মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
ঝালকাঠি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত একটি শহর ও নদী বন্দর। শহরটি দক্ষিণবঙ্গের বরিশাল বিভাগে অবস্থিত ঝালকাঠি জেলার জেলা শহর। শহরটি ঝালকাঠি জেলার সবচেয়ে বড় শহর এবং বাণিজ্য কেন্দ্র। শাসনিকভাবে শহরটি ঝালকাঠি জেলা এবং ঝালকাঠি সদর উপজেলার সদর দফতর। সুগন্ধা নদীর উত্তর তীরে এবং গাবখান খাল ও ধানসিঁড়ি নদীর পূর্বতীরে অবস্থিত এ শহরটি প্র্াচীনকাল হতেই ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত। ঝালকাঠি জেলায় রয়েছে বহুসংখ্যক নদ-নদী। কালের বিবর্তনে অনেক নদী মরা খালে পরিণত হয়েছে। তার মধ্যে ঐতিহ্যবাহী একটি নদী হলো পোনা নদী।
ঝালকাঠির রাজাপুরের ঐতিহ্যবাহী পোনা নদী খননের অভাব ও দখল দূষণের কারণে ধীরে ধীরে যৌবন হারিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। রাজাপুর উপজেলার দক্ষিণ রাজাপুরের আঙ্গারিয়া গ্রামের সত্যনগর এলাকার জাঙ্গালিয়া নদী থেকে শুরু করে আংগারিয়া, আলগী, জীবনদাসকাঠি, কৈবর্তখালী, গালুয়া, চাড়াখালি গ্রাম হয়ে ভান্ডারিয়ার কচানদী পর্যন্ত বাঁকে বাঁকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এ নদীর খরস্রোতায় পলি মাটির কারণে দু’পাশের কৃষকরা অধিক ফসল ফলাতো। বেশি বেশি প্রাকৃতিক মাছ জন্মাতো। কিন্তু বর্তমানে এ নদীটি মরা খালে পরিণত হওয়ায় তীরবর্তী অনেক গ্রামে পানি সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এই পোনা নদী দিয়ে এক সময় বড় বড় লঞ্চ, স্টিমার চলতো কিন্তু এখন নৌকাও চলছে না। বিভিন্ন স্থান দিয়ে পানি প্রবাহই হচ্ছে না।
উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ধানসিঁড়ি নদী নিয়ে কবি জীবনানন্দ দাশ কবিতা লেখায় বিশ্বের মানুষের কাছে অনেক পরিচিতি লাভ করলেও ওই নদীর চেয়ে পোনা নদীর গুরুত্বও কোনো অংশেই কম ছিলো না। অব্যাহত দূষণ-দখলে মরা খালে পরিণত হয়েছে ঝালকাঠির রাজাপুরের পোনা নদী। সেইসঙ্গে প্রতিনিয়ত ভরাট হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে পুরো উপজেলায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।
১৯৫০ সালের পরবর্তী সময়ে মাত্র ১০ ফুট গভীরতায় পোনা নদীটি খনন করা হয়েছিলো। দেশ স্বাধীণ হওয়ার পরে কয়েকবার খনন করা হলেও পূর্বের যৌবন ফিরিয়ে আনতে না পারায় নদীটি বর্তমানে মরা খালে পরিণত হয়েছে।
দেশের নদ-নদী দখল ও দূষণের কারণে ভয়াবহ আবার কোথাও জলে বিষ ঢেলে মারা হচ্ছে মাছ। কোথাও জলে এমনিতেই মিশছে বর্জ্য পদার্থ। দিনের পর দিন তাই দূষণ বাড়ছে। হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন নদীয়ালি মাছ। একসময় টেংরা,সরপুঁটি,বোয়াল, এমনকি নদীর রুই-কাতলাও দেখা যেতো। এখন আর ওই মাছের দেখা মেলে না। রুই, কাতলা বাজারে পাওয়া গেলেও তা চাষ করা হয় পুকুরে। হারিয়ে যেতে বসেছে বোয়াল মাছও।
ঔপনিবেশিক আমলে বাংলাদেশে নদীর (উপনদী-শাখা নদীসহ) সংখ্যা ছিলো এক হাজারের ওপরে। বিশেষজ্ঞদের মতে ষাটের দশকে সাড়ে সাতশ’ নদী ছিলো বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। বর্তমানের ২৩০ নদীর মধ্যে ৫৯টি আন্তর্জাতিক।এগুলোর মধ্যে ৫৪টি ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আদি যুগে সহজ যোগাযোগের কারণেই নদীতীরে সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো। বাংলাদেশে সত্তরের দশকেও নদীপথে পণ্য পরিবহন হতো বেশি। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ভারতের বাঁধের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ অন্যদিকে নেয়ায় এই চার দশকে ১৬ হাজার কিলোমিটার নদীপথ কমে গেছে।
মানবসভ্যতার অনন্য বাহন হচ্ছে নদী। সভ্যতাকে প্রাগ্রোসর করেছে নদী। জলপান থেকে যোগাযোগ নদীকেন্দ্রিক। নদীর মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করে মানুষ গড়ে তুলেছে শহর ও ব্যবসাকেন্দ্র। সঙ্গত কারণেই নদীর লালন ও রক্ষণ সব দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাদৃত। ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। পাঁচ দশক আগের হাজার নদীর দেশের তকমা হারিয়ে এখন বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা দুইশতে ঠেকেছে। সংখ্যা ও নাব্যতা দুই-ই হ্রাসের মাধ্যমে অবস্থা সঙ্গিন। এমনকি দেশের প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র রীতিমতো হুমকির মুখে। বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলো যে বিপুল পরিমাণ পলি সারাবছর বয়ে নিয়ে আসে, তার সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাবে অবস্থান পৃথিবীতে দ্বিতীয়। বাংলাদেশের নদ-নদীর সৃষ্টি ও বিস্তার নিয়ে আছে কিংবদন্তি ধর্মীয় পুরাণ,লোকগাথা ইত্যাদি। বাংলাদেশের বড় নদ-নদীগুলোর তর্জন-গর্জন প্রমত্ততা নিয়েও আছে নানা ইতিহাস।
বিশ্বব্যাপী নদীপথে যাত্রী ও মালপত্র পরিবহন সহজসাধ্য ও স্বল্পব্যয়ী মাধ্যম। অথচ আমরা প্রতিদিন নদীপথের আয়তন সংকুচিত করেছি। হাতে থাকা সুযোগকে আমরা সংকোচন করেছি নিজ স্থূল স্বার্থে। বাংলাদেশের নদীপথ এখন কেবল দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে চালু আছে। অথচ জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদ-নদীকে ধারণ করে আমাদের যাত্রাপথের অন্যতম মাধ্যম হতে পারত নদী। নদীপথ যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তাও নানা সংকটে পতিত। একসময় পোনা নদীতেও চলতো নৌকা কালের বিবর্তনে এখন এসব স্মৃতি।
এক সময়ের যৌবনা পোনা নদীর বুক চিরে চলতো বাহারী রঙের পালতোলা নৌকা। যে নদীকে নিয়ে শত বছর ধরে মাঝিমাল্লার জারী, সারী,ভাটিয়ালি ও পল্লীগানে মুখরিত হতো এ নদী,মাল বোঝাই বড় বড় নৌকা দাঁড়টেনে,গুণটানা দিয়ে নিয়ে যেতো কতক নৌশ্রমিক। পালতোলা নৌকায় চড়ে নববধূসহ কতশত নাউরি নাইওর যাইতো পোনা নদী দিয়ে, মাছ শিকার করে যুগের পর যুগ পার করেছে জেলে সম্প্রদায়,নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছিলো কতক জনপদ যাদের বলা হতো কৈবর্ত্য দাস, জালো বা মাঝি।দল বেধে গোসল করতো নর-নারী, শিশু কিশোর, আবাল- বৃদ্ধ-বণিতারা। ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি আর দেশীয়,পরিযায়ী পাখপাখালিদের বিচরণ আর খাদ্য সংস্থান হতো এ নদী।বাস্তুসংস্থান এর এক অনন্য নজির ছিলো আমাদের প্রাকৃতিক এ জলাধার। ডিঙি, ছিপ,বজরা,পানসি, খোল,ট্রলারসহ আরো কত রঙবাহারী নামের নৌকা,এ জলযান দিয়ে নদীর উত্তাল জলে ভেসে ভেসে যেতো দূরদূরান্তে। আজ সব কিছুই ইতিহাস আর অতিত দিনের স্মৃতিকথা ছাড়া আর কিছুই নয়।
নদীনির্ভর বাংলা কথাশিল্পের ধারাবাহিকতায় অবিস্মরণীয় কীর্তি নদী। জল ও জীবনের ঐকতান একাকার হয়ে যেনো বয়ে গেছে বিভিন্ন নদী। ঝালকাঠি জেলার নদীর প্রায় সব ক’টিই এখন আর কলস্বরা নেই। তার মধ্যে পোনা নদী একটি। পলির প্রভাবে নদীর তলদেশ ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে।অবৈধভাবে নদীর দুই পাশ ভরাট করায় এর প্রশস্ততা সংকুচিত হচ্ছে এবং নদীর গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে। একসময় এদেশের মানুষের জীবিকার উৎস ছিলো নদী। এই নদীগুলো কৃত্রিম কারণে ও সময়ের ধারায় আজ বিপর্যয়ের সম্মুখিন। তেমনি কৃত্রিম কারণে ও সময়ের ধারায় আজ বিপর্যয়ের সম্মুখিন খরস্রোতা পোনা নদীটি। দেশের প্রাণ নদী আর নদ-নদীকে কেন্দ্র করেই একসময় দেশের বিভিন্ন শহর গড়ে ওঠেছে। অর্থনৈতিক সম্ভাবনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দেশের নদ-নদী। অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় এই দেশটি আজ থেকে কতোটা বছর পেছনে ফেলে এসেছে।
১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে ও এদেশে মাকড়শার জালের মতো ছড়িয়ে ছিলো অসংখ্য নদী-উপনদী,শাখা-প্রশাখা নদী,ছড়া নদী,নালা নদী এবং অগণিত নদীখাত। অসংখ্য খাল-বিল-ঝিল ও হাওড়-বাওড়। কিন্তু আজ আর নেই সেসব সীমাহীন স্রোতস্বিনী ও প্রমত্তা নদীর বিশাল স্রোতধারা। মানুষ আজও বড় অসহায়। নদ-নদী সুরক্ষা নিয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে এখনো তৎপরতা দেখা যায় না অনেকেরই। নদী বেদখল হচ্ছেই। দূষণে প্রাণ হারাচ্ছেই সেই নদ-নদী। পৃথিবীতে প্রাণী জগৎ বেঁচে ধমনীতে যেমন রক্ত প্রবাহ জরুরি তেমনি দেশকে বাঁচাতে হলে সে দেশের বুকের ভেতর নদী প্রবাহ জরুরি। নদীর রূপ ও রূপান্তর নিয়ে সাহিত্য হয়নি, এমন কোনো ভাষা নেই। এমনকি লিপিহীন ভাষাতেও নদী নিয়ে রচিত হয়েছে বিস্তর উপাখ্যান। সাহিত্যের সব শাখায় কমবেশি এসছে নদী প্রসঙ্গে।বস্তুত মানুষের সমস্ত বিশুদ্ধ কল্পনায় নদী বা নদীবিশেষের প্রসঙ্গ সগর্বে উপস্থিত। জীবনের প্রাণ শক্তি নদীর সাথে। কালের আবর্তনে দখলের কবলে খরস্রোতা পোনা নদী। দেশের অন্যান্য জেলার মতো ঝালাকাঠি জেলার পোনা নদী উদ্ধার ও নাব্য হারিয়েছে যেসব নদী দখল-দূষণ রয়েছে সেসকল নদ-নদীকে বাঁচাতে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সকলের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের ২৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথের মধ্যে এখন মাত্র ৫ হাজার কিলোমিটার নদীপথ আছে। সরকার ইতিমধ্যে ৮০০ কিলোমিটার নদীপথ খননের কাজ হাতে নিয়েছে। এখন বড় প্রকল্পগুলো হাতে নেয়ায় নদীর নাব্যতা ফিরে পাবে এটা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক দিক। অর্থাৎ দেশের মধ্যে প্রবহমান অন্যান্য নদীর মতো পোনা নদীকে বাঁচানোই এখন সময়ের দাবি।
অবিরাম সৌন্দর্যে আঁকা নদীমাতৃক দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। এককালের প্রায় হাজার নদীর দেশ। জোয়ারভাটার দেশ। নদীমাতৃক বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে নদীভিত্তিক সমস্যার সমাধান করতে হবে দীর্ঘমেয়াদিভাবে। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের জীবন, জীবিকা ও সার্বিক উন্নতি নির্ভর করে নদীর ওপর।এ কারণে নদী সমস্যাকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ দেশের নদী বাঁচলে,মানুষ বাঁচবে। অর্থাৎ দেশের মধ্যে প্রবহমান অন্যান্য নদ-নদীর মতো পোনা নদীকে বাঁচাতে সরকারের পাশাপাশি সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ(কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান),সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক, গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট