগ্রত করেছেন।’কোন বিপদ আপদে পড়লে তখন আমরা আল্লাহকে সরণ করি। তখন আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না কিভাবে আল্লাহ তা’য়ালার কাছে দোয়া ইস্তেগফার করতে হয়। কারণ আল্লাহ তা’য়ালার রাজি খুশি হয়ে গেলে আমাদের এস্তেগফার তওবা ও তাওবার দোয়া কবুল হলে আমাদের ইহ জীবন পরকালের জীবন খুব সুন্দর হবে।

বান্দা তাওবা এবং ইস্তেগফারের মাধ্যমেই অন্যায় পথ থেকে মাওলার দিকে ফিরে আসে। বিগত জীবনে অন্যায় কাজের জন্য আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়। তার এ অনুশোচনা ও অনুতাপই তাকে মাওলার দরবারে একান্ত আপনজন ও প্রিয় করে তোলে।
তাওবা ও ইস্তিগফার আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক সুদৃঢ় করে। এর মাধ্যমে রবের কাছে বান্দার মুখাপেক্ষিতার স্বীকারোক্তি উচ্চারণ করা হয়। ইস্তিগফারের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। এরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীকে ভালোবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরও ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২২২)।

মানুষের প্রতি আল্লাহ তাআলার দয়া ও করুণা অসীম। তার দয়ার কোনো সীমা নেই। কোরআনে আল্লাহ নিজের ব্যাপারে ঘোষণা দেন- নিশ্চয় তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, অতিশয় দয়ালু। আল্লাহ তা’য়ালা ক্ষমা, দয়া ও করুণা লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো তাওবা ও ইস্তেগফার। সুতরাং যে ব্যক্তি কৃত অন্যায়ের জন্য তওবা করবে, সে অবশ্যই আল্লাহর নাফরমানীর কাজ থেকে সর্বদা বিরত থাকতে সচেষ্ট হবে। আল্লাহ পাকের তরফ থেকে আরোপিত ফরজ সমূহকে যত্নসহকারে আদায় করবে। বান্দার অধিকার খর্ব হলে (যেমন-কাউকে গাল-মন্দ, গীবত-শেকায়াত, অত্যাচার-নির্যাতন করলে) তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে। আল্লাহ তাআলা ওই বান্দাকে ক্ষমা করে দেবেন।

মূলত মরদুদ শয়তান মানুষের মাঝে নৈরাশ্য সৃষ্টি করে। সে মানুষকে এভাবে বিপথগামী করে যে, সে মানুষের মনে একথা জাগিয়ে দেয় যে, তুই এত মারাত্মক ও ভয়ংকর গুনাহ করেছিস যে, তুই মরদুদ ও বিতাড়িত হয়ে গেছিস। তুই এতো বেশি গুণাহ করেছিস যে, তোর আর কোনো মুক্তির পথ নেই। তাই তুই এখন যা ইচ্ছা কর। যে গুণাহ ইচ্ছা করতে পারিস। শয়তান মানুষের মাঝে এভাবে নিরাশা সৃষ্টি করে বিপথগামী করে। গুণাহকে পূণ্য দ্বারা পরিবর্তিত করে দেন। কোরআনে বর্ণিত আল্লাহ এরশাদ করেছেন‘যারা এসব গুণাহ কুফুর-শিরক, মানব হত্যা, যিনা ইত্যাদি করবে, তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে। কিয়ামত দিবসে তাদের শাস্তি দ্বিগুণ হবে এবং তথায় লাঞ্চিত অবস্থায় থাকবে চিরকাল। কিন্তু যারা তাওবা করে ঈমান আনে এবং নেক আমল করে আল্লাহ তা’য়ালা তাদের গুণাহ সমূহ পূণ্য দ্বারা পরিবর্তিত করে দিবেন। আর আল্লাহ তা’য়ালা বড় ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু এবং যারা তাওবা করলো এবং নেক আমল করলো, তারা ফিরে আসার স্থান আল্লাহ তা’য়ালার দিকে ফিরে আসলো। (ফুরকান:৬৮-৭১) বর্ণিত আয়াতগুলো প্রমাণ বহন করে অপরাধ বা গুণাহ যত বড়ই হোক, যত বেশিই হোক, যথা নিয়মে তাওবা করলে আল্লাহ তা’য়ালা তা মাফ করে দেন। অধিকন্তু গুণাহকে পূণ্য দ্বারা পরিবর্তিত করে দেন। তো এরচে বড় আশার বাণী আর কি হতে পারে। কাজেই বান্দার হতাশ ও নিরাশ হওয়া কোনো কারণ নেই। যত গুণাহই করুক না কেন, সাহস করে যথা নিয়মে খাঁটি দিলে তাওবা করলেই মাফ হয়ে যাবে।

তাওবার পর তাওবা ভেঙ্গে যেতে পারে। আবারও গুণাহ হয়ে যেতে পারে। এতে ভেঙ্গে পড়া যাবে না। হিম্মত হারানো যাবে না। নব উদ্যমে আবার তাওবা করতে হবে। এভাবে যতবারই তাওবা ভঙ্গ হয়ে যাবে, ততবারই নতুন করে তাওবা করে নিবে। এভাবে চলতে থাকলে শয়তান দুর্বল ও নিস্তেজ হবে এবং পাপাচার কমতে থাকবে। (ইসলাহী মাজালিস:২০৯-২১১) তাওবা মূলত তিন জিনিসের সমষ্টির নাম। একটি হলো বিগত দিনগুলোতে যে গুণাহগুলো হয়ে গেছে এর মন্দ পরিণামের ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্তরে খুব অনুশোচনা সৃষ্টি হওয়া। দ্বিতীয়টি হলো, তৎক্ষণাৎ গুণাহ করা ছেড়ে দেওয়া। তৃতীয়টি হলো, সামনের দিনগুলোতে গুণাহ না করার দৃঢ় ইচ্ছা করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিমতো তাঁর আনুগত্য করে চলার সংকল্প গ্রহণ করা। এই তিন জিনিস পরিপূর্ণভাবে পাওয়া গেলে তাওবা পূর্ণাঙ্গতা পায়।

‘তাওবা করার সময় যদি ভবিষ্যতে গোনাহ না করার প্রতিজ্ঞা না থাকে, তবে গোণাহ করার প্রতিজ্ঞাও যেনো না থাকে, বরং তার চিন্তা যেনো প্রতিজ্ঞা থেকে মুক্ত থাকে। যদি এভাবে চিন্তামুক্ত অবস্থায় লজ্জা ও অনুতাপের সঙ্গে তাওবা করা হয় তাহলে তাওবা ছহী হয়ে যাবে।’ অর্থাৎ তাওবার সর্বোচ্চ স্তর তো এই প্রতিজ্ঞা থাকা যে, ভবিষ্যতে কখনো কোনভাবেই এ গোণাহ আর করবো না। কিন্তু যদি কোন কারণে এ প্রতিজ্ঞা চিন্তায় উপস্থিত না থাকে, তাহলে কমপক্ষে ভবিষ্যতে এই গোণাহ করার ইচ্ছা যেনো পোষণ না করা হয়, বরং গোনাহ করার প্রতিজ্ঞা থেকে যেনো যেহেনটা মুক্ত থাকে। অর্থাৎ গুণাহটি ভবিষ্যতে না করার চিন্তা যেমন থাকবে না তেমনি করার চিন্তাও থাকবে না। তার মন্তদিল যদি উভয় প্রতিজ্ঞা ও সঙ্কল্প থেকে মুক্ত থাকে তাহলেও তাওবা ছহীহ হয়ে যাবে।

প্রসঙ্গে কোরআন মাজীদে এরশাদ হয়েছে,‘হে আমার ঐ সকল বান্দা যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছো,গুনাহ করেছো, আল্লাহর নাফরমানী করেছো, কুফুর, শিরক ও বিদআতে লিপ্ত হয়েছো। তারা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। কারণ নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’য়ালা সকল গুণাহই ক্ষমা করেন। নিশ্চয় তিনি বড় ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’ (যুমার: ৫৩)

লজ্জা ও অনুতাপই আসল তাওবা। তাই আমরা যেনো ইসলামের অত্যাবশ্যকীয় পঞ্চ স্তম্ভসহ শরিয়তের সব বিধিবিধান মেনে চলে আল্লাহর হুকুম-আহকাম সম্পূর্ণভাবে পালন করে তওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে অশেষ রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে নাজাত লাভ করতে পারি এবং পাপকাজ করে ফেললে ভবিষ্যতে আর যেনো পাপকাজ না করি খালিছ দিলে আল্লাহর কাছে তওবা করতে পারি এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি।

লেখকঃ গবেষক,সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,
চেয়ারম্যান গ্রীণ ক্লাব, মানিকগঞ্জ,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম