শালীনতা মানুষের মানবিক গুণ যা জীবনকে মধুময়,সুুন্দর ও সার্থক করে

মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
ইসলাম সৌন্দর্যের ধর্ম। ইসলাম সব মানুষকে সুন্দর, সুরুচিপূর্ণ শালীন জীবনযাপনে উৎসাহিত করে। বিকশিত মানুষ গড়ে তোলা ইসলামের মূল শিক্ষা। শালীনতা অর্থ মার্জিত, সুন্দর, শোভন, সভ্য ইত্যাদি। কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও চলাফেরায় ভদ্র, সভ্য ও মার্জিত হওয়াকে শালীনতা বলে। শালীনতার পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। যা বহু নৈতিক গুণের সমষ্টি। ভদ্রতা, নম্রতা, সৌন্দর্য, সুরুচি, লজ্জাশীলতা ইত্যাদি গুণাবলীর সমন্বিত রূপের মাধ্যমে শালীনতা প্রকাশ পায়। তাই শালীনতার গুরুত্ব অপরিসীম।

শালীনতা ইমানের অংশ। শালীনতার পুরোটাই কল্যাণময়। ব্যবহারিক জীবনে শালীনতা অবলম্বনে ইমানে পূর্ণতা আসে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলছেন “লজ্জাশীলতা হলো ইমানের অংশ।” (সহিহ বুখারি) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,‘‘লজ্জাশীলতার সবটুকুই কল্যাণময়’’ (সহিহ মুসলিম) রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন,‘‘লজ্জাশীলতাই কল্যাণ বয়ে আনে’’ (সহিহ মুসলিম) শালীনতা মানুষের একটি মহৎ গুণ। এটির গুরুত্ব অপরিসীম। শালীনতাবোধ মানুষকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। শালীনতা আল্লাহর অনুগত বান্দা হতে সাহায্য করে। আচার-ব্যবহারে শালীন ব্যক্তিকে সবাই পছন্দ করে। শালীন পোশাক পরিচ্ছদ সৌন্দর্যের প্রতীক। শালীন ও ভদ্র আচরণের মাধ্যমে বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়। সমাজকে সুুন্দর ও সুশৃঙ্খল রাখতে শালীনতার প্রয়োজন সর্বাধিক। শালীনতাপূর্ণ আচার ব্যবহার সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে চাবিকাঠি। অশোভন বা অশালীন পোশাক পরিচ্ছদ ও আচরণ অনেক সময় সমাজে বিপর্যয় ডেকে আনে, সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে। নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় ঘটায়।

শালীনতাই ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। যেসব কাজ শালীনতাবিরোধী,ইসলাম সেসব কাজ নিষিদ্ধ করেছে। কেননা, অশ্লীল ও অশালীন কাজকর্ম মানবিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধ বিনষ্ট করে দেয়। মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশুত্বের অভ্যাস গ্রহণ করে। যার কারণে সমাজে অনাচার, ব্যভিচার, অশ্লীলতা, ইভটিজিংয়ের মতো অশালীন কাজ প্রকাশ পায়। যা সমাজ ধ্বংসের কারণ। মহান আল্লাহ তা’য়ালা শালীনতার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন, ‘‘আর তোমরা (নারীরা) নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন জাহেলি যুগের নারীদের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না।’’ (সূরা আল আহযাব: আয়াত-৩৩) শালীনতা অর্জনের জন্য লজ্জাশীলতা পরিপূরক বিষয়। লজ্জাশীলতা মানুষকে শালীন হতে সাহায্য করে। এ ব্যাপারে মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, লজ্জাশীলতার পুরোটাই কল্যাণময়। (মুসলিম) অন্য এক হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন- লজ্জাশীলতা ইমানের একটি শাখা। (নাসাই) রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্য এক হাদিসে বলেন, অল্লীলতা যে কোনো জিনিসকে খারাপ করে। লজ্জাশীলতা যে কোনো জিনিসকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে। (তিরমিজি) সুতরাং চলাফেরা, পোশাক-পরিচ্ছদ, কথাবার্তা, আচার-আচরণে লজ্জাশীল হওয়া প্রয়োজন। আমাদের প্রত্যেকের উচিত শালীনতা বজায় রেখে চলা। অশালীন কাজ পরিত্যাগ করা।

শালীনতা মানুষের জীবনে অপরিহার্য বিষয়। মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের শালীনতা শিক্ষা দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের সূরা লোকমানে উল্লেখ আছে, হযরত লোকমান (আ.) তাঁর পুত্রকে শালীনতা শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন, হে পুত্র, অহঙ্কার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না। পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে চলো না, কারণ আল্লাহ কোনো উদ্ধত-অহঙ্কারী ব্যক্তিকে পছন্দ করে না। তুমি পদচারণ করবে সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করবে। নিশ্চয়ই স্বরের মধ্যে গাধার স্বর সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর। (সূরা লোকমান, আয়াত-১৯) শালীনতার গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শালীনতা অবলম্বন করে চলা উচিত। এতে জীবনে সুুন্দর ও মধুময় হয়ে ওঠে। সমাজে ও সুুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। অতএব, আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে, বাঁকে বাঁকে সব কাজে শালীনতা রক্ষা করে উচিত।
শালীনতাপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পক্ষান্তরে, অভদ্র বা অশালীন আচরণ বন্ধুকেও দূরে ঠেলে দেয়। মানুষ অশালীন ব্যক্তিকে পছন্দ করে না। তার সাহায্য পরিত্যাগ করে। মহানবী (সা.) বলেছেন মানুষের মধ্যে ওই ব্যক্তি সবচেয়ে নিকৃষ্ট, যার অশ্লীলতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লোকেরা তাকে পরিত্যাগ করে। (বুখারি) অশালীন ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন না। মহানবী (সা.) বলেন নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’য়ালা অশালীন ও দুশ্চরিত্র ব্যক্তিকে ঘৃণা করেন।(তিরমিজি)
ইসলাম ধর্মে নারী-পুরুষ উভয়েই শালীনতা বজায় রাখার জন্য সমানভাবে দায়িত্বশীল এবং তাদের অনৈতিক কামনা বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সচেষ্ট হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কেউ একজন শালীন পোশাক পরিধান করবে কি করবে না তা লিঙ্গ অনুসারে প্রত্যেকের নিজস্ব পবিত্রতার বিষয়। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘মু’মিনদেরকে বলুন, তারা যেনো তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুবই পবিত্রতা আছে। নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। (সূরা নুর-২৪:৩০)

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’য়ালা ঘোষণা করেন, ‘হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন। (সূরা হুজুরাত ৪৯:১৩)

অনেকেই মনে করেন, নারীরা হিজাব পরিধান করেন পুরুষদের অনৈতিক কামনা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য, এটিও সত্য নয়। কারণ একজন পুরুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব একজন নারীর নয়। প্রত্যেক পুরুষ তার নিজের আচরণের জন্য নিজেই দায়ী। পুরুষদেরকেও তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখতে হবে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রেই শালীন আচরণ করতে হবে।
পোশাক-পরিছদে শালীনতারর অভাবে সমাজে অশ্লীলতা বিস্তার ঘটে। ইভটিজিং, যিনা-ব্যভিচার নানাবিধ পাপকাজ সংঘটিত হয়ে থাকে। ব্যক্তির মাঝে সৌন্দর্য, রুচি, লজ্জাশীলতা, ভদ্রতা, নম্রতা প্রভৃতি গুণাবলি অনুপ্রবেশের মাধ্যমে শালীনতার প্রকাশ ঘটে। আর এ কারনে ইসলামে নারী-পুরুষ উভয়কে পর্দা ও শালীনতা বজায় রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,‘‘তোমরা (নারীগণ) নিজেদের ঘরে অবস্থান করবে এবং জাহিলিয়া যুগের (নারীদের) ন্যায় নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না ।’’ (সূরা আল আহযাব ৩৩ : ৩৩)
মহান আল্লাহ শালীন হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। উল্লিখিত আয়াতে মহান আল্লাহ নারীদেরকে উচ্ছৃঙ্খল ও অশালীন অবস্থায় ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছেন। তবে একান্ত প্রয়োজনে বাইরে যাওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। সে ক্ষেত্রে শালীন পোশাক পরিধান করে বের হতে হবে। এটাই আল্লাহর নির্দেশ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘হে নবি! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মু’মিনদের নারীদেরকে বলুন, তারা যেনো তাদের চাঁদরের কিছু অংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে। ফলে তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না। ’’(সূরা আল আহযাব ৩৩: ৫৯)

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ আদর্শ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে ইসলামের দিকনির্দেশনা। পোশাক পরিচ্ছদের বিষয়েও ইসলামে রয়েছে দিকনির্দেশনা। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের পোশাক কেমন হওয়া উচিত, আমরা কি পড়বো, পুরুষের পোশাক কেমন হওয়া উচিত, আবার নারীর পোশাক কেমন হওয়া উচিত ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট পোশাক কারো ওপর চাপিয়ে দেননি। পুরুষ ও নারীদের জন্য শালীনতা এবং সৌন্দর্যের সমন্বয় দিকনির্দেশনা ও বিধিমালা দেয়া হয়েছে। যার আলোকে একজন পুরুষ বা নারী তার পোশাক নির্বাচন করবে। তবে অবশ্যই তাতে যেনো পর্দা এবং পোশাকের পূর্ণ অর্থের বাস্তব প্রতিফলন ঘটে। পোশাক পাঁচ ধরনের( ১) ফরজ পোশাক : এমন পোশাক, যা দ্বারা সতর ঢেকে যায়। (২) মুস্তাহাব পোশাক : এমন পোশাক, যা রাসূল (সা.)-এর পোশাকের মতো বা তাঁর পোশাকের খুব কাছাকাছি অথবা সমকালীন নেককার লোকদের পোশাকের মতো হয়। (৩) মুবাহ ও জায়েজ পোশাক : এমন পোশাক, যার মধ্যে শরিয়তের সীমানার ভেতর থেকে সৌন্দর্যের প্রতি খেয়াল রাখা হয়। (৪) মাকরুহ পোশাক : এমন পোশাক, যা পরিধান করার দ্বারা পরিধানকারীর অহংকার, প্রসিদ্ধি বা অন্যকে ছোট করা উদ্দেশ্য হয়। (৫) হারাম পোশাক : পুরুষ মহিলার মতো এবং মহিলা পুরুষের মতো পোশাক পরিধান করা হারাম পোশাকের অন্তর্ভুক্ত। নাবালক ছেলে-মেয়ের বেলায়ও এ মাসআলা প্রযোজ্য। তবে যে এলাকায় নারী ও পুরুষের পোশাকের খুব বেশি পার্থক্য থাকে না, সেখানে পোশাক এক হওয়া হারামের মধ্যে গণ্য হবে না। তাদের পোশাকের মধ্যে পার্থক্য হবে হিজাব বা টুপি ইত্যাদি দ্বারা। (ফাতাওয়া শামি : ৫/২২৩, ফাতহুল বারি : ১০/৩৪৫, বুখারি : ২/৮৭৪, ইবনে মাজাহ : ১/৩৪৮, ২/২৯৯, নাইলুল আউতার : ৬/১২৬)

ইসলামের দৃষ্টিতে শালীনতার গুরুত্ব অপরিসীম। শালীনতা বলতে ব্যক্তির আচার-আচরণের প্রকাশ ভঙ্গি, যথা- নম্রতা, ভদ্রতা, সম্মান, স্নেহ ইত্যাদি গুণাবলীকে বুঝায়। শালীনতা বোধ মানুষকে যে কোনো ধরনের অন্যায় ও অশ্লীল কাজ হতে বিরত রাখে। একজন শালীন ব্যক্তি কখনো অন্যকে অসম্মান করে না। অন্যের অনিষ্ট করতে পারে না। একজন শালীন ব্যক্তির কাছে গোটা সমাজ নিরাপদে থাকে। আচার ব্যবহারে শালীন ব্যক্তিকে সবাই পছন্দ করে। পোষাক, পরিচ্ছদে শালীন ব্যক্তি সমাজে সৌন্দর্য্যরে প্রতীক। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শালীনতাকে ইমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেছেন। মানুষের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে নিকৃষ্ট যার অশ্লীলতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লোকেরা তাকে পরিত্যাগ করে (বুখারী)।

যার মধ্যে শালীনতাবোধ নেই, যার আচরণ অন্য মানুষকে আহত করে, যার অভদ্র আচরণে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অস্বস্তি সৃষ্টি করে, মানুষ যার কাছ থেকে দূরে থাকাকে নিরাপদ মনে করে তারা নিঃসন্দেহে অভিশপ্ত। এ ধরনের বদগুণের অধিকারীদের সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে ওই ব্যক্তি সবচেয়ে নিকৃষ্ট, যার অশালীন আচরণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষ তাকে পরিত্যাগ করে’ (বুখারি)।

সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি মহান নিয়ামত। যার স্বভাব-প্রকৃতিতে এই গুণ বিদ্যমান তিনি নিঃসন্দেহে পরম সৌভাগ্যবান। তবে অনেকেরই স্বভাব বেশ রুক্ষ ও উগ্র। এ ধরনের চরিত্রের মানুষদের পক্ষে সদাচারের গুণাবলি অর্জন করার জন্য একটু বেশি চেষ্টা চালানো দরকার। অবশ্য আল্লাহর কাছে কোনো কিছুই গোপন নেই; তিনি সবকিছুই দেখেন। যারা নৈতিক সচ্চরিত্রের গুণগুলো অর্জন করতে চান, আল্লাহ তাদের যথাযথ প্রতিদান দেন।
ইসলামে নৈতিক সৎ গুণের ব্যাপক প্রশংসা করা হয়েছে। এমনকি বলা হয়েছে, পরিপূর্ণ ইমানের অধিকারী হলেন তিনিই, যার চারিত্রিক গুণাবলি সুন্দর। সচ্চরিত্রের দুটি অর্থ আছে- একটি অর্থ হলো নৈতিকতার গুণাবলিতে ভূষিত হওয়া এবং পূর্ণতার সামগ্রিক ফজিলত অর্জন করার পাশাপাশি আত্মগঠন করার লক্ষ্যে মানুষের পছন্দনীয় গুণাবলি দিয়ে নিজের ভেতরটাকে সুসজ্জিত করা। নৈতিকতার দ্বিতীয় অর্থটি হলো সদা হাস্যোজ্জ্বল থাকা অর্থাৎ সবার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করা, হাসি-খুশি থাকা এবং অন্যদের সঙ্গে সদা উদ্যমী ও উৎফুল্ল থাকা।
সমাজের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে সামাজিক নীতি-নৈতিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে আত্মগঠন করা এবং নিজেকে যোগ্য ও সক্ষম করে তোলার জন্য এই গুণগুলোর বিস্তৃত ভূমিকা রয়েছে। সমাজ পারস্পরিক যোগাযোগ ও সম্পর্কের একটি বিস্তৃত ক্ষেত্র নিঃসন্দেহে। তাই সমাজে সুন্দর আচার-আচরণ, গ্রহণযোগ্য নৈতিকতা ও চারিত্রিক মাধুর্যের একটা বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।
ইসলামী পরিভাষায় নৈতিক সৌন্দর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বলতে বোঝায়, যিনি আনন্দচিত্তের অধিকারী, কোমল ও বিনম্রভাষী এবং মানুষের সঙ্গে হাসিখুশি ব্যবহার করেন। এই রূপটি যে কোনো পরিস্থিতিতে পরিবর্তন হয় না বরং অটুট থাকে। এমন স্বভাব-চরিত্রের লোকেরা যে সমাজে কী পরিমাণ জনপ্রিয় তা নিশ্চয়ই কারও অজানা নয়।

পক্ষান্তরে, যারা বদমেজাজি, রুক্ষ স্বভাবের, কর্কশভাষী, নির্দয়- সমাজে তাদের তেমন কোনো মর্যাদা নেই। আর এই ব্যক্তিত্বহীনতার পেছনে রয়েছে অনৈতিকতা এবং চরিত্রহীনতা। সুন্দর চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতা ধারণ করলে, অহঙ্কার ও স্বেচ্ছাচারিতার মতো বদগুণের লাগাম টেনে ধরলে জীবন হয় প্রশান্ত এবং সর্বাবস্থায় আত্মনিয়ন্ত্রণের ধৈর্যগুণসম্পন্ন। তবে সদাচার তখনই সাফল্যের মুখ দেখে, যখন ইমানের দৃঢ়তা থাকে, কোনোরকম মুনাফেকি কিংবা দ্বিমুখী চিন্তা থেকে দূরে থাকা যায়।
সংস্কৃতিবান মানুষ অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা থেকে বিরত থাকেন। এটা তাদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মু’মিনরা, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়ী, যারা অসার কার্যকলাপ বা অনর্থক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকে।’ (সূরা মু’মিনুন, আয়াত : ১-৩) রাসূল (সা.) বলেন, ‘ব্যক্তির জীবনে ইসলামের সৌন্দর্য প্রকাশ পায় তার অহেতুক কথা ও কাজ ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩১৮)

ব্যক্তিত্বের গুণ বোঝা যায় আচরণ-উচ্চারণে। মান-মর্যাদাও প্রকাশ পায় ব্যবহারে। অহেতুক কথা বিপদ টেনে আনতে পারে। তাই ইসলামে বাকসংযমের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তা সংরক্ষণের জন্য তার কাছেই (অদৃশ্য) তৎপর প্রহরী রয়েছে।’ (সূরা ক্বাফ: আয়াত -১৮)

কথার মাধ্যমে ভাববিনিময় মানুষের জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ইসলাম মুখ তালাবদ্ধ করে রাখতে বলেনি। বরং নম্রভাবে ও বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতে আদেশ দিয়েছে। নিজেকে প্রভু দাবিদার ফিরাউনের কাছে হযরত মুসা (আ.) ও হারুন (আ.)-কে যখন পাঠানো হয়, তখন আল্লাহ তা’য়ালা তাদের আদেশ দিয়েছিলেন, ‘তোমরা তার সঙ্গে নম্র ভাষায় কথা বলবে। (এতে) হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় পাবে।’ (সুরা ত্বাহা, আয়াত : ৪৪)

মহানবী (সা.) মানবজাতির অনুকরণীয় মহান উদার, বিনয়ী ও নম্র ব্যক্তিত্ব। তিনি উত্তম চরিত্র ও মহানুভবতার আধার। অবিস্মরণীয় ক্ষমা, মহানুভবতা, বিনয়-নম্রতা, সত্যনিষ্ঠতা প্রভৃতি চারিত্রিক গুণ দিয়েই তিনি বর্বর আরব জাতির আস্থাভাজন হয়েছিলেন। তিনি যে সৎচরিত্রের অধিকারী ছিলেন, তা সকলে একবাক্যে অকপটে স্বীকার করেছে। তিনি মানুষকে সদাচরণ, উত্তম ব্যবহার ও সততার মাধ্যমে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তার চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সূরা আল-কালাম, আয়াত: ৪) সব মানুষের জন্য অকৃত্রিম ও মহান আদর্শ। কল্যাণকর প্রতিটি কাজেই তিনি সর্বোৎকৃষ্ট। তার অসাধারণ চারিত্রিক মাধুর্য ও অনুপম ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আল-আহজাব, আয়াত: ২১)তাই কথাবার্তা, বাক্যালাপ, আচার-আচরণ ও সামগিগ্র জীবনযাত্রায় মহানবী (সা.)-এর আদর্শ হোক প্রতিটি মু’মিনের অনুসরণীয়।

সভ্য-সমাজের একটি চরিত্র হলো শালীনতা। শালীনতাকে সমাজের মানুষ নানাভাবে চিত্রায়িত করেন। কেউ হিজাব, কেউ পর্দা বা কেউ দৃষ্টি অবনত রাখা ইত্যাদি বলে ব্যাখা দেন। তবে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং পরস্পর মর্যাদা রক্ষার জন্য ইসলাম শালীনতাকে খুব গুরুত্ব দিয়েছে। অবশ্যই শালীনতা আমাদের ধর্মবিশ্বাসেরও অংশ। কোরআন ও হাদিসে নারী-পুরুষের পরস্পর সম্পর্ক, দেখা সাক্ষাৎ, আলাপচারিতা, টেলিফোন, চেটিং এবং পোশাকের সীমারেখাও নির্ধারণ করে দিয়েছে। কোরআনের এই আয়াতে প্রথমত পুরুষকে দৃষ্টির সংযম শেখালেন, চারিত্রিক পবিত্রতায় উৎসাহিত করলেন’ সঙ্গে নারীকেও শালীন জামা-কাপড়ের কথা বললেন। আরও বললেন, নারী তোমার রূপ-সুন্দর্য দেখবে কারা আয়াতের বলা আছে এমন ১২ শ্রেণির মানুষ। এর বাইরে যাকে দেখাবে তা শালীনতা বা সভ্যতা নয়।

শালীনতা মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মগুত গুণ হলেও পবিত্র কোরআনে শালীনতার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। হযরত লোকমান আ. তার প্রিয় পুত্রকে শালীনতার শিক্ষা দিয়েছন। হজরত লোকমান পুত্রকে বলেন, ‘হে পুত্র, অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কর না। পৃথিবীতে ঔদ্ধত্যভাবে চল না, কারণ আল্লাহ কোনো ঔদ্ধত্য অহংকারী ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। তুমি পদচারণ করবে সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করবে। নিশ্চয়ই স্বরের মধ্যে গাধার স্বর সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ১৯)
শালীনতা অর্থ মার্জিত, সুুন্দর ও শোভন হওয়া ভদ্রতা, নম্রতা, লজ্জাশীলতা প্রভৃতি। আচার-আচরণে, কথাবার্তায়, বেশভূষায়, চালচলনে সভ্য ও মার্জিত পন্থা অবলম্বন করাকে শালীনতা বলে। পোশাক আল্লাহর বিশেষ দান ও অনুগ্রহ। আল্লাহ তা’য়ালা মানবজাতিকে পোশাকের মাধ্যমে সম্মানিত ও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছেন। আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কোরআনে পোশাককে তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘হে মানব সন্তান, আমি তোমাদের পোশাক দান করেছি, যেন তোমরা তোমাদের আব্রু ঢাকতে পারো এবং তা (তোমাদের জন্য) সৌন্দর্য। আর খোদাভীতির পোশাকই উত্তম। এটা (পোশাক) আল্লাহর নিদর্শন, যদি তারা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সূরা আরাফ: আয়াত – ২৬)

শালীনতার বিপরীত হলো অল্লীলতা। গর্ব, অহংকার, ঔদ্ধত্য, কুরুচি, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ইত্যাদি শালীনতাবিরোধী অভ্যাস। শালীনতা হলো পোশাক এবং আচরণের একটি ধরণ, যার উদ্দেশ্য হলো অপরকে শারীরিক বা যৌন আকর্ষণে উৎসাহিতকরণ থেকে বিরত থাকা। তবে এর মানদন্ডের বিভিন্নতা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে, বলা যায় যে, শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অংশ ঢেকে না রাখাকে অনৈতিক এবং অশালীন বলে বিবেচিত হয়। অনেক দেশে, নারীদের পূর্ণরুপে পোশাকে আবৃত রাখা হয়, যেনো পুরুষেরা তাদের দ্বারা আকর্ষিত না হয় এবং তাদের জন্য পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য পুরুষদের সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ। আবার, যেখানে বিকিনি পরার প্রচলন স্বাভাবিক সেখানে এক টুকরো কাপড় পরাও শালীন বলে বিবেচিত হয়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই লোকসম্মুখে নগ্নতাকে অভদ্র শরীর প্রদর্শন মনে করা হয়।
শালীনতা মানুষের মানবিক গুণ যা জীবনকে মধুময়,সুুন্দর ও সার্থক করে । সমাজের সকল মানুষই সভ্য নয়। তবে যারা সভ্য ও শালীন তারা সমাজের আদর্শ ও প্রিয় মানুষ। ইসলাম প্রতিটি মানুষকে এই গুণে গুণান্বিত হওয়ার শিক্ষা দিয়েছে। শালীনতার প্রকারও অনেক। মুখের শালীনতা, ভাষার শালীনতা, চোখের শালীনতা, পোশাকের শালীনতা, কাজের শালীনতা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শের মূর্তপ্রতিক মুহাম্মদ (সা.) এর গোটা জীবনই ছিলো শালীনতায় পরিপূর্ণ। শুধু পরিপূর্ণ নয়, তিনি উম্মতের জন্য শালীনতার উত্তম আদর্শ রেখে গেছেন। তাঁর আচার আচরণে মুগ্ধ হয়েই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে হাজারও মানুষ। কথা বলতেন খুবই নম্র ভাষায়। কাউকে কোনো দিন গালমন্দ পর্যন্ত করেননি। মিষ্টি হাসির বিনিময়ে জয় করেছেন শত্রুর মন।

অনেক ইসলামী স্কলার বলে থাকেন, কিয়ামতের দিন সৎ চরিত্রবানদের হিসাব-নিকাশ সহজ করে নেওয়া হবে। তার মানে হলো, সচ্চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতা পাপের বোঝা কমিয়ে দেয়। নৈতিক সততা বহু পাপের কাফ্ফারা হিসেবে কাজ করে। তাই মানুষের উচিত এসব গুণে নিজেকে গুণান্বিত করা। মাধুর্যপূর্ণ ভাষা দিয়ে মুহূর্তেই কারও মন জয় করা যায়। আবার কর্কশ ভাষা অন্যের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাতে পারে। অশ্রাব্য ও কুরুচিপূর্ণ ভাষা এবং অহেতুক বাঁচালতা যেকোনো সমাজে নিন্দনীয়।

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম