হুমকির মুখে খরস্রোতা বৌলাই নদী

মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব সীমান্তে খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের কোল ঘেষে সুনামগঞ্জ জেলার অবস্থান। হাওরের জেলা সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী তাহিরপুর উপজেলার বৌলাই নদীতে অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করার কারণে একদিকে নষ্ট হচ্ছে ফসলী জমি।অন্যদিকে নদীর পাড়ে বসবাসরত বাড়িঘরসহ পরিবেশের ভারসাম্য রয়েছে হুমকির মুখে। সুনামগঞ্জে বালু-পাথর পরিবহনের কারণে জামালগঞ্জ-তাহিরপুর ও ধর্মপাশা ঘেঁষে প্রবাহিত বৌলাই নদীতে দেড় কিলোমিটারব্যাপী নৌজটের সৃষ্টি হয়েছে।এক সপ্তাহ ধরে চলছে এ অবস্থা। এতে নদী তীরবর্তী মানুষেরা পড়েছে বিপাকে। এ দিকে বৌলাই নদীতে নৌজটের কারণে নৌযানের মালিক শ্রমিকদের পাশাপাশি দুর্ভোগে পড়েছেন নদী তীরের গ্রামগুলোর মানুষেরা। নদীর পানি দূষিত হয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন আশপাশের গ্রামের কৃষকসহ এলাকাবাসী।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়,নৌপথে তাহিরপুরের ফাজিলপুর থেকে বালু-পাথর সংগ্রহ করে সারা দেশে পরিবহনের জন্য সুনামগঞ্জের সুরমা,রক্তি,বৌলাই নদীসহ বেশ কয়েকটি নদী পাড়ি দিতে হয়। বৌলাই নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ায় প্রতি বছরই নদীর বিভিন্ন স্থানে নৌজটের সৃষ্টি হয়। এতে তিন-চার দিনের নদীপথ অতিক্রম করতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ এক স্থানেই বসে থাকতে হয়। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি, নৌযানের মালিক-শ্রমিকেরাও চরম লোকসানের শিকার হচ্ছেন দিন দিন। প্রতি বছরই ভরাটকৃত নদী খননকাজ করা না হলে দূর্ভোগ পুহাতে হবে। বৌলাই নদীর বেশির ভাগ জায়গা ভরাট হয়ে গেছে। প্রতি বছরই এই মওসুমে মাহমুদপুর, পৈরুপ, হিজলা গ্রামের সামনে হাঁটু থেকে কোমর পানি হয়ে যায়। এ জন্যই কয়েকটি গ্রামের সামনে নৌজটের সৃষ্টি হয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই এ সমস্যা দেখা দিছে। নদী ভরাটে শুধু নৌজটই হয়, এমন না। চৈত্র-বৈশাখ মাসে ফসল কাটার সময় পাহাড়ি ঢলের পানি নদীর তীর উপচে হাওরে প্রবেশ করে। এ সময় ফসল রক্ষা বাঁধ অনেক ঝুঁকিতে থাকে।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার তাহিরপুর সদর থেকে সুলেমানপুর পর্যন্ত বৌলাই নদীর বুকে বালু ও মাটির স্তর নৌ-যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়াও শ্রীপুর থেকে সুলেমানপর পর্যন্ত নাব্যতা সংকটের কারনে স্থানীয় সংঘবদ্ধ চাদাঁবাজ চক্র নৌকা থেকে জোর পূর্বক চাদাঁ তুলে। বৌলাই নদীতে বর্তমানে নাব্যতা হারানো ফলে নদীতে বালির ও পলি মাটির স্তর পরে শুকিয়ে চড়ে পরিনত যাওয়ায় এর বিরুপ প্রভাব পড়েছে উপজেলাবাসীর জীবন যাত্রা,জীবিকা ও ব্যবসা বাণিজ্য পড়েছে হুমকির মুখে। এছাড়াও নাব্যতা হারানোর কারনে নৌ-যান চলাচল বন্ধ থাকায় টাংগুয়ার হাওরে বেড়াতে আসা পর্যটক ও দর্শনার্থীরা পড়ের দূভোর্গে। তাহিরপুরের বিভিন্ন ইউনিয়ন,পার্শ্ববর্তী উপজেলা ও অন্যান্য জেলার সাথে অভ্যন্তরীন যোগযোগ বিচ্ছিন্ন।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সঙ্গে ৭টি ইউনিয়ন অভ্যন্তরীণ,পাশ্ববর্তী উপজেলা,জেলা ও অন্যান্য জেলার সাথে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই,ফলে মালামাল পরিবহনে বর্ষায় নৌ-পথ ই ভরসা। হেমন্ত প্রয়োজনের তাগিদে লোকজন পাঁয়ে হেঁটে কিংবা বাই সাইকেল ও মটর সাইকেলে চলাচল করলেও মালামাল পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম নদী পথ। সে জন্য হাওর বেষ্টিত উপজেলার সকল হাট-বাজার নদী তীরবর্তী স্থানে গড়ে উঠেছে। কিন্তু বর্তমানে নদী গুলো নাব্যতা হারানো,নদীর বুকে বালির ও পলি মাটির স্তর পরে শুকিয়ে চড়ে পরিনত যাওয়ায় এর বিরুপ প্রভাব পড়েছে উপজেলা বাসীর জীবন যাত্রা,জীবিকা ও ব্যবসা বাণিজ্য পড়েছে হুমকির মুখে। পরিবহনের দুরবস্থার কারনে তাহিরপুরে দ্রব্য মূল্যের দাম পাশ্ববর্তী উপজেলা গুলোর চেয়ে অনেক বেশী।

বৌলাই,রক্তি,যাদুকাটা ও পাটলাই উপজেলার প্রধান নদী। নদী গুলোর নাব্যতা হারানোর ফলে মরে গেছে এর শাখা নদী ও খাল গুলো। পাটলাই,রক্তি নদীর দিয়ে কয়লা,বালি ও পাথর পরিবহনের মাধ্যমে সরকার বিপুল পরিমান রাজস্ব আদায় করে থাকে। বৌলাই নদী উপজেলা সদরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমে-দক্ষিন শ্রীপুর ইউনিয়নের সুলেমানপুর গিয়ে পাটলাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পূর্ব দিকে জেলা সদর সুনামগঞ্জ, মহোনগঞ্জ, কমলাকান্দা, মধ্যনগর,ধর্মপাশা ও কিশোরগঞ্জ,ভৈরব সহ দেশের দক্ষিন-পশ্চিম অঞ্চল সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাথে যোগাযোগ করা হয়।এখানকার অন্যতম কয়লা আমদানী শুল্ক ষ্টেশন বড়ছড়া,চারাগাঁও,বাগলী দিয়ে ভারত থেকে আমদানী করে পাটলাই নদী দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে চাহিদা মিটায় আর এ থেকে সরকারের বিপুল পরিমান রাজ্যস্ব আদায় হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়,ড্রেজার দিয়ে স্থানীয় শক্তিশালী বালু খেকো চক্রের সাথে আঁতাত করে নদীতে অপরিকল্পিতভাবে বৌলাই নদীতে মাটি খননের কাজ করে। খননে উত্তোলিত বালু ও মাটি কৌশলে বালু খেকো চক্রের সহযোগিতায় দীর্ঘদিন ধরেই উপজেলার দক্ষিণকুল,হোসেনপুর,সীমানা,মাহতাবপুর,পিরোজপুর, রসুলপুর, চিসকা গ্রামে মাটি ভরাটের নামে প্রতি শতাংশে ২০-৩০ হাজার টাকা কোনো কোনো স্থানে আরও বেশি টাকা হাতিয়ে নেয়। আবারও টাকা কামানোর লোভে বৌলাই নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করে ফসলি জমি, নদীর পাড়ে বসবাসরত বাড়ি ঘর ও পরিবেশ হুমকির মুখে ফেলে বালু ভরাটের কাজ করছে চিসকা গ্রামে। আর লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে যেন দেখার কেউ নেই।

আরও জানা যায়, চিসকা গ্রামের উত্তর দিকে বৌলাই নদীর বুক থেকে মাটি না কেটে নদী সংলগ্ন ফসলি জমি কেটে দক্ষিণ দিকের শনি হাওরের দিকে জায়গা ভরাট করছে ও বালু মজুত করে রাতের আঁধারে পাঠাচ্ছে অন্যত্র। এছাড়াও শনি হাওরের ফসলি জমি ভরাটের জন্য লাখ টাকা চুক্তি করেছে। আর যাদের জায়গা ভরাট ও বিক্রি করছে তাদের কাছ থেকে গোপনে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা এবং মাটি ভরাটের কারণে চাষযোগ্য জমি নষ্ট হচ্ছে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার বৌলাই নদীতে আটকা পড়েছে বালু ও পাথরসহ পণ্যবাহী শত শত নৌযান। নাব্য সংকটের কারণে নদীর গভীরতা ও পানি কমে যাওয়ায় চলাচল করতে পারছে না পণ্যবাহী এসব নৌযান। পণ্য পরিবহন ব্যাহত হওয়ায় দিনের পর দিন লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। বিপাকে পড়েছেন নৌ শ্রমিকরা।

সুজলা-সুফলা,শস্য-শ্যামলা এই বাংলা মায়ের শীতল বক্ষ চিরে বয়ে চলেছে অসংখ্য নদ ও নদীর অববাহিকা। নদীনির্ভর বাংলা কথাশিল্পের ধারাবাহিকতায় অবিস্মরণীয় কীর্তি নদী। আদিকাল থেকে জীবন ও জলের প্রবাহ একাকার, অবিচ্ছিন্ন। ধমনীতে যেমন রক্ত প্রবাহ জরুরি তেমনি দেশকে বাঁচাতে হলে সে দেশের বুকের ভেতর নদী প্রবাহ জরুরি। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীর সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকা, সুখ-দুঃখ, আবেগ-ভালোবাসা জড়িত রয়েছে। নদীর সঙ্গে আমাদের প্রাণের সম্পর্ক। নদীপথ আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ। আজ যে যানজটের কারণে মানুষের জীবন থমকে দাঁড়িয়েছে, নদী পথকে আরও আধুনিকায়ন ও সড়কপথের তুলনায় গুরুত্ব দিতে পারলে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ হত। আমাদের জনজীবনে নদীর গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় বৌলাই নদীতে অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজিংয়ের কারণে একদিকে নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি, নদীর পাড়ে বসবাসরত বাড়ি ঘর ও পরিবেশ পড়েছে হুমকির মুখে। অপরদিকে নদীর বুক থেকে মাটি কাটার কথা থাকলেও এখন তা করছে না। আর সরকারিভাবে ড্রেজারে নদী খননের মাটি ও বালি বিনামূল্যে মসজিদ, মন্দির, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নিচু জায়গা, গর্ত ভরাট করার কথা থাকলেও তা না করে বালু খেকো টাকার বিনিময় ব্যক্তির স্বার্থে কাজ করছেন। নদ-নদী এখনো প্রবাহমান রয়েছে সেসব নদনদী রক্ষার উদ্যোগ কর্তৃপক্ষকে আশু নিতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদ-নদীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যদি নদীগুলো এভাবে তাদের অস্তিত্ব হারাতে থাকে তাহলে অচিরেই পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে। যা আমাদের চিরায়ত জলবায়ুর বিরুদ্ধে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। আর এ সব কারণেই দেশের নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থেকে দখলমুক্ত করতে হবে। এ কাজে সাধারণ মানুষ কর্তৃপক্ষের পাশে থাকবে। আমাদের কৃষিভিত্তিক দেশের সেচ ব্যবস্থা অধিকাংশ নির্ভর করে আমাদের নদ-নদীর ওপর। সেচকার্য পরিচালনা এবং দেশের জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নদীর গুরুত্ব সর্বাধিক। ফলে নদী রক্ষা করতে হবে। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই নদী রক্ষা করতে হবে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে নদীপথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধিত হবে এবং ব্যবসা বাণিজ্যে গতি আসবে।

আবহমানকাল ধরেই এ উপমহাদেশের নদীর সঙ্গে জীবন জড়িত। নদীকে কেন্দ্র করে যুগে যুগে রচিত হয়েছে কালজয়ী সব গান। বারবার লেখক-কবির লেখায় স্থান পেয়েছে নদী। রচিত হয়েছে নদী ও নদীপারের মানুষের জীবনসংগ্রাম নিয়ে পদ্মানদীর মাঝির মতো কালজয়ী উপন্যাস। কিন্তু দখল,দূষণ,নজরদারির অভাবসহ নানা কারণে নদীমাতৃক দেশের আজ করুণ অবস্থা। অবিরাম সৌন্দর্যে আঁকা নদীমাতৃক দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। ষড়ঋতুর দেশ। এককালের প্রায় হাজার নদীর দেশ। জোয়ারভাটার দেশ। নদীমাতৃক বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে নদীভিত্তিক সমস্যার সমাধান করতে হবে দীর্ঘমেয়াদিভাবে। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের জীবন, জীবিকা ও সার্বিক উন্নতি নির্ভর করে নদীর ওপর। এ কারণে নদী সমস্যাকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ দেশের নদী বাঁচলে,মানুষ বাঁচবে। অর্থাৎ দেশের মধ্যে প্রবহমান অন্যান্য নদ-নদীর মতো বৌলাই নদীকে বাঁচানোই এখন সময়ের দাবি। ছবি-প্রতিকী

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ (কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান) সভাপতি শারীরিক
শিক্ষাবিদ সমিতি,চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,গবেষক,শিক্ষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম