মোঃ আলতাফ হোসেন ঃঃ
দুর্নীতি দেশের প্রধান অন্তরায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, আমলা নয়, মানুষ সৃষ্টি করুন। মানুষ সৃষ্টি করতে হলে অবশ্যই শিক্ষা ব্যবস্থা স্বচ্ছ এবং দুর্নীতি মুক্ত হতে হবে। কোনো রাষ্ট্রের উন্নতি তার পর্যটন শিল্প, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ক্রিকেট খেলার উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে ঐ রাষ্ট্রের শিক্ষার উপর। যে দেশের মানুষের প্রকৃত দেশপ্রেম থাকে না সে দেশ যথার্থ উন্নয়ন করতে পারে না। দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ। দুর্নীতির মুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠী তৈরী করা যেতে পারে। বর্তমান
সরকার শিক্ষাবান্ধব সরকার। প্রধান মন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা শিক্ষার মানোন্নয়নে আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। একটি অসুস্থ ধারার বিকলাঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থায় ভর করে পুরো জাতি আগামীতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে বিষয়ে এখনই পরিকল্পনা নির্দিষ্ট করা দরকার। বাংলাদেশে মোটামুটি চার স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চতর স্তর (বিশ্ববিদ্যালয়)। এই হলো আমাদের শিক্ষার প্রচলিত কাঠামো। এই চার স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে আছে আরো নানা উপস্তর (মক্তব, গ্রামভিত্তিক শিক্ষা, কওমি শিক্ষা, তথাকথিত ইংরেজি মাধ্যম ইত্যাদি)। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাস্তর আগের চেয়ে আধুনিক হয়েছে এবং পাঠ্যক্রমে যুক্ত হয়েছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, এমনটিই শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন। কিন্তু ভেতরের খবর খুবই হতাশাব্যঞ্জক। আমাদের অবুঝ শৈশবে আমরা যে প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছি সেই শিক্ষাকে যদি বর্তমান দৃষ্টিকোনে ত্রুটিপূর্ণ বলে ধরা হয়, তাহলে এই প্রশ্ন করা নিশ্চয়ই অসঙ্গত নয় যে, সেই ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা নিয়েই আমরা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক শিক্ষার সমস্ত সুযোগ পেয়েও, পরীক্ষায় সোনালি প্রতীক (গোল্ডেন এ+) পেয়েও কেন এ যুগের শিক্ষার্থীরা দুই জনের বেশি বিশ^বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পার না তা পুরো জাতিকে চিন্তিত করে তুলেছে।
বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাগুলো খুললেই প্রায়শ একটি শব্দ ঘুরে-ফিরে চোখে পড়ে প্রশ্ন ফাঁস। শব্দটি শুনলেই এখন ভয়ে আঁতকে ওঠে সচেতন নাগরিক সমাজ। তাই এর নাম দিলাম ভয়ংকর শব্দ। প্রশ্ন ফাঁস শব্দটি প্রতিটি শিক্ষার্থী এবং রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য বাধাস্বরূপ। একটি রাষ্ট্র প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে তার শক্তিশারী অবস্থানটি তৈরি করে নেয় মেধা দিয়ে। যে রাষ্ট্র মেধার দিক থেকে যত দুর্বল, সে রাষ্ট্র বিশে^ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে তত ভঙ্গুর। আর বাংলাদেশে চলছে সস্তায় মেধা বিক্রি নামক ব্যবসা। বিভিন্ন ধরণের কোটার পাশাপাশি মেধা ধ্বংসের মাধ্যম হিসাবে অন্যতম এখন প্রশ্ন ফাঁস। শিক্ষা বলতে সাধারণ অর্থে বোঝায় জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগত জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়াই হলো শিক্ষা। ব্যক্তির মধ্যে অভিজ্ঞতার বিন্যাস করে বলে শিক্ষাকে সামাজিক অগ্রগতির হাতিয়ারও বলা হয়। সেই শিক্ষায় যদি খুঁত থাকে তাহলে সামাজিক অগ্রগতি কি করে সম্ভব ?
২০১৭-১৮ স্নাতক (সম্মান) শিক্ষাবর্ষের চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে এবং মেডিক্যালের প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রায় প্রতিবছর। তাছাড়া ১৯ মে ২০১৭ সালের অগ্রণী ব্যাংকের চাকরির পরীক্ষা স্থগিত করা হয় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে অভিযোগ উঠে। গত বছরের ৬ অক্টোবর সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। এছাড়া এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষায় প্রশ্ন প্রতি বছর ফাঁস হচ্ছে। ৫০০ টাকা থেকে ২৫,০০০ টাকায় মিলে যাচ্ছে এসব সোনার হরিণ প্রশ্ন। শিক্ষা ব্যবস্থায় বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে এই প্রশ্ন ফাঁস নামক এক ভাইরাস। ভাইরাসটি আস্তে আস্তে বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামোর প্রতিটি স্তরে বিষাক্ত রক্ত কণিকার মত অবস্থান করছে। নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাবলিক পরীক্ষা, চাকরির পরীক্ষাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস এখন রীতিমত ডাল-ভাত। তার সঙ্গে সর্বশেষ যোগ হলো গত বছরের ঢাবি স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় ‘ডি’ ইউনিটের প্রশ্ন ফাঁস। এই ঘটনা শুধু জাতিকে অবাক করেনি বরং শঙ্কিত করেছে বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা কোথায় যাচ্ছে?
প্রশ্ন ফাঁসের কারণে প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীগুলো ঝরে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে বাঙালি জাতি তৃতীয় বিশ্বের তৃতীয় শ্রেণির মেধায় পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না। একটি রাষ্ট্র তখনি উন্নত হয় যখন তার শিক্ষা কাঠামো এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্তরগুলো স্বচ্ছ ও সুগঠিত হয়। তাই এগুলো প্রতিরোধ করার জন্য এখনি জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে রাষ্ট্রকে। পাবলিক পরীক্ষায় নতুন নিয়ম অনুযায়ী সচিব ব্যতীত অন্য কেউ পরীক্ষাকেন্দ্রে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। অর্থাৎ হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকও ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না, এটি অবশ্যই একটি ভালো পদক্ষেপ কিন্তু জালিয়াতি রোধের জন্য যথোপযুক্ত নয় বলে মনে হয়।
কেননা প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে থাকে। সাধারণত পরীক্ষার আগে রাতে কিংবা পরীক্ষার দিন সকালে। এর জন্য প্রত্যেক শিক্ষা বোর্ডের মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে। মনিটরিং সেলটি গঠন করা হবে বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে। অন্য সদস্যরা হবেন বিভাগীয় শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, বিভাগীয় শিক্ষা কর্তকর্তা, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা পুলিশ সুপার। সব থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ হলো ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধ আইন’ প্রণয়ন করা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ। যেহেতু সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা কেরও ঠেকাতে পারছে না জালিয়াতি চক্রকে। তাই কঠোর আইনি পদক্ষেপ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই রাষ্ট্রের হাতে। রাষ্ট্রকে মেধার যত্ন নিতে হবে দেশ এবং জনগণের জীবন ব্যবস্থার গঠনমূলক অগ্রগতির জন্য।
শিক্ষাকে যেহেতু জাতির মেরুদন্ড বলা হয়, তাই সেখানে দুর্নীতি অযোগ্যতা থাকার অর্থ হচ্ছে গোটা জাতির অস্তিত্বই হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া। একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্ট সকলেরই সচেষ্ট থাকা জরুরি। যেখানে চীন, ভারত কোরিয়া শিক্ষাখাত এবং অর্থনৈতিকখাতে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়ে বিশ্বকে শাসন করতে চাইছে, সেখানে বাংলাদেশ শিক্ষা ব্যবস্থার অচল অবস্থাই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। শিক্ষা খাত থেকে দুর্নীতির মূল উপড়ে ফেলে শিক্ষা খাতকে তথা শিক্ষা ব্যবস্থাকে করতে হবে পবিত্র। এর মাধ্যমেই তরুণ প্রজন্ম সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এই প্রিয় মাতৃভূমিকে বিশ্বের মানচিত্রে এনে দেবে ডালা ভরা সম্মান আর সর্বোচ্চ মর্যাদা।
লেখক: সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ(কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান) চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব
সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি, গবেষক,শিক্ষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট