মো. আলতাফ হোসেন ঃঃ
আহসান হাবীব একজন খ্যাতিমান বাংলাদেশী কবি ও সাহিত্যিক। দীর্ঘ দিন দৈনিক বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদের দায়িত্ব পালন সূত্রে তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গণে অভিভাবকের ভূমিকা রেখেছেন। তিনি চল্লিশের দশকের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি হিসেবে পরিগণিত। বাংলা ভাষা সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৮ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক এবং ১৯৯৪ সালে মরণোত্তর দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।
ত্রিশ-উত্তর বাংলা কবিতার এক উজ্জ্বল নাম আহসান হাবীব। চল্লিশ দশকের শুরুতে বাংলা কবিতার যে উল্লেখযোগ্য রূপান্তর ঘটে, সে ক্ষেত্রে যারা অগ্রসর ভূমিকা পালন করেন, আহসান হাবীব তাদের মধ্যে শীর্ষতম। ত্রিশ-উত্তর কবিদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারাকে সমুন্নত রেখে আহসান হাবীব তাঁর কবিতার নিজস্ব ভুবন নির্মাণে সফল হয়েছেন। নিজস্ব বলয়ে তিনি ছিলেন অন্তর্মুখী, সৃষ্টির জন্য ব্যাকুল নিভৃতচারী একজন। নিজ স্বভাবের মতোই চুপচাপ। কবিতার ক্ষেত্রে তাঁর নিভৃত সাধনা তাঁকে অভিষিক্ত করেছে সফল কবির মহিমায়। কবিতার শব্দ প্রয়োগ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, ছন্দ, বাক্য গঠনে তিনি যেমন ছিলেন পরিশীলিত, তেমনি সচেতনও। সমকালীন সমাজ ও জীবনের বিরুদ্ধবোধ তাকে আহত করেছে, পীড়িত করেছে, তার শুভবোধকে করেছে বিপন্ন একজন সচেতন কবি হিসেবে। আর এসবের প্রকাশ ঘটেছে তার কবিতা, লেখার শৈল্পিক বিন্যাসে। তিনি এ ব্যাপারে ছিলেন অনেকটা আপসহীন, কবিতার সার্বভৌমত্বে তার আস্থা ছিলো প্রবল। তার কবিতায় চল্লিশের কাব্যচেতনার সুর নানাভাবে ধ্বনিত হলেও দেশকালের চেতনা তার কবি মানসকে সমানভাবে প্লাবিত করেছিলো। আর তার প্রকাশ ঘটে তার কবিতায়। তার কবিতায় মানবিকতার ও রোমান্টিকতার সমন্বয় ঘটে এক আশ্চর্য কুশলতায়। এটি আহসান হাবীবের কবিতার এক অনন্য বৈশিষ্ট।
কবি আহসান হাবীবের জীবন রোমান্টিকতার অনুসারী। তবে তা সমাজ ও সমাজের ভাবনার বিষয়বস্তুর বাইরের ছিলো না। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিলো প্রায় প্রবাদতুল্য। এ দেশের বহু লেখক ও কবির জীবনের প্রথম রচনা তাঁর হাত দিয়েই প্রকাশিত হয়। সাহিত্য ক্ষেত্রে তাদের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে তাঁর প্রচেষ্টা ছিলো অগ্রগণ্য। বাংলা সাহিত্যে অনিবার্য একটি নাম আহসান হাবীব, প্রচন্ড জীবন সংগ্রামের মধ্যে যিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন সাহিত্য সাধনায়। মৃদুভাষী, আত্মমগ্ন ও ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন। নিসর্গের প্রতি তাঁর ছিলো প্রবল আকর্ষণ। বৈরী ও প্রতিকূল পরিবেশের প্রসঙ্গ অনুষঙ্গকে আহসান হাবীব নিজের কবিতায় তুলে আনতে পেরেছেন চমৎকারভাবে, কারণ এইসব তিনি প্রত্যক্ষ ভাবেই দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন।
মানুষের জীবন এক বিচিত্র অবস্থান, চারদিকে ছড়িয়ে থাকে নানা বৈচিত্র্য, সুখ, দুঃখ, আনন্দ আর বেদনা। কবিগণ এ আনন্দময় বিচিত্র জীবন থেকে বেঁচে থাকার সুখ ও সার্থকতা তুলে ধরেন তাঁর কবিতায়। কবি আহসান হাবীবের বেলায়ও হয়েছে তাই। নিজের আত্মচরিত্রকে উন্মুক্ত করে আহসান হাবীব চৈতন্য নতুন পথ সঞ্চারের নির্দেশে শিকড় স্পর্শী চেতনায় জানান দিয়েছেন নিজেই নিজের কবিতার লাইনে। কবিতা যে একজন কবির জীবনের সম্ভাবনার একটা ইতিবাচক প্রান্তর, তা তিনি রচনা করে গেছেন। কবিতার শাখায় শাখায় আধুনিকতার জটিল মাত্রা খুঁজে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন তিনি। রাজনীতিতে কবিতার সচেতন মানসভূমির উচ্চারণ হিসেবেই এনেছেন তিনি, সেখানেও শিল্পের দায়-দাবি পূরণে তিনি ছিলেন নিখুঁত যত্নশীল। কোনো ধরনের বাহুল্য, পক্ষপাতিত্ব, কূপমুকতা সেখানে জায়গা পায়নি। প্রত্যক্ষ করেছেন কাল ও সংকটের আবর্তে প্রতিনিয়ত ঘূর্ণায়মান মানুষের জীবনযাত্রা। আবহমান কালের অস্থিরতা নৈরাজ্য প্রতিনিয়ত তাকে বিচলিত করেছে। তাইতো সকল সংকটের তীব্রতায় দু’চোখে দেখে তিনি অক্লান্ত আকাঙ্খা ও অস্থির চিত্তে উচ্চারণ করেছেন কবিতার শব্দ।
মধ্যবিত্তের সংকট ও জীবনযন্ত্রণা তাঁর কবিতার মুখ্য বিষয়। সামাজিক বাস্তবতা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংগ্রামী চেতনা এবং সমকালীন যুগযন্ত্রণা তাঁর কবিতায় শিল্পসম্মতভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। কবিতার ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিতে নাগরিক মননের ছাপ খুঁজে পায় তাঁর ভক্ত ও কবিতা প্রেমীরা। খ্যাতিমান বাংলাদেশী কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে আহসান হাবীব দীর্ঘ দিন দৈনিক বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনেও অভিভাবকের ভূমিকা রেখেছেন। তিনি দেশ বিভাগের আগেই সমকালীন কবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। মধ্যবিত্তের সংকট ও জীবনযন্ত্রণা তাঁর কবিতার মুখ্য বিষয়। সামাজিক বাস্তবতা, মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংগ্রামী চেতনা এবং সমকালীন যুগ যন্ত্রণা তার কবিতায় শিল্পসম্মতভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে।
সমকালীন জীবন ও সমাজের বাস্তবরূপ তাঁর কবিতায় সহজ-সরল ভাষায় উঠে এসেছে। গভীর জীবনবোধ ও আশাবাদ তাঁর কবিতাকে বিশিষ্ট ব্যঞ্জনা দান করেছে। তাঁর কবিতার স্নিগ্ধতা পাঠকচিত্তে এক মধুর আবেশ সৃষ্টি করে। তিনি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং আর্ত-মানবতার পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন।
রোমান্টিকতা ও সমাজচেতনার সংমিশ্রণ সত্যই যদি দেশকালকে ইতিবাচক ফলপ্রসূ চরিত্রে ধারণ করতে পারে এবং সচেতন রোমান্টিকতা নামক একটি স্বাতন্ত্রকাব্য চরিত্রের জন্ম দিতে পারে, তাহলে আহসান হাবীবের প্রথম কবিতার বই রাত্রিশেষ প্রথম হয়েও সেই অর্থে সবিশেষ। শুধু বইটির নামেই সমাজসচেতনতার প্রকাশ নয়, স্বদেশের কাছে ঋত স্বীকার করে তবেই রাত্রি শেষ হওয়ার স্বাপ্নিকতায় কবিতাগুলোর যাত্রা প্রহর থেকে সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণের গুণ অর্জন করেছে।
বাংলা কবিতার ক্রমবিকাশের পথ ধরে তিরিশোওোর কালের কবিতার ধারায় কবি আহসান হাবীব এক অনিবার্য নাম। প্রথম প্রকৃত আধুনিক কবি হিসাবে তিরিশের আধুনিক চিন্তাশৈলি ,স্বতন্ত্র কাব্যভাষা ও ত্রা পথ ধরে কবিতায় অনন্ত দর্শন ও কাব্যও আধুনিক মননশৈলী নির্মাণে আহসান হাবীব নতুন পথ সৃষ্টি করেছিলেন। পঞ্চাশের কাব্য আন্দোলনের উওর পুরুষ হিসাবে আধুনিক কবিতার উওরাধিকার অনিবার্য করে তুলে ছিলেন আহসান হাবীব। কবিতায় জীবন দর্শনের শিল্পরীতি, চৈতন্যে জুড়ে তীব্র দহন ,অস্তিত্বের সংকট, মধ্যবিও জীবনের আকাংখার স্বরুপ নির্মাণে নিজস্ব শক্তিমওায় ঋদ্ব করেছেন আহসান হাবীব। কবি হুমায়ূন আজাদ এক মূল্যায়নে আহসান নিয়ে বলেছেন- ‘আহসান হাবীবের কবিতাই আমাদের আধুনিকতা চর্চার প্রকৃত সোপান তৈরি করেছেন। তিরিশের কবিরা কবিতায় যে রবীন্দ্রওোর ধারা প্রবাহিত তরেছেন আহসান হাবীব তাতে অবগাহন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে আহসান হাবীব তার রচনাকর্মে আশাবাদ, সচেতনতা, ভাষাশৈলিতে আধুনিকতার সঙ্খামুক্ত ও সম্প্রসারিত করেছেন। কবি হিসাবে বরেণ্য কেবল আমাদের কাছে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের কারণে নয়, তিরিশোওোরকালে আর্বিভূত তিনিই আমাদের শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবিদের একজন’।
কবি আহসান হাবীব কবিতায় নিমার্ণ করেছেন স্বদেশলগ্নতা, জীবনঘনিষ্ঠতা, মানবিক বেদনাবোধ, প্রেমানুভবের উৎসারণ, নিজস্ব আত্বজৈবনিক কাব্য শৈলি। তিরিশ কাব্যশৈলীর আধূনিকতার সঙ্গে রবীন্দ্র – নজরুল যুগের কাব্যকলার সংমিশ্রনে দেশ ও জীবনবোধের সাহচর্যে নতুন আধুনিক কাব্য আন্দোলনের সূচনাক্রম উদ্ভাসিত হয়েছে আহসান হাবীবে’র সকল রচনাকর্মে। তাইতো আহসান হাবীব শুধূ আমাদের প্রকৃত আধুনিক কবি নন, উওরাধুনিকতার এক পথ প্রদর্শক। কারণ তিনি কবিতায় তুলে ধরেছেন সমকালীন ইতিহাস,সমাজ,জীবন বাস্তবতা, কাব্য নিরীক্ষা,ঐতিহ্যের নবরুপায়ন,দার্শনিকতার নতুনবোধ ও শিল্পরীতি। আহসান হাবীবের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুরের শংকরপাশা গ্রামে। পিতার নাম হামিজুদ্দীন হাওলাদার। মাতা জমিলা খাতুন। তার পাঁচ ভাই ও চার বোন। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পিতা- মাতার প্রথম সন্তান তিনি। পারিবারিকভাবে আহসান হাবীব সাহিত্য সংস্কৃতির আবহের মধ্যে বড় হয়েছেন। সেই সূত্রে বাল্যকাল থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। সেইসময় তার বাড়িতে ছিলো আধুনিক সাহিত্যের বইপত্র ও কিছু পুঁথি। যেমন আনোয়ারা, মনোয়ারা, মিলন মন্দির প্রভৃতি । এসব পড়তে পড়তে একসময় নিজেই কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করেন।
আহসান হাবীব আধুনিক কাব্যধারার কবি ছিলেন। তাঁর কাব্যচর্চার শুরু বাল্যকাল থেকেই। সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে ১৯৩৩ সালে স্কুল ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম লেখা একটি প্রবন্ধ ‘ধর্ম’ প্রকাশিত হয়। ১৯৩৪ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘মায়ের কবর পাড়ে কিশোর’ ছাপা হয় পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল ম্যাগাজিনে। তখন তিনি দশম শ্রেণীর ছাত্র। এভাবেই তাঁর সাহিত্যিক জীবনের শুরু। পরে দেশ, মোহাম্মদী, বিচিত্রা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। সাহিত্যের অণুকূল পরিবেশ নিয়ে পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে ১৯৩৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি পিরোজপুর থেকে প্রবেশিকা (১৯৩৫) পাস করে কিছুদিন বিএম কলেজে আইএ ক্লাসে অধ্যয়ন করেন, কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে লেখাপড়া ত্যাগ করে কলকাতা গিয়ে সাংবাদিকতার পেশা গ্রহণ করেন এবং আজীবন ওই পেশাতেই নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৩৬ সালের শেষার্ধে কাজের খোঁজে তিনি রাজধানী কলকাতায় পাড়ি জমান। এভাবেই কবি আহসান হাবীবের বরিশাল থেকে তৎকালীন রাজধানী কলকাতায় পদার্পণ। কলকাতায় তিনি তকবীর (১৯৩৭), বুলবুল (১৯৩৭-৩৮) ও সওগাত (১৯৩৯-৪৩) পত্রিকায় কাজ করেন। কয়েক বছর (১৯৪৩-৪৮) তিনি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকায় এসে তিনি বিভিন্ন সময়ে আজাদ, মোহাম্মদী, কৃষক, ইত্তেহাদ প্রভৃতি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫৭-৬৪ পর্যন্ত তিনি ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনস-এর প্রডাকশন অ্যাডভাইজার ছিলেন। পরে তিনি কিছুদিন দৈনিক পাকিস্তানে কাজ করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দৈনিক বাংলার সাহিত্য-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
আহসান হাবীবের প্রথম কবিতার বই রাত্রিশেষ প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ ছায়াহরিণ (১৯৬২), সারা দুপুর (১৯৬৪), আশায় বসতি (১৯৭৪), মেঘ বলে চৈত্রে যাবো (১৯৭৬), দুহাতে দু আদিম পাথর (১৯৮০), প্রেমের কবিতা (১৯৮১), বিদীর্ণ দর্পণে মুখ (১৯৮৫) ইত্যাদি। তাঁর দুটি বিশিষ্ট উপন্যাস হলো অরণ্য নীলিমা (১৯৬০) ও রাণীখালের সাঁকো (১৯৬৫)। এ ছাড়া তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ: জ্যোৎস্না রাতের গল্প, বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর (১৯৭৭), ছুটির দিন দুপুরে (১৯৭৮) ইত্যাদি। মধ্যবিত্তের সংকট ও জীবনযন্ত্রণা আহসান হাবীবের কবিতার মুখ্য বিষয়। সামাজিক বাস্তবতা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংগ্রামী চেতনা এবং সমকালীন যুগযন্ত্রণা তাঁর কবিতায় শিল্পসম্মতভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। তাঁর ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিতে নাগরিক মননের ছাপ আছে। সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬১), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬১), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৭৭),একুশে পদক (১৯৭৮),আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০) এবং আবুল কালাম স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৪) লাভ করেন।
১৯৪৭ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ‘ রাত্রিশেষ’ প্রকাশিত হয়েছিলো কলকাতা থেকে। রাত্রিশেষের কবিতাগুলো ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে রচিত হয়েছিলো। বাঙলা কবিতা যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরিবর্তন, পরাধিনতা, বৈষম্য, দাঙ্গা ও মহামারী,ছাড়াও রাজনৈতিক জটিলতার মধ্যে আবর্তিত সে সময় বাংলাদেশের বরেণ্য আধুনিক ধারার উপন্যাসিক, গল্পকার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র প্রকাশনা সংস্থা কমরেড পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থে আহসান হাবীব সমকালীন সমাজের জীবন যাপনের নানান অনুসঙ্গ গভীর অর্ন্তদৃষ্টিতে চিত্রিত করেছেন তার লেখনিতে। ১৯৫০ সালে বাংলাদেশের প্রথম উল্লেখ্যযোগ্য কবিতা সংকলন ‘নতুন কবিতা’র মধ্যে দিয়ে যে নতুন পথ নিমার্ণ হয় সে সময়ে সংকলনের সকল কবিতাই নতুন আধুনিকতার প্রতিনিধি ছিলো। তাদের রচনাতে ভাষার দক্ষতা, রুচিবোধ, বিষয় বৈচিত্র্যতা নতুন আঙ্গিকে উঠে আসে। পরবর্তীতে নতুন কাব্যর নিজস্বতার পথ ধরে কাব্য সংকলনের দিক নির্দেশনায় এগিয়ে গেছে কবিদের কাব্য আন্দোলন।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের চেতনায় মধ্যবিত্ত সমাজের প্রগতিশীল নতুন রাজনৈতিক ধারার সাথে কাব্য আন্দোলনে স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্ঠিকর্ম নিয়ে আর্বিভূত হন আহসান হাবীব। প্রথম কাব্যগ্রন্থের দীর্ঘ বিরতির পর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ‘ ছায়াহরিণ’ (১৯৬৩) ছাড়াও এক এক নতুন শৈলীতে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হতে থাকে নতুন নতুন চেতনায়। যেমন- সারাদুপুর (১৯৬৪), আশায় বসতি (১৯৭৪), মেঘ বলে চৈত্রে যাবো (১৯৭৬), দুই হাতে দুই আদিম পাথর (১৯৮০), প্রেমের কবিতা ( ১৯৮৫), এবং সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ‘ বিদীর্ন দর্পনে মুখ’(১৯৮৫)। ছাড়াও কবির ৬৮ বৎসরের জীবনে উপন্যাস, শিশুতোষ উপন্যাস ‘রাণী খালের সাঁকো’, শিশু- কিশোর উপযোগী ছড়া ,কবিতা ও গল্প রচনায় নিবেদিত ছিলেন। কবিতায় স্বদেশ, সমাজ, জীবনবোধের সংগ্রামী চেতনা, মধ্যবিও জীবনের টানাপোড়েনের সংকটবোধ, ও আধুনিকতার জটিল মাত্রা খুঁজতে গিয়ে নতুন পথের সন্ধ্যান দিয়েছেন আহসান হাবীব। প্রত্যক্ষ করেছেন সংকটের আবর্তে মানুষের জীবনযাত্রা। সমকালের ধ্বনি তাকে প্রতিনিয়ত বিচলিত করেছে।
জন্মভূমির সঙ্গে মানুষের আজীবনের সম্পর্ক। এর সবকিছুই তার মনে হয় কত চেনা, কত জানা এই অনুভূতি তুলনাহীন। দেশ মানে তো শুধু চারপাশের প্রকৃতি নয়, একে আপন সত্তায় অনুভব করা। আর দেশকে অনুভব করলেই দেশের মানুষকেও আপন মনে হবে আমাদের। এই কবিতায় সেই অনুভবই আন্তরিক মমতায় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন কবি আহসান হাবীব। তিনি উচ্চারণ করছেন, তিনি এ কোনো আগন্তুক নন। তিনি যেমন ওই আসমান, জমিনের ফুল, জোনাকি, পুকুর, মাছরাঙাকে চেনেন,তেমনি তারাও তাকে চেনে। পাখি, কার্তিকের ধান কিংবা শুধু শিশির নয়, তিনি এই জনপদের মানুষকেও ভালোভাবে চেনেন। তিনি কদম আলী, জমিলার মা’র মতো মানুষের চিরচেনা স্বজন। কবি অনুভব করেন, যে-লাঙল জমিতে ফসল ফলায়, সেই লাঙল আর মাটির গন্ধ লেগে আছে তার হাতে, শরীরে। ধানক্ষেত আর ধূ ধূ নদীর কিনার, অর্থাৎ এই গ্রামীণ জনপদের সঙ্গেই তার জীবন বাঁধা। এই হচ্ছে তাঁর অস্তিত্ব। এই হচ্ছে মানবজীবন, জন্মভূমির সঙ্গে যে-মানুষ গভীরভাবে সম্পর্কিত। ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়।
লেখক, সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ(কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান)
গবেষক,সাংবাদিক,কলামিস্ট ও চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব, মানিকগঞ্জ