স্রোত হারিয়ে মরা খাল খরস্রোতা বন্নী নদী

মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
নেত্রকোণা জেলা নদী ও হাওড় বেষ্টিত। এর বুকচিড়ে বয়ে চর্তুদিক হতে উপজেলা দিয়ে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন নদী ও হাওড়। নেত্রকোণা জেলা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের ময়মনসিংহ বিভাগের একটি প্রশাসনিক এলাকা। উপজেলার সংখ্যানুসারে নেত্রকোণা বাংলাদেশের একটি “এ” শ্রেণীভুক্ত জেলা। এখানে রয়েছে পাহাড়ি জলপ্রপাত, চীনা মাটির পাহাড়, নদী, খাল, বিল। এই জেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ জেলা,পূর্বে সুনামগঞ্জ জেলা,পশ্চিমে ময়মনসিংহ জেলা। নেত্রকোনা জেলার রয়েছে বহুসংখ্যক নদী। তার মধ্যে একটি নদী হলো বন্নী নদী।
পৃথিবীর ইতিহাস খুঁজতে গেলে দেখা যায় প্রায় সকল বড় বড় মানবসভ্যতা গড়ে ওঠেছিলো নদী তীরে। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নগর, বন্দর,শহর,গ্রাম, জেলেপাড়া, বাণিজ্যকেন্দ্র প্রভৃতি। এই নদীকে ঘিরেই ছিলো আদিকালের যাতাযাতের সকল ব্যবস্থা। জাহাজে, নৌকায় চড়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত মানুষ ঘুরে বেড়িয়েছে। কৃষি, মৎস্য, জেলেদের পেশা এবং সংস্কৃতির পাশাপাশি মানুষের নিত্যদিনের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ সকল কিছুর একমাত্র উৎস ছিলো নদী। নদী আজ দখল, দূষণ আর ভরাটের প্রেিযাগিতায় বিপন্ন অনেকাংশে বিলুপ্ত। বিলুপ্ত প্রায় বন্নী নদী।

নিকট অতীতেও নেত্রকোনা জেলায় জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো ৫৮টি ছোট বড় নদী। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে এই এলাকার মানুষের জীবন, পেশা, কৃষি, ব্যবসা, খাদ্য-পুষ্টি। নদী ছিলো এই এলাকার সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। নদীই ছিলো মানুষের প্রাণ। কতো বাহারি নামের নদীই না ছিলো নেত্রকোনার ভুমিতে। ধনু, ধলাই, গুনাই, ঘোড়াউতরা, পিয়াইন, মগড়া, কংস, সাইডুলি, পাঠেশ্বরী, তুষাই, মহাদেও, গণেশ্বরী, নাগঢড়া, কালমগড়া, বিষনাই, ভোগাই কংস, উবদাখালী, মরাসুরমা, পিয়াং, পাটকুড়া,রাজরাজেশ্বরী, লাউয়ারি, কালিহর, সাপমারা, বেতাই, খারছা, চেন্নাই, হলোলিয়া, বন্নী, বয়রাহালা,বালই,চেলাই,গন্টবতী,বালিয়া,মঙ্গেশ্বরী,রাজাখালি,বৌলাই, বিষনাইল, ধনাইখালি, লারখালি, গোলামখালি, রাঙ্গাধাইর, কাউনাই, খরপাই, আতরখালি, দিংঘানা, চেল্লাখালি, দেওদিয়া, মারিসি, মলিজি, ভূগাই, নিতাই, খানিগাঙ, শলাখালি,সোয়াই, মাদল মরানদী, বালচ, প্রভৃতি। বর্তমানে ৭ থেকে ৮ টি নদী ছাড়া বাকী নদীগুলো বিপন্ন; কোনো কোনোটা বিলুপ্ত। মরাখালে পরিণত হয়েছে নদীগুলো। মরণ থাবায় রক্ষা পায়নি খরস্রোতা বন্নী নদী।
নদীতে প্যাঁচিয়ে থাকা শহরের নাম নেত্রকোনা। একটি মাত্র নদীর মধ্যে পুরো শহরটা প্যাঁচানো। নেত্রকোনাবাসীকে বাইরের লোকেরা মগড়া পাড়ের মানুষ হিসেবেই জানেন। আর সেই এক সময়ের খরস্রোতা মগড়া নদীও এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। দখলে আর দূষণে শীর্ণকায় মগড়া শুধুই কাঁদে। নদীমাতৃক এই জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ৫৭টি নদী ছিলো। আর কালের আবর্তে এখন মাত্র ৭টি নদী চলমান রয়েছে। অন্যান্য নদীগুলো একেবারে বিলীন হয়ে গেছে। তার মধ্যে একটি হলো বন্নী নদী। অন্যগুলো খাল বা নালা আকার ধারণ করেছে।

ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস প্রাচীন ঐতিহ্যে টই-টুম্বুর ও ঐতিহ্যের বিচিত্র ঘটনা সম্ভারে গর্বিত। বিভিন্ন তাত্ত্বিক পর্যালোচনায় স্পষ্টতঃ প্রমাণ করে যে সাগর বা সমুদ্রগর্ভ থেকে জেগে ওঠায় এ অঞ্চলটি মানব বসবাসের যোগ্য ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। গারো পাহাড়ের পাদদেশ লেহন করে এঁকেবেঁকে কংস, সোমেশ্বরী, গণেশ্বরী, মহেশ্বরী, গোরাউৎরা নদীসহ অন্যান্য শাখা নদী নিয়ে বর্তমান নেত্রকোণা জেলার জলধারার উদ্ভব। এ জেলার প্রত্যেক নদীই জেলার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত। ফলে সমগ্র জেলার ভূমি উত্তরাংশে উঁচু এবং ক্রমে দক্ষিণ-পূর্বাংশে ঢালু।
নদীকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের কোনো সৌন্দর্য কল্পনা করা যায় না। নদীর গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। নদীর গুরুত্ব অপরিসীম।দখল-বেদখলে নদীর দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। এক সময়ের খরস্রোতা বন্নী নদী আজ তৃষ্ণার্ত! বুক চিরে চাষ হওয়া ধানক্ষেতের নালাগুলো দিয়ে যেনো তার চোখের জল ঝরছে।
আদিকাল থেকে জীবন ও জলের প্রবাহ একাকার, অবিচ্ছিন্ন। নদী ও জীবন পরস্পরের সবচেয়ে সার্থক উপমান এবং এতোটাই সঙ্গত যে,ক্রমাগত পুনরাবৃত্ত হয়েও নতুন জীবনের অনিঃশেষ বহমানতা, পরিক্রমণ,বিবর্তন, সবকিছু একই সঙ্গে নদীতে দৃশ্যমান। দেশ,সুজলা-সুফলা,শস্য-শ্যামলা এই বাংলা মায়ের শিতল বক্ষ চিরে বয়ে চলেছে অসংখ্য নদ ও নদীর অববাহিকা।এ দেশের অর্থনীতিও নদীনির্ভর। নদী প্রকৃতির দান। নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নদী-নালার ওপর নির্ভরশীল।

নদ-নদী মানবজীবনে ও মানবসভ্যতায় এক অনবদ্য সংযোজন।নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর উপস্থিতি আমাদের জীবনে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে নদীর প্রভাব। ‘নদীও নারীর মতো কথা কয়’- অর্থাৎ নদীর সঙ্গে রয়েছে আবেগের সম্পর্ক। নদীর জন্য কত মানুষের কত বিচিত্র রকমের আকুতি। তাই নদীকে বাঁচাতে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
কালের বিবর্তনে নেত্রকোনার জেলার বন্নী নদীতে এখন আর পালতোলা নৌকার বহর দেখা যায় না। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পানিশূন্য নদীর বুকে চলে চাষবাস। খনন না করা ও দখলদারদের থাবায় নদীর নাব্যতা যেমন কমছে, ঠিক একইভাবে কমছে নদীর সংখ্যাও। নদী গবেষকরা বলছেন, ষাটের দশকে সাড়ে সাতশ নদী ছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবাহিত ২৩০ নদীর মধ্যে ৫৯টি আন্তর্জাতিক। তবে সরকারি হিসেবে দেশে নদীর সংখ্যা ৪০৫। শুকনো মৌসুমে এসব নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকে না। ফলে বদলে যাচ্ছে নদীগুলোর গতিপথ, শুকিয়ে মরে যেতে যেতে দেশের মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদী।
দেশের নদ-নদী হারিয়ে যাচ্ছে ফলে ইকোসিস্টেম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, পরিবেশ বিপর্যয়ের মারাত্মক পর্য্যায়ে উপনীত। মাছ, পশুপাখি, গাছপালা, বন্য ও জলজপ্রাণী, উদ্ভিদ, ফ্লোরা-ফনা প্রভৃতি তাদের জীববৈচিত্র্য হারিয়ে অস্তিকত্বের সঙ্কটে ভূগছে, শহরের বায়ু নিশ্বাস গ্রহণের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৮শ’ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪ হাজার ১শ’ ৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতো। কিন্তু কালের বির্তন আর নদী শাসনের ফলে কমে গেছে নদ-নদীর পরিমাণ। তেমনি একটি নদী নেত্রকোনা জেলার বন্নী নদী।

অমিত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। এদেশে বিরাজমান প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশের কাতারে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন অঞ্চলভিত্তিক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং কেন্দ্রমুখী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে অঞ্চলভিত্তিক অবকাঠামো উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলই ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিক দিয়ে স্বকীয় বা অনন্য। অন্যান্য জেলার মত নেত্রকোনা জেলাও রয়েছে কিছু স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য।
১৭৮৩ সালে জেমস রেনেল অংকিত বাংলাদেশের মানচিত্র যে নদী-নালাগুলোর বিবরণ রয়েছে বর্তমানে সেগুলি চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য। নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে এবং পরিত্যক্ত গতিপথ ভরাট হয়ে পুরানো নদীপথের চিহৃ মুছে গেছে। আবার একই নদীর গতিপ্রবাহ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত।

নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশর ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে শত শত নদী। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন নদী ও শাখা নদীর সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার এর বাইরেও ১৮ হাজার থেকে ২২ হাজার শাখা ও উপনদী রয়েছে। সে হিসেবে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬ হাজার। নদী দখল,বাঁধ, নগরায়ন,ভরাটের কারণে দেশের নদ-নদী বিলুপ্ত। এমনি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে খরস্রোতা বন্নী নদী। নদী আমাদের অস্তিত্ত্বর অংশ। নদী আমাদের নান্দনিকতার উৎস। নদীর আত্মহনন বা হত্যা দিয়ে আমরা সভ্যতা ও সংস্কৃতির সচল ধারাকে অবলুপ্ত করতে চাই না। সভ্যতা প্রবহমান; সংস্কৃতি চলমান ধারায় পরিবর্তনের অগ্রদূত। নদী সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রধানতম ধারক ও বাহক। নদীকেন্দ্রিক জীবন প্রবাহের এ ধারাকে সজীব ও জীবন নির্ভর করতে হবে।

শীত-গ্রীষ্মে নদীর ভিন্ন ভিন্ন প্রবাহ। রূপও আলাদা। অনেক নদীতে শীতে চর পড়ে। বর্ষায় স্টম্ফীত হয়ে ওঠে তখন নদীকে বিশাল দেখায়। উদাসীনতার কারণে নদীগুলো মরে যাচ্ছে। দেশের নদী-খালের অবস্থা দেখলে সত্যি কান্না পায়। দখল দূষনে জর্জরিত, ভূমি দস্যুদের আগ্রাসী থাবায় ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে হাওর, বাওর, বিলের সাথে নদীগুলো তাদের সংযোগ হারিয়ে ফেলছে। পলাবন ভূমি, জলাভূমি, জলাশয় প্রভৃতি বিলুপ্তির পথে। নদী দখল-দূষণের বিরুদ্ধে হবেন সোচ্চার। অর্থাৎ দেশের অন্যান্য নদী মতো নেত্রকোনার বন্নী নদীকে বাঁচানোই এখন সময়ের দাবি।ছবি-প্রতিকী

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ(কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান),সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক, গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম