আল্লাহর প্রকৃত বন্ধু ও উত্তম জাতি বিনির্মাণের আদর্শ পুরুষ হযরত ইব্রাহিম (আ.)

মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
মুসলিম উম্মাহ ও সমগ্র মুসলিম জাতীর পিতা ও ইসলামের একজন কালজয়ী নবী ও রাসূল এর নাম হযরত ইব্রাহিম (আ.)। ইসলাম ধর্মমতে, তিনি সমগ্র মুসলিম জাতির পিতা। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর পিতার নাম আযর। তার স্ত্রীর নাম সারাহ ও হাজেরা। তাঁর পুত্র ছিলেন: ইসমাইল ও ইসহাক,মতান্তরে, তার ৬-১২জন পুত্র ছিলেন।তবে,ইসমাইল ও ইসহাকের বর্ণনাটিই ইতিহাসে পুত্র হিসেবে প্রসিদ্ধ। অন্যদের ব্যাপারে তেমন কোনো ঐতিহাসিক উল্লেখের প্রমাণ পাওয়া যায় নি। হযরত আদম (আ.) হতে ইব্রাহিম (আ.)পর্যন্ত ১০/১২ জন নবী বাদে শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)পর্যন্ত ১ লাখ ২৪ হাজার পয়গম্বরের প্রায় সকলেই ছিলেন ইব্রাহিম (আ.)- এর বংশধর।হযরত ইব্রাহিম (আ.) জন্মগ্রহণ করেন ইরাকের উর নগরীতে। তাঁর বাবা ছিলেন মূর্তি নির্মাতা এবং পুরোহিত। হযরত ইব্রাহিম (আ.) মূর্তিপূজার অসারতা উপলব্ধি করেন ছোটবেলাতেই। বলেন,সূর্য,চাঁদ,আকাশের তারা কিংবা সৃষ্ট কোনো জীব মানুষের উপাস্য হতে পারে না। এগুলোর মূর্তি বানিয়ে পূজা করার মধ্যেও নেই কোনো সার্থকতা। যে সত্ত্বা সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা তিনিই হতে পারেন একমাত্র উপাস্য। হযরত ইব্রাহিম (আ.) একেশ্বরবাদের আধ্যাতিক চেতনাকে ইরাক,ফিলিস্তিন,সিরিয়া,আরব, মিসর বা ধারে-কাছের সব ভূখন্ডে ছড়িয়ে দেন। তাঁর জীবদ্দশাতেই একেশ্বরবাদের পতাকা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।
ইব্রাহিম (আ.) হলেন ইসলাম ধর্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ নবী ও রাসূল। ইব্রাহিম (আ.) যৌবনের প্রারম্ভেই নবুয়াত প্রাপ্তি হন। উপাধি দ্বিতীয় আদম,আবুল আম্বিয়া,খলিলুল্লাহ ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়। তাঁকে সমগ্র মুসলিম জাতির পিতা বলা হয়। পবিত্র কোরআনের ১৪ নম্বর সূরার নাম ‘সূরা ইব্রাহিম’। ইসলামে হযরত ইব্রাহিম (আ.) খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর প্রকৃত বন্ধু হিসেবে পরিচিত। ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মেও হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে সম্মান করা হয়। বহু আগে জন্মগ্রহণ করায় হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সঠিক জন্মকাল নিরূপণ করা কঠিন। তবে গবেষকের মতে,খ্রিস্টপূর্ব ১৮১৩ অব্দে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৩৮৩৩ বছর আগে তৎকালীন প্রাচীন শহর চালডিনসের উর এলাকায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন, যা বর্তমানে ইরাক নামে পরিচিত। অপর গবেষণায় তাঁর জন্ম বর্তমান তুরস্কের এডেসা অঞ্চলের আসিরিয়ান শহরে বলে দাবি করা হয়। তাঁর বাবার নাম পবিত্র কোরআন অনুসারে আজর,তবে যিনি তেরাহ নামেও কোনো কোনো ইতিহাস গ্রন্থে পরিচিত।
ইব্রাহিমের আবির্ভাবকালীন সময়ে কালেডীয় সমাজ শিক্ষা ও সভ্যতায় শীর্ষস্থানীয় ছিলো। এমনকি তারা সৌরজগত নিয়েও গবেষণা করতো কিন্তু অসীলা পূজার রোগে আক্রান্ত হয়ে তারা আল্লাহকে পাবার জন্য বিভিন্ন মূর্তি ও তারকা সমূহের পূজা করতো। হযরত ইব্রাহিম (আ.) উভয় ভ্রান্ত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে প্রেরিত হন।
৩১৫ জন রাসূলের মধ্যে ইব্রাহিম (আ.) অন্যতম একজন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন পশ্চিম ইরাকের নিকটবর্তী “বাইবেল” শহরে। হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর নাম পুরা কোরআনে অনেকবার উল্লেখিত হয়েছে। ইসলাম ছাড়াও,তিনি ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছেন ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্মে। এজন্য ইব্রাহিম(আ.) কে সেমেটিক ধর্মগুলোর জনকও বলা হয়ে থাকে। হযরত ইব্রাহিমকে (আ.)সেমেটিক ধর্মগুলোর জনকও বলা হয়ে থাকে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাসের ছিলো ইসলামে তাঁর কার্যক্রম কে স্মরণ করে ঈদুল আযহা পালিত হয়। ইব্রাহিম(আ.) ও তাঁর শিশুপুত্র ইসমাইল(আ.) ইসলামে কোরবানি ও হজ্জের বিধান চালু করেন যা বর্তমানের মুসলিমদের দ্বারাও পালিত হয়।
ইসলাম ধর্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ নবী ও রাসূল হলেন হযরত ইব্রাহিম (আ.)। ইবরাহীম (আ.) ছিলেন হযরত নূহ (আ.)-এর এগারোতম অধঃস্তন পুরুষ। নূহ (আ.) থেকে ইব্রাহিম (আ.) পর্যন্ত প্রায় ২০০০ বছরের ব্যবধান ছিলো। হযরত ছালেহ (আ.)-এর প্রায় ২০০ বছর পরে ইব্রাহিম (আ.) আগমন ঘটে। ঈসা থেকে ব্যবধান ছিলো ১৭০০ বছর অথবা প্রায় ২০০০ বছরের। তিনি ছিলেন ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের পিতা এবং তাঁর স্ত্রী ‘সারা’ ছিলেন ‘উম্মুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের মাতা। তাঁর স্ত্রী সারার পুত্র হযরত ইসহাক-এর পুত্র ইয়াকুব (আ.)-এর বংশধর ‘বনী ইসরাঈল’ নামে পরিচিত এবং অপর স্ত্রী হাজেরার পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর বংশে জন্ম নেন বিশ্বনবী ও শেষনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। যাঁর অনুসারীগণ ‘উম্মতে মুহাম্মাদী’ বা ‘মুসলিম উম্মাহ’ বলে পরিচিত। বাবেল হ’তে তিনি কেন‘আনে (ফিলিস্তীন) হিজরত করেন। সেখান থেকে বিবি সারা-র বংশজাত নবীগণের মাধ্যমে আশপাশে সর্বত্র তাওহীদের দাওয়াত বিস্তার লাভ করে। অপর স্ত্রী হাজেরার পুত্র ইসমাঈলের মাধ্যমে বায়তুল্লাহ ও তার আশপাশ এলাকায় তাওহীদের প্রচার ও প্রসার হয় এবং অবশেষে এখানেই সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর আগমন ঘটে। এভাবে ইবরাহীমের দুই স্ত্রীর বংশজাত নবীগণ বিশ্বকে তাওহীদের আলোয় আলোকিত করেন। শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর দেহসৌষ্ঠব ও চেহারা মুবারক পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর ন্যায় ছিলো। যা তিনি মে‘রাজ থেকে ফিরে এসে উম্মতকে খবর দেন।
পৃথিবীর মূল জনপদ ও সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হিসেবে খ্যাত পবিত্র মক্কা। কারণ এখানেই রয়েছে পবিত্র বাইতুল্লাহ। ইসলামে বাইতুল্লাহর গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের ৫টি রুকনের একটি হলো হজ্ব। আর এই রুকনটি আদায় করতে হলে অবশ্যই বাইতুল্লাহ যিয়ারত করতে হবে। তাই আমাদের বাইতুল্লাহ সৃষ্টির ইতিহাস জানা উচিত। হযরত আদম (আ.) সর্বপ্রথম বাইতুল্লাহ নির্মাণ করেন কিন্তু তা হযরত নূহ (আ.) এর প্লাবনে ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে হযরত ইব্রাহিম (আ.)তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তান হযরত ইসমাঈল আ. কে সেই ধ্বংসস্তুপের নিকটে রেখে আসার সময় দোয়া করেন,‘‘হে আমাদের প্রভু! আমি আমার বংশধরদের কিয়দংশকে একটি তরুলতা বিহীন উপত্যকায় আপনার সম্মানিত ঘরের নিকটে বসবাস করিয়েছি। হে আমাদের প্রভু,এ উদ্দেশ্যে যেনো তারা নামায প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কাজেই কিছু মানুষের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে দিন, আর তাদেরকে ফলমূল দিয়ে রিযিকের ব্যবস্থা করে দিন। যেনো তারা আপনার শুকরিয়া আদায় করতে পারে।’’ (সূরা ইব্রাহিম ৩৭)
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন যে,ইব্রাহিম (আ.) যখন কাবা গৃহের নির্মাণ কার্য সমাপ্ত করলেন তখন জিব্রাইল (আ.) এসে তাকে বললেন,এবার এর চতুর্পার্শ্বে সাত চক্কর তাওয়াফ করে নিন। তখন তিনি এবং ইসমাঈল (আ.) কাবা গৃহের চতুর্দিকে সাতবার তাওয়াফ করলেন। প্রত্যেক তাওয়াফে চারটি কোনার প্রত্যেকটি একবার করে স্পর্শ করতেন। সম্মানিত পাঠক, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের এই তাওয়াফকে এত পছন্দ করেছেন যে কেয়ামত পর্যন্ত জারি রাখার জন্যে উম্মতে মুহাম্মদীর ওপরে এই তাওয়াফকে হজ্বের ফরয করে দিয়েছেন। সাত চক্কর তাওয়াফ শেষে তিনি এবং ইসমাঈল (আ.)মাকামে ইব্রাহিমের পেছনে দাঁড়িয়ে দু রাকাত নামায আদায় করলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের এই নামাযকে এতো পছন্দ করেছেন যে কেয়ামত পর্যন্ত জারি রাখার জন্যে উম্মতে মুহাম্মদীর ওপরে এই নামাযকে হজ্বের সুন্নাত করে দিয়েছেন।
মহান আল্লাহর তাওহীদ বা একত্ববাদ বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা কোরবানীর অন্যতম শিক্ষা।মানব সৃষ্টির ইতিহাসের ন্যায় কোরবানির ইতিহাসও অতি প্রাচীন। সমগ্র বিশে^র মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর জিলহজ¦ মাসের ১০ তারিখ যে কোরবানি দিয়ে থাকেন সেটা সমগ্র মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) থেকে প্রচলিত। আল্লাহ তা’য়ালা হযরত ইব্রাহীম (আ:) কে প্রিয় সন্তান হযরত ইসমাঈল (আ:) কে কোরবানির নির্দেশ দিয়েছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ:) সে হুকুম পালন করে সফল হয়েছিলেন। সেই থেকে মুসলিম জাতি কোরবানির এ বিধান পালন করে আসছেন। আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা সাফ্ফাত এর ১০২ নম্বর আয়াতে এভাবে তুলে ধরেছেন ‘অতঃপর যখন সে তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন সে বললো, ‘হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি,অতএব দেখ তোমার কী অভিমত?;সে বললো,‘হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে,আপনি তাই করুন। আমাকে ইনশাআল্লাহ আপনি অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ এর পরের আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,‘অতঃপর বাবা-ছেলে উভয়েই যখন আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং ইব্রাহিম (আ.) তাকে জবেহ করার জন্য কাত করে শুইয়ে দিলেন।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০৩)
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ, আলে ইবরাহীম ও আলে ইমরানকে বিশ্ববাসীর উপরে নির্বাচিত করেছেন’ (আলে ইমরান ৩/৩৩)। এই নির্বাচন ছিলো বিশ্ব সমাজে আল্লাহর তাওহীদের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য। ইব্রাহিম (আ.) ছিলেন নবীগণের পিতা এবং পুত্র মুহাম্মাদ ছিলেন নবীগণের নেতা,এ বিষয়টি সর্বদা মুমিনের মানসপটে জাগরুক রাখার জন্য দৈনিক সালাতের শেষ বৈঠকে পঠিত দরূদের মধ্যে ইব্রাহিম ও মুহাম্মাদের ওপরে এবং উভয়ের পরিবার বর্গের ওপরে আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষণের জন্য দো‘আ করার বিধান রাখা হয়েছে। ইব্রাহিমের বংশে বরকত হলো নবুয়ত ও ঐশী কিতাবের বরকত এবং মুহাম্মাদের ও তাঁর বংশে বরকত হলো বিজ্ঞানময় কোরআন ও হাদিস এবং তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থার বরকত। ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর বংশধর সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,‘‘আমি তাকে দান করলাম ইসহাক ও ইয়াকুবকে এবং তাঁর বংশধরগণের মধ্যে প্রদান করলাম নবুয়ত ও কিতাব।
উত্তম জাতি বিনির্মাণের আদর্শ পুরুষ হযরত ইব্রাহিম (আ.)। হযরত ইব্রাহীম (আ.) ছিলেন ইয়াহুদী খ্রিষ্টান ও মুসলমান জাতির পূর্বপুরুষ। কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী তিনি ইয়াহুদী বা খ্রিষ্টান ছিলেন না,তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলমান (৩:৬৭)। মুসলমান জাতির উৎপত্তিও ইব্রাহীম থেকে। কোরআন বলে-‘‘এবং আল্লাহর রাস্তায় মনে প্রাণে যথাসাধ্য সংগ্রাম করো, তিনিই তোমাদের এ ধর্ম পছন্দ করেছেন এবং তোমাদের ওপর ধর্মে কোনো কঠোরতা স্থাপন করেননি। ইহা তোমাদের পিতা ইব্রাহিমর ধর্ম’ (২২:৭৮)। আল্লাহ ইব্রাহীমকে শুধু তখনই তার জাতির নেতৃতৃব দিয়েছেন, যখন সে তাঁর জন্য নির্ধারিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আ.)-এর জীবনের ঐতিহাসিক ঘটনা আমাদেরকে জানিয়ে দেয় যে কাজ যত বড় হবে, তার সফলতার জন্য প্রয়োজন হবে তত বড় কোরবানির। ‘হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে আল্লাহ পাক এক শাশ্বত পয়গাম, চিরন্তন ইমামতি ও নেতৃত্বের সম্মান দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন।ফলে উত্তরাধিকার সূত্রে পরবর্তী বংশধররাও লাভ করেছেন নবুওত ও রিসালতের এ মহা সম্মান এবং বিভ্রান্ত মানবতাকে মুক্তির পথ প্রদর্শন করার এ গুরু দাযিত্ব যুগ যুগ ধরে তাদেরকেই দিয়ে যেতে হবে ত্যাগ ও কোরবানি এবং রক্ত ও শাহাদত। শত ঝড়-ঝাপটার মুখেও বয়ে যেতে হবে মানবতার নিভু নিভু প্রদীপকে রক্ষা করার মহা দায়িত্ব। হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এ যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তাওহীদ প্রদীপের এ নিষ্কম্প আলো দানের উপরেই নির্ভর করছে গোটা মানবতার মুক্তি ও নাজাত’। যে জাতির বুনিয়াদ স্থাপিত হয়েছিল হযরত ইব্রাহিমের পবিত্র হাতে,সেই জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন ইব্রাহিমের চরিত্রে জাতির নেতৃত্ব গড়ে তোলা।
আল্লাহ তা’য়ালা ইব্রাহিমকে যে যে বিষয় পরীক্ষা করেছিলেন মুসলিম তাফসীরকারককগণ বিভিন্নভাবে উহাদের ব্যাখ্যা করেছেন। মনে হয় সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে,আল্লাহ তা’য়ালা দুটি বিষয় সম্পর্কে তার পরীক্ষা নিয়েছিলেন-যথা চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রসমূহ যেগুলোকে তাঁর জাতির লোকেরা উপাসনা করতো,তিনি সেগুলোকে রব বলে স্বীকার করতে অস্বীকার করে ছিলেন। অতঃপর তাঁকে অগ্নি, তাঁর দেশান্তর ও আল্লাহর রাহে পুত্রের কোরবানি দ্বারা পরীক্ষা করা হয়েছিলো। সমগ্র মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রাণাধিক প্রিয় কিশোর পুত্র হযরত ইসমাঈলকে আল্লাহর নির্দেশে তাঁরই সমীপে কোরবানি করার হুকুম পালনোদ্যত ঘটনাকে কেন্দ্র করেই মুসলিম বিশ্বে ঈদুল আযহা পালিত হয়ে আসছে। ঈদুল আযহা আমাদেরকে বার বার স্মরণ করিয়ে দেয় হযরত ইব্রাহিমের সমস্ত নিষ্ঠা, বিশ্বপালকের কাছে মৃত্যু ও জীবন উৎসর্গের ইতিহাস।
ইসলামে প্রথম থেকে শেষ সব নবীর জীবনেই বিপদ এসেছে কিন্তু প্রত্যেক নবী ধৈর্য ধারণ ও মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করেই বিপদমুক্ত হয়েছেন। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের ৬৭ নম্বর ‘সূরা মুলক’-এর দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে ‘যিনি (আল্লাহ) মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য যে কে তোমরা কর্মে উত্তম।’ প্রথম সূরা বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের (কাউকে) ভয় ও ক্ষুধা দিয়ে, আর (কাউকে) ধনেপ্রাণে বা ফল ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে পরীক্ষা করবো। আর যারা ধৈর্য ধরে তাদের তুমি সুসংবাদ দাও।’ অন্যদিকে বিপদে পড়লে করণীয় সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে একই সূরার ১৫৬ ও ১৫৭ নম্বর আয়াতে।এক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশনা “(তারাই ধৈর্যশীল) যারা তাদের ওপর কোনো বিপদ এলে বলে ‘আমরা তো আল্লাহরই, আর নিশ্চিতভাবে আমরা তাঁরই দিকে ফিরে যাব।’ এই সব লোকের প্রতি তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে আশীর্বাদ ও দয়া বর্ষিত হয়, আর এরাই সৎপথপ্রাপ্ত।”
আমরা জানি পৃথিবীতে যত নবী-রসূল এসেছিলেন সকলেই মূর্তির বিরোধিতা করেছিলেন। তবে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) অন্য ধর্মের উপাসনালয়ের মূর্তির ওপর আঘাত করতে ও প্রতিমা সম্পর্কে বিষোদগার করতে নিষেধ করেছেন) হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর কওমের মানুষদের মূর্তি পূজায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত দেখে মানসিকভাবে বেকার গ্রস্ত হয়ে পড়লেন। যার কারণে তাদের মূর্তির ওপর তিনি সুযোগ বুঝে আঘাত করেছিলেন। এটা ছিলো তাওহিদের দাবী কিন্তু খোদা দাবীদার জালিমশাহী নমরুদ এটা বরদাস্ত করে নাই। সে বিশাল আগুনের কুন্ডলী তৈরি করে তাতে নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে হযরত ইব্রাহিম (আ.)কে মারার পরিকল্পনা করেছিল। হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাতে বিন্দুমাত্র ঈমান থেকে দূরে সরেন নাই। শংকিতও হন নাই। নমরুদ হাজার হাজার শ্রমিক দিয়ে বিশাল বড় গর্ত খনন করে তাতে রাজ্যের বড় বড় গাছগুলো ভরে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ আগুনের লেলিহান তৈরি করেছিল। এরপর হযরত ইব্রাহিম (আ.)কে সেখানে হাজির করা হলো। গর্তের আগুনের বিশালতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কোন মানুষ গর্তের ধারে-কাছেও যেতে পারে না। তারা হযরত ইব্রাহিম (আ.)কে আগুনে ফেলার জন্য উপায় বের করল। একটি চড়ক তৈরি করা হলো। অনেক উঁচু এই চড়কে হযরত ইব্রাহিম (আ.)কে উঠিয়ে দিয়ে ঘুরপাক দিয়ে তাঁকে আগুনের মাঝখানে ফেলে দেওয়া হবে। তিনি আগুনে পুড়ে কিভাবে ছাই হয়ে যাবে সেটা দেখার জন্য নমরুদ এবং তার মন্ত্রী পরিষদ গর্তের অনতিদূরে উঁচু মঞ্চ করে বসে দেখছে। যে সময় হযরত ইব্রাহিম (আ.)কে চড়কে উঠিয়ে ঘুরপাক দিয়ে ফেলে দিবে, সেই মুহূর্তে তাঁর ঈমান পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ তা’য়ালা হযরত জিব্রাইল (আ.)কে পাঠালেন। হযরত জিব্রাইল (আ.) এসে বললেন, হে ইব্রাহিম! আপনাকে আগুনে ফেলা হচ্ছে। আপনি আমার কাছে সাহায্য চান। আমি আপনাকে বাঁচিয়ে দেবো। হযরত ইব্রাহিম (আ.) বললেন, জিব্রাইল, আমি তোমার কাছে কেনো সাহায্য চাইবো? আমি তো কোনো অন্ধ আল্লাহর ইবাদত করি না? যিনি তাঁর বান্দার দুঃখ-কষ্টগুলো নিজের চোখে না দেখেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) এই মুহূর্তেও ঈমান থেকে টলেন নাই। যার কারণে এই পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হলেন। এর কিছুক্ষণ পরেই তাঁকে আগুনের কুন্ডলীতে নিক্ষেপ করা হলো। আল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে আগুনকে আদেশ করলেন হে আগুন, আমার ইব্রাহিমের জন্য শান্তিদায়ক ঠান্ডা হয়ে যাও। আগুন শান্তিদায়ক হয়েছিলো। সেদিন ইব্রাহিম (আ.) এর ঈমানের জোড়ে একটি পশমও পুড়ে যায়নি।
নবীগণ ছিলেন মহান আল্লাহর পূত পবিত্র দূত। তাঁরা দিকভ্রান্ত মানুষকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। বলে দিয়েছেন অনন্ত জান্নাতের পথ। জান্নাতের নিয়ামত অসীম। মানুষ যা কল্পনাও করতে পারবে না তার চেয়ে ঢের নিয়ামত সেখানে। মহান আল্লাহর এসব নবীগণ তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী উম্মতের মাঝে দ্বীনের কাজ করেছেন। অবশেষে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রায় দু’শো বছরের পুরা জীবনটাই ছিলো পরীক্ষার জীবন। সুখে-দুখে,আনন্দে-বিষাদে সর্বাবস্থায় তিনি ছিলেন আল্লাহর ওপরে একান্ত নির্ভরশীল। পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা তাঁকে তাঁর বিশ্বাস থেকে এক চুল টলাতে পারেনি। অবশেষে জন্মভূমি ত্যাগ করে হিজরত করে আসতেও তিনি পিছপা হননি। আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায় বৃদ্ধ বয়সের নয়নের মণি একমাত্র শিশু পুত্রকে তার মা সহ মক্কার বিজনভূমিতে নির্বাসনে দিয়ে আসতেও তাঁর হৃদয় টলেনি। অবশেষে ঐ সন্তানকে যবেহ করার মতো কঠিনতম উদ্যোগ নিতেও তাঁর হাত কেঁপে ওঠেনি। এভাবে জীবনভর অগণিত পরীক্ষার চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পূর্ণ-পরিণত ইব্রাহিম পেলেন‘বিশ্বনেতা’ হবার মতো বিরল দুনিয়াবী পুরস্কারের মহান এলাহী ঘোষণা। হলেন ভবিষ্যৎ নবীগণের পিতা ‘আবুল আম্বিয়া’ এবং মিল্লাতে ইসলামিয়াহর নেতা হবার মতো দুর্লভ সম্মান। আজও যদি পৃথিবীর দিকে দিকে ইব্রাহিমী ঈমানের জ্যোতি বিকীরিত হয়,আবার মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সে ঈমান ফিরে আসে,তবে বর্তমান অশান্ত পৃথিবীর নমরূদী হুতাশন আবারও পুষ্পকাননে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ। ইকবাল তাই গেয়েছেন,‘বিশ্বে যদি সৃষ্টি হয় ফের ইবরাহিমী ঈমান হুতাশনে তবে সৃষ্টি হবে ফের পুষ্পের কানন’॥ মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৬৬ ‘মে‘রাজ’ অনুচ্ছেদ। আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৪৫৩-৫৪; হাকেম ৪/৫৫৭-৫৮ পৃঃ প্রভৃতি। হযরত ইব্রাহিম (আ.) ১৬৯ বছর বেঁচে ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ধারণা মতে, খ্রিস্টপূর্ব ১৬৪৪ অব্দে তাঁর মৃত্যু হয় এবং তাঁকে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে অবস্থিত পুরাতন হেবরন শহরের পাটরিআরক্স নামক গুহায় সমাহিত করা হয়। হযরত ইব্রাহিম (আ.) স্ত্রী সারা ছিলেন আদি মাতা বিবি হাওয়ার পরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী। তিনি ১২৭ বছর বয়েসে হেবরনে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানেই তাঁকে কবরস্থ করা হয়। হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর আরেক স্ত্রী হাজেরা ও পুত্র ইসহাক এবং পুত্রবধূ লিয়াহর কবরও হেবরন শহরে রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে একটি মসজিদের ভিতরে বুলেটপ্রুফ কাচ দিয়ে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কবর সংরক্ষিত আছে।

লেখকঃ গবেষক,সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,মানিকগঞ্জ,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম