মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
নদীনির্ভর বাংলা কথাশিল্পের ধারাবাহিকতায় অবিস্মরণীয় কীর্তি নদী। জল ও জীবনের ঐকতান একাকার হয়ে যেনো বয়ে গেছে বিভিন্ন নদী। কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নদীর প্রায় সব ক’টিই এখন আর কলস্বরা নেই। তার মধ্যে বুড়ি নদী একটি। পলির প্রভাবে নদীর তলদেশ ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অবৈধভাবে নদীর দুই পাশ ভরাট করায় এর প্রশস্ততা সংকুচিত হচ্ছে এবং নদীর গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে। একসময় এদেশের মানুষের জীবিকার উৎস ছিলো নদী। এই নদীগুলো কৃত্রিম কারণে ও সময়ের ধারায় আজ বিপর্যয়ের সম্মুখিন। তেমনি কৃত্রিম কারণে ও সময়ের ধারায় আজ বিপর্যয়ের সম্মুখিন খরস্রোতা বুড়ি নদীটি।
বুড়ি নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ২৬ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৫৪ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক বুড়ি নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নদী নং ১৪।
কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নূরনগর ও বরদাখাত পরগনার মাঝখান দিয়ে বিল-ঝিলের ওপর দিয়ে সর্পিলাকারে বয়ে চলা মুরাদনগর-কসবা-নবীনগরের সম্মিলন পয়েন্ট এই বুড়ি নদী। লাউরফতেহপুর ইউনিয়নের আশ্রয়ন গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প অবস্থানে মোহনা সৃষ্টিকৌশলে বুড়ি নদীটি নবীনগরে লঞ্জঘাট সংলগ্ন তিতাসের সাথে মিশেছে।
বুড়ি নদীর উৎস হলো সালদা নদী। সালদা নদী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে উৎপত্তি লাভ করে কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারপর এটি কিছুদুর প্রবাহিত হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার বুড়ি নদীতে পতিত হয়েছে। এক সময় এ নদীর বুক চিরে বহু পণ্যবাহী নৌকা আসা যাওয়া করতো। জনশ্রুতি রয়েছে যে কোনো এক পূর্ণিমারাতে এই নদীতে পালতোলা নৌকার মাঝি টলটলে পানিতে চাদের বুড়ির ছবি দেখতে পায় এবং পরদিন অনেক চড়া দামে তাদের পণ্যসামগ্রী হাটে বিক্রি হয়। চাদের বুড়ির দর্শন তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে সহায়ক হয় বলে সেই থেকে নদীর নাম হয় বুড়ি নদী।
বুড়ি নদী তীব্র স্রোত সম্পন্ন একটি নদী ছিলো। বর্ষাকালীন সময়ে নদীটি কানায় কানায় পূর্ণ থাকতো। একসময় বুড়ি নদীতে চলতো জাহাজ ও সওদাগরদের বড় বড় নৌকা। বর্তমানে নদীটি অদৃশ্যপ্রায়। নদীটি খাল, ডোবা, বসতভিটা ও কৃষি জমিতে পরিণত হয়েছে। বুড়ি নদীটি নবীনগর উপজেলা থেকে কসবা উপজেলার কুটি হয়ে ধরখার পর্যন্ত প্রবহমান ছিলো। বর্তমানে নদীর প্রায় ১৯ কি.মি. ভরাট হয়ে গেছে।
নদী-মাতৃক বাংলাদেশের মধ্য-পূর্বাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী তিতাস-বিধৌত জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নামকরণ নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। শোনা যায়, সেন বংশের রাজত্বকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অভিজাত ব্রাহ্মণকুলের অভাবে পূজা-অর্চনায় বিঘ্ন সৃষ্টি হতো। এ কারণে রাজা লক্ষণ সেন আদিসুর কন্যকুঞ্জ থেকে কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবারকে এ অঞ্চলে নিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে কিছু ব্রাহ্মণ পরিবার শহরের মৌলভী পাড়ায় বাড়ী তৈরী করে। সেই ব্রাহ্মণদের বাড়ির অবস্থানের কারণে এ জেলার নামকরণ ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। অন্য একটি মতানুসারে দিল্লি থেকে আগত ইসলাম ধর্ম প্রচারক শাহ সুফী হযরত কাজী মাহমুদ শাহ এ শহর থেকে উল্লেখিত ব্রাহ্মণ পরিবার সমূহকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ প্রদান করেন,যা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়।
নদী(সমার্থক শব্দ-তটিনী,তরঙ্গিনী,সরিৎ ইত্যাদি)সাধারণত মিষ্টি জলের একটি প্রাকৃতিক জলধারা যা ঝরনাধারা,বরফগলিত স্রোত অথবা প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট হয়ে প্রবাহ শেষে সাগর, মহাসাগর, হ্রদ বা অন্য কোনো নদী বা জলাশয়ে পতিত হয়। মাঝে মাঝে অন্য কোনো জলের উৎসের কাছে পৌঁছানোর আগেই নদী সম্পূর্ণ শুকিয়ে যেতে পারে। নদীকে তার গঠন অনুযায়ী শাখানদী, উপনদী, প্রধান নদী,নদ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা যায়। আবার ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে ছোট নদীকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে প্রাচীন বাংলার অনেক শহর।
নদ-নদী বিধৌত বাংলাদেশকে বলা হয়- নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের নদীগুলোর উৎস, উত্তরে হিমালয় পর্বতশ্রেণী, নেপাল, সিকিম ও ভুটান প্রভৃতি রাজ্য। উত্তর-পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ ও তার উপত্যকা, পূর্বে গারো, খাসিয়া,জয়ন্তিয়া, ত্রিপুরা ও মায়ানমারের পার্বত্যভূমি।উত্তর-পশ্চিমে দ্বারবঙ্গ বা দ্বারভাঙ্গা পর্যন্ত সমভূমি, পশ্চিমে রাজমহল, সাঁওতাল পরগনা, ছোটনাগপুর, মানভূম, সিংভূম, কেওঞ্জর, ময়ূরভঞ্জের পর্বতময় গৈরিক মালভূমি। বাংলাদেশের মাটির মতোই এদেশের নদ-নদী অনবরত তাদের স্রোতধারাগুলি পরিবর্তিত করে সময়ে অনেক সভ্যতা গড়ে তুলেছে আবার সময়ে ধ্বংস করেছে। কাজেই নদ-নদীর স্রোতধারার সাথে শুধু বাংলাদেশের নয়, বৃহত্তর বাংলার সভ্যতা ও অর্থনৈতিক বুনিয়াদের অনেক কিছু জড়িত। তার প্রধান কারণ নদ-নদী, জলাভূমি ও বন-জঙ্গলে পূর্ণ এই দেশে রাস্তা- ঘাট ছিলো অত্যন্ত সীমিত। কাজেই ব্যবসা-বাণিজ্য, লেন-দেন, আদান-প্রদান, যাতায়াত সবই প্রায় গড়ে উঠেছে নৌপথকে কেন্দ্র করে। নদী পথেই মালপত্র পরিবহন ছিলো সহজ এবং কোনো কোনো অঞ্চলে একমাত্র পরিবহন ব্যবস্থা ছিলো নৌপথ।
বাংলার ভূ-প্রকৃতি গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। নদ-নদীর গতিপ্রকৃতি বাংলার আকার-আকৃতি নির্ধারণ করেছে।এই অঞ্চলের প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি হিসেবে এই নদীসমূহ চিহ্নিত। বর্তমানের মতো প্রাচীনকালেও এই নদ-নদীসমূহের গতিপথ ঘন ঘন পরিবর্তিত হতো। বিশেষ করে সমতলভূমিতে নদীর খাত পরিবর্তন করা খুবই সাধারণ ঘটনা। এই নদীসমূহের তীরবর্তী অঞ্চলে শহর, বন্দর ও ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, তাছাড়া রাজনৈতিক কেন্দ্রও এদের তীরে স্থাপিত হতো।
এক সময় অসংখ্য নদ-নদী সারা দেশে জালের মতো বিছানো ছিলো।কালক্রমে সে সকল নদীসমূহের অনেকগুলোই বর্তমানে হারিয়ে গেছে। আরও বহু নদী এখন হারিয়ে যাবার পথে। হারিয়ে যাওয়ার পথে বুড়ি নদীটি। তাছাড়া সীমান্তের ওপাড়ে ভারতীয়দের বাঁধের কারণে বিভিন্ন বড় বড় জীর্ণ শীর্ণ হয়ে পড়েছে নদীগুলো এবং সেই সাথে এই সকল বড় বড় নদীর শাখা নদীগুলোও দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। তারপরে এখনো যে সকল নদী অবশিষ্ট রয়েছে, সে সকল নদী নিয়ে এই অংশের তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে বিকশিত নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের অনেক নদী-তীরে গড়ে উঠেছে বন্দর, নগরী হাট বাজার। পাউবো কর্তৃক সারা দেশে প্রায় ৪০৫টি নদ-নদীর মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশে ছোট বড় সব মিলিয়ে ২৩০ থেকে ২৪০টির মতো নদ- নদী সরকারি হিসেব আছে। এসব নদীগুলোর মধ্যে ৫৭ টি হচ্ছে আন্তসীমান্ত নদী যার মধ্যে ৫৪টি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন এবং ৩টি বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে অভিন্ন। দেশের মধ্যে প্রবহমান একটি নদীর নাম বেসানী নদী। ১৭৮৩ সালে জেমস রেনেল অংকিত বাংলাদেশের মানচিত্র যে, নদী -নালাগুলোর বিবরণ রয়েছে বর্তমানে সেগুলি চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য। নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে এবং পরিত্যক্ত গতিপথ ভরাট হয়ে পুরানো নদীপথের চিহৃ মুছে গেছে। আবার একই নদীর গতিপ্রবাহ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। আদিকাল থেকে নদী তার পলি দিয়ে অঞ্চলকে করেছে সুজলা-সুফলা।সময়ের বিবর্তনে নদীগুলো হারিয়েছে তার জৌলুস। নদীর সঙ্গে মানুষের দীর্ঘকাল ধরে যে আত্মার সম্পর্ক ছিলো তা কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়া এমনি একটি নদীর নাম বুড়ি নদী।
নদ-নদী সুরক্ষা নিয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে এখনো তৎপরতা দেখা যায় না অনেকেরই। নদী বেদখল হচ্ছেই। দূষণে প্রাণ হারাচ্ছেই সেই নদ-নদী। দেশের প্রাণ নদী আর নদ-নদীকে কেন্দ্র করেই একসময় দেশের বিভিন্ন শহর গড়ে ওঠেছে। অর্থনৈতিক সম্ভাবনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দেশের নদ-নদী। অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় এই দেশটি আজ থেকে কতোটা বছর পেছনে ফেলে এসেছে। ১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে ও এদেশে মাকড়শার জালের মতো ছড়িয়ে ছিলো অসংখ্য নদী-উপনদী,শাখা-প্রশাখা নদী,ছড়া নদী,নালা নদী এবং অগণিত নদীখাত। অসংখ্য খাল-বিল-ঝিল ও হাওড়-বাওড়। কিন্তু আজ আর নেই সেসব সীমাহীন স্রোতস্বিনী ও প্রমত্তা নদীর বিশাল স্রোতধারা। তাই ভবিষ্যতে এর দ্রুত পরিবর্তিত পরিণতির ফলাফল কী হতে পারে তা অনুমান করা যায়! প্রাকৃতিকভাবে যেসব নদী-নালা,হাওড়-বাওড়,বিল-ঝিল ও পাহাড় পর্বতের পরিবর্তন ঘটে তার ওপর মানুষ আজও অসহায়।
পৃথিবীতে প্রাণী জগৎ বেঁচে ধমনীতে যেমন রক্ত প্রবাহ জরুরি তেমনি দেশকে বাঁচাতে হলে সে দেশের বুকের ভেতর নদী প্রবাহ জরুরি। নদীর রূপ ও রূপান্তর নিয়ে সাহিত্য হয়নি, এমন কোনো ভাষা নেই। এমনকি লিপিহীন ভাষাতেও নদী নিয়ে রচিত হয়েছে বিস্তর উপাখ্যান। সাহিত্যের সব শাখায় কমবেশি এসছে নদী প্রসঙ্গে। বস্তুত মানুষের সমস্ত বিশুদ্ধ কল্পনায় নদী বা নদীবিশেষের প্রসঙ্গ সগর্বে উপস্থিত। জীবনের প্রাণ শক্তি নদীর সাথে। কালের আবর্তনে দখলের কবলে খরস্রোতা বুড়ি নদী। দেশের অন্যান্য জেলার মতো জেলার বুড়ি নদী উদ্ধার ও নাব্য হারিয়েছে যেসব নদী দখল-দূষণ রয়েছে সেসকল নদ-নদীকে বাঁচাতে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সকলের এগিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ দেশের মধ্যে প্রবহমান অন্যান্য নদীর মতো বুড়ি নদীকে বাঁচানোই এখন সময়ের দাবি।
লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ(কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান),সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক, গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট