শিশুমৃত্যু হ্রাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য

মো: আলতাফ হোসেন ঃঃ
শিক্ষা ক্ষেত্রে, মাতৃত্বজনিত মৃত্যুহ্রাস, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ শিশু মৃত্যুরোধে অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। দেশের জনসংখ্যা বেড়ে ১৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজারে উন্নীত হয়েছে। গেলো বছর জানুয়ারি পর্যন্ত হিসেবে করে বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে দেশে প্ররুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১০ লাখ এবং নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার। জরিপের তথ্যানুযায়ী দেশে পাঁচ বছরের ব্যবধানে ৪ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার কমেছে প্রায় ২২ ভাগ। মাতৃমৃত্যু হারও কমেছে। গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭১ দশমিক ৬ বছর। স্বাক্ষরতার হার বেড়ে হয়েছে ৭১ শতাংশ। তবে এক থেকে ১১ মাস বয়সী শিশুমৃত্যুর হার গত তিন বছরেও কোন পরিবর্তন হয়নি। প্রতিহাজারে মৃত্যুহার ৯ জনে স্থির রয়েছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার বাড়েনি পাঁচ বছরেও। তাছাড়া অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে মাইগ্রেশন বা স্থানান্তর।

পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমুত্যুর হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে। গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্য পরিসেবার উন্নয়নে ফলেই দেশে শিশুমুত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে বলে জাতিষংঘ শিশু উন্নয়ন তহবিলের (ইউনিসেফ) ‘বিশ^ শিশু পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০১৬’ তে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মুত্যুর হার ১৯৯০ সালে ছিল প্রতি হাজারে ১৪৪ জন। ২০১৫ সালে তা কমে হয়েছে ৩৮। সফল টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন, ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং ভিটামিন ‘এ’ সম্পূরক ওষুধের সফল ব্যবহারের কারণে এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া গত দেড় দশকে বাংলাদেশে এক বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর হারও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৯০ সালে এ হার ছিল হাজারে ১০০। ২০১৫-তে এসে তা দাাঁড়ায় ৩১-এ।

আমাদের দেশে দেখা গেছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর প্রধান কারণ জন্ম-পরবর্তী শ^াসকষ্ট, কম ওজনের কারণে জন্মগত জটিলতা, সেপটিসেমিয়া, নিউমোনিয়া ও এনকেফেলাইটিস। এ ছাড়া অপুষ্টির কারণেও এই বয়সের শিশুরা মারা যায়। এসব শিশুর মৃত্যুরোধে নানা ধরনের সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার মান আরও বাড়াতে হবে। পুষ্টি-সম্পর্কিত জ্ঞান সারা দেশে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশে এখন নবজাতকের মৃত্যুর হার হাজারে ২৩। এই ২৩ সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। এদিকেও নজর দিতে হবে।

তবে বাংলাদেশের এই সাফল্যের খবরের পাশাপাশি প্রতিবেদনটি বর্তমান চলমান পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে, তবে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিরোধ করা যায় এমন রোগে বিশে^ পাঁচ বছরের কম বয়সী ৬ কোটি ৯০ লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটবে। এই শিশুদের মধ্যে বাংলাদেশের শিশুরাও থাকবে। ফলে প্রতিরোধযোগ্য এই রোগগুলোর ব্যাপারে সতর্কতা ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্জিত সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা গেলে এই দিকটি বিবেচনায় নিতে হবে।

বিশে^র শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে। অন্যদিকে শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম জাপানে। জাতিসংঘের শিশু-বিষয়ক তহবিলের (ইউনিসেফ) বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আফ্রিকাসহ বিশের দরিদ্র দেশগুলোতে মৃত্যুর ঝুঁকি খুবই মারাত্মক রূপ নিয়েছে। ধনী দেশগুলোর চেয়ে এই ঝুঁকি ৫০ শতাংশ বেশি।

শিশু মৃত্যুহারে সবার ওপরে রয়েছে পাকিস্তান। দেশটিতে প্রতি ২২ শিশুর মধ্যে একজন শিশু মারা যায়। এরপরই রয়েছে আফ্রিকা । আফ্রিকাতে প্রতি ২৪ জনে একজন মারা যায়। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে প্রতি ২৫ জনে ১, সোমালিয়া, লেস্তো, গিনিয়া, দক্ষিণ সুদানে প্রতি ২৬ জনে ১, আইভরি কোস্টে ২৭ জনে ১ এবং মালি ও চাদে ২৮ জনে একজন শিশু মারা যায়।

প্রতিদিন সাত হাজার শিশু মারা গেলেও গোটা বিশে^ শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। এদিকে শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম জাপানে। আর জাপানের পরই রয়েছে আইসল্যান্ড। এরপর যথাক্রমে রয়েছে সিঙ্গাপুর, ফিনল্যান্ড, ইস্তোনিয়া, স্লোভেনিয়া, সাইপ্রাস, বেলারুস, নরওয়ে ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো। ইউনিসেফের প্রতিবেদনেআরও বলা হয়েছে, জাপানে প্রতি এক হাজার ১১১ জনের মধ্যে একজন শিশুর মৃত্যু হয়। আইসল্যান্ডে প্রতি এক হাজারের মধ্যে ১, সিঙ্গাপুর প্রতি ৯০৯ জনের মধ্যের একজন শিশু মৃত্যু বরণ করে। মা ও শিশুদের জন্য স্বাস্থ্য সেবা বাংলাদেশকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়েছে। তথ্যমতে ১৯৯০ এর দশকে দেশে টিকাদান কর্মসূচির আওয়ায় ছিল মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশের মতো শিশু। এখন সেটা দাঁড়িয়েছে ৮০ শতাংশের ওপরে।

বাংলাদেশে এ সফলতার পেছনে সরকারী প্রচেষ্টার পাশাপাশি বিদেশী এনজিও গুলোর সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শিশুমৃত্যু হার কমাতে ইতিমধ্যেই সফলতা অর্জন করেছে ইউএসএআইডি, কইকা এবং সেভ দ্যা চিলড্রেন কোরিয়া সহায়তায় পাইলট প্রজেক্ট ‘মা মনি’।

লেখক: সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ(কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান)
গবেষক,সাংবাদিক,কলামিস্ট ও চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব, মানিকগঞ্জ

শিরোনাম