মো:আলতাফ হোসেন ঃঃ
ইসলাম মানুষকে সুন্দর জীবন দিয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে সুন্দর জীবনের জন্য সুন্দর নীতিমালা প্রদান করেছে। কারণ ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানুষের জীবনে প্রতিটি বিষয়, প্রতিটি দিক সম্পর্কে ইসলাম সুষ্ঠু ও সুন্দর দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। একজন মুসলমানের জীবন ও মুনাফেকের জীবন এবং জীবন পদ্ধতি এক হতে পারে না। মুসলমান ও মুনাফেকের মাঝে বিশদ পার্থক্য রয়েছে। মুনাফেক বলা হয় যারা মুখে এক কথা বলে কিন্তু অন্তরে অন্য কথা ও বিশ্বাস লালন করে। মুনাফেকদের কথা ও কাজে কোনো মিল থাকে না। আর একজন মুনাফেকের উদ্দেশ্য কেবলই দুনিয়া। আখেরাতের প্রতি তার কোনো বিশ্বাস ও ভরসা নেই। আর মুসলমান বলা হয়, আল্লাহ তা’য়ালার একান্ত অনুগত বান্দাকে। একজন মুসলমানের জীবনের উদ্দেশ্য দুনিয়া এবং আখেরাত উভয়টাই। একজন মুসলমান আখেরাতকে প্রাধান্য দেয় এবং দুনিয়ায় ভালো থাকার জন্য সৎ ও হালাল পথে জীবনযাপনের চেষ্টা করে।
ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে সাধারণত সমাজে তিন ধরনের লোক পাওয়া যায়। মুসলিম, নন মুসলিম আর মোনাফিক। আল্লাহর রাসূল (সা:) এর জামানায়ও এই তিন ধরনের লোকের পরিচিতি ছিলো। পবিত্র কোরআনে তাদের সম্বন্ধে খুবই জোরালোভাবে আলোচনা এসেছে। তাদের মধ্যে মুনাফিকেরা ছিলো অন্যতম। তারা মুসলিম সমাজের জন্য এমনই ভয়ঙ্কর ছিলো যে,তাদের ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য আল্লাহ তা’য়ালা ও তাঁর রাসূল (সা.)কে পবিত্র কোরআনের একেবারে প্রথম দিকেই তাদের থেকে সতর্ক থাকার জন্য বলে দিয়েছেন।
মুনাফিক আরবিতে এর বহুবচন মুনাফিকুন একটি ইসলামি পরিভাষা যার অর্থ একজন প্রতারক বা “ভন্ড ধার্মিক” ব্যক্তি। যে প্রকাশ্যে ইসলাম চর্চা করে; কিন্তু গোপনে অন্তরে কুফরী বা ইসলামের প্রতি অবিশ্বাস লালন করে। আর এ ধরনের প্রতারণাকে বলা হয় নিফাক। কোরআনের শতাধিক আয়াতে মুনাফিকদের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং মুসলমানদের জন্য তাদের অমুসলিম শত্রুদের তুলনায় মুনাফিকদেরকে অধিক বিপজ্জনক শত্রু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কোরানে ইরশাদ করেছেন, মুনাফেকের জন্য রয়েছে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্থান।
নবিজি (সা.) মুনাফেকের আলামত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, মুনাফেকের আলামত তিনটি। এক. যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে। দুই. ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি দিলে তা ভঙ্গ করে। তিন. কোনো কিছু আমানত রাখলে খেয়ানত করে। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের সবার ইমানি দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো নিজের নামটা যেনো কোনোভাবেই মুনাফেকের তালিকাভুক্ত না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা। কারণ আমার নাম যদি মুনাফেকের তালিকাভুক্ত হয়, জাহান্নাম আমার জন্য ওয়াজিব হয়ে যাবে। তাই জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য মুনাফেকের আলামত-আমল ত্যাগ করতে হবে। জীবনের প্রতিটি কাজে, প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে কোনোভাবেই মুনাফেকের কোনো আলামত নিজের মাঝে না আসে। কারণ যার মাঝে নিফাকের আলামত থাকবে তার কোনো আমলই কবুল হবে না। যে মুসলমানের মাঝে নবিজির (সা.) বর্ণিত তিনটি আলামত কিংবা তিনটির কোনো একটি পাওয়া যাবে,সে মুনাফেক।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। নবী করীম (সা.) বলেন, মুনাফিকের আলামত তিনটি- কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে, আর তার কাছে কোনো আমানত রাখলে তার খেয়ানত করে। (বুখারী)
মুখে মধু মনে বিষ, গিরগিটির মতো ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো মানুষগুলোকে আমরা মুনাফিক বলে থাকি। এরা খুব চালাক প্রকৃতির হয়। ফলে এদের জালে আটকা পড়ে থাকতে হয় সরলমনা মু’মিনদের। এরা সব সময় মানুষকে ব্যবহার করে, কিন্তু কখনো কারো কল্যাণে কাজ করে না। সুযোগ পেলেই মানুষের ক্ষতি করে বসে। মহান আল্লাহ এ ধরনের লোকদের পছন্দ করেন না। এদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তর।
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে। আর তুমি কখনো তাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী পাবে না।’ (সূরা নিসা, আয়াত : ১৪৫) এ ছাড়া এমন অনেক অভ্যাস আছে, যেগুলোকে পবিত্র কোরআন-হাদিসে মুনাফিকদের অভ্যাস বলা হয়েছে। যেমন নামাজে অলসতা : নামাজে অলসতা ও লোক দেখানো নামাজ এ দুটিকেই কোরআনের ভাষায় মুনাফিকের অভ্যাস বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয়। আর (আল্লাহ) তিনি তাদের ধোঁকায় ফেলেন। আর যখন তারা নামাজে দাঁড়ায় তখন অলসভাবে দাঁড়ায়, তারা লোকদের দেখায় এবং তারা আল্লাহকে কমই স্মরণ করে।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৪২)
জামাতে অংশগ্রহণ না করা : যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া জামাত তরক করাকেও সাহাবায়ে কেরাম মুনাফিকের আলামত বলেছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমরা মনে করি যার মুনাফিকি সর্বজনবিদিত এমন মুনাফিক ছাড়া কেউ-ই জামাতে নামাজ আদায় করা ছেড়ে দেয় না। অথচ রাসূল (সা.)-এর যুগে এমন ব্যক্তি জামাতে উপস্থিত হতো যাকে দুজন মানুষের কাঁধে ভর দিয়ে এসে নামাজের কাতারে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো। (মুসলিম, হাদিস : ১৩৭৪)
দ্বিমুখী আচরণ করা : আমাদের সমাজে মানুষের মতো দেখতে এমন কিছু প্রাণী আছে, যারা সব মহলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ঘন ঘন রং বদলায়। সবার কাছে মহৎ সাজতে চায়। মূলত তারা এভাবেই মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে। রাসূল (সা.)-এর যুগেও এমন মুনাফিক ছিলো। মহান আল্লাহ বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘আর যখন তারা তোমাদের নিকট আসে, তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি। অথচ অবশ্যই তারা কুফরি নিয়ে প্রবেশ করেছে এবং তারা তা নিয়েই বেরিয়ে গেছে। আর আল্লাহ সে সম্পর্কে জ্ঞাত, যা তারা গোপন করতো।’ (সূরা মায়েদা, আয়াত : ৬১)
বাচাল হওয়া : বাকপটু লোকদের সব কথা বিশ্বাস করতে নেই। এটি নিফাকের একটি শাখা মাত্র। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘লজ্জা, সমভ্রম ও অল্প কথা বলা ঈমানের দুটি শাখা। অশ্লীলতা ও বাকপটুতা (বাচালতা) নিফাকের (মুনাফিকির) দুটি শাখা।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২০২৭)
অশ্লীলতা পছন্দ করা : বর্তমান যুগে অনেকেই অশ্লীল কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। কিছু কিছু বিষয় এমন হয়ে পড়ছে যে সেগুলোকে গুণাহই মনে করা হচ্ছে না। অথচ অশ্লীলতা পছন্দ করা মুনাফিকের অভ্যাস। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারীরা একে অপরের অংশ, তারা মন্দ কাজের আদেশ দেয় আর ভালো কাজ থেকে নিষেধ করে, তারা নিজেদের হাতগুলোকে সংকুচিত করে রাখে। তারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে; ফলে তিনিও তাদের ছেড়ে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই মুনাফিকরা হচ্ছে ফাসিক।’(সুরা তাওবা, আয়াত : ৬৭)
মিথ্যা বলা : গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলা মানুষগুলো সবার প্রিয়,আস্থাভাজন হয়। কিন্তু পবিত্র কোরআনে এদের মুনাফিক বলা হয়েছে, এদের থেকে সাবধান থাকা উচিত। এ রকম লোকদের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সাবধান করেছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘যখন তোমার কাছে মুনাফিকরা আসে, তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ জানেন যে অবশ্যই তুমি তাঁর রাসূল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী।’(সূরা মুনাফিকুন,আয়াত : ১)
ধোঁকা দেওয়া : ধোঁকা মুনাফিকদের অভ্যাস। তারা সব সময় মানুষকে ধোঁকা দেবে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে,‘তারা আল্লাহকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদের ধোঁকা দিচ্ছে। অথচ তারা নিজেদেরই ধোঁকা দিচ্ছে এবং তারা তা অনুধাবন করে না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ৮-১০)
ওয়াদা ভঙ্গ করা : নবী করিম (সা.) বলেছেন, মুনাফিকের চিহ্ন তিনটি : যখন সে কথা বলে, তখন মিথ্যা বলে, যখন সে ওয়াদা করে, তখন তা ভঙ্গ করে, আর যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় সে তা খিয়ানত করে। (বুখারি, হাদিস : ৬০৯৫)
আমানতের খিয়ানত : মুনাফিক লোকদের কাছে আমানত রাখা হলে তারা তা রক্ষা করে না। রাসূল (সা.) এই অভ্যাসকে মুনাফিকের চিহ্ন বলেছেন। (বুখারি, হাদিস : ৬০৯৫)
গান-বাজনায় মগ্ন থাকা : গান-বাজনা মানুষের অন্তরে মুনাফিকি সৃষ্টি করে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, পানি যেমন (ভূমিতে) তৃণলতা উৎপন্ন করে তেমনি গান মানুষের অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে।(ইগাসাতুল লাহফান (১/১৯৩,আবু দাউদ,হাদিস : ৪৯২৭,তাফসিরে কুরতুবি : ১৪/৫২)। তাছাড়া মানুষকে আল্লাহর জিকির থেকে অমনোযোগী করে।
নিফাক দুই ধরনের ১.বিশ্বাসগত নিফাক ২. কর্মগত নিফাক। বিশ্বাসগত নিফাক একটি বড় কুফর যা মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে দেয়। এগুলো আবার ০৬ প্রকার। রাসূল (সা.)কে মিথ্যা সাব্যস্ত করা, অথবা রাসূল যে দ্বীন নিয়ে এসেছেন তার কোনো কিছুকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা, কিংবা রাসূলকে ঘৃণা করা, অথবা রাসূল যে দ্বীন নিয়ে এসেছেন তাকে ঘৃণা করা, রাসূলের দ্বীনের ক্ষতিতে খুশি হওয়া অথবা রাসূলের দ্বীনের বিজয় অপছন্দ করা। কর্মগত নিফাক হলো ছোট কুফর যা মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে না। তবে এটি বড় ধরনের অপরাধ ও মহাপাপ।
মুনাফিকি তথা কপটতা একটি মারাত্মক রোগ। বিশ্বাসগত দিক থেকে কুফরির নিকৃষ্টতম প্রকার হলো মুনাফিকি। যার ভিতরের অবস্থা প্রকাশ্যের বিপরীত তাকে নিফাক বলে। যার মধ্যে নিফাক রয়েছে সে মুনাফিক। নবী করিম (সা.) এর যুগে মুনাফিকদের ওহীর মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়েছে। আজও মুনাফিকদের চরিত্র বর্তমান সমাজে রয়েছে। দিন দিন এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
যার ভেতরের অবস্থা বাহ্যিক প্রকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় সেই মুনাফিক। মিথ্যা বলা, ওয়াদা ভঙ্গ করা এবং আমানত খেয়ানত করা হলো মুনাফিকের পরিচয়। মুনাফিকের পরিচয় সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তরা যখন ঈমানদার লোকদের সঙ্গে মিলিত হয় তখন বলে আমরা ঈমান এনেছি। কিন্তু যখন নির্জনে তারা তাদের শাইতানদের সঙ্গে মিলিত হয় তখন তারা বলে, আসলে আমরা তোমাদের সঙ্গেইে আছি, আর আমরা তাদের সঙ্গে ঠাট্টাই করি মাত্র। (সূরা বাক্বারাহ : আয়াত ১৪)
ইসলামের দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে শত্রুর চাইতে মুসলিম বেশধারী মুনাফিকরা ইসলামের ক্ষতিসাধন করেছে সবচেয়ে বেশি। মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল মহানবী হযরত মুহাম্মা (সা.) এর জমানায় মদিনার পরিবেশ বিষিয়ে তোলে,আউস-খাজরাজ এবং আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে দ্বন্দ ও বিবাদ তৈরি করে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে দুর্বল করার ব্যর্থচেষ্টা চালায়। স্পেনে আমর ইবনে হাফসুন, পশ্চিমবঙ্গে মীরজাফর এবং দাক্ষিণাত্যে মীর সাদিক শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্বধর্ম, স্বজাতি ও স্বদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে এবং মুসলমানদের ঐক্যের পরিবেশ নষ্ট করে দেয়, শত্রুর হাত শক্তিশালী করে,বৈদেশিক আগ্রাসী শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে। আল্লাহ তা’য়ালা ওহির মাধ্যমে মহানবী করিম (সা.)কে মুনাফিকের পরিচয় ও অবস্থান চিহ্নিত করে দিতেন। ফলে তিনি তাদের চক্রাক্ত ও কর্মকান্ড আগেভাগে অবগত হয়ে যেতেন। তিনি সাহাবি হযরত হুজাইফা (রা.)-কে মদিনার মুনাফিকদের একটি তালিকা প্রদান করেন। এ কারণে তাকে ‘সাহিবু সিররে রসুল’ বা রসূলুল্লাহ (সা.)-এর গোপন তথ্য জানা ব্যক্তি বলা হতো।
মুখের কথার সঙ্গে অন্তরের ভাবনার যার মিল নেই সে মুনাফিক। হাদিসের ভাষায় এ বদভ্যাসকে বলা হয় ‘নিফাক’ যার অর্থ দ্বিমুখিতা ও কপটাচার। অন্তরে কুফরি রেখে মুখে ইসলাম ঘোষণা করাকে নিফাক বলা হয়। অর্থবিত্ত ও পার্থিব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের জন্য তারা এ ঘৃণ্যপথ অবলম্বন করে। ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান। তাদের অন্তর কলুষিত ও ব্যাধিগ্রস্ত। মুনাফিকরা মুখে ইমানের দাবি করলেও মুমিন নয়; তারা আল্লাহকে ধোঁকা দিতে চায়; তারা বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলে। মুনাফিকদের জন্য এশার ও ফজরের নামাজ কঠিন বোঝাস্বরূপ।
মুনাফিকি তথা ভন্ডামী বা কপটতা একটি মারাত্মক রোগ। মুনাফিকরা মূলত দুমুখো সাপ যার অন্তরে কুফরি থাকে এবং মুখে নিজেকে মু’মিন বলে দাবি করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরা কাফিরও না আবার মু’মিনও না বরং এর মাঝামাঝিতে এদের অবস্থান। এরা ইসলাম তথা পুরো মানবসমাজের জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ।
মুনাফিকদের মৃত্যুর পরে তাদের জানাযা পড়া নিয়ে রাসূল (সা.) এর একটি হাদীসও বর্ণিত আছে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন যে- আব্দুল্লাহ বিন উবাই নামক মুনাফিক নেতা যখন মৃত্যু বরণ করলেন তখন তার ছেলে আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে বলল যে, হে রাসূল আপনার পরিধেয় কাপড়টি চাই আমার পিতার কাফনের কাপড় হিসেবে এবং আপনি আমার পিতার জানাযার নামাজ পড়াবেন ও তার আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করবেন।
এ কথা শুনে রাসূল তার কাপড় দিলেন এবং জানাযার নামাজ পড়ানোর জন্য যথা সময়ে প্রস্তুতি নিলেন। এই কথা হজরত ওমর (রা.) শোনা মাত্র এসে রাসূলুল্লাহর জামা টেনে ধরলেন এবং বললেন হে রাসূল, মুনাফিকদের জানাযা পড়াতে মহান আল্লাহ তা’য়ালা আপনাকে নিষেধ করেননি কি? তখন রাসূল (সা.) বললেন দোয়া পড়া না পড়া উভয় আমার ইচ্ছা, আল্লাহ পাক এই ব্যাপারে আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। এই কথা বলে রাসূল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের জানাযা পড়ালেন।
এই ঘটনার পরে মহান আল্লাহ পাকের তরফ থেকে রাসূল (সা.) এর কাছে ওহী নাজিল হলো যে, ‘হে রাসূল (সা.), মুনাফিকদের কেউ মারা গেলে আপনি তাদের জানাযার নামাজ আদায় করবেন না এমনকি তাদের কবরের পাশেও দাঁড়াবেন না।’ (সূরা: আত -তাওবাহ, আয়াত: ৮৪)
মুনাফিক একটি ভয়ঙ্কর শব্দ। মুনাফিক শব্দটি শুনলেই শরীর শিউরে ওঠে। মানব সমাজের সবচেয়ে ক্ষতিকর দোষ হচ্ছে মুনাফিকী। মুনাফিক আরবি শব্দ। এর মানে দু’মুখো ব্যক্তি। যে ব্যক্তি দু’মুখো নীতি অবলম্বন করে, যে কুফুরি গোপন করে নিজেকে মু’মিন বলে প্রকাশ করে সে ‘মুনাফিক’ এরূপ ব্যক্তি কাফিরও নয়, মু’মিনও নয়; বরং এর মাঝামাঝি। এরা ইসলাম, মুসলমান তথা গোটা মানব সমাজের জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।
মুনাফিক একটি নিকৃষ্ট চরিত্রের নাম। আমাদের সমাজে কিছু মুসলমান রয়েছে যারা নামে ইসলামকে ব্যবহার করে কিন্তু কাজে নয়। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এর আমলেও এ ধরনের মুসলমান ছিলো। তাদের কারণে তখনো মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছিলো। মুনাফিক অর্থ হলো কথায় এবং কাজে দ্বিমুখী আচরণ করা। মুখে এক রকম এবং কাজে আরেক রকম ভাব পোষণ করা। মুনাফিকেরা মানুষের সামনে এক ধরনের এবং পেছনে আরেক ধরনের আচরণ করে থাকে।
ঈমানের ক্ষেত্রে মুনাফিকী এতো জঘন্য ও ভয়ানক যে, তাদের জন্য কেউ যদি ক্ষমা প্রার্থনা করে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর নবীকে বলেছেন,‘‘তাদের জন্যে আপনি ক্ষমা প্রার্থনা করেন আর নাই করেন উভয় তাহাদের ক্ষেত্রে সমান। আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না।’’ (সূরা মুনাফিকুন: আয়াত-৬)
মুনাফিক শব্দটি নিফাক শব্দমূল থেকে এসেছে, যার অর্থ কোনো কিছুকে গোপন রেখে এর বিপরীত কথা বা কাজ প্রকাশ করা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মুনাফিক বলা হয় ওই ব্যক্তিকে, যে অন্তরে কুফরি ও ইসলামবিরোধিতা রেখে মুখে ও প্রকাশ্যে ইসলাম প্রকাশ করে এবং মুসলমান হওয়ার দাবি করে। এরা কেন এ কাজ করে, এর ব্যাখ্যায় কোরআনের এক আয়াতে বলা হয়েছে, তারা আল্লাহ ও মু’মিনদের ধোঁকা দিতে চায়, আসলে তারা নিজেদের সঙ্গেই প্রতারণা করছে, কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করতে পারছে না। সূরা বাকারা, আয়াত : ৯
মু’মিন একজন পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি। তাঁর মধ্যে শিরক, ফিসক,নিফাক,মিথ্যা, হিংসা, লোভ, রাগ ইত্যাদির সংমিশ্রণ ঘটে না, বিশেষ করে ঈমানদারের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হলো নিফাক তথা দ্বিমুখী আচরণ করা। নিফাক মুমিন থেকে ঈমান বের করে দেয়। মুমিনদের মধ্যে এ নিফাক থাকা অনুচিত। কেননা এ বৈশিষ্ট্যের কারণে তার সব সদ্গুণ বদগুণে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
মুনাফিক হলো এমন ব্যক্তি যে ইসলামকে মুখে প্রকাশ করে এবং অন্তরে কুফরিকে লালন করে। মুনাফিকের চরিত্র : আল্লাহ তা’য়ালা সুরা বাকারার ৮ থেকে ২০ পর্যন্ত মোট ১৩টি আয়াত মুনাফিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে নাজিল করেছেন। তা ছাড়া বিভিন্ন সূরায় আরো ৩৮টি আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা করেছেন।
আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন,‘‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী’’। (সূরা মুনাফিকুন;আয়াত-১)আল্লাহ তা’য়ালা আরো এরশাদ করেন যে, ‘‘তারা কোনো দলেই স্থির থাকে না। না এ দলে না অন্য দলে অর্থাৎ না মুসলমানদের দলে না কাফিরদের দলে।’’ (সূরা নিসা: আয়াত-১৪৩)
মুনাফিকী একটি মারাত্মক ব্যাধি। এ ব্যাধি মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে ঠেলে দেয়। মানুষের মনকে কলুষিত করার যতরকম ব্যাধি আছে তন্মধ্যে মুনাফিকী অন্যতম বড়ো ব্যাধি। মুনাফিক শব্দটি একবচন, বহুবচন মুনাফিকুন। এটি একটি ইসলামী পরিভাষা যার অর্থ কোন জিনিস গোপন করা, বিচ্ছিন্ন হওয়া, প্রতারণা করা ও দ্বিমুখী নীতি বিশিষ্ট হওয়া।
সজারু তার গর্তের মধ্যে থেকে বের হওয়ার জন্য কয়েকটি মুখ রাখে। একটি মুখ নরম মাটি দিয়ে বন্ধ করা থাকে। রাস্তাটি দেখতে বন্ধ মনে হলেও আসলে বন্ধ নয়। কোনো দুশমন দ্বারা আক্রাক্ত হলেই সে গোপন নরম মাটির মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়। এ গোপন রাস্তাটি দিয়ে বের হওয়ার নাম ‘নাফিকা’। মানুষের মধ্যে এরূপ যে করে সেই মনুাফিক। মুনাফিক মানুষের চরিত্রও তাই। সে সুবিধাভোগী। সুযোগ পেলেই সে তার মত পাল্টায়। এমনকি নিজ ধর্ম ত্যাগ করতেও বাধ্য হয়। বিভিন্ন ধরনের মুনাফিক রয়েছে।আক্বীদা, বিশ্বাসে ও কাজে। যার মধ্যে যতটুকু মুনাফিকের আলামত আছে সে সে হারে ততটুকুই মুনাফিক। তবে আক্বীদাগত মুনাফিক অত্যন্ত মারাত্মক ক্ষতিকর।
আরো মারাত্মক যে গোপনে ইসলামী কাফেলায় প্রবেশ করে ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধন করে। মুনাফিকরা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কাফির মুশরিকদের চেয়েও ক্ষতিকর। কাফির-মুশরিকরা তো মুসলমানদের চিরশত্রু এটা তাদের জানা। তাই মুসলমানরা কাফির-মুশরিকদের থেকে সর্বদা সতর্ক থাকে। কিন্তু মুনাফিকরা মুসলমানদের রূপ ধরে মুসলমানদের মধ্যে অবস্থান করে গোপনে গোপনে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী ষড়যন্ত্র করে মুসলমানদেরকে তিলে তিলে ধ্বংস করে। মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র সব সময় আঁচ করা যায় না। এজন্য মুনাফিকরা ইসলাম, মুসলমান ও গোটা মানব সমাজের জন্যই মারাত্মক হুমকি। মুনাফিকদের পরিচয় করা অতি কঠিন এজন্য যে, তারা মুসলমানদের মতো নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, ভালো ভালো কথা বলে এমনকি এতো বেশি বেশি ইবাদত করে যা দেখে মুমিন-মুসলমানরা অবাক হয়ে যায়- মুসলমানরা তাদের ইবাদতকে অতি তুচ্ছ মনে করে। মপরশাদ হচ্ছে- “তুমি যখন তাদের (মুনাফিকদের) দিকে তাকাও তাদের দেহাকৃতি তোমার নিকট প্রীতিকর মনে হয়!” (সূরা মুনাফিকুন, আয়াত: ৪)
মুনাফিকী একটি প্রাণঘাতী মানসিক রোগ এবং নিন্দনীয় স্বভাব। নবী করিম (সা.) এহেন স্বভাবের অধিকারীকে বিশ্বাসঘাতক, আত্মসাৎকারী, মিথ্যুক ও পাপাচারী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা মুনাফিক মনে যা লুকিয়ে রাখে, বাইরে তার উল্টোটা প্রকাশ করে। সে সত্য বলছে বলে দাবী করে অথচ সে জানে যে সে মিথ্যুক। সে দাবী করে আমানত রক্ষা করার, অথচ সে ভালই জানে যে সে তা আত্মসাৎকারী। সে আরও দাবী করে যে, সে অঙ্গীকার পালনে অত্যন্ত দৃঢ় অথচ সে অঙ্গীকার ভঙ্গকারী। সে তার প্রতিপক্ষের নামে বানোয়াট সব দোষ বলে বেড়ায় অথচ সে ভালো করেই জানে তার এসব দোষারোপের মাধ্যমে সে পাপাচারী হচ্ছে। সে মারাত্মক অপরাধ করছে। সুতরাং তার স্বভাব চরিত্রের পুরোটাই ধোঁকা ও প্রতারণার ওপর দন্ডায়মান।
আল্লাহ তা’য়ালা সূরা বাকারার ১৬ নম্বার আয়াতে এরশাদ করেন,‘‘এরাই হেদায়েতের বিনিময়ে অন্ধকার ক্রয় করেছে। তাদের এই ব্যবসা লাভজনক হয়নি। তারা হেদায়েত প্রাপ্তও নয়। ’’ ১৬-১৭ আয়াতে মুনাফিকদের ব্যাপারে কোরআনে ২টি উপমা দেয়া হয়েছে। ১. এক ব্যক্তি আগুন প্রজ্জলিত করলো। সেই আগুন যখন চারদিকে আলোকিত করলো, আল্লাহ হঠাৎ করে সেটি নিভিয়ে দিলেন। ফলে অন্ধকার সবাই পথ হারিয়ে ফেলল। ২. আকাশে বিদ্যমান ঘন কালো মেঘ। মেঘের বিদ্যুৎচমকে তার চোখ ঝলসে যায়। যখন ক্ষণিক আলো দেখা যায় তখন তারা সামনে এগিয়ে চলে। যখন বিদ্যুৎচমক থেকে যায় তখন তারা থমকে দাঁিড়য়ে যায়। তাফসীর ইবনে কাসীর এর মতে এখানে দুই ধরনের মুনাফিকের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। এক ধরনের মুনাফিক প্রথম দিকে ঈমানের স্বাদ পায় ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে কুফুরের দিকে চলে যায়। কিন্তু বাহ্যিকভাবে ঈমানদারের খোলস পড়ে থাকে। আরেক ধরনের মুনাফিক যখন ঈমানের সংস্পর্শে আসে তখন কোরআন এর বাণী তাদের অন্তরকে কাপিয়ে তোলে। তারা তা সহ্য করতে না পেরে কানে আঙ্গুল দেয়। আবার কুফরি পরিবেশে গেলে ভিন্ন হয়ে যায়।
লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,লেখক,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট