সংবাদ জমিন ডেস্ক ঃঃ
আমাদের সৌরজগতের শেষ প্রান্তে অদ্ভুত একটি বিষয় ঘটে চলেছে। অদৃশ্য একটি বস্তু তার নিজের দিকে আশেপাশের সকল গ্রহাণুকে টানছে। বস্তুটির ভর পৃথিবীর তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। এটি কি আসলে একটি গ্রহ, নাকি অন্য কিছু?
এ নিয়ে প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী পার্সিভাল লয়েল। পাগলাটে ধরনের এই মানুষটা ছিলেন ভ্রমণ বিষয়ক লেখক এবং সফল ব্যবসায়ী। মঙ্গলগ্রহ নিয়ে একটি বই পড়ে তিনি মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এরপরই তিনি একাধিক উদ্ভট দাবি করে বসেন। যার মধ্যে একটি হচ্ছে, মঙ্গলের সভ্যতা। তবে তিনিই প্রথম সৌরজগতের শেষে একটি অদৃশ্য গ্রহের কথা বলে যান, যা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো মাথা ঘামাচ্ছেন। ইউরেনাস ও নেপচুনের কক্ষপথের বক্রতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি এমন দাবি করেছিলেন। তিনি ৬১ বছর বয়সে তার কল্পিত ‘প্ল্যানেট এক্স’ এর ধারণা নিয়েই মারা যান।
মৃত্যুর আগে লয়েল তার প্ল্যানেট এক্সকে খুঁজে বের করতে মিলিয়ন ডলার রেখে যান। তার মৃত্যুর ১৪ বছরের মাথায় ১৯৩০ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি এক তরুণ মহাকাশবিদ প্লুটো আবিষ্কার করেন। কিছু সময়ের জন্য হলেও অনেকেই একে প্ল্যানেট এক্স ধরে নিয়েছিলেন। তবে দ্রুতই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন প্লুটোর যে ভর তা দিয়ে নেপচুন কিংবা ইউরেনাসকে কক্ষপথ থেকে টেনে আনা সম্ভব নয়। এরপর ১৯৮৯ সালে ভয়েজার-২ মহাকাশযান নেপচুনের পাশ দিয়ে উড়ে যায়। ভয়েজার মিশনের মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পারি কাইপার বেল্ট সমপর্কে। মহাজাগতিক বরফ কণার এই বেষ্টনী আমাদের সৌরজগতকে ঘিরে রয়েছে।
নেপচুনের কক্ষপথ থেকেই এই বেষ্টনীর শুরু যা আমাদের সৌরজগতের সব থেকে আলোচিত বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি। এটি বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত আর এতে আছে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি ব্যাসসমপন্ন লাখো গ্রহাণু।
এছাড়া আছে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ধূমকেতু। দ্রুতই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন সৌরজগতের নতুন আবিষ্কৃত অংশে প্লুটোই একমাত্র অধিক ভরসম্পন্ন বস্তু নয়। এরপরই প্লুটো গ্রহ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। এরপরই বিজ্ঞানীরা খুঁজে পান সেডনাকে যা প্লুটোর আকৃতির প্রায় ৪০ শতাংশ। খুঁজে পাওয়া যায় আরো বড় কিছু বস্তুকে যার মধ্যে এরিসের আকৃতি প্রায় প্লুটোর সমানই। ফলে গ্রহের জন্য নতুন একটি সংজ্ঞা সৃষ্টির প্রয়োজন পড়ে বিজ্ঞানীদের। ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা ইউনিয়ন প্লুটোর গ্রহের মর্যাদা কেড়ে নেয়। এরপর থেকে এটি বামন গ্রহ নামে পরিচিত হয়।
এ সময়েই বিজ্ঞানীরা একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করেন। তারা বুঝতে পারেন, সেডনা সূর্যের চারদিকে স্বাভাবিক নিয়মে ঘুরছে না। এটি রীতিমতো আঁকাবাঁকা পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। ফলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন অদৃশ্য কোনো গ্রহ সেডনাকে নিজের দিকে টানছে বলেই তার গতিপথে এই পরিবর্তন এসেছে। দ্রুতই বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন, শুধু সেডনাই নয় আরো ৬টি বামন গ্রহ ও গ্রহাণুর গতিপথও একইভাবে বেকে গেছে। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়টি ছিল সবগুলো বস্তুরই অক্ষরেখা একই দিকে হেলে আছে। অথচ হিসাব বলছে, সবগুলো বামন গ্রহের একদিকে হেলে থাকার সম্ভাবনা আসলে মাত্র ০.০০৭ শতাংশ। ফলে এখানে যে অন্য একটি বস্তুর প্রভাব রয়েছে তা অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেল। বছর যত যাচ্ছে অদৃশ্য প্ল্যানেট এক্সের প্রভাবে গতিপথ বদলে যাওয়া বস্তুর সংখ্যাও বাড়ছে। এখন এই সংখ্যা ৬ থেকে বেড়ে ১৯-এ দাঁড়িয়েছে। এতো প্রমাণ থাকার পরেও আসলেই সৌরজগতের নবম গ্রহ আছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। কারণ, যদি গ্রহটি আসলেই থেকে থাকে তাহলে তা কেনো আমরা শনাক্ত করতে পারছি না। বিজ্ঞানীরা নতুন গ্রহ খুঁজতে চেষ্টার কমতি রাখছেন না। কিন্তু মহাকাশ গবেষণায় আসলে কখনো একটি নির্দিষ্ট টার্গেট ধরে অনুসন্ধান চালানো হয় না। মহাকাশ গবেষকরা মূলত একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির বস্তু নিয়ে কাজ করেন। যেমন- নির্দিষ্ট ধরনের কোনো গ্রহ বা নক্ষত্র। যদি সংখ্যায় এগুলো বিরলও হয়ে থাকে তবুও বিশাল মহাকাশজুড়ে অনুসন্ধান চালালে তাদের খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়। কিন্তু শুধুমাত্র একটি গ্রহকে খুঁজে বের করতে সম্পূর্ণ আলাদা কর্মপদ্ধতির প্রয়োজন হয়। গ্রহটি বিশাল এই মহাকাশের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশে রয়েছে। এবং বিজ্ঞানীদের শুধু এই প্ল্যানেট এক্সকেই খুঁজে বের করতে হবে। মহাকাশজুড়ে এরকম শত শত গ্রহ খুঁজে বের করার মতো চেষ্টা করে এ ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া যাবে না।
তাছাড়া, গ্রহটি সূর্য থেকে এতো দূরে যে এ থেকে সামান্য আলোই প্রতিফলিত হয়। ফলে নির্দিষ্ট ধরনের টেলিস্কোপ ছাড়া এই গ্রহের সন্ধান পাওয়া অসম্ভব। তবে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দুর্বল প্রতিফলন শনাক্তে সক্ষম সুবারু টেলিস্কোপ ব্যবহার করে খুঁজছেন সৌরজগতের নবম গ্রহকে। হয়তো নিকট ভবিষ্যতেই দেখা মিলবে সৌরজগতের এই অদৃশ্য সদস্যের।