মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
জিকির এর আভিধানিক অর্থ-স্মরণ করা, মনে করা, উল্লেখ করা,বর্ণনা করা। পারিভাষিক অর্থে শরীয়তের আলোকে জিকির বলা হয় মুখে বা অন্তরে আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা এবং প্রশংসা করা,পবিত্র কোরআন পাঠ করা, আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা, তার আদেশ-নিষেধ পালন করা, তার প্রদত্ত্ব নেয়ামত ও সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা।
আল্লাহর জিকির সবচেয়ে বড় ও সর্বোত্তম ইবাদত। কেননা, আল্লাহ তা’য়ালাকে স্মরণ করা হচ্ছে ইবাদতের আসল লক্ষ্য। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,‘‘আর আল্লাহর স্মরণই সরচেয়ে বড় কাজ। তোমরা যা করো আল্লাহ তা জানেন’’ (সূরা আনকাবুত ৪৫) আল্লাহ তা’য়ালা আরো বলেন, ‘‘এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী- এদের জন্য আল্লাহ রেখেছেন ক্ষমা ও মহা প্রতিদান’’ (সূরা আহযাব:আয়াত ৩৫)
নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাতসহ ফরজ ইবাদতের পর আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার সর্বোত্তম উপায় হলো অধিক হারে জিকির করা। এজন্য হজ্জ সমাপনের পরপরই আল্লাহ তা’য়ালা তার বান্দাদেরকে জিকিরে মাশগুল হতে বলেছেন। ‘যখন হজ্জের যাবতীয় অনুষ্ঠানক্রিয়াদি সমাপ্ত করে সারবে, তখন স্মরণ করবে আল্লাহকে, যেমন করে তোমরা স্মরণ করতে নিজেদের বাপ-দাদাদেরকে; বরং তার চেয়েও বেশি স্মরণ করবে। (সূরা বাকারা : ২০০)।
হযরত ইমাম নববী (রহ.) বলেন, জিকির কেবল তাসবীহ, তাহলীল, তাহমীদ ও তাকবীর ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আনুগত্যের সাথে প্রত্যেক আমলকারীই জিকিরকারী হিসেবে বিবেচিত। আল্লাহ তা’য়ালার জিকির এমন এক মজবুত রজ্জু যা সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে সম্পৃক্ত করে। তাঁর সান্নিধ্য লাভের পথ সুগম করে। মানুষকে উত্তম আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে। সরল ও সঠিক পথের ওপর অবিচল রাখে। এ কারণে আল্লাহ তা’য়ালা ইমানদারদেরকে দিবা-রাত্রে গোপনে-প্রকাশ্যে জিকির করার আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,‘‘হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো এবং সকাল বিকাল আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করো’’ (সূরা আহযাব:আয়াত- ৪১,৪২)
আল্লাহর জিকির সুরক্ষিত দুর্গ। বান্দা এর দ্বারা শয়তান থেকে রক্ষা পায়। নবী করিম (সা.) বলেন, ইয়াহইয়া বিন জাকারিয়া (আ.) ইসরাঈল তনয়দেরকে বলেছেন,‘‘এবং আমি তোমাদেরকে আল্লাহর জিকিরের আদেশ দিচ্ছি। কারণ, এর তুলনা এমন এক ব্যক্তির ন্যায় যার পিছনে দুশমন দৌঁড়ে তাড়া করে ফিরছে, সে সুরক্ষিত দুর্গে প্রবেশ করে নিজেকে রক্ষা করেছে। অনুরূপ, বান্দা আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে শয়তান থেকে সুরক্ষা পায়।’’ (আহমদ:২৭৯০)
আল্লাহর জিকিরকারী, তাঁর নিদর্শনাবলী থেকে শিক্ষা লাভকারী, তারাই বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,‘‘আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে নিদর্শনাবলী রয়েছে বোধশক্তি সম্পন্ন লোকের জন্য, যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করে (এবং বলে) হে আমাদের প্রভূ! আপনি এগুলো অযথা সৃষ্টি করেননি। বরং আপনি নির্দোষ। অতএব; আমাদিগকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন’’ (সূরা আলে -ইমরান ১৯০-১৯১)
হযরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন,‘‘আমি কি তোমাদেরকে এমন এক আমল সম্পর্কে অবহিত করবো না, যা তোমাদের অধিপতির নিকট সবচেয়ে উত্তম ও পবিত্র, এবং তোমাদের মর্যাদা অধিক বৃদ্ধিকারী, এবং তোমাদের জন্য স্বর্ণ-রূপা দান করা ও দুশমনের মুখোমুখি হয়ে তোমরা তাদের গর্দানে বা তারা তোমাদের গর্দানে আঘাত করার চেয়েও উত্তম? তাঁরা বললেন, হ্যাঁ- ইয়া রাসূলুল্লাহ! তিনি বললেন, জিকরুল্লাহ (আল্লাহর জিকির বা স্মরণ)’’ (তিরমিজি:৩২৯৯)
জিকির অন্তর দ্বারা হতে পারে, জিহ্বা দ্বারা হতে পারে, বা এক সঙ্গে উভয়টা দ্বারাও হতে পারে। এর বিভিন্ন প্রকার রয়েছে যেমন ১. কোরআন কারিম পাঠ করা। এটি হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ওপর নাজিলকৃত আল্লাহ তা’য়ালার কালাম। আল্লাহর কালাম বিধায় সাধারণ জিকির-আজকারের চেয়ে কোরআন পাঠ করা উত্তম। আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন,‘‘যে কিতাবুল্লাহর একটি অক্ষর পড়লো তার জন্য এর বিনিময়ে একটি নেকি অবধারিত এবং তাকে একটি নেকির দশ গুণ সাওয়াব প্রদান করা হবে। আমি বলছি না যে, আলিফ লাম মীম একটি অক্ষর বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর, এবং মীম একটি অক্ষর।’’ (তিরমিজি:২৭৩৫)
সর্বোত্তম আমল: জিকিরের ফজিলত স¤পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে না তাদের দৃষ্টান্ত জীবিত ও মৃত ব্যক্তির মতো।’ (বুখারী : ৬০৪৪)। সাহাবিদের উদ্দেশ্যে রাসূল (সা.) বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন উত্তম আমলের কথা বলে দিব না? যা তোমাদের প্রভুর নিকট অত্যন্ত পবিত্র, যা সর্বাধিক মর্যাদাস¤পন্ন, এবং স্বর্ণ-রৌপ্য ব্যয় করা অপেক্ষা উত্তম আর শত্রুর মোকাবিলায় যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তাদের ঘাড়ে আঘাত করা আর তারা তোমাদের ঘাড়ে আঘাত করার চেয়েও উত্তম? সাহাবাগণ (রা.) বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন, ‘তা হলো আল্লাহ তা’য়ালার জিকির।’ ( ইবনে মাজাহ : ৩৭৯০)। নিজেকে এমনভাবে জিকিরে অভ্যস্ত করা উচিত যাতে মৃত্যুর সময় জবানে জিকির জারি থাকে। একবার হযরত মুআজ বিন জাবাল রাসূল (সা.) কে প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) সর্বোত্তম আমল কোনটি? রাসূল (সা.) বললেন ‘মৃত্যুর সময় যেনো তোমার জিহ্বা আল্লাহর জিকিরে সিক্ত থাকে।’ (মুজামুল কাবীর : ১৮১)।
জিকির মানসিক প্রশান্তির মহৌষধ। জিকির ছেড়ে দিয়ে দুনিয়ার জীবনে ভালো থাকা যায় না। আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, ‘যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করবো।’ (সূরা ত্বহা : ১২৪)। আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, ‘‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখো, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।’’ (সূরা রাআদ : ২৮)।
শয়তানের ধোকা থেকে বাচার রক্ষামন্ত্র হলো এই জিকির। জিকির ছেড়ে দিলে বান্দা আল্লাহর জিম্মাদারী থেকে বেড়িয়ে যায়। আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্যে এক শয়তান নিয়োজিত করে দেই, অতঃপর সে-ই হয় তার সহচর।’ (সূরা জুখরুফ : ৩৬)।
কোরআন ও হাদিসের বহু স্থানে আল্লাহর জিকির করার প্রতি বিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জিকির আস্তে করবে, না জোরে করবে এ নিয়েও সমাজে মতপার্থক্য দেখা যায়। সূরা আরাফের আয়াত থেকে আস্তে জিকির করা উত্তম বলে প্রমাণিত হয়। খায়বর যুদ্ধে সাহাবায়ে কেরামের তাকবির ধ্বনি উচ্চস্বরে হয়ে গেলে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘‘হে জনগণ, নরম হও, বিনম্র আওয়াজে ডাকো তোমরা কোনো বধির বা অনুপস্থিত কাউকে ডাকছ না।’’ (মুসলিম)
হযরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘পূর্ববর্তী মনীষীরা বেশির ভাগ সময় আল্লাহর জিকির ও দোয়ায় মশগুল থাকতেন; কিন্তু কেউ তাঁদের আওয়াজ শুনতে পেত না।’ তবে শরিয়তে যেসব স্থানে সরব ও উচ্চস্বরে জিকির করার নির্দেশ দিয়েছে, সেখানে সরব জিকির উত্তম। যেমন-আজান, ইকামত, কোরআন তিলাওয়াত, নামাজের তাকবির, তাকবিরে তাশরিক ও হজের ‘লাব্বাইকা’ ইত্যাদি উচ্চস্বরে বলা উত্তম। আর অন্যান্য ক্ষেত্রে উচ্চস্বরে জিকির করার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে। এক. এতে লোক দেখানো মনোভাব থাকতে পারবে না। দুই. নিজের জিকিরের শব্দে অন্যের নামাজ, তেলাওয়াত, কাজকর্ম বা বিশ্রামে ক্ষতি করা যাবে না। তিন. জিকিরের এ পদ্ধতিকেই একমাত্র সঠিক পদ্ধতি হিসেবে জ্ঞান করা যাবে না।
রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন ১০০ বার ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর’ বলবে, সে দশটি গোলাম আযাদ করার সমান সাওয়াব লাভ করবে। আর তার নামে লেখা হবে ১০০ টি সাওয়াব এবং তার আমল থেকে ১০০ টি গুনাহ মুছে ফেলা হবে। আর সে সেদিন সন্ধ্যা হওয়া পর্যন্ত শয়তানের ধোকা থেকে মুক্ত থাকবে এবং কিয়ামতের দিন কেউ তার চেয়ে ভালো আমল আনতে পারবে না, একমাত্র সেই ব্যক্তি ব্যতীত যে তার থেকে বেশি নেক আমল করেছে।’ (বুখারী : ৬০৪০)। যার কলবে আল্লাহর জিকির জারি থাকে সেখানে শয়তান থাকতে পারেনা। প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘শয়তান আদম সন্তানের কলবে জেঁকে বসে থাকে যখনই আল্লাহর যিকির করে ছিটকে পড়ে এবং যখনই কলবের জিকির বন্ধ থাকে সে কুমন্ত্রনা দেয়।’ (মুসান্নাফে আবি শায়বাহ : ৩৫৯১৯)।
বিশ^ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের পর ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ ৩৩ বার ‘আল হামদুলিল্লাহ’ ৩৩ বার ‘আল্লাহু আকবার’ পড়ে এবং ১০০ বার পূর্ণ করার জন্য ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ দাহু লা শারীকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির’ পড়ে, তার সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়, যদিও তা সাগরের ফেনাপুঞ্জের সমতুল্য হয়। (মুসলিম : ১৩৮০)।
আল্লাহর জিকির করা একটি বিশেষ নফল ইবাদত। এ ইবাদতের ধরাবাঁধা সময় নেই। যে কোনো সময়েই তা পালন করা যায়। জিকির সাধারণত তিন প্রকার। প্রথমত, জিকিরে লিসানি বা মৌখিক। দ্বিতীয়ত, জিকিরে কালবি বা আন্তরিক, স্মরণ তথা মনে মনে স্মরণ। তৃতীয়ত, জিকিরে আমালি বা কার্যত স্মরণ, তথা বাস্তব কর্মের মধ্য দিয়ে আল্লাহকে স্মরণ। তাৎক্ষণিকভাবে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়ন করাও আল্লাহকে স্মরণ করার নামান্তর।
পবিত্র কোরআন কারিমে আল্লাহ তা’য়ালা ৪০ বার জিকিরের কথা বলেছেন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করো। ’ জিকির বিভিন্ন রকমের বা বিভিন্নভাবে করা যায়। এস্তেগফারের মাধ্যমেও আল্লাহ তা’য়ালার স্মরণ বা জিকির করা যায়। সবারই দৈনিক ১০০ বার এস্তেগফার পাঠ করা উচিত। এস্তেগফারের মাধ্যমে আল্লাহ তা’য়ালা বান্দার রিজিক বাড়িয়ে দেন।
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে ক্ষমা চাও, নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল। ’ এস্তেগফার করতে হবে নিজের গুণাহ ক্ষমা করানোর জন্য। কেউ রিজিক বাড়ানোর উদ্দেশে এস্তেগফার করলে তার এস্তেগফার কবুল হবে না। বান্দা নিজের গুণাহ, নিজের অবাধ্যতার প্রতি লজ্জিত হয়েই আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে ক্ষমা ভিক্ষা চাইবে। তাহলে আল্লাহ তা’য়ালা তাকে ক্ষমা করবেন এবং তার রিজিক বাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু এর ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য থাকলে সেটি আর এস্তেগফার হবে না। হাদিস শরিফে আছে- লা হাউলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লাবিল্লাহ- এটি জান্নাতের ভান্ডারগুলোর একটি। এটি দৈনিক ১০০ বার পড়তে হবে। যে কোনো দরুদ শরিফ ১০০ বার পড়লে ১০০টি রহমত পাওয়া যায়। শুদ্ধ করে দরুদ শরিফ পড়তে হবে। অশুদ্ধ দরুদ শরিফ পড়লে হবে না। কেউ ১ হাজার বার দরুদ শরিফ পড়লে ১ হাজার নেকি পাবে, তার ১ হাজার গুণাহ মাফ হবে এবং সে ১ হাজার প্রমোশনও পাবে।
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমি তোমাদের স্মরণ করবো। ’ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু জিকিরের মানে হচ্ছে, লা ইলাহা বলার সময় মনে করতে হবে, আমি দুনিয়ার সবকিছু আমার হৃদয় থেকে বের করে দিলাম। আর ইল্লাল্লাহ বলার সময় মনে করতে হবে, আমি আল্লাহর সবটুকু ভালোবাসা আমার হৃদয়ে ঢুকিয়ে নিলাম। এ জিকির দৈনিক ৩০০ অথবা ৫০০ বার পড়তে হবে। যে হৃদয়ে আল্লাহর জিকির আছে, সেটি জীবিত হৃদয়, আর জিকিরহীন হৃদয় হলো মৃত হৃদয়ের সমান।
এক দরিদ্র সাহাবি রাসূল (সা.) কে বললেন,বিত্তবানেরা তাদের বিত্তের কারনে হজ্ব,যাকাত,ওমরা ও জেহাদের আমলগুলো করার সুযোগ পায়। এভাবে তারা পুণ্যের দিক দিয়ে হয়ে যায় অধিক অগ্রগামী। রাসূল পাক (সা.) বললেন,আমি তোমাদেরকে একটি সহজ আমলের কথা বলে দেই। তোমরা নামাজের পর ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ও ‘আল্লাহু আকবার’ বেশি বেশি করে পড়ো। তাহলে তোমরাও পুন্ন্যার্জনের ক্ষেত্রে পিছনে পড়ে থাকবে না।
জিকিরের উপকারিতার মধ্যে-আল্লাহর জিকির শয়তানকে তাড়িয়ে দেয় ও তার শক্তি খর্ব করে। জিকির আল্লাহর পরিতোষ লাভের উপায়। জিকিরের দ্বারা লাভ হয় মোরাক্বাবা(ধ্যনমগ্নতা) যা পৌঁছে দেয় এহসানের স্তরে। জিকির দিলকে জিন্দা করে। জিকির হচ্ছে ক্বলব(মন) ও রুহের(আত্না) আহার। ক্বলবের মরিচা দুর করে। জিকির ক্রীতদাস মুক্ত করে দেয়ার সমতুল্য।
দ্বীনের নামে নাজায়েয কাজ যারা গান বাদ্য বাজায় তাদের তো দ্বীনের বুঝ নেই। গুণাহ কাকে বলে তারও খবর নেই। সওয়াব কী জিনিস তাও খবর নেই। কিন্তু তার চেয়েও দুঃখের কথা হলো যারা দ্বীনের জন্য মেহনত করেন, যাদেরকে দ্বীনের প্রতিনিধি মনে করা হয়, তারাও এ ব্যাপারে উদাসীন। দেখা যায় মাইকে বিকট শব্দে প্রয়োজনাতিরিক্ত আওয়াজে ওয়াজ মাহফিল চলছে, অথবা হামদ নাত ইসলামী সঙ্গিত চলছে যদ্বরুণ মাহফিল শেষ না হওয়া পর্যন্ত সারা এলাকার লোক ঘুমাতে পারছে না। উঁচু স্বরে কোরআন তেলাওয়াত: সকল ফুকাহায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, বিকট স্বরে যে কোনো কাজ করা, যা দ্বারা লোকদের স্বাভাবিক কর্মকান্ড ব্যাহত হয় (যেমন: কেউ ঘুমাতে চাইলে ঘুমাতের পারে না, অসুস্থ মানুষ বিশ্রাম নিতে চাইলেও সম্ভবপর হয়ে উঠে না) এ জাতীয় কাজ সম্পূর্ণ হারাম। আর যদি এ জাতীয় কাজ দ্বীনের নামে করা হয় তাহলে দ্বিগুণ হারাম। কেননা এ দ্বারা সাধারণ মানুষের মনে দ্বীনের ব্যাপারে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। ফুকাহায়ে কেরাম আরো লিখেছেন, যেখানে কেউ ঘুমাচ্ছে সেখানে উচ্চ স্বরে কোরআন তেলাওয়াত করবে না। এমনিভাবে যেখানে লোকেরা এমন কোনো কাজে ব্যস্ত রয়েছে যে, সেখানে কোরআন পড়া হলে তারা সেদিকে লক্ষ্য করবে না বা কোরআনের আদব রক্ষা করবে না তাহলে সেখানেও উঁচু স্বরে কোরআন তেলাওয়াত করবে না। এমনিভাবে যেখানে উঁচু স্বরে কোরআন তেলাওয়াত করলে মানুষের কাজের ব্যাঘাত ঘটে সেখানেও জোরে তেলাওয়াত করবে না। এরূপ অগণিত মাসআলা শরীয়ত আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে যে, দ্বীনের কাজও এমনভাবে করতে হবে যেন অপরের কষ্ট না হয়।
জিকিরে আমালি হচ্ছে মোমিনের ফরজ-নফলসহ সব ধরনের ইবাদত-বন্দেগি। এ অর্থে যেকোনো নামাজ, হজ্জ, ওমরাহ বা যেকোনো দোয়া-মোনাজাত প্রভৃতিও জিকির বা আল্লাহর জিকির। মু’মিনদের জন্য জীবনের সর্বক্ষেত্রে কোনো না কোনো উপায়ে আল্লাহকে স্মরণ করতেই হবে। আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল হওয়ার সুযোগ নেই। মানুষ সর্বাবস্থায় আল্লাহর জিকির করে প্রকৃত অর্থে সে শান্তির মধ্যেই থাকে। শান্তির উৎস ক্বলব বা অন্তর। আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন: জেনে রাখো, আল্লাহর জিকিরেই ক¦লব বা অন্তর প্রশান্ত হয়। (সূরা রা’দ: আয়াত-২৮)
হাদীসে কুদসিতে এসেছে, “আল্লাহ বলেন, বান্দা আমার ব্যাপারে যেমন ধারণা করে আমাকে তেমনি পাবে। যখন সে আমার জিকির (স্মরণ) করে আমি তার সঙ্গে থাকি। সে যদি তার অন্তরে আমার জিকির স্মরণ করে তাহলে আমিও তাকে আমার অন্তরে স্মরণ করি। আর যদি সে কোনো জনগোষ্ঠীর সামনে আমার জিকির করে, তাহলে আমি তাদের চেয়ে উত্তম জনগোষ্ঠীর কাছে তাকে স্মরণ করি। (মুসলিম শরীফ -২০৬১)। জিকিরের মাধ্যমে শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে এসেছে, যারা পরহেজগার, শয়তান যখন তাদের কুমন্ত্রণাদেয়, তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে। ততক্ষনাৎ তাদের চোখ খুলে যায়”। (সুরা: আরাফ, আয়াত: ২০১)
আল্লাহর জিকির ও স্মরণে ঈমানদারের অন্তর প্রশান্ত হয়। জিকির কষ্ট বিহীন একটি ইবাদত। খাঁটি ঈমানদার সব সময় জিকিরে নিমগ্ন থাকে। শত ব্যস্ততা তাঁদের আল্লাহর স্বরণ থেকে বিমুখ করতে পারে না, জিকির ছাড়া খাঁটি ঈমানদার হওয়া কল্পনাতীত। পৃথিবীতে যতো নবী রাসূল ও অলি আউলিয়া আগমন করেছেন। সবার সব সময়ের আমল ছিলো জিকির। জিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়।
হযরত আবু সাঈদ খুদরি ও হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে ঘুম থেকে ওঠে তার স্ত্রীকে জাগাবে এবং দু’জনই দুই রাকাআত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করবে, আল্লাহর দরবারে তারা আল্লাহর শ্রেষ্ঠ জাকিরিন বা জিকিরকারী নারী-পুরুষ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হবে।’
মহান আল্লাহ জিকিরের মধ্যে যে কল্যাণ রেখেছেন তা যদি কেউ মনে করত তবে সর্বদা মহান আল্লাহর নামই জপ করতো। আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, হে মু’মিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো, তাঁর প্রতি নৈকট্য-মাধ্যম অন্বেষণ করো এবং তাঁর পথে সংগ্রাম করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা মায়েদা, আয়াত : ৩৫)
জিকির মানুষের ইহকাল ও পরকালের মর্যাদা বৃদ্ধি করে। আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,‘‘মক্কার একটি রাস্তায় রাসূলুল্লাহ (সা.) হাঁটছিলেন। জুমদান নামক পাহাড় অতিক্রম করার সময় বললেন, তোমরা দ্রুত চলো, এটা জুমদান। মুফাররাদুন অর্থাৎ একক গুণে গুণান্বিতরা এগিয়ে গেছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ! মুফাররিদূন অর্থাৎ একক গুণে গুণান্বিত কারা? জবাবে তিনি বললেন, আল্লাহকে বেশি করে স্মরণকারী নারী-পুরুষ।’’ (মুসলিম:৪৮৩৪)
জিকিরের সবচেয়ে বড় সওয়াব হলো, জান্নাত অর্জন ও জাহান্নাম থেকে রক্ষা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। জিকির আদায়কারীকে আল্লাহ তা’য়ালা বিপদ-দুর্বিপাক, কষ্ট-অসুবিধা ও সামগ্রিক সমস্যা থেকে রক্ষা করেন। আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেনÑ যদি তিনি আল্লাহর তসবিহ পাঠ না করতেন, তবে তাকে পুনরুত্থানের দিন পর্যন্ত মাছের পেটেই থাকতে হতো। ’(সূরা সাফফাত, আয়াত- ১৪৩-১৪৪)
লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,লেখক,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট