মানুষের সব কাজের মূল পরিকল্পনাকারী হচ্ছে ক্বলব

মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
রূহের মন্ত্রণালয় হলো ক্বলব । ক্বলব বা অন্তঃকরণ হলো-দেহের মূল অংশ, যার মাধ্যমে রূহ দেহের সাথে সংযুক্ত হয়। ক¦লব হলো কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের ন্যায়, যা নুরানী পর্দার মাধ্যমে রূহের সাথে এবং জৈবিক পর্দার মাধ্যমে নাফসের সাথে সংযুক্ত থাকে। বস্তুত ক্বলব ও দেহের সমন্বয়ে মানুষ গঠিত। তবে এর মধ্যে ক্বলবই হচ্ছে আসল। দেহ হচ্ছে আবরণ মাত্র। দেহের হিদায়াতের চেয়ে ক্বলব এর হিফাযত আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মূলত ক্বলবই হচ্ছে হিদায়াতের কেন্দ্রবিন্দু।

আল্লাহ সংগীয় ফিরিশতা, বিবেক, ভালো মাতা-পিতা, ভালো অভিভাবক, ভালো স্বামী-স্ত্রী, ভালো আত্মীয়-স্বজন, ভালো বন্ধুমহল, ভালো পরিবেশ থেকে ক্বলবের মধ্যে সর্বদা ভালো পরামর্শ ও নসীহত প্রেরিত হয়। আবার তাগুতী শক্তি, সংগীয় শয়তান, রিপুসমূহ, দেহের কামনা, খারাপ মাতা-পিতা-অভিভাবক, খারাপ নেতা, খারাপ স্বামী-স্ত্রী, খারাপ আত্মীয়-স্বজন, খারাপ বন্ধুমহল ও খারাপ পরিবেশ কলবের মধ্যে সর্বদা খারাপ পরামর্শ ও ওয়াসওয়াসা প্রদান করে থাকে।

ক্বলব বা হৃদয়সমূহ হলো কল্যাণের আধার। ক্বলবের সঙ্গে কল্যাণ শব্দটি যুক্ত হয়ে এসেছে আল্লাহর বাণীতেও : ‘আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তরে কোনো রকম মঙ্গলচিন্তা রয়েছে বলে জানেন; তবে তোমাদের তার চেয়ে বহুগুণ বেশি দান করবেন, যা তোমাদের কাছ থেকে বিনিময়ে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া তোমাদের তিনি ক্ষমা করে দেবেন। বস্তুত আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়।’ (সূরা আনফাল : ৭০)। অতএব, যে হৃদয়ে মঙ্গল রয়েছে, তা পরিমাণে যতো কম হোক না কেনো, সেটি ইমানের জন্য উš§ুক্ত হবেই। আল্লাহ তা’য়ালার এ বাণীতে একটু লক্ষ করুন : ‘তাদের অন্তরে আল্লাহ ইমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদের শক্তিশালী করেছেন তাঁর অদৃশ্য শক্তি দ্বারা।’ (সূরা মুজাদালা : ২২)। আল্লাহ জাল্লাহ শানুহু আরো বলেন : ‘কিন্তু আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ঈমানের মহব্বত সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তা হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন।’ (সূরা হুজুরাত : ৭)।

ক্বলব-রূহের সংযোগ। মাতৃগর্ভে শুক্রানু ও ডিম্বানুর মিলনের মাধ্যমে সন্তানের সুত্রপাত হতে হলে তার জন্য রূহ নির্দিষ্ট থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট রূহ আল্লাহর হুকুমে রিমোট কন্ট্রোলে মাতৃগর্ভে তার বসবাসের উপযোগী দেহ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। ৪০ দিনের মধ্যে সর্বপ্রথম ক্বলব তৈরি হয়। ১২০ দিনে যখন দেহটি পূর্ণাঙ্গ আকৃতি পায়, তখন আল্লাহ তা’য়ালা দেহের সাথে রূহের সংযোগ স্থাপনের জন্য রূহটিসহ জনৈক ফিরিশতাকে প্রেরণ করেন। ক্বলব ও রূহের সংযোগস্থলে নাফস তৈরি হয়। ফিরিশতা তখন আল্লাহর হুকুমে কতিপয় ইলহাম ও তাকদীর (যেমন- হায়াত, মৃত্যু, রিযিক ইত্যাদি) নাফস-এর মাঝে সেট-আপ করে দেন। মূল সংযোগ কলবের সাথে হলেও দেহের সর্বত্র এর প্রভাব বিস্তৃত হয়। দুনিয়ায় আগমনকালীন রূহ-কলব-নাফস সবই পরিশুদ্ধ থাকে এবং সন্তান ইসলামের ওপর জন্ম নেয়। পরে রূহের তিন অবস্থার মত কলবেরও তিন অবস্থার যে কোনো এক অবস্থায় পরিণতি লাভ করে।

নিশ্চয়ই শুভ পরিণতি শুধুমাত্র মুত্তাকীনদের জন্য নির্ধারিত। নবী করিম (সা.) বলেন : নিশ্চয়ই মানুষের দেহে এক টুকরা গোশত আছে, যখন তা পবিত্র হয় তখন সমস্ত দেহই পবিত্র হয়ে যায়, আর যখন তা অপবিত্র হয়ে যায় তখন সমস্ত দেহই অপবিত্র হয়ে যায়, আর জেনে রাখো তা হলো ক্বলব। (বুখারী ও মুসলিম)

আল্লাহর নাফারমানী, নাফসের তাবেদারী ও দুনিয়ার মহব্বতে নানাবিধ পাপের কারণে ক¦লবের ওপর দাগ পড়তে থাকে, ফলে কলব ক্রমাগত অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অসুস্থ হতে থাকে। ক্বলবের এই অসুস্থতা নাফসের মাধ্যমে কামনা-বাসনা, চরিত্র ও আচরণে প্রকাশিত হয়। কিন্তু বিবেকের সতর্কতা ও কলবের নসিহত গ্রহণ করার মতা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় না। ক্বলবের এই অবস্থাকে রোগগ্রস্ত কলব বলে। যারা নাফসে লাউয়ামা পর্যায়ের পাপী মু’মিন তাদের ক্বলব হলো রোগাগ্রস্ত কলব। যেমন-আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : আর যাদের অন্তরে রোগ আছে, তা তাদের কলুষের সাথে (ক্রমাগত পাপের কারণে) আরও কলুষ বৃদ্ধি করেছে। (সূরা তওবাহ : আয়াত-১২৫) তিনি আরও বলেন,কখনোও না, বরং তাদের অন্তরসমূহে তাদের কৃত পাপের কারণে মরিচা ধরেছে। (সূরা মুতফফিফীন : আয়াত-১৪) তিনি আরও বলেন,যাদের ক্বলবের মধ্যে ব্যাধি রয়েছে, আপনি দেখবেন, তারা অতি দ্রুত ইহুদি-খৃষ্টান-মুশরিকদের সাথে মিলিত হবে। তারা বলবে, আমরা আমাদের ওপর যে কোনো রকমের বিপদ আপতিত হওয়ার আশংকা করি। অচিরেই আল্লাহ বিজয় দান করবেন কিংবা তাঁর নিকট থেকে এমন কিছু দেবেন যাতে তারা অন্তরে যা লুকিয়ে রেখেছিল সে জন্য লজ্জিত হবে। (সূরা মায়িদা : আয়াত-৫২)

রোগগ্রস্থ ক্বলব ক্রমাগত পাপের কারণে ক্বলবের ওপর দাগ পড়তে পড়তে সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। তাদের কৃতকর্ম ও আল্লাহ দ্রোহীতার কারণে শক্ত আবরণে ঢেকে যায়। ফলে আল্লাহ তাদের ক্বলব সিলগালা করে দেয় । বিবেকের সতর্কতা ও নসিহত গ্রহণ করার মতা একেবারে হারিয়ে যায়। ক¦লবের এই অবস্থাকে বলা হয় মোহরাংকিত কলব। এ হলো নাফসে আম্মারা সাথে সংশ্লিষ্ট মুনাফিক, তাগুত, কাফির, মুশরিক, ইহুদী, নাসারা ও জালিমদের কলব। যেমন, আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, নিশ্চয়ই যারা কাফির, আপনি তাদেরকে সতর্ক করুন অথবা না করুন, তাদের জন্য দুটোই সমান, তারা ঈমান আনবে না। আল্লাহ তাদের অন্তর ও কানসমূহের ওপর (অবিরাম আল্লাহদ্রোহীতা ও নাফারমানীর কারণে) মোহর মেরে দিয়েছেন, তাদের চোখসমূহের উপর রয়েছে পর্দা এবং তাদের জন্য আছে চরম শাস্তি। (সূরা বাকারাহ : আয়াত ৬-৭) তিনি আরও বলেন,আর আমি বহু জ্বিন এবং মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তারা তা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে না, তাদের চোখ আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখার চেষ্টা করে না, তাদের কান আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনার চেষ্টা করে না। তারা পশুর মত, এমনকি পশুর চেয়েও বেশি নিকৃষ্ট। বস্তুত তারাই উদাসীন। (সূরা আরাফ : আয়াত-১৭৯)

রোগগ্রস্থ কলব যখন উপযুক্ত চিকিৎসা ও সাধনার মাধ্যমে রোগমুক্ত, পবিত্র ও আয়নার মত পরিষ্কার হয়ে যায়, তখন ঐ ক্বলবকে কলবুন সালীম বা নিষ্কলুষ কলব বলা হয়। কলবের এ অবস্থা হল নাফসে মুতমাইন্নাহ এর সাথে সংশ্লিষ্ট খাঁটি মু’মিনগণের ক্বলব । যেমন, আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনো কাজে আসবে না, শুধু সে-ই উপকৃত হবে যে আল্লাহর কাছে পরিশুদ্ধ ক্বলব নিয়ে হাজির হবে। -(শুয়ারা : আয়াত ৮৮, ৮৯) তাকওয়া ভিত্তিক গঠিত, রোগমুক্ত, পবিত্র ও নিষ্কলুষ ক্বলব আল্লাহ তা’য়ালার বিরাট নিয়ামত এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বশ্্েরষ্ঠ সম্পদ। ক্বলব চিকিৎসার জ্ঞান অর্জন এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সবার জন্যই ফরজ। কারণ, আল্লাহর দরবারে ক্বলবুন সালীম বা নিষ্কলুষ ক্বলব ছাড়া কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়।
মৌলিক চিকিৎসা হলো ঐ সমস্ত চিকিৎসা যা ক্বলবের মরিচা বা কালিমা দূর করার জন্য সরাসরি ক্বলবের ওপর প্রয়োগ করা হয়। সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি হলো-আল্লাহর জিকির দ্বারা ক্বলবের মরিচা বা কালিমা দুর হয়ে যায় এবং ক্বলব পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, তারা এমন লোক, যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর যিকরে তাদের অন্তর প্রশান্ত হয়। হুঁশিয়ার! আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়। (সুরা রাদ : ২৮)

হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন : প্রত্যেক জিনিস পরিস্কার করার জন্য যন্ত্র বা রেত আছে। আর কলবসমুহকে পরিষ্কার করার যন্ত্র হলো আল্লাহর জিকির (বায়হাকী, ইবনে আবী শাইবাহ, তাবরানী মিশকাত) জিকির কয়েক প্রকার, যথা- (১) জিকরে আমালী- আল্লাহর স্মরণে নেক আমল করা। (২) জিকরে লিসানী- আল্লাহর স্মরণে কোরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ-তাহমীদ-তাহলীল-তাকবীর পাঠ, দুরূদ পাঠ, মাসনুন দোয়ার আমল, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা ইত্যাদি। (৩) জিকরে ক্বলবী- দাড়ানো, বসা, শায়িত সর্বাবস্থায় আল্লাহকে হাজির নাজির জানা। (৪) জিকরে মালী- আল্লাহর মহব্বতের আশায় আল্লাহ প্রদত্ত মহব্বতের ধন-সম্পদ থেকে আল্লহর পথে দান করা।

হযরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্র্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই ক্বলবসমূহে মরিচা পড়ে যেমন লোহায় পানি লাগলে মরিচা পড়ে। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটা পরিষ্কার করার উপায় কি? জবাবে তিনি বললেন : মৃত্যুকে খুব বেশি স্মরণ করা আর কোরআন তিলাওয়াত করা। দুনিয়ায় প্রচলিত যাবতীয় আইন-কানুন, বিধি-বিধান, রসম-রেওয়াজের মহব্বতের রোগে রোগগ্রস্থ ক্বলবের চিকিৎসার জন্য নবী করিম (সা.) এর মহব্বত ও সুন্নাতের অনুসরণের মজবুত নিয়াত ও কামনা-বাসনা ক্বলবের মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্র্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, শয়তান মানুষের কলবের মধ্যে আসন গেড়ে বসে থাকে। যখন সে আল্লাহর জিকির করে তখন শয়তান ক্বলব ছেড়ে পিছনে সরে যায়। আর যখন জিকির থেকে অমনোযোগী হয়ে যায়, তখন আবার (কলবের মধ্যে) ওয়াস-ওয়াসা দিতে থাকে।

হযরত আবু যার (রা.) থেকে বর্র্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেছেন : তুমি যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় করো। খারাপ কাজ হয়ে গেলে পরপরই ভাল কাজ কর, তাতে খারাপ (গুণাহের কালিমা) দূরীভূত হয়ে যাবে। আর মানুষের সাথে উত্তম ব্যবহার কর। (তিরমিযী-১৯৩৭ : হাসান ও সহীহ্) হযরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণি, নবী করিম (সা.) বলেছেন, কিয়ামুল লাইল (তাহাজ্জুদ) তোমাদের ওপর বিধিবদ্ধ করে নাও। কেননা তা হচ্ছে তোমাদের সলিহীন বান্দাগণের অভ্যাস ও ঐতিহ্য, তোমাদের প্রভুর নৈকট্য লাভের উপায়, গুণাহসমূহের কাফ্ফারা এবং পাপসমূহের প্রতিবন্ধক। (তিরমিযী)

হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন , যখন কোনো মু’মিন বান্দা গুণাহ করে তখন তার ক্বলবের মধ্যে একটি দাগ পড়ে যায়। অতঃপর যদি সে তওবাহ ও ইস্তিগফার করে তাহলে তার কলব পরিষ্কার হয়ে যায়। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) রোগাক্রান্ত ক্বলবের লক্ষণ নাফস বা প্রবৃত্তির মাধ্যমে কামনা-বাসনা, চরিত্র ও আচরণে প্রকাশিত হয়। তাই ক্বলবের দোষ ও গুণসমূহকে অনেকে নাফসের দোষ-গুণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাই লক্ষনের চিকিৎসা হলো- নাফস বা প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা সংশোধন করার চিকিৎসা। সংশোধনের জন্য সাধনা করা একান্তভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব।

আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : হে মু’মিনগণ! তোমাদের সংশোধনের দায়িত্ব তোমাদের নিজেদেরই ওপর। তোমরা যদি সঠিক পথ অবলম্বন কর, তাহলে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহর কাছেই তোমাদের সকলের ফিরে আসা। এরপর তিনি সে সম্পর্কে জানাবেন যা তোমরা করতে। (মায়েদা : ১০৫) চিকিৎসা ও সাধনার মাধ্যমে নাফসকে মুতমাইন্নার স্তরে উপনীত করার জন্য কোরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক অবিরাম সাধনা করতে হবে। পরামর্শ হলো-নাফসের মাধ্যমেই জীবনের সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। তাই সংশোধনের জন্য নাফসকে বিবেকের অনুগত করতে হবে। রূহ ও দেহের সংযোগস্থলে জীবন পরিচালনা শক্তি নাফস বা জীবাত্মা তৈরি হয়। আল্লাহ প্রেরিত ফিরিশতা যখন মাতৃগর্ভে এই সংযোগ স্থাপন করেন তখন ঐ নাফসের মধ্যে আল্লাহর হুকুমে কিছু নির্ধারিত তথ্য সেট-আপ করে দেন। আল্লাহ ঐ নাফসকে সুবিন্যস্ত করেন এবং তাকওয়ার পথ ও গোনাহের পথের সুস্পষ্ট জ্ঞান ইলহামের মাধ্যমে প্রদান করেন, যার নাম হলো- বিবেক। বিবেক হল দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ আদালত। এই ইলহাম সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : শপথ আত্মার! এবং তার, যা তিনি সুবিন্যস্ত করেছেন! অতঃপর তাকে তার খারাপ পথ ও তাকওয়ার পথের এলহাম করেছেন। যে তাকে পবিত্র করলো, সে সফল হলো। আর যে তাকে কলুষিত করলো, সে ধ্বংস হয়ে গেলো। (সূরা আস-সামছ : ৭-১০)

ক্বলবের রোগ জনিত ক্ষতিপূরণ ও পুষ্টি সাধনের জন্য ব্যক্তিগতভাবে কিছু পুষ্টিকর ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হয়। সাধনার পথের পথিককে এ ব্যাপারে ও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এ ব্যাপারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ পেশ করা হলো- ১) পবিত্রতা : পবিত্রতা অবলম্বন কলবকে আল্লাহমুখী, দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি এবং গুণাহ থেকে হিফাজত করে। অজু, গোসল ও তাইমুম দ্বারা বাহ্যিক পবিত্রতা অর্জিত হয়। হালাল পথে অর্জিত রিজিক দ্বারা শরীরের রক্ত-মাংস পবিত্র হয়। নিষিদ্ধ ও বেহুদা চিন্তা, কামনা-বাসনা, কথা ও কাজ পরিহার এবং চুক্ষ, কর্ণ, জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের হিফাজত করার মাধ্যমে হৃদয় ও মন পবিত্র হয়। ২) ভাল বন্ধু : হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন : মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে গড়ে উঠে। সুতরাং খেয়াল রাখা উচিৎ, সে কেমন লোককে বন্ধু বানিয়ে নিচ্ছে। (তিরমিযী, আবু দাউদ) ৩) জুহুদ : হযরত আবুজার (রা.) থেকে বর্র্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘‘যে বান্দা দুনিয়াতে জুহুদ অবলম্বন করে অবশ্যই আল্লাহ তার কলবের মধ্যে হিকমাত উৎপন্ন করে দেন, তার মুখে তা প্রকাশ করান, তাকে দুনিয়ার দোষত্রুটি, আত্মিক ব্যাধিসমূহ থেকে বাঁচার পথ দেখিয়ে দেন এবং দুনিয়া থেকে নিরাপত্তাসহ বের করে জান্নাতে নিয়ে যান। ’’(বাইহাকী) ৪) ভাল সংসর্গ : নবী করিম (সা.) বলেছেন : নেককার লোকের সংসর্গ ও গোনাহগার লোকের সংসর্গের দৃষ্টান্ত হলো যথাক্রমে মেশ্ক বিক্রেতা ও কামারের হাঁপরে ফুঁক দানকারীর মতো। মেশ্ক বিক্রেতার কাছে গেলে সে হয়তো তোমাকে এমনিতেই কিছু লাগিয়ে দিবে, না হয় তুমি তার নিকট থেকে কিছু খরিদ করবে আর না হয় তুমি তার নিকট থেকে অবশ্যই সুগন্ধ পাবে। আর কামারের হাঁপরে ফুঁক দানকারীর নিকটে গেলে হয়তো তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দেবে নতুবা অন্তত তার নিকট থেকে দুর্গন্ধ পাবেই। (বুখারী ও মুসলিম) ৫) খিদমাতে খালক : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,নবী করিম (সা.) বলেছেন, গোটা সৃষ্টিকুল আল্লাহর পরিবার। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবারের সাথে সদয় ব্যবহার করে সে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়। -(বায়হাকী)

মানব সত্তার পাঁচ অংশ : যে কোনো ব্যক্তির পাঁচটি অংশ রয়েছে, যথা রূহ , ক্বলব, নাফ্স, জাসাদ ও লিবাস । পরিশুদ্ধির জন্য সব অংশই পরিশুদ্ধ করতে হবে। ১) রূহের পরিশুদ্ধি : গাইরুল্লাহর মহব্বত বর্জন করে রূহকে (নিজেকে) সর্বদা আল্লাহর দিকে রুজু রাখলে রূহ আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হয়, আল্লাহর নুরে আলোকিত হয়, ফলে রূহ পরিশুদ্ধ হয়ে আল্লাহর মহব্বত লাভের যোগ্য হয়। ২) কলবের পরিশুদ্ধি : আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমেই ক্বলব পরিশুদ্ধ হয়। আল্লাহকে সর্বদা হাজির-নাজির জানা, সার্বণিক জিকির, কোরআন তিলাওয়াত, মৃত্যুর স্মরণ, তওবা ও ইস্তিগফার -এর মাধ্যমে ক্বলব পরিশুদ্ধ করতে হয়। ৩) নাফসের পরিশুদ্ধি : আত্মার মুনজিয়াত গুণাবলী (ইখলাছ, তাওয়াক্কুল, সবর, শোকর ইত্যাদি) অর্জন এবং মুহলিকাত ত্রুটিসমুহ (রিয়া, কেবর, হাসাদ ইত্যাদি) বর্জনের মাধ্যমে অন্তকরণ পরিশুদ্ধির জন্য সাধনা করতে হবে। ৪) জাসাদের পরিশুদ্ধি : অজু, গোসল ও তাইমুম দ্বারা বাহ্যিক পবিত্রতা অর্জিত হয়। হালাল রিজিক দ্বারা রক্ত-মাংস পবিত্র হয়। নিষিদ্ধ ও বেহুদা চিন্তা-কথা-কাজ পরিহার, চোখ-জিহ্বা-লজ্জাস্থানের হিফাজত, বেশি কাঁদা, কম হাসা, কম কথা বলা, কম খাওয়া, কম ঘুমানো -এর মাধ্যমে জাসাদ পরিশুদ্ধ হবে। ৫) লিবাসের পরিশুদ্ধি : লিবাস হতে হবে পবিত্র, পরিচ্ছন্ন, হালাল পথে অর্জিত, শালীন এবং নবী করিম (সা.) এর সুন্নাহ মোতাবেক তাকওয়ার লিবাস। তাকওয়ার লিবাস গোণাহ থেকে বেঁচে থাকার সহায়ক।

কখনো গুণাহর মাধ্যমে কলবে ময়লা জমে যেতে পারে। তখন ময়লা দূর করতে হবে। পরিষ্কার করতে হবে। গুণাহ হলে যেমন তাওবা করতে হয়। তেমনি কলবে ময়লা জমলে ক্বলব পরিষ্কার করতে হয়। যেমন অনেকে নিজের জামা কাপড় খুব যত্নের সাথে পরে, কোনো ময়লা লাগতে দেয় না। আর একটু ময়লা হলেই ধুয়ে ফেলে। কারো জামা অল্পতেই ময়লা হয়ে যায় বেখেয়ালির কারণে। তো সেই জামা আবার ধুয়ে ব্যবহারযোগ্য করতে হয়। ঠিক তেমনি কারো ক্বলব একদমই ময়লা হয় না। নিজেকে সগিরা কবিরা সব ধরণের গুণাহ থেকে বাচিঁয়ে রাখে। তার ক্বলব সব সময়ই পরিচ্ছন্ন। ক্বলববে কোন দাগ নেই। আর কারো ক্বলবে গুণাহের কারণে দাগ পড়ে যায়। ক্বলব ময়লা হয়ে যায়। ক্বলব ময়লা হয়ে গেলে ক্বলব পরিষ্কার করতে হয়।
ক্বাল্বের পরিচয় ও গুরুত্ব তুলে ধরে হাদিসে পাকে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, ‘জেনে রেখো! তোমাদের শরীরের মধ্যে এক টুকরো গোশ্ত পিন্ড আছে; যদি তা সংশোধিত হয়, তবে গোটা শরীরই সংশোধিত হয়। আর যদি তা খারাপ হয়; তবে সমস্ত শরীরই খারাপ হয়ে যায়। মনে রেখ তাহলো ক্বাল্ব বা দিল।’ (বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত)

মানুষের বাহ্যিক যেকোনো কাজের মূল পরিকল্পনাকারী আত্মা, সে কারণে বাহ্যিক আমল যেমন নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি শরিয়তের বিধান ইমানদার ব্যক্তিকে পালন করতে হয়, তেমনি চিন্তাজগতের পাপ দূর করে সেখানে ইখলাস, তাকওয়া, সবর, শোকর ইত্যাদি অর্জনের জন্যও শরিয়তের রূহানি বিধান পালন করতে হয়। সেসব বিধানের চর্চা এবং সেমতে আমল করার নামই হলো আত্মশুদ্ধি। নবী করিম (সা.)-কে দুনিয়ায় প্রেরণের যে উদ্দেশ্য, পবিত্র কোরআন সুস্পষ্ট করে বলেছে, তা হলো তাযকিয়ায়ে নাফস বা আত্মশুদ্ধি।
ক্বলবকে শয়তানের ওয়াস-ওয়াসা থেকে সর্বদা হিফাজাত করা ও ক্বলব সংশোধনের জন্য এবং সংশোধিত কলবের উপর টিকে থাকার জন্য আল্লাহর কাছে সর্বদা প্রার্থনা করতে হবে। যেমন- ১) দ্বীনের পথে হিদায়াতের ওপর টিকে থাকার জন্য আল্লাহর শেখানো দোয়া- হে আমাদের প্রতিপালক! হিদায়াত প্রদান করার পর আপনি আমাদের অন্তঃকরণকে বক্র করবেন না এবং আপনার নিকট থেকে আমাদেরকে অনুগ্রহ দান করুন! নিশ্চয়ই আপনি সবকিছুর দাতা। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত- ৮) ২) রাসূলের শেখানো দোয়া- হযরত শাহর ইবনে হাওশাব (রা.) থেকে বর্ণি, তিনি বলেন, আমি উম্মে সালমা (রা)কে জিজ্ঞেস করলাম, হে উম্মুল মু’মিনীন! রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন আপনার কাছে অবস্থান করতেন তখন অধিকাংশ সময়ে তিনি কি দোয়া করতেন? তিনি বলেন, বেশির ভাগ সময়ে তিনি এই দোয়া করতেন-(হে অন্তর সমুহের ওলট-পালটকারী! আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের ওপর অবিচল রাখুন)- তিরমিযী।

কোরআনুল কারীম বোঝার জন্য বুদ্ধিমত্ত্বার চাইতে ‘ক¦লব’ এর পরিশুদ্ধতার প্রয়োজন অনেক বেশি। কেননা, কোরআন নাযিল করা হয়েছে ক্বলব এর ওপর। কোরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই এ কোরআন সৃষ্টিকূলের রবেরই নাযিলকৃত। বিশ্বস্ত ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) এটা নিয়ে অবতরণ করেছেন তোমার নূরানি ক্বলবে (হৃদয়ে) যাতে তুমি সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত হও।’(সূরা আশশুয়ারা, আয়াত : ১৯২)
মোটকথা পরিশুদ্ধ ক্বলবের নানাবিধ উপকারিতা রয়েছে। এ প্রকার ক্বলব সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী, ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান, সকল প্রকার কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম। তার ভালোবাসা, চিন্তা-চেতনা, ইচ্ছাশক্তি, মন-মানসিকতা, কাজ-কর্ম, শয়ন-স্বপন, উঠা-বসা, কথা-বার্তা সবই আল্লাহর জন্য।

মৃত ক্বলব জীবিত ক্বলবের বিপরীত। ক্বলব বিদ্যমান কিন্তু নি®প্রাণ। যার ফলে ঐ ক্বলব দ্বারা ভালো-মন্দ কিছুই বুঝতে পারে না। আর এর আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন,‘আর আমি সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য বহু জিন ও মানুষ। তাদের ক্বলব রয়েছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা অনুধাবন করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তা দিয়ে দেখে না, কান রয়েছে তা দিয়ে শুনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তার চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হলো গাফেল শৈথিল্যপরায়ণ’ (আ‘রাফ ১৭৯)। ক্বলব স্বচ্ছ আয়নার মতো। মানুষ যখনই কোনো গুণাহের কাজ করে, তখনই কলবে একটি কালো দাগ পড়ে। যারা কলব বা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে, তারাই দুনিয়াতে ও আখিরাতে সত্যিকার সফলতা ও সৌভাগ্য লাভ করবে। ক্বলব সম্পর্কে রাসূল পাক (সা) বলেন : “ক্বলব হলো সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গেঁর বাদশা।” (মিশকাত শরীফ ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৬২) ক¦লব তিন প্রকার। ১। ক্বলবে সালীম (সুস্থ হৃদয়) ২। ক্বলবে মারিজ (অসুস্থ হৃদয়) ৩। ক্বলবে মাইয়িত (মৃত হৃদয়)। ক্বলবে সালীম জান্নাতে যাবে। ক্বলবে মাইয়িত জান্নাতে যাবে না। এটা হলো কাফেরদের ক্বলব। আর ক্বলবে মারিজ জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করে জান্নাতে যাবে।

মানুষের সব কাজের মূল পরিকল্পনাকারী হচ্ছে ক্বলব বা আত্মা যাকে নিয়ন্ত্রণ করেন স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন,‘‘বলো, তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তঃকরণ। তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’’(সূরা মুলক: আয়াত-২৩) আল্লাহ পাক মানুষের অন্তরের সব বিষয় দেখেন, সব বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। তবে আল্লাহ পাক দেখতে চান ওই লোকের অন্তর কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে? ভালোর দিকে, নাকি খারাপের দিকে। সে যদি অন্তরে খারাপ নিয়ত রেখে বাহ্যিকভাবে কোনো ভালো কাজও করে, তাহলেও আল্লাহর কাছে তা গৃহীত হয় না।

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম