মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
ইসলামী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় কর্জে হাসানার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। মহান আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টি লাভের আশায়, সওয়াবের নিয়তে বিনা শর্তে কাউকে কোনো কিছু ঋণ দিলে তাকে ‘কর্জে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ বলে। কর্জ অর্থ ঋণ বা ধার আর হাসানা অর্থ উত্তম। উভয়ে মিলে ‘কর্জে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ। যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ শুধু পাওনা আদায়ই নয়,বরং এটা ওয়াদা রক্ষার অন্তর্ভুক্ত।
ঋণ যথারীতি পরিশোধের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঋণ প্রদান করে ঋণদাতা গ্রহীতাকে উপকার ও অনুগ্রহ করে থাকে। কিন্তু ঋণ পরিশোধ কোনো অনুগ্রহ নয়, বরং ঋণগ্রহীতার ওপর এক অবধারিত দায়িত্ব। ঋণগ্রহীতার ওপর এটি ঋণদাতার অধিকার। এমনকি যদি ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করার পূর্বে মারা যায়, তাহলে কাফন-দাফনের পর প্রথমেই তার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে ঋণ পরিশোধ করে দিতে হবে। ঋণ পরিশোধের পর যদি অতিরিক্ত কিছু থাকে, তাহলেই কেবল তার ওয়ারিশদের মাঝে তা বণ্টন করা হবে এবং তাতে তার অসিয়ত কার্যকর হবে।
করজে হাসানা বা উত্তম ঋণ প্রদান প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,‘‘কে সেই ব্যক্তি? যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করবে, ফলে আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ, বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন। আর আল্লাহই রিজিক সংকুচিত করেন এবং বৃদ্ধি করেন আর তোমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।’’ (সূরা বাকারা : আয়াত ২৪৫)
ঋণের আদান-প্রদানে ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকা নিয়ে যেমন উপকৃত হয় এবং তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে, তেমনি ঋণদাতাও এর মধ্য দিয়ে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির সাহায্যে এগিয়ে আসে।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে একদিকে ঋণ প্রদানকে উৎসাহিত করা হয়েছে, অপরদিকে ঋণ পরিশোধের বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধে টালবাহানা করবে তাদের জন্যে হুঁশিয়ারিও উচ্চারিত হয়েছে।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, সচ্ছল ব্যক্তির (ঋণ পরিশোধে) টালবাহানা করা অন্যায়। -সহিহ বোখারি: ২৪০০
সময়মতো যেনো ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া যায় এজন্যে হাদিসে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ইমাম বোখারি (রহ.) বর্ণনা করেছেন, হযরত আবু যর (রা.) বলেছেন, আমি একদিন হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। একপর্যায়ে উহুদ পাহাড় তার দৃষ্টিগোচর হলে তিনি বললেন, ‘আমি চাই না- উহুদ পাহাড় আমার জন্যে স্বর্ণে পরিণত করে দেওয়া হলেও এর একটি দিনার আমার নিকট তিনদিনের বেশি সময় থাকুক; হ্যাঁ, যদি কোনো দিনার আমি আমার ঋণ পরিশোধের জন্যে রেখে দিই সেটা ভিন্ন। (সহিহ বোখারি: ২৩৮৮)
ঋণ পরিশোধের বিষয়টি একদিকে যেমন বাধ্যতামূলক, তেমনি হাদিস শরিফে এর ফজিলতের কথাও বর্ণিত হয়েছে। এতে প্রকারান্তরে যথারীতি ঋণ পরিশোধের প্রতি উৎসাহিতও করা হয়েছে। সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.)থেকে বর্ণনা, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি পরিশোধ করে দেওয়ার নিয়তে কারও নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করে আল্লাহ তা’য়ালা তার পক্ষ থেকে তা আদায় করে দেন। ’ (সহিহ বোখারি: ২৩৮৭)
সময়মতো প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। ঋণগ্রহীতা যেনো এ দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে পারে সেজন্যে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবাদের দোয়াও শিখিয়েছেন। অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আপনার হালাল বিষয়ের মাধ্যমে হারাম থেকে বাঁচান। এবং আপনার দয়া ও করুণা দিয়ে অন্যদের থেকে আমাকে অমুখাপেক্ষী করে দিন। (জামে তিরমিজি: ৩৫৬৩)
বোখারি শরিফে আছে, এক ব্যক্তির কাছ থেকে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কিছু ঋণ নিয়েছিলেন। সে এসে তার সঙ্গে কঠোর ভাষায় কথা বলতে লাগলো। তা দেখে সাহাবায়ে কেরাম তাকে মারতে উদ্যত হচ্ছিলেন। কিন্তু হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে ছেড়ে দাও,পাওনাদারের একটু কথা বলার অধিকার রয়েছে। (সহিহ বোখারি: ২৪০১)
সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করলে পাওনাদার অনেক সময় কটুকথাও বলে। ইসলামের শিক্ষা হলো- পাওনা টাকার জন্যে তাগাদা করার সময় ঋণদাতা যেন সহজ ও কোমল আচরণ করে, কোনো কটুবাক্য ব্যবহার না করে। কিন্তু এরপরও যদি সে কটুকথা বলে, অসুন্দর আচরণ করে, তাহলে ঋণগ্রহীতার উচিত তার সঙ্গে বাদানুবাদে কিংবা ঝগড়া-তর্কে জড়িয়ে না পড়া।
হযরত জাবের (রা.) বলেছেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার কাছ থেকে একবার ঋণ নিয়েছিলেন। পরে যখন তিনি তা আমাকে পরিশোধ করলেন, তখন আমার পাওনার চেয়েও বাড়িয়ে দিলেন। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৩৪৯) পাওনা পরিশোধকালে পাওনাদারের কৃতজ্ঞতা জানানো এবং তার জন্যে কল্যাণের দোয়া করা ইসলামের এক অনন্য শিক্ষা।
ঋণপরিশোধের সময় ঋণগ্রহীতা ইচ্ছা করলে ঋণদাতার অনুগ্রহের বদলাস্বরূপ তাকে কিছু টাকা বাড়িয়েও দিতে পারে কিংবা যে মানের সম্পদ ঋণ নিয়েছিল তাকে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট মানের জিনিস ফেরত দিতে পারে। বাড়িয়ে দেয়ার যদি স্পষ্ট কিংবা অস্পষ্ট কোনো পূর্ব কথা না থাকে, তাহলে এটা নিষিদ্ধ সুদের অন্তর্ভুক্তও হবে না। অনুগ্রহের বিনিময় তো অনুগ্রহ দিয়েই হতে পারে। প্রিয় নবী (সা.) এর জীবনালেখ্য থেকেও আমরা এ অনুগ্রহের শিক্ষা পাই।
হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) একবার সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবি রবিয়া (রা.)-এর থেকে চার হাজার দিরহাম ঋণ করেছিলেন। যখন তা পরিশোধ করলেন, তখন তিনি তার জন্য এ দোয়া করলেন, আল্লাহ তা’য়ালা তোমার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদে বরকত দান করুন। (সুনানে নাসায়ি: ৪৬৮৩) স্বাভাবিক জীবনে মানুষকে প্রায়ই ঋণ আদান-প্রদান করতে হয়। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেও মাঝে-মধ্যে ঋণ করতেন। এমনকি তিনি অমুসলিমদের থেকেও ঋণ গ্রহণ করতেন।
হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ঋণ আদায়ের সময় নিজের পক্ষ থেকে কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া শুধু বৈধই নয়, বরং মুস্তাহাব ও সুন্নত। তবে এ বাড়িয়ে দেওয়াটা যেনো কিছুতেই কোনো পূর্বনির্ধারিত শর্ত বা চুক্তির ভিত্তিতে না হয়। আগে থেকে এ ধরনের কোনো চুক্তি থাকলে তা সুদ হয়ে যাবে। কিন্তু কোনো ধরনের শর্ত ও চুক্তি ছাড়া সম্পূর্ণ নিজের পক্ষ থেকে ঋণগ্রহীতা যদি ঋণদাতাকে কিছু বাড়িয়ে দেয়, তাহলে সেটাই হবে অনুগ্রহ ইহসানের বিনিময়ে।
হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) একবার এক অমুসলিমের কাছ থেকে একটি উট কর্জ নিয়েছিলেন। তৎকালীন আরবে এ রীতি চালু ছিলো। টাকা-পয়সার মতো মানুষ প্রয়োজনে উট কর্জ নিতো। বয়স ও মানের দিক থেকে এমন আরেকটি উট দিয়েই এ ঋণ শোধ করতে হতো। কিছুদিন পর ঋণদাতা হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে ঋণ পরিশোধের তাগিদ দিলেন এবং কিছুটা কঠোরতা অবলম্বন করলেন। উপস্থিত সাহাবিরা তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদের জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের থামালেন এবং বললেন, তাকে কিছু বলো না। আমাদের কাছে তো তার একটি পাওনা আছে। আর পাওনাদাররা একটু শক্ত কথা বলতেই পারে। হ্যাঁ, তোমরা যদি পার, তার পাওনাটা পরিশোধের ব্যবস্থা করো। যে মানের উট সে পায়, সে মানের একটি উট কিনে এনে তাকে দিয়ে দাও। এ কথা শোনে সাহাবায়ে কেরাম অনেক খোঁজাখুঁজি করলেন, কিন্তু সে মানের কোনো উট পেলেন না। যা পেয়েছেন তা আরও ভালো মানের। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিষয়টি জেনে বললেন, ভালোটিই কিনে এনে তাকে দিয়ে দাও। হাদিসের ভাষ্যমতে, এখানে আরেকটি দিক প্রতিভাত হয়, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) অমুসলমানদের সঙ্গেও লেনদেন করেছেন। তাদের তুচ্ছ ও সাধারণ অধিকারগুলোকেও বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। তার হাতে গড়া মদিনার ইসলামি শাসনে অমুসলিমরা কী পরিমাণ নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা পেতো, এ হাদিসে তা ফুটে ওঠে।
ঋণপ্রদান- ঋণদাতার পক্ষ থেকে গ্রহীতার ওপর একটি অনুগ্রহ এতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকা এক সময় পরিশোধ করে দেবে; কিন্তু তার যখন দরকার, তখন তার হাতে টাকা নেই, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে কারও কাছ থেকে চেয়ে নেবে- এমন অবস্থাও হয়তো নেই। পরে তার নিজেরই টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা বিদ্যমান। এমন পরিস্থিতিতে ঋণের দ্বারস্থ হতে হয়। তাই পরে আদায়যোগ্য হলেও ঋণগ্রহীতার জন্য তা অবশ্যই এক বড় অনুগ্রহ। আর অনুগ্রহের বদলা তো অনুগ্রহ দিয়েই হয়।
বস্তুত পাওনা পরিশোধকালে পাওনাদারের কৃতজ্ঞতা জানানো এবং তার জন্য কল্যাণের দোয়া করা ইসলামের এক অনন্য শিক্ষা।
হযরত আবু উমামা (রা.) বিদায় হজ্জের ভাষণে নবী করিম (সা.) কে এই কথা বলতে শুনেছেন যে, ‘ধার নেয়া বস্তু ফেরৎ দেয়া অপরিহার্য’। (আবু দাউদ)
ইসলামী শরিয়ত ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছে। হাদিস শরিফে এসেছে- হযরত সামুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.)বলেন, ‘হাতের ওপর ওই বস্তুর দায়বদ্ধতা রয়েছে, যা সে গ্রহণ করেছে, যে পর্যন্ত না তা প্রাপকের নিকট ফিরিয়ে দেয়।’ (বুখারী)।
রাসূল সা. বলেছেন, ‘ত্বরাপ্রবণতা শয়তানের পক্ষ থেকে উদ্ভুত; তবে পাঁচটি ক্ষেত্র ব্যতীত : ১. বয়প্রাপ্ত হলে মেয়েকে বিয়ের ব্যবস্থা করা, ২. মেয়াদ এসে গেলে ঋণ পরিশোধ করা, ৩. কেউ মৃত্যুবরণ করলে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা, ৪. মেহমান আগমণ করলে তাকে আপ্যায়ন করা, ৫. গুণাহ হয়ে গেলে তাওবা করা।’ (মিনহাজ)। হাদিসসমূহ প্রমাণ করে যথাযথ ঋণ পরিশোধ অত্যাবশ্যক। ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সূরা নিসা এর ১১ থেকে ১৪ নম্বর আয়াতে। আয়াতসমূহে মহান আল্লাহ তা’য়ালা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এমনকি তিনি তাঁর বান্দাদের নির্দেশ দিয়েছেন যেনো মৃত ব্যক্তির ওসিয়ত ও ঋণ পরিশোধের পর তার পরিত্যাক্ত সম্পত্তি বন্টন করা হয়।ঋণমুক্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তা জান্নাতের কারণ। হাদিস শরিফে উলেখ রয়েছে যে, হযরত সাওবান (রা.) বলেন, রাসূলুলাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তির আত্মা অহংকার, আত্মসাৎ এবং ঋণ থেকে মুক্ত অবস্থায় দেহ ত্যাগ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (তিরিমিযী)।
ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করা এক প্রকার অর্থনৈতিক অপরাধ। ইসলাম এরকম অপরাধ নিরসনে নির্ণয় করেছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। হাদিস শরিফে এসেছে- হযরত শারীদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘ধনী ব্যক্তির গড়িমসি করা তার মানহানী ও শাস্তিকে বৈধ করে দেয়।’
হযরত ইবনুল মুবারক বলেন, ‘মানহানী হলো রাগান্বিত হওয়া আর শাস্তির অর্থ হচ্ছে বন্দী করা।’ (আবু দাউদ)। হযরত মাকহুল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুলাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই হকদারের রয়েছে হাত ও জিহ্বা।’ (দারে কুতনী)। অর্থাৎ- হাত বলে আটক করা ও বল প্রয়োগ করা এবং জিহ্বা বলে তাগাদা করা ও আইনের আশ্রয় নেয়া। (ইলাউসসুনান)।এক্ষেত্রে জরিমানা বা কোনোরূপ অর্থদন্ড ঋণপরিশোধকে বরং জটিল থেকে জটিলতর করার নামান্তর।
কিছু লোক আছেন, যারা কোনক্রমে ঋণ গ্রহণ করে তা পরিশোধের কথা বেমালুম ভূলে যান। এতে সামাজিক ন্যায়-নীতি প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং সংশিষ্ট ব্যক্তির সাথে ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন হয়। এক্ষেত্রে একটি আরবি প্রবাদ প্রচলিত আছে যে, ‘ঋণ ভালবাসার কাঁচি স্বরূপ।’ হযরত আব্দুলাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে গড়িমসি (দেবো-দিচ্ছি) করার অভ্যাস থাকে তবে সে দুষ্টু লোক। আর গড়িমসি করা এক প্রকারের জুলুম। (মুসান্নাফ ইবনু আবি শায়বা)।
হযরত মায়মুন কুরদি (রা.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুলাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি যে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কম বেশি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মহর ধার্য করে বিবাহ করে, কিন্তু মনে মনে স্ত্রীর হক আদায় করার ইচ্ছা রাখে না বরং ধোকা দিয়ে থাকে। অতঃপর পরিশোধ করা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করলো, তাহলে লোকটি কিয়ামতের ময়দানে আলাহ তা’য়ালার সামনে যিনাকারী হিসেবে উঠবে। আর যে ব্যক্তি কারো থেকে ঋণ গ্রহণ করে তা পরিশোধ করার ইচ্ছা রাখে না বরং ধোকা দিয়ে অন্যের মাল গ্রাস করে; অতঃপর সে অপরিশোধিত অবস্থায় মারা গেলে আল্লাহ তা’য়ালার সামনে চোর সাব্যস্ত হয়ে উঠবে।’ (তিবরানী)।
ঋণ পরিশোধ সহজভাবে সম্পন্ন করতে মহান আল্লাহ পাক লিখনীর ব্যবহারে গুরুত্বারোপ করেন। ঋণদানে গৃহীত চুক্তিসমূহ মানুষের মগজে সীমাবদ্ধ থাকলে তার ব্যাত্যয় ঘটা স্বাভাবিক। তাছাড়া সমাজে বিশৃঙ্খলা ও বিবাদ- বিসম্বাদের সূত্রপাত ঘটতে পারে। তাই আল্লাহ পাক এ বিষয়ে সতর্ক সংকেত প্রদান করে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যখন পরস্পরে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণের আদান-প্রদান করো, তখন তা লিখে নাও।’ (সূরা বাকারা : ২৮২)। এই আয়াতের অনুসরণে ঋণদান করলে পরিশোধ সহজীকরণ সম্ভব। সহজে ঋণ পরিশোধ করতে হলে ব্যবসা, পশু পালন, হস্ত শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানে অধিক মনযোগী হতে হবে এবং অকর্মণ্য লোকদের ব্যক্তিগত ঋণদান থেকে বিরত থাকতে হবে।
মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন, ‘আর ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি যদি অভাবী হয়, তাহলে তাকে স্বচ্ছল হওয়া পর্যন্ত অবকাশ দাও। আর যদি ঋণ মাফ করে দাও, তাহলে সেটা তোমাদের জন্য আরও উত্তম, যদি তোমরা তা জানতে।’ (সূরা বাকারা : ২৮০)। আয়াতে বর্ণিত অবস্থায় ঋণ গ্রহণকারীকে অবকাশ প্রদান করার পরও যদি স্বচ্ছলতা ফিরে না আসে, তবে তা পরিশোধ করারদায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর বর্তাবে। রাষ্ট্রের যাকাত-ফিতরার ফান্ড থেকে এ ঋণ শোধ করার নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। আল্লাহ তা’য়ালা কোরআনে কারিমে মানুষকে উত্তম ঋণ প্রদানের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। উত্তম ঋণের বহুগুণ বিনিময় ঘোষণা করেছেন। যাতে মানুষ পরস্পরের বিপদে এগিয়ে আসে।
সাক্ষ্য দিতে ডাকা হলে সাক্ষীরা যেনো অস্বীকার না-করে। ঋণ যদি নির্দিষ্ট মেয়াদের ভিত্তিতে হয়, তাহলে তা ছোট-বড় যা-ই হোক, লিখে রাখার ব্যাপারে হেলাফেলা করবে না। কারণ, আল্লাহর কাছে এটা বেশি সুবিচারপূর্ণ, প্রমাণ হিসেবে বেশি নির্ভরযোগ্য এবং তোমাদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে তাৎক্ষণিক লেনদেন হলে না-লিখলে সমস্যা নেই। আর যখন পরস্পর বেচাকেনা করো, তখন সাক্ষী রাখো। চুক্তিলেখক বা সাক্ষীর কাউকেই কোনো ক্ষতি করা যাবে না। করলেই তোমাদের অপরাধ হবে। আল্লাহর প্রতি সাবধান! আল্লাহই তোমাদের শেখান। আর আল্লাহ সবকিছুই ভালোভাবে জানেন। (আল-বাকারাহ ২৮২)
হযরত মুহাম্মদ (সা.) মানুষকে তাদের ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে অনেক সতর্ক করেছেন। ঋণ পরিশোধের গুরুত্ব সম্পর্কে রয়েছে অসংখ্য হাদিস। যেমন-হযরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, ‘কোনো ব্যক্তি ঋণ রেখে মারা গেলে রাসূল (সা.) ওই ব্যক্তির জানাজা পড়াতেন না বরং অন্যকে পড়াতে নির্দেশ দিতেন। বুখারির এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন- ‘যে ব্যক্তি কারও কাছে কর্জ নেয় এবং তা আদায় করার নিয়ত রাখে না, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেবেন।’
মহান আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কোরআনে মানুষকে উত্তম ঋণ প্রদানের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। উত্তম ঋণের বহুগুণ বিনিময় ঘোষণা করেছেন। যাতে করে মানুষ পরস্পরের বিপদে এগিয়ে আসে এবং একে অপরকে সহযোগিতা প্রদান করে। আর্থিক ইবাদতের মধ্যে অন্যতম হলো ‘কর্জে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ। কর্জে হাসানা বা উত্তম ঋণ প্রদান প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা’য়ালা সূরা আল ইমরানের ৯২ আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন-‘কখনো তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু আল্লাহ তা’য়ালার রাস্তাায় ব্যয় না করবে।’ অন্যত্র সূরা বাকারার ২৪৫ আয়াতে এরশাদ হয়েছে-‘‘কে সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করবে? ফলে আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ, বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন। আর আল্লাহ তা’য়ালাই রিজিক সংকুচিত করেন ও বৃদ্ধি করেন। তোমাদের তাঁঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।’’
হযরত ছোহায়েব (রা.) বর্ণনা করেন, ‘যে ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করেছে কিন্তু তা পরিশোধ করার ইচ্ছা পোষণ করেনি, সে ব্যক্তি চোর সাব্যস্ত হয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে’ (ইবনে মাজাহ, তারগিব)। হযরত বারা ইবনে আজে (রা.) বর্ণনা করেন, ‘ঋণী ব্যক্তি ঋণের কারণে নিঃসঙ্গ-বন্দি জীবনযাপন করবে এবং তা অশান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে থাকবে। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য ঋণ পরিশোধ করা অত্যন্ত জরুরি। এ কারণেই কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর যদি সে ঋণগ্রস্ত হয়ে থাকে, তবে তার সম্পদ থেকে প্রথমে ঋণ পরিশোধ করা জরুরি। তঃপর বাকি সম্পদ অংশীদারদের জন্য প্রযোজ্য। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি ইসলামের জন্য শাহাদাতকার ীও হয়, তবু তাকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
ঋণ একটি অত্যাবশ্যকীয় ও মানবীয় বিষয়। আবহমান কাল থেকে ঋণ প্রথা দুনিয়াতে চালু রয়েছে। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে ঋণ ছাড়া চলা অকল্পনীয়।এক কথায় ঋণ ছাড়া দুনিয়ার অর্থনীতি, ব্যবসা বানিজ্য একেবারে স্থবির ও বিকল হতে বাধ্য। এ ছাড়া ঋণ আদান-প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন অটুট ও মজবুত হয়। এজন্য ইসলাম, ঋণ প্রদানে মানুষকে যেমন উৎসাহিত ও সোয়াবের কাজ বলে অভিহিত করেছে, ঠিক তেমনি ঋণ পরিশোধের ব্যাপারেও গুরুত্ব আরোপ করেছে।
ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে হাদীসে অনেকবার তাগিদ দেয়া হয়েছে। ইসলামে ঋণ দেয়াকে যেমন মানুষের সাহায্য তথা তাদের কষ্ট দূরীকরণের জন্য স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, তেমনি ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে উত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করার কথা বার বার বলা হয়েছে। ‘আর তাই গৃহিত ঋণ পরিশোধ করার সময় বেশি বা উত্তম ফেরত দেয়াকে শরীয়তের ভাষায় ‘হুসনুল্ কাযা’ বা উত্তম পরিশোধ বলা হয়।’
রাসূলুল্লাহর এই হাদীস থেকে বোঝা যায় যে রাসূল (সা.) ঋণ নেয়া থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন কিন্তু যদি কেউ খুব বিপদের পরে ঋণ করে তাহলে যেনো তা অবশ্যই পরিশোধ করে। এই বিষয়ে রাসূলের বিদায় হজের ভাষণে হযরত আবু উমামা (রা.) নবী করিম (সা.)-কে এই কথা বলতে শুনেছেন যে, ‘ধার নেয়া বস্তু অবশ্যই ফেরত দেয়া অপরিহার্য।’ (আবু দাউদ)
ঋণগ্রহীতাকে হঠাৎ চাপ প্রয়োগ বা ত্বরিত আদায়ে বাধ্য না করা। কেননা সঙ্কটের কারণেই মানুষ ঋণ করে। এ ঋণের চাপে তাকে দিশেহারা বা অন্যত্র হাত বাড়াতে বাধ্য করা অমানবিক। এক্ষেত্রে তাকে অবকাশ দিতে হবে। কিংবা একটা সময় বেঁধে দিয়ে সে পর্যন্ত অপেক্ষা করা। ঋণগ্রহীতার প্রতি করুণাও করা যেতে পারে। ইসলামি শরিয়তে তা জায়েজ আছে।
অনেকে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধে ইচ্ছাকৃত বিলম্ব করে থাকে কাজটি সুস্পষ্ট অন্যায়। ঋণগ্রহীতার মনে রাখা উচিত- ঋণদাতা তার ওপর অনুগ্রহ করেছে, এ অনুগ্রহের পরিবর্তে তার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করাই কর্তব্য। সময়মতো যদি তার ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য না থাকে, তাহলে সে সৌজন্য রক্ষা করে ঋণদাতাকে তা জানাতে পারে, তার কাছ থেকে আরও কয়েকদিন সময় চেয়ে নিতে পারে। কিন্তু সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ যথাসময়ে আদায়ে টালবাহানা করা- হাদিসে একে সরাসরি জুলুম বলা হয়েছে।
লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট