সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় প্রতিবেশীর অধিকার


মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
ইসলামে প্রতিবেশীর হক তথা অধিকার প্রসঙ্গে মু’মিনদের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা রয়েছে। মানুষ সামাজিক জীব, সমাজে বসবাসকারী প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি মানুষের দায়-দায়িত্ব হক তথা তাদের অধিকার সংরক্ষণ এবং তাদের প্রতি সদয় ও সদ্ব্যবহারের নির্দেশ রয়েছে মানবতার ধর্ম পবিত্র ইসলামে। মানুষের ডানে বামে সামনে ও পেছনে অর্থাৎ চারপাশের চল্লিশ বাড়ি পর্যন্ত যারা বসবাস করেন তারা সকলেই প্রতিবেশী। নিজের সন্তান-সন্তুতি ও স্ত্রীর অধিকার সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন থাকার ব্যাপারে যেভাবে ইসলামে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে তেমনিভাবে প্রতিবেশীর অধিকারের প্রতি যত্নবান থাকা তথা সচেতন থাকার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। ইসলামে নিজের ক্ষতি অনিষ্টতা ও অকল্যাণ যেমন সমর্থন করে না তেমনিভাবে অন্যজনের ক্ষতিসাধন তথা সুখ শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্টকারী কোনো কার্যকলাপ আচার আচরণ অনুমোদন করে না। ইসলাম মানে শান্তি মুসলিম অর্থ শান্তিকামী। সর্বস্তরে সর্বক্ষেত্রে প্রতিটি পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের মূল শিক্ষা ও মহানবীর আদর্শ।

নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন: “অনেক প্রতিবেশী কিয়ামতের দিন তাদের প্রতিবেশীদের আঁচল সমূহ ধরবে! অত্যচারিত প্রতিবেশী আরয করবে: হে আল্লাহ্! এই ব্যক্তির কাছে জিজ্ঞাসা করো! সে আমার উপর তার দরজা সমূহ বন্ধ করে রেখেছিলো এবং নিজের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বস্তু আমার কাছ থেকে বেঁধে রেখেছিলো।”-কানযুল উম্মাল,৫/২৩ হাদীস নং : ২৪৮৯৮

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধানের নাম। একজন মানুষ তার জীবন চলার পথে যেসকল সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে তার সবগুলোরই সমাধান পেশ করেছে ইসলাম। একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনে ইসলামের দিকনির্দেশনা অত্যন্ত বিজ্ঞান সম্মত এবং গঠনমূলক। ইসলামের বিধান অনুাযায়ী প্রতিবেশীর হক বা অধিকারসমূহ হচ্ছে: ১. কোনো প্রতিবেশী বিপদগ্রস্ত হয়ে সাহায্য প্রার্থনা করলে সাধ্যানুসারে তাকে সাহায্য করা কর্তব্য। নবী করিম (সা.)বলেন,‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে অন্য কোনো মোমেন ব্যক্তিকে একটি বিপদ থেকে উদ্ধার করবে, আল্লাহ তাকে পরকালের মহাবিপদসমূহের কোনো একটি হতে নিরাপদ রাখবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘যতক্ষণ কোনো বান্দা অন্য কোনো বান্দাকে (বিপদে) সাহায্য করার কাজে লিপ্ত থাকে, ততোক্ষণ আল্লাহ তা’য়ালাও সেই সাহায্যকারী বান্দার প্রতি সাহায্য সহায়তার হস্ত প্রসারিত রাখেন।’

হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মদ গাযালী (র.) বলেন: মনে রাখবেন! প্রতিবেশীর হক শুধুমাত্র এটা নয় যে, প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা, বরং প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে পাওয়া কষ্ট সমূহ সহ্য করাও প্রতিবেশীর হকের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। কেননা, এমনও হয়ে থাকে যে, এক ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না এবং সেও এর বিনিময়ে তাকে কষ্ট দেয় না। অথচ সেইভাবে প্রতিবেশীর হক আদায় হয় না। সেজন্য শুধুমাত্র কষ্ট সহ্য করার উপর যথেষ্ট মনে করবে না, বরং প্রয়োজন বশত: তার সাথে নম্র এবং উত্তম আচরণ করবে।(ইহ্ইয়াউল উলুম,২/২৬৭)

খাজা গরীবে নেওয়াজ (র.) তাঁর প্রতিবেশীদের প্রতি অনেক খেয়াল রাখতেন এবং তাদের দেখাশোনা করতেন। যদি কোন প্রতিবেশীর ইন্তেকাল হয়ে যেতো, তখন তার জানাযার সাথে অবশ্যই তাশরীফ নিয়ে যেতেন। তার দাফনের পর যখন লোকেরা ফিরে আসে, তখন তিনি একাকী তাঁর কাছে তাশরীফ নিয়ে যেতেন এবং তার জন্য ক্ষমা ও নাজাতের দোয়া করতেন। আর তার পরিবারের লোকদেরকে ধৈর্যের শিক্ষা দিতেন এবং তাদেরকে সান্ত্বনা দিতেনা।

হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (র.) একজন অমুসলিম প্রতিবেশী সফরে গিয়েছিলো। তার সন্তানগণ ঘরের মধ্যে ছিলো। রাতের বেলায় তার সন্তানগণ কান্না করতো, তিনি (তার স্ত্রীর নিকট) জিজ্ঞাসা করলো: বাচ্চারা কেন কান্না করছে? সে বললো: ঘরের মধ্যে বাতি নেই। বাচ্চারা অন্ধকারের মধ্যে ভয় পাচ্ছে। সেই দিন থেকে তিনি দৈনিক চেরাগের মধ্যে বেশি করে তেল ভর্তি করে চেরাগ জালাতেন এবং তার ঘরে পাঠিয়ে দিতেন। যখন সেই অমুসলিম সফর থেকে ফিরে আসলো, তখন তার স্ত্রী এই ঘটনা তাকে শুনালো, সেই অমুসলিম বললো: যেই ঘরের মধ্যে বায়েজিদ বোস্তামির চেরাগের (বাতির) আলো এসেছে, সেখানে অন্ধকার কেন থাকবে। তারা সকলে মুসলমান হয়ে গেলো।( মিরআতুল মানাজীহ,৬/৫৭৩)

কোনো প্রতিবেশী রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে তার খোঁজখবর নেয়া এবং সম্ভবপর হলে কিছু সময় তার পরিচর্যায় ব্যয় করা উচিৎ। ৩. কোনো প্রতিবেশী দাওয়াত করলে, শরীয়ত বিরুদ্ধ কাজে জড়িত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে সেই দাওয়াত সাদরে গ্রহণ করা সৌজন্য। ইসলাম কতই না উত্তম ধর্ম, যা শুধুমাত্র আমাদেরকে পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনদের সাথে উত্তম আচরণের শিক্ষা দেয় বরং এও শিখায় যে, আমাদের নিকটতম ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর সাথে কি ধরণের আচরণ করা উচিত। কোরআন ও সুন্নাহর একাধিক স্থানে প্রতিবেশীর সাথে উত্তম আচরণ করা এবং তাদের হক সমূহ আদায় করার প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন: “তোমাদের জানা আছে, প্রতিবেশীর হক কি?” (অতঃপর নিজেই এরশাদ করেন) যখন তারা তোমাদের কাছ থেকে সাহায্য চায়, তখন সাহায্য করবে এবং যখন কর্জ চায় তখন কর্জ দিবে। আর যখন মুখাপেক্ষী হয়, তখন তাকে দান করবে। যখন অসুস্থ হয়, তখন সেবা করবে। যখন সফলতা লাভ করে, তখন ধন্যবাদ দাও। যখন বিপদগ্রস্থ হয়, তখন তার প্রি সমবেদনা জ্ঞাপন করো। মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযার সাথে যাও। অনুমতি ছাড়া নিজের উচ্চ দালান নিমার্ণ করিও না, যাতে তার বাতাস বন্ধ হয়ে যায় এবং সক্ষম হলে তোমার ডেকসি হতে তাকে কিছু দাও, নতুবা তা দ্বারা তাকে কষ্ট দিবে না। আর যখন কোনো ফল লাভ করো, তখন তার কাছেও হাদীয়া পাঠিয়ে দাও। আর যদি হাদিয়া না দাও, তখন লুকিয়ে ঘরের মধ্যে নাও এবং তোমার সন্তানেরা যেনো তা নিয়ে বাহিরে না যায়, যার কারণে প্রতিবেশীর সন্তানেরা কষ্ট পায়। তোমাদের জানা আছে যে, প্রতিবেশীর হক কী? ঐ সত্তার শপথ! যার কুদরতের হাতে আমার প্রাণ রয়েছে! পরিপূর্ণভাবে প্রতিবেশীর হক আদায়কারীর সংখ্যা কম। তারাই (আদায় করে), যাদের উপর আল্লাহ্ তা’য়ালার দয়া রয়েছে।” নবী করিম (সা.) প্রতিবেশীদের সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে উপদেশ দিচ্ছিলেন, এমনকি লোকেরা মনে করেছিলো যে, প্রতিবেশীদেরকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিবেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করলেন: “প্রতিবেশী তিন প্রকার; কারও হক তিনটি, কারও হক দুইটি এবং কারও হক একটি। যে সকল প্রতিবেশী মুসলমান এবং আত্মীয়, তাদের হক তিনটি; প্রতিবেশীর হক, ইসলামের হক এবং আত্মীয়তার হক। মুসলমান প্রতিবেশীর হক দুইটি; প্রতিবেশীর হক এবং ইসলামের হক। আর অমুসলিম প্রতিবেশীর শুধুমাত্র একটি হক আর তা হলো প্রতিবেশীর হক।”(শুয়াবুল ঈমান,বাবুন ফি ইকরামিল জার,৭/৮৩-৮৪, হাদীস নং: ৯৫৬০)

সমাজে এক শ্রেণির নর-নারী আছে, যারা নামায রোজা হজ্ব যাকাত দান সাদকাহ ইত্যাদি পুন্যময় আমল করেন অথচ প্রতিবেশীর প্রতি নিকৃষ্ট আচরণ করেন। প্রতিবেশীকে গালমন্দ করেন, অশ্লীলভাষা কটূবাক্য দ্বারা প্রতিবেশীর অন্তরে কষ্ট দেয়। সামান্য বিষয় নিয়েও প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়। প্রতিবেশীর ব্যাপারে কুৎসা রটনা করে সমালোচনা করে। প্রতিবেশী দুর্বল হলে কূটকৌশলে তার সম্পত্তি আত্মসাৎ করতেও পিছপা হয় না। বিভিন্নভাবে প্রতিবেশীকে হয়রানি করে এ ধরনের ধার্মিকতা কোনো কাজে আসবে না, বরং তার করুণ পরিণতি হবে ভয়াবহ জাহান্নাম। আর কোন বান্দার মধ্যে নামায রোজা দান সাদকার পরিমাণ কম হলেও তিনি যদি প্রতিবেশীর হক বা দায়িত্ব যথাযথভাবে আদায় করেন এর উত্তম প্রতিদান হিসেবে তার জন্য রয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ।মূলত ঘরের আশেপাশে থাকা মানুষদের প্রতিবেশী বলা হয়। তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা ইসলামের সৌন্দর্য। প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেওয়াকে ইসলামে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এমনকি জমি বিক্রি থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিবেশীকে আগে জিজ্ঞেস করার কথা ইসলামে বলা হয়েছে। হাদীসে আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, মুসলমানগণ ভাই ভাই। (মুসলিম)

প্রতিবেশীর প্রতি সহিষ্ণুতার পরিচয় দেওয়া খুবই মহৎ কাজ। হযরত সাহল ইবনে আবদুল্লাহ তাসতারীর (র.)-এর একজন অগ্নি উপাসক প্রতিবেশী ছিলো। প্রতিবেশীর ঘর থেকে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ ময়লা-আবর্জনা তার অলক্ষ্যে সাহলের ঘরে এসে পড়তো। কিন্তু সেজন্য তিনি প্রতিবেশীর কাছে কোন অভিযোগ করতেন না। দিনের বেলা আবর্জনা জমা করে ঢেকে রাখতেন এবং রাত্রে বাইরে ফেলে দিতেন। সাহলের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলে তিনি তার প্রতিবেশীকে ডেকে আবর্জনার স্তুপ দেখিয়ে বললেন, আমার মৃত্যু ঘনিয়ে না আসলে আপনাকে এটা দেখাতাম না। আমার আশঙ্কা যে, আমার মৃত্যুর পর আমার পরিবারের আর কেউ আমার মতো সহনশীলতা দেখাতে পারবে না। তাই আপনাকে দেখালাম। আপনি যা ভালো মনে হয় করুন। প্রতিবেশী অগ্নি উপাসকের বিস্ময়ের অবধি রইলো না। সে সাহলের হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণ করলো। রাসূল (সা.) পৃথিবীর মানুষকে বললেন, সব মানুষ সমান। সবাই একজন আরেকজনের আত্মীয়। সবার বাঁচার অধিকার রয়েছে। কারো ওপর কোন অন্যায় করা যাবে না। মদীনা সনদের একটি ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। পৃথিবীতে আগে এর চেয়ে অসাম্প্রদায়িক ঘোষণা আর কেউ দিতে পারেনি। কোরআনের সূরা আল-বাকারার ১২৩ আয়াতে বলা হয়েছে,‘পৃথিবীর সব মানুষ তোমরা একটিমাত্র সম্প্রদায়।’
একজনের কাছে যা ভালো রীতি, অন্যের কাছে তা মন্দ বা অপ্রয়োজনীয় হতে পারে। তাই মানবজীবনের সব সমস্যার ও প্রয়োজনের শ্রেষ্ঠ সমাধান ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর তা আমরা পাই কোরআন ও প্রিয় রাসূল (সা.) এর সুন্নাহ থেকে। সমাজে বসবাসের অন্যতম অনিবার্য উপাদান হচ্ছে প্রতিবেশী। আমরা যেখানেই থাকি যেভাবেই থাকি, প্রতিবেশী বেষ্টিত হয়েই থাকি। এই প্রতিবেশীরা হয়তো আমাদের আত্মীয় বা নিকট আপনজন নন; কিন্তু সারা জীবনের নিকট প্রতিবেশীরা আত্মীয়ের চেয়েও বেশি নিকটে থাকেন। তাদের সবাই হয়তো মানে, গুণে, রুচি, আচরণে, জ্ঞানে, বুঝে এক রকম নন অথবা শিক্ষা-সম্পদ ও সামাজিক মর্যাদায় আমাদের সমপর্যায়েরও নন; তবুও তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য কম নয়। প্রতিবেশীর হক বা অধিকার বিষয়ে প্রিয় নবী (সা.) অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন, যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকারের কথা বলা হয়েছে। মহানবী (সা.) প্রতিবেশীর ব্যাপারে মানবজাতিকে দিয়েছেন শাশ্বত পাঠ। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.)বলেন,‘জিবরাইল এসে আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে অবিরত উপদেশ দিতে থাকলেন। এমনকি আমার মনে হলোÑ হয়তো তিনি প্রতিবেশীকে আমার উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেবেন।’ (বুখারি, হাদিস: ৬০১৫; মুসলিম,হাদিস : ২৬২৪)। ইসলাম প্রতিবেশীর অধিকার নিশ্চিত করেছে।

মানুষের ভালোমন্দ, শত্রু-মিত্র, উপকার-অপকার এসব কিছু নির্ভর করে প্রতিবেশীর ওপর। প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তম ব্যবহার সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে যে, তোমরা প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী, অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন করো না। তাদের ধন-ঐশর্যের প্রতি লোভাতুর-লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করো না। হযরত ঈসা (আ.) প্রতিবেশী সম্বন্ধে বলেন, তোমরা তোমাদের প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসো। ইসলাম ধর্মে প্রতিবেশীর ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

পবিত্র কোরআনে মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, মা-বাবার সঙ্গে সৌহার্দ পূর্ণ আচরণ করো। আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম এবং মিসকিনদের সঙ্গে সদাচার করো। সদ্ব্যবহার করো পরিচিত অপরিচিত প্রতিবেশী ও সাময়িক প্রতিবেশী এবং মুসাফিরদের সঙ্গে। (সূরা নিসা: ৩৬) প্রতিবেশীকে আমরা তিনভাগে বিভক্ত করতে পারি। ১. নিকটতর আত্মীয় প্রতিবেশী। ২. অনাত্মীয় প্রতিবেশী। এবং ৩. সাময়িক প্রতিবেশী।

প্রতিবেশী অভাবী হলে তার অভাব পূরণে আর্থিক সাহায্য সহযোগীতা করা। পিড়ীত হলে তার সেবা করা। সুখে-দুঃখে সদাসর্বদা তার পাশে দাঁড়ানো। নিজে যা খাবে সম্ভব হলে প্রতিবেশীকেও তার কিছু অংশ দেয়া। নতুবা এমনভাবে আহার করা যেনো প্রতিবেশী টের না পায়। এমনটি না হলে তার মনে কষ্ট পাওয়ার আশংকা থাকে। এ বিষয়টি মহানবী (সা.)- এর বাণীতে উচ্চারিত হয়েছে এভাবে, ‘সে ব্যক্তি মু’মিন নয় যে রাত যাপন করলো পরিতৃপ্ত অবস্থায় অথচ তার পাশে তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত এবং সে তা জানে।’ (তহাবী শরীফ: ১/২৫) উক্ত হাদীসে শুধু খাবারের কথা উল্লেখ করা হলেও উদ্দেশ্য শুধু খাবারই নয়; বরং উদ্দেশ্য হলো, প্রতিবেশী কোনো কষ্ট ভোগ করলে সাধ্যানুযায়ী খোঁজ খবর রাখা এবং সহযোগিতা করা। প্রতিবেশীর ভেতর কেউ মারা গেলে তার জানাজার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিবেশীর হক আদায়ের কারণে একদিকে আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.) খুশি হন, অপরদিকে সে সমাজে হয়ে ওঠেন একজন মর্যাদাশীল ব্যক্তি। সামাজিকভাবে তার সম্মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহর কসম, ঐ ব্যক্তি মু’মিন নয়; আল্লাহর কসম, ঐ ব্যক্তি মু’মিন নয়; আল্লাহর কসম, ঐ ব্যক্তি মু’মিন নয়। উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ কোন ব্যক্তি মু’মিন নয়? প্রতি উত্তরে তিনি বললেন, যার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ নয়।’ (বোখারী: ২/৮৮৯) উক্ত হাদীসের বর্ণনা বিন্যাসের প্রতি লক্ষ্য করলে বুঝে আসবে, হাদিসের বাক্য ও শৈলী হাদীসের মর্মকে কিরূপ শক্তিশালী করেছে এবং প্রতিবেশীর হকের বিষয়টিকে রাসূল (সা.) কিরূপ তীব্রভাবে অনুভব করেছিলেন এবং অন্যদের মধ্যে কিরূপ চেতনা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।

প্রতিবেশীর হক বা অধিকার সম্পর্কে সজাগ হওয়া অত্যন্ত জরুরী। ইসলাম প্রতিবেশীর হককে খুবই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই বর্তমানে প্রতিবেশীর হক ও অধিকার সম্পর্কে বে-খবর। প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে আমাদের উদাসীনতার উপলব্ধি থেকে মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন ও সজাগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ বা দলবদ্ধ হয়ে পরস্পরে মিলেমিশে বসবাস করতে হয়। একাকী বসবাস করতে পারেনা। আর ‘যারা আমাদের আশে পাশে বসবাস করে তারাই আমাদের প্রতিবেশী’। সমাজে বাস করতে হলে এক মানুষের সঙ্গে অপর মানুষের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক জরুরি। ইসলামে এ জন্য প্রতিবেশীর সঙ্গে সু-সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সব কিছু বদলানো গেলেও প্রতিবেশী বদল করা যায় না। এ বাস্তবতাকে মনে রেখে পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণের যে বাধ্যবাধকতা ইসলামে আরোপ করা হয়েছে তা দৃষ্টান্তস্থানীয়।

হাদিস শরীফে প্রতিবেশীর এ হকটিকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, যদি কেউ তার জমি বিক্রি করতে চায় তাহলে সে যেনো তার প্রতিবেশীকে জানায়। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৪৯৩) আরেক হাদীসে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘শুফ্আ’-র বিষয়ে প্রতিবেশীর হক সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেশী উপস্থিতনা থাকলেও তার অপেক্ষা করতে হবে। এটা তখন যখন তাদের উভয়ের চলাচলের পথ এক হয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হা. ২৪৯৪; জামে তিরমিযী, হা. ১৩৬৯) এ ধরনের আরো অনেক হাদীসে হক্কে শুফ্আর বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।

হক্কে শুফ্আ এটি প্রতিবেশীর গুরুত্বপূর্ণ একটি হক। নিজের জমি বা বাড়ি যদি কেউ বিক্রি করতে চায় তাহলে সে ব্যাপারে পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশীর হক সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ তাকে আগে জানাতে হবে যে, আমি আমার বাড়ি বা জমি বিক্রি করতে চাই তুমি তা কিনবে কি না। যদি সে কিন তেনা চায় তাহলে অন্যের কাছে বিক্রি করা যাবে। তাকে না জানিয়ে কারো কাছে বিক্রি করা যাবেনা। করলে সে দাবি করতে পারবে যে, আমি এই জমি ক্রয় করব। এটা তার হক। কারণ, হতে পারে এ জমিটি তার প্রয়োজন বা এমন ব্যক্তি তা ক্রয় করলো যার কারণে সে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে ইত্যাদি। আর একেই শরীয়তের পরিভাষায় ‘হক্কে শুফ্আ’ বলে।

মন্দ প্রতিবেশী থেকে আমরা আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। কারণ একজন মন্দ প্রতিবেশী সাধারণ জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করবে বা আমাকেও মন্দের দিকে নিয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মন্দ প্রতিবেশী থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও।(সুনানে নাসায়ী,হাদীস ৫৫০২; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী হা. ৯১০৬)

প্রতিবেশীর হক নষ্ট করা বা তাকে কষ্ট দেওয়া অনেক বড় অন্যায়। কখনো দুনিয়াতেই এর সাজা পেতে হয় আর আখেরাতের পাকড়াও তো আছেই। আমার অর্থবল বা জনবল আছে বলে প্রতিবেশীর হক নষ্ট করে পার পেয়ে যাবে এমনটি নয়। হাঁ, দুনিয়ার আদালত থেকে হয়তো পার পেয়ে যাবে, কিন্তু আখেরাতের আদালত থেকে কে বাঁচাবে? হযরত উকবা ইবনে আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.)বলেছেন, কিয়ামতের দিন প্রথম বাদী-বিবাদী হবে দুই প্রতিবেশী। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৩৭২; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৮৩৬)

প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়ার বিষয়টিকে নবী করিম (সা.) ঈমানের দুর্বলতা বলে চিহ্নিত করেছেন। কোনো ব্যক্তি মুমিন আবার প্রতিবেশীকে কষ্টও দেয় তা ভাবা যায় না। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহর শপথ সে মু’মিন নয়! আল্লাহর শপথ সে মু’মিন নয়! আল্লাহর শপথ সে মু’মিন নয়! সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, সে কে হে আল্লাহর রাসূল? রাস্লূুল্লাহ (সা.) বললেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১৬)

হাদীস শরীফে এসেছে, আল্লাহ তিন ব্যক্তিকে পছন্দ করেন, তাদের একজন ঐব্যক্তি, যার একজন মন্দ প্রতিবেশী রয়েছে, সে তাকে কষ্ট দেয়। তখন ঐ ব্যক্তি ছবর করে এবং আল্লাহর ছাওয়াবের আশা রাখে। এক পর্যায়ে ঐ প্রতিবেশীর ইন্তেকাল বা চলে যাওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তাকে মুক্তি দেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১৩৪০; আলমুসতাদরাক, হাকেম খন্ড ২ পৃ. ৮৯; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৯১০২)

প্রতিবেশী আমার জীবনের আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। তার সাথে আমার আচরণ সুন্দর হবে তা কিবলে বোঝাতে হয়? আর আমি যদি মু’মিন হই তাহলে তো তা আমার ঈমানের দাবি।হযরত আবু শুরাইহ্ (রা.)বলেন, আমার দুই কান শ্রবণ করেছে এবং আমার দুই চক্ষু প্রত্যক্ষ করেছে যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, যে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং আখেরাতে বিশ্বাস রাখে সে যেনো স্বীয় প্রতিবেশীকে সম্মান করে। সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় আছে ‘সে যেনো স্বীয় প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮)
প্রতিবেশী যদি দরিদ্র হয় তাহলে এ বিষয়ে তার হক আরো বেশি। কারণ দরিদ্রকে খানা খাওয়ানো যেমন অনেক সওয়াবের কাজ তেমনি দরিদ্রকে খানা না-খাওয়ানো জাহান্নামে যাওয়ার একটি বড় কারণ। কোরআন মাজীদে ‘ছাকার’ নামক জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে নামায না পড়ার বিষয়টির সাথে সাথে দরিদ্রকে খানা না খাওয়ানোও গুরুত্ব সহকারে উল্লেখিত হয়েছে। কোরআন মাজীদে এরশাদ হয়েছে,(জাহান্নামীকে জিজ্ঞেস করা হবে) (অর্থ) কোন বিষয়টি তোমাদেরকে ‘ছাকার’ নামক জাহান্নামে ঠেলে দিয়েছে? (তারা উত্তরে বলবে) আমরা নামায পড়তাম না এবং দরিদ্রকে খানা খাওয়াতাম না। (সূরা মুদ্দাছ্ছির: আয়াত-৪২-৪৪)

প্রতিবেশীর প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিবো। অনেক সময় এমন হয়, প্রতিবেশীর প্রয়োজনে কিছু ছাড় দিতে হয়। কিংবা নিজের কিছু ক্ষতি স্বীকার করলে প্রতিবেশীর অনেক বড় উপকার হয় বা সে অনেক বড় সমস্যা থেকে বেঁচে যায়। তেমনি একটি বিষয় হাদীস শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে, যা মু’মিনকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোনো প্রতিবেশী যেনো অপর প্রতিবেশীকে তার দেয়ালে কাঠ স্থাপন করতে বাধা না দেয়। (সহীহ বুখারী,হাদীস ২৪৬৩; সহীহ মুসলিম,হাদীস ১৬০৯)

আফসোস! বর্তমানে প্রত্যেক লোক নিজেদের হকের ব্যাপারে আওয়াজ উঁচু করে। কিন্তু নিজেদের প্রতিবেশীদের হকের প্রতি একেবারে খেয়াল করে না। আমরা তো নিজেরা অনেক নেয়ামত দ্বারা সম্পদশালী হই এবং সুস্বাদু খাবার দ্বারা ক্ষুধা নিবারণ করি। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী কোনো অবস্থায় সময় অতিবাহিত করছে আমাদের সেই ব্যাপারে কোন সহযোগীতা নেই। যদি আমাদের অভাবী প্রতিবেশী আমাদের কাছে কোনো কিছু চায়,তখন তাদের অভাব পূরণ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমরা কৃপণতা করি। অনেক সময় তো অত্যন্ত অপছন্দনীয় আচরণ করে থাকে। অনুরূপভাবে কতিপয় অজ্ঞগণের এই অবস্থা হয় যে, তারা তাদের ময়লা উদাহরণ স্বরূপ ফল এবং সবজির চামড়া, কোরবানীর প্রাণীর রক্ত এবং লেজ অথবা পঁচা মাংস ইত্যাদি নিক্ষেপ করে, দুর্গন্ধযুক্ত পানি ছেড়ে দেয়া, অনুমতি ছাড়া তাদের ঘরে উঁকি দেয়া, বিবাহ অথবা অন্যান্য অনুষ্ঠানে গান-বাজনা, বাজি ফুটানো অথবা আতশবাজি করা, তাদের ঘর অথবা দোকানের সামনে কোন কারণ ছাড়া বাধা দেয়া, তাদের ঘরের ঘন্টা বাজানো, তাদেও সন্তানদেরকে ধমক দেয়া, তাদের সত্ত্বা ও এর সাথে সম্পৃক্ত বস্তু সমূহ উদাহরণ স্বরূপ- কোরবানীর জন্তু, বাড়ি, দোকান অথবা গাড়ি ইত্যাদির মধ্যে দোষ বের করা, তাদের দেয়াল সমূহ পানের ফিক দ্বারা ময়লাযুক্ত করে দেয়া ইত্যাদি বিষয় দ্বারা নিজেদের প্রতিবেশীদেরকে উত্যক্ত করে এবং তাদের আরাম ও শান্তি বিনষ্ট করে নিজেদের কবর ও পরকালকে ধ্বংস করে দেয়।এই ধরণের লোকদের উচিত, তারা প্রতিবেশীদের হক নষ্ট করা এবং তাদেরকে বিরক্ত করা থেকে ভয় করা। কেননা, প্রতিবেশীদেরকে বিরক্ত করার কারণে যদি আল্লাহ তা’য়ালা ও তাঁর প্রিয় হাবিব অসন্তুষ্ট হয়ে যায়, তখন মনে রাখবেন! নামায, রোযা এবং দান-সদকার আধিক্যও জাহান্নামের থেকে বাঁচাতে পারবে না। রাসূলে করিম (সা.) এরশাদ করেন,“যে তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দিলো, নিশ্চয়ই সে আমাকে কষ্ট দিলো। আর যে আমাকে কষ্ট দিলো,সে আল্লাহ্ তা’য়ালাকে কষ্ট দিলো। যে তার প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া করলো, সে আমার সাথে ঝগড়া করলো। আর যে আমার সাথে ঝগড়া করলো, নিশ্চয়ই সে আল্লাহ তা’য়ালার সাথে ঝগড়া করলো।” অতএব প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে যদি কোনো কষ্ট পৌঁছে যায়, তখন আবেগের বশবর্তী হয়ে তার সাথে ঝগড়া এবং মারামারি, তার বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান কিংবা তার কোনো প্রকারের ক্ষতি করার স্থলে ধৈর্যধারণ করা উচিত। কেননা, প্রতিবেশীর কষ্টের উপর ধৈর্যধারণ করার বরকতে মানুষ আল্লাহ তা’য়ালার প্রিয় বান্দা হয়ে যায়। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন: “ আল্লাহ তা’য়ালার প্রিয় বান্দাদের মধ্যে ঐ সকল ব্যক্তিও অন্তর্ভুক্ত, যার মন্দ প্রতিবেশী তাকে দেয়া কষ্টের ওপর মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করে।”

সাধারণত আমরা আমাদের পিতা-মাতা, পরিবারের লোকজন, আত্মীয়-স্বজনের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে অনেক সচেতন। কিন্তু বাড়ির পাশের লোকজনের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে আমাদের তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তাদের অধিকার রক্ষার প্রসঙ্গ আমরা অধিকাংশ সময়েই পাশ কাটিয়ে যাই। সম্মান ও আন্তরিকতার সাথে প্রতিবেশীর সাথে আচরণ করা সুন্নতের অংশ, এবং সত্যিকার মুসলমান হিসেবে প্রতিবেশীর সাথে আমাদের সম্পর্ক হবে সৌহার্দ্যরে ও সংহতির। অনেক সময় এমন হয় যে দুই প্রতিবেশী তাদের বাড়ির সীমানা নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। যে প্রতিবেশীর শক্তি বেশি সে জোরপূর্বক নিজের সীমানা বাড়িয়ে নেয়। এটা বসত বাড়ির ক্ষেত্রে যেমন হয় ফসলের জমির প্রতিবেশীর সাথে আরো বেশি হয়। যাকে বলে ‘আইলঠেলা’। সামান্য যমিন ঠেলে সে নিজের ঘাড়ে জাহান্নাম টেনে আনল। যতটুকু যমিন সে জবরদস্তি বাড়িয়ে নিল সে নিজেকে তার চেয়ে সাতগুণ বেশি জাহান্নামের দিকে ঠেলে নিল। হাদীস শরীফে এসেছে, যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে এক বিঘত জমি দখল করল, কিয়ামতের দিন ঐ জমির সাত তবক পরিমাণ তার গলায় বেড়ি আকারে পরিয়ে দেয়া হবে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬১১)

প্রতিবেশীর সাথে মানুষের সম্পর্ক সামান্য সময়ের নয়; বরং সকাল-সন্ধ্যা, রাত-দিন, মাস ও বছরের বা সারা জীবনের। এ প্রতিবেশী যদি মন্দ হয় তাহলে ভোগান্তির আর শেষ থাকে না। তেমনি এক মন্দ প্রতিবেশীর ঘটনা হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী করিম (সা.) এর কাছে এসে তার প্রতিবেশীর ব্যাপারে অভিযোগ করলো। রাসূলুল্লাহ (সা.)তাকে বললেন, তুমি ছবর করো। এভাবে সে তিনবার আসার পর তৃতীয় বা চতুর্থ বারে নবীজী তাকে বললেন,তোমার বাড়ির আসবাবপত্র রাস্তায় নিয়ে রাখো। সাহাবী তাই করলেন। মানুষ সেখান দিয়ে যাচ্ছিলো এবং ঐ প্রতিবেশীকে অভিশাপ দিচ্ছিলো। তখন ঐ প্রতিবেশী নবীজী (সা.) এর কাছে গিয়ে বলল, আল্লাহর রাসূল! মানুষ আমাকে যা তা বলছে। নবীজী বললেন, মানুষ তোমাকে কী বলছে? সে বলল, মানুষ আমাকে লানত করছে। রাসূলুল্লাহ (সা.)বললেন, তার আগেই আল্লাহ তোমাকে লানত করেছেন। সে বলল, আল্লাহর রাসূল! আমি আর এমনটি করব না (প্রতিবেশীকে কষ্ট দিব না।)। তারপর অভিযোগকারী নবীজীর দরবারে এলে নবী (সা.)কে বললেন, তুমি (প্রতিবেশীর অনিষ্ট থেকে) নিরাপদ হয়েছ। (আলমুসতাদরাক,হাকেম, হাদীস ৭৩০৩; আলমুজামুল কাবীর,তবারানী, হাদীস ৩৫৬; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৫২০)

প্রতিবেশীর সাথে মন্দ আচরণ ব্যক্তির সব আমল বরবাদ করে দেয়। তাকে নিয়ে ফেলে জাহান্নামে। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলল, এক নারীর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ, সে বেশি বেশি (নফল) নামায পড়ে, রোযা রাখে, দুই হাতে দান করে। কিন্তু যবানের দ্বারা স্বীয় প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় তার অবস্থা কী হবে?। নবী করিম (সা.) বললেন, সে জাহান্নামে যাবে। আরেক নারী বেশি (নফল) নামাযও পড়ে না, খুব বেশি রোযাও রাখে না আবার তেমন দান সদকাও করে না; সামান্য দু-এক টুকরা পনির দান করে। তবে সে যবানের দ্বারা প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না এই নারীর ব্যাপারে কী বলেন?। নবী (সা.) বললেন, সে জান্নাতী। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৬৭৫; আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ১১৯)

প্রতিবেশীর দোষ ঢেকে রাখবো। পাশাপাশি থাকার কারণে একে আপরের ভালো মন্দ কিছু জানাজানি হয়ই। গোপন করতে চাইলেও অনেক কিছু গোপন করা যায় না। প্রতিবেশীর এসকল বিষয় পরস্পরের জন্য আমানত। নিজের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণেই একে অপরের দোষ ঢেকে রাখা জরুরি। আমি যদি তার দোষ প্রকাশ করে দিই তাহলে সেও আমার দোষ প্রকাশ করে দিবে। আর আমি যদি তার দোষ ঢেকে রাখি তাহলে সেও আমার দোষ গোপন রাখবে। এমনকি এর বদৌলতে আল্লাহও আমার এমন দোষ গোপন রাখবেন, যা প্রতিবেশীও জানে না। হাদীস শরীফে এসেছে, যে তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ ঢেকে রাখে আল্লাহও কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮০)

মানুষ একা নয়, সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধতা মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা। তাই তো সমাজের সংজ্ঞা এভাবে দেয়া হয়, পরস্পরের সহযোগীতায় অবস্থানকারী মানব সংঘকে সমাজ বলে। সমাজে মানুষ একে অপরকে সহযোগীতার করে। মানুষের এ পারস্পরিক সহযোগীতা সূচনা হয়েছিলো হযরত আদম (আ.) ও হযরত হাওয়া (আ.)- এর সময়কাল থেকে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে মানুষের সামাজিক পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষের সামাজিক চাহিদা ও প্রয়োজন। তাই ইসলাম পরস্পরের মাঝে হক যথাযথ আদায়ের ব্যাপারে কঠোর উচ্চারণ করেছে। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, জিবরাঈল (আ.) আমাকে প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে এতো বেশি তাগিদ করতেন যে এক পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে হয়তো অচিরেই প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী সাব্যস্ত করা হবে। (বোখারী : ২/৮৮৯)

আজকের মুসলিম সমাজ ইসলামের সুমহান শিক্ষা ও মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর আদর্শ থেকে বিচ্যুতির কারণেই বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের করুণ দুরবস্থা।মুসলমানদের নৈতিক অধঃপতন,চারিত্রিক অবক্ষয়,শঠতা-কপটতা,অনাচার-পাপাচার,মিথ্যাচার ইত্যাদি অবক্ষয় গর্হিত ক্রিয়াকলাপই মুসলমানদের পশ্চাদপদতা ও বিপর্যয়ের মূল কারণ। ইসলামে শুধু একজন মুসলিমের অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়নি, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি শ্রেণির মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তার ন্যায্য পাওনার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকের সমাজে প্রতিবেশীর হক তথা অধিকার উপেক্ষিত। প্রতিবেশীর অধিকারের প্রতি চরমভাবে উদাসীন।

ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের বাইরে আমাদের অন্যতম নিকটবর্তী ব্যক্তিরা হলেন আমাদের প্রতিবেশীরা।সম্পর্কের নিকটবর্তিতার কারণে আমাদের ওপর তাদেরও কিছু অধিকার রয়েছে। মুসলমান হিসেবে এসকল অধিকারকে সম্মান করা এবং তা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম আদর্শ বিশ^ মানবতার দূত হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রদর্শিত পথে সত্যান্বেষী মুক্তিকামী মানুষের সর্বাঙ্গীন সুখ শান্তি মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত। তাই আসুন মহানবীর হাদীসের আলোকে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় প্রতিবেশীর প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করি। প্রতিবেশীর কল্যাণ ও উন্নয়নে এগিয়ে আসুন। প্রতিবেশীর প্রতি সুসম্পর্ক করুন। প্রতিবেশীর প্রতি দূরত্ব নয় নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করুন। তাদের সুখে দুঃখে সাড়া দিন, তাদের দাওয়াত সাদরে গ্রহণ করুন। তাদের অনুষ্ঠানাদিতে সাধ্যানুযায়ী উপহার বিনিময় করুন। তাদের বাসা বাড়িতে যাতায়তের পথে প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার অমানবিক আচরণ পরিহার করুন। পারস্পরিক সহযোগিতামূলক প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য সামগ্রী আদান প্রদানে সহযোগিতা করুন। পার্শ্ববর্তী পরিবার দরিদ্র বলে তাদেরকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞামূলক আচারণ থেকে বিরত থাকুন। মানুষ মানুষের জন্য এ নীতিতে সুন্দর শালীন ও মার্জিত আচরণ করুন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) এর সন্তুষ্টি অর্জনই আমাদের কাম্য।

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি


শিরোনাম