মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
শিক্ষকেরা জাতির বিবেক। একজন শিক্ষকই একটি জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। একজন শিক্ষকের সুষ্ঠু পাঠদানের মূল্য অর্থ দিয়ে পরিশোধ করা যায় না। শিক্ষকতা একটি মহান ও মর্যাদাশীল পেশা। শিক্ষকেরা সমাজ ও জাতি গঠন এবং শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে অগ্রণী ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। বাবা-মা কিংবা পরিবারের গন্ডির বাইরে একটি শিশুকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন একজন শিক্ষক। যাকে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। ছাত্রের ব্যক্তিত্ব, আত্মবিশ্বাস এবং দক্ষতার স্তরকে উন্নত করতে শিক্ষকের যথেষ্ট ভূমিকা থাকে। তাঁরা ভবিষ্যত প্রজন্মকে যেকোনো অসুবিধা এবং সমস্যার মুখোমুখি হতে পারার জন্য সক্ষম করে তোলে। করোনা মহামারির মধ্যে পুরো বিশ্বের জনজীবনের সাথে থমকে ছিল শিক্ষাব্যবস্থাও। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এ বছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে,“শিক্ষা পুনরুদ্ধারের কেন্দ্রবিন্দুতে শিক্ষক”। মানবিক বিপর্যয় বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে আক্রান্ত হয়েও সামাজিক,অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিনির্মাণে শিক্ষকরা তাদের ভূমিকা রেখে চলেছেন।
শিক্ষকদের সার্বিক সহযোগিতার জন্য আমাদের যে মুহূর্তে যে বিষয়গুলো আলোচনা করা দরকার তা হলো-শিক্ষকতার পেশার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। অনেকেই করোনার কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে জীবিকার জন্য অন্য পেশাগুলো বেছে নিয়েছে। অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিয়ে অন্যান্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন। জানতে পারি যে, করোনাকালীন সময়ে প্রায় ১০ হাজার কিন্ডার গার্ডেন বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অনেক শিক্ষক চাকরি হারিয়েছে। শিক্ষকতা পেশার নিরাপত্তা না থাকার ফলে আগামীতে শিক্ষকতা পেশায় অনেক মেধাবীরাই আসতে চাইবে না। আমাদের এখনই সময় এসেছে, এই পেশার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শিক্ষকেরা আগামীতেও যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে, সেই জন্য বিভিন্ন বীমা, বিশেষ ঋণ সহায়তা দিয়ে পেশার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সময়েরসঙ্গে জীবন ও জীবিকার কথা বিবেচনা করে তাদের বেতনের মানদন্ড মানসম্মত করতে হবে।
শিক্ষা সময়ের সেরা বিনিয়োগের ক্ষেত্র। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা স্থায়ী উন্নয়নের জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই। ভারতের নোবেল জয়ী শিক্ষাবিদ কৈলাশ সত্যার্থী বলেন, শিক্ষায় ১ ডলার বিনিয়োগ করলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ১৫ গুন রিটার্ন পাওয়া সম্ভব। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়াতে হবে। শিক্ষক সমাজের অতুলনীয় অবদানের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর থেকে ইউনেস্কোর অনুপ্রেরণায় পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। বিশ্বব্যাপী করোনা অতিমারির তীব্র ছোবলে বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে ২০২১ সালে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের আয়োজন করা হয়েছে বিশেষ প্রতিপাদ্যের ভিত্তিতে ‘শিক্ষকরা শিক্ষা পুনরুদ্ধারের কেন্দ্রবিন্দুতে’-‘টিচার্স অ্যাট দ্য হার্ট অব এডুকেশন রিকভারি’। অতিমারিকালীন শিক্ষকদের নিবেদিত ও কঠোর পরিশ্রমের প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক ইউনেস্কো এ প্রতিপাদ্যটি নির্ধারণ করেছে।এ স্লোগান দিয়ে গ্লোবাল কমিউনিটিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, শিক্ষকদের গুরুত্ব দিয়েই অতিমারিতে মুখ থুবড়ে পড়া শিক্ষাব্যবস্থাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করা হলে শিক্ষাব্যবস্থার ধসে যাওয়া ভিত পুনঃনির্মাণ করা যাবে না। আর এ জন্য দরকার হবে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের প্রকট অভাবের বিষয়টি মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সমৃদ্ধ জাতি গঠন আর ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন করতে হলে শিক্ষক সমাজের বঞ্চনা কমাতে হবে। বিশেষ করে করোনার কারণে যেসব শিক্ষক দুর্দশায় পতিত হয়েছেন,তাদের বিশেষ প্রণোদনার আওতায় আনা জরুরি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল শিক্ষা আর মাদ্রাসা শিক্ষাসহ সর্বত্রই মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের মান উন্নয়ন করতে পারলেই নিশ্চিত হতে পারে শিক্ষার সার্বিক গুণগত মান।
এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবস এসেছে করোনা অতিমারির মধ্যে। করোনার মধ্যে দীর্ঘ সময় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ থাকলেও শিক্ষকরা বসে ছিলেন না। তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে কাজ করেছেন। সরাসরি ক্লাস বন্ধের সময় অনলাইন কিংবা দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের শিখন নিশ্চিত করতে অনেক শিক্ষক নিরলস পরিশ্রম করেছেন। করোনা অতিমারির মধ্যে সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে আমরা চিকিৎসকদের ভূমিকার প্রশংসা করি। চিকিৎসকরা যেভাবে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সেবা দিয়ে গেছেন; তেমনি শিক্ষকরাও শিক্ষাসেবায় পিছিয়ে ছিলেন না।আমাদের শিক্ষকদের বহুমুখী দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে।উন্নত-অনুন্নত দেশ তথা বলা চলে গোটা বিশ্বই অতিমারির সময়ে অনলাইননির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
শিক্ষার পুনরুদ্ধারে শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন খুবই জরুরি। এজন্য নীতি নির্ধারকদের উচিত হলো, শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং তাদের মানোন্নয়নে সর্বদা সমর্থন করা,প্রশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকদের শিক্ষাগত সিদ্ধান্তের ওপর বিশ্বাস রাখা এবং শিক্ষাকে সহায়তা করার জন্য শিক্ষাগত প্রযুক্তি ব্যবহার করার দক্ষতা বৃদ্ধি করা,হাইব্রিড শিক্ষার সকল সরঞ্জাম নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন চাহিদা, ইচ্ছা এবং আকাক্সক্ষার প্রতি মনযোগ দেয়া। এছাড়া বাধাগ্রস্ত শিক্ষার ক্ষতি কাটাতে শিক্ষকদেরকে যে বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিতে হয় তাহলো সম্পূরক শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নেওয়া, সঠিক স্তরে শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিখনফল নিশ্চিত করা, শিক্ষার প্রাসঙ্গিককরণ এবং মহামারী চলাকালীন শিক্ষার ক্ষতি এবং লাভগুলো বিবেচনায় নেওয়া। আর এর জন্য প্রয়োজন হয় নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। যেমন, শ্রেণীকক্ষ পর্যায়ে শিক্ষার মূল্যায়ন এবং পাঠ্যক্রমকে শিক্ষার্থীদের চাহিদার সঙ্গে মানানসই শিক্ষার সমন্বয় করা। এগুলো এমন পদক্ষেপ যা শিক্ষকদের সচেতনতার সঙ্গে অনুশীলন করতে হয়, যেন ভবিষ্যতের সংকটগুলোর জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তত হওয়া যায় এবং প্রযুক্তিগত বিকাশের সুবিধাগুলো গ্রহণ করে শিক্ষা পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করা যায়।
করোনা সারাবিশে^র মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার গতিপথ রুদ্ধ করে দিয়েছে।আর্থসামাজিক পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতির সঙ্গে পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় যে ভঙ্গুরতার সৃষ্টি হয়েছে, তা ভবিষ্যতের অনেকটা সময় ধরে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী বিশে^র ১৩৪টি দেশের পুরো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ৩৮টি দেশের অঞ্চলভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। ৯৮.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখনবঞ্চিত হচ্ছে করোনার কারণে। এতে কেবল শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো মানবজাতি।
করোনা মহামারীর কারণে একটি ব্যতিক্রমী দীর্ঘবিরতির পর পুণরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলাটা কেবল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য একটি স্বস্তিকর মুহূর্ত নয়, উপরন্তু একটি মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার আকাক্সক্ষী জাতির সাক্ষরতা সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা কী, সেটি পর্যালোচনা করতে পুরো সমাজের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের আধুনিক পদ্ধতিতে নিয়মিত ও যথাযথ পাঠদান ও শিক্ষাদানের সক্ষমতা, কৌশল ও নৈপুণ্যের ওপর নির্ভর করবে শিক্ষার গুণগত মান ও মানসম্মত শিক্ষা। যেকোনো দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প নেই। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করণে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের নিয়মিত,সুষ্ঠু, উন্নত ও পদ্ধতিগত পাঠদান প্রণিধানযোগ্য। শ্রেণিকক্ষে মানসম্মত আধুনিক সফল, যথাযথ ও নিয়মিত পাঠদান এবং শিক্ষাদান শিক্ষার্থীদের জন্য বড় পাওনা,বড় প্রাপ্তি আর শিক্ষকদের বড় সন্তুষ্টি,বড় সাফল্য,বড় কৃতিত্ব। যেসব দেশে শিক্ষকদের মান যত বেশি উন্নত,সেসব দেশে শিক্ষার মানও তত বেশি উন্নত। শিক্ষকতা কেবল একটি চাকরি নয়,একটি সম্মানজনক ও অভিজাত পেশাও বটে।
শিক্ষকতা অন্যান্য পেশার রোল মডেল।একজন শিক্ষক মানুষ,সমাজ ও জাতি গড়ার কারিগর। সুস্থ দেশ গড়ার জন্য চাই একজন শিক্ষক। উল্লেখ্য, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা প্রশাসন,যোগ্য শিক্ষকমন্ডলী ও কারিকুলামের ওপর নির্ভর করে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন সম্ভব। শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ,তথ্য-উপাত্তসহ মানসম্মত পাঠদানের অভিনবত্ব সৃষ্টির মাধ্যমেই নিশ্চত হবে শিক্ষার গুণগত মান। শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মানে হলো একটি জাতির বিলুপ্তি। শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়ন ছাড়া কোনো দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে গেলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত। অভাব শুধু গুণগত বা মানসম্মত শিক্ষার। শিক্ষার মান বাড়বে শিক্ষকদের গুণে। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষা সম্প্রসারণ ও জ্ঞান বিতরণের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক শিক্ষা ও সভ্যতার অধিকতর অগ্রগণ্য অভিভাবক।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সম্পর্ক সুদৃঢ় করা-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম উপাদান হল শিক্ষার্থী,আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হল শিক্ষক। একজন আদর্শ শিক্ষকের হাত ধরেই তৈরি হয় আদর্শ ছাত্র-ছাত্রী। একজন মানুষের সফতার পেছনে শিক্ষকের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা চিন্তাও করা যায় না। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ও অভিভাবকের গুরুত্ব অপরিসীম। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক সফলতা পেতে হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
সত্যিকার অর্থে একজন প্রাজ্ঞ,দূরদৃষ্টিসম্পন্ন,বিচক্ষণ শিক্ষক সমাজ বদলে দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন।একজন আদর্শবান শিক্ষকই পারেন একটি আদর্শবান সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে দিতে। একজন শিক্ষক সমাজের সকল নেতিবাচকতা,অন্ধকার দূর করে জ্ঞানের আলো দিয়ে আলোকিত করতে পারেন।এজন্যই শিক্ষককে শুধুমাত্র তাঁর পেশার মানদন্ডে পরিমাপ করা যাবে না। কারণ সত্যিকারের জ্ঞান মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে থাকে। পিতামাতা আমাদের জীবনদান করেন ঠিকই কিন্তু শিক্ষকরা সেই জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।’রবীন্দ্রনাথ বলেন,“আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় সেই গুরুকেই খুঁজিতেছি,যিনি আমাদের চিত্তের গতিপথকে বাধামুক্ত করিবেন”। উইলিয়াম আর্থার ওয়ার্ড-এর মতে,‘একজন সাধারণ শিক্ষক বক্তৃতা করেন,একজন ভালো শিক্ষক বিশ্লেষণ করেন, একজন উত্তম শিক্ষক প্রদর্শন করেন,একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক অনুপ্রাণিত করেন’।
আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে তাঁর প্রতিচ্ছবি হলো আজকের শিক্ষকেরা। শিক্ষকদের মানোন্নয়ন ব্যতীত শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন হবে না। ফলে শিক্ষকের দক্ষতা উন্নয়ন,স্বাধীনতা ও সম্মানের বিষয়ে যত্নশীল হওয়ার মাধ্যমেই আগামীর স্বনির্ভর ও উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আজন্ম স্বাধীন, সম্পদবিহীন ব্রিটেন সূর্যাস্তবিহীন রাজ্যশাসন করে সম্পদের পাহাড় গড়েছিলো মেধা আর শিক্ষা দিয়ে। ইতিহাস বলে, বিশে^র যে দেশ যত বেশি উন্নতির সোপান গড়েছে সে দেশ তত বেশি শিক্ষায় বিনিয়োগ করেছে। আকাশচুম্বী প্রত্যাশা নিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। শতভাগ নিরক্ষরতা দূরীকরণ,নারী শিক্ষা,বৈষম্যবিহীন একমুখী শিক্ষা,মেধার মূল্যায়ন,মেধা পাচার রোধ, শিক্ষকতায় মেধাবীদের সর্বাধিক মূল্যায়ন,উচ্চশিক্ষায় গবেষণা,দলীয় প্রভাবমুক্ত শিক্ষা প্রশাসন,কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন, মাদরাসা শিক্ষায় আধুনিকীকরণ,সর্বোপরি সুশিক্ষিত জাতি গঠন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে জাতি গঠনে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
প্রকৃত অর্থে ‘শিক্ষকরাই’ জাতির মেরুদন্ড এই কথাটি যথার্থ,সময়োপযোগি ও ন্যায় সঙ্গত। শিক্ষা চিন্তাবিদরা তাই বলেছেন,সমাজ পরিবর্তনের মৌল উপাদানও শিক্ষা। শিক্ষাকে যিঁনি শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেন তিনি হলেন শিক্ষক। শিক্ষকরা প্রতিটি দেশের জাতীয় সম্পদ। তিনি সমাজ,দেশ ও জাতি গঠনের সম্ভাবনাময় সংগঠক। আধুনিক মননশীল শিক্ষকের অভাবের কারণে আজকাল শিক্ষাকে সমাজ উপযোগি করার যে স্বপ্ন তা হয়ে উঠছে না। এই কাজটি অতি সহজে করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষককে আধুনিক দীক্ষায় দিক্ষিত করা। শিক্ষক পারেন শিক্ষার বিকাশ ও শিক্ষার্থীর মনন তৈরীতে সহায়তা করতে। অনেক সময় তাও হচ্ছে না। কারণ বাবা মা সন্তান লাভের পরই যে চিন্তা তাকে নিয়ে সেটা হল, সন্তান হয় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা মোটাদাগের অফিসার হবে। যারফলে সন্তানের মধ্যে এমন এক ধরনের মানসিকতা বিকাশ লাভ করছে, সে শিক্ষকতাকে আর পেশা হিসাবে ভাবতেও পারছেন না। যারফলে মেধাবীরা শিক্ষকতাকে আর কাজ হিসাবে বেচে নিচ্ছেন না। আধুনিক চিন্তাবিদরা বলেছেন একটি জাতির শ্রেষ্ঠ শিক্ষাব্যবস্থাটাই হচ্ছে শিক্ষক। শিক্ষকতা পেশায় কেবল ওদের আসা উচিত যারা সমাজে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে চান। কারণ এই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন মানবতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক মুহাম্মদ (সা.), ছিলেন সক্রেটিস, রবীন্দ্র নাথ ও স্বামী বিবেকানন্দসহ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষগন। তারা এই বিষয়টিকে শ্রেষ্ঠ হিসাবে দেখেছেন বলেই কেবল নিজেরাই দেশ-জাতি ও সীমানার উর্ধ্বে উঠে শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হয়েছেন।
একটি দেশের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন,অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন,টেকসই প্রযুক্তির উন্নয়ন ও সার্বিক অগ্রগতিতে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষক একজন শিল্পীর ন্যায়; তিনি মানব মনের সহজাত প্রবৃত্তি/শক্তি ও সুপ্ত সম্ভাবনার পরিস্ফুটন ঘটিয়ে সত্যিকারের মানুষ তৈরির কাজে নিয়োজিত থাকেন। একজন শিক্ষক শুধু কাক্সিক্ষত বিষয়বস্তু পাঠদানই করেন না,পাশাপাশি তিনি শিক্ষার্থীর মনে দেশপ্রেম, মানবতাবোধ, নৈতিকতাবোধ,মূল্যবোধ সৃষ্টিতেও অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। অধিকন্তু কায়িক শ্রমের মর্যাদা,নেতৃত্বের গুণাবলীর বিকাশ, সৃজনশীলতা,বিজ্ঞানমনস্কতা,শিক্ষার্থীদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখানো, সামাজিক অগ্রগতির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি বিষয়ে অপরিহার্য কূশলী হিসেবে শিক্ষক সম্পৃক্ত থাকেন।
শিক্ষাকে যাবতীয় উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হলে, শিক্ষকের ভূমিকার গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ প্রাকৃতিকভাবে মূর্ত ও প্রত্যক্ষ নমুনা দ্বারাই বেশি প্রভাবিত হয়। পঠিত বই বা শ্রুতবাণী দ্বারা তেমন প্রভাবিত হয় না। আর একজন ছাত্রের সামনে মূর্ত নমুনা হলো,তার আদর্শ শিক্ষক। তার মন-মানসিকতা গঠন ও পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন তার শিক্ষক। শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব,আদর্শ ও মানবিক মূল্যবোধ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একজন শিক্ষার্থীর উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। পিতা-মাতা সন্তান জন্ম দিলেও শিক্ষকই তাকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। একজন শিক্ষকই পারেন শিশুর সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করে জাতির উন্নয়নে নিযুক্ত করতে। তার চিন্তা-চেতনা ও মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন একজন শিক্ষক।
দেশে প্রায় ৫ লক্ষেরও বেশি শিক্ষক সরকারি বেসরকারি স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসায় কাজ করছে। নানা প্রতিকুলতা যাঁদের উপর সব সময় ভর করে আছে তার আরেক নাম শিক্ষক।দেশকে একটি সুন্দর ও কল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার জন্য যাদের শ্রম সাধনা সরাদিন সারারাত তারাই অবহেলিত বঞ্চিত শিক্ষক।এবারের শিক্ষক দিবস অন্য বারের তুলনায় ব্যতিক্রম। করোনার মত বৈশ্বিক মহামারিতে যখন আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিশেষত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন হুমকির একেবারে কিনারায় ঠিক সেই মূহুতে শিক্ষক দিবস এবং এর ব্যতিক্রমী প্রতিপাদ্য বিষয় আমাকে আবেগ তাড়িত করেছে কিন্তু শিক্ষাকে পুনরুদ্ধারের কেন্দ্র বিন্দুতে যে শিক্ষকদের কথা বলা হচ্ছে আদৌ তাঁরা কতটা পরিস্থিতির স্বীকার ছিল সেটিও বিবেচনায় আসবে।
দেশে শিক্ষকদের মর্যাদা কতটা সমুন্নত আজ? আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবসে দেখি একটু সদ্য-অতীত ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে। দেখি সিস্টেম লেভেলে কী করা হয়েছে। সরকারের কিছু পদক্ষেপ শিক্ষকদের মর্যাদায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী আর শিক্ষামন্ত্রীর সরাসরি উদ্যোগে শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দ্বিগুণ করা হয়েছে,পদমর্যাদায় পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের মাধ্যমে অবকাঠামোগত ও পরিবেশগত পরিবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষকদের ক্ষমতায়নের পথে বাধার অচলায়তন সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।
আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠনে খেলাধুলাসহ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সৃষ্টিশীল প্রজন্ম গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখেন একজন শিক্ষক।স্বাধীন বাংলাদেশেসহ বিশ্বের সকল শিক্ষকই পারেন সময়োপযোগী নানা পদক্ষেপে নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে একটি জাতিকে শিক্ষিত করে তার সোনালী ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য প্রয়োজন হবে বিশ্বমানের শিক্ষা। আমাদের প্রত্যয় হোক,প্রথমে আমরা জাতীয় ও আঞ্চলিক শিক্ষামানের সুস্পষ্ট বোধগম্য সংজ্ঞা নির্ধারণ করব এবং তদনুযায়ী শিক্ষক গড়ে তোলার ব্যবস্থা করব-সঠিক শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে। করণীয়গুলো সঠিকভাবে পালন করব। সঠিক রাস্তা ধরে হেঁটে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করব। আর বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা-ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তারই সুযোগ্যকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্র বিনির্মাণের দর্শন অনুসরণ করে শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন রূপে সাজিয়ে তুলব। শিক্ষাসংক্রান্ত সব রকমের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখব।
লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট