মানবীয় মৌলিক গুণাবলীর মধ্যে প্রশংসনীয় চরিত্র জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ

মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
আখলাক বলতে মানুষের স্বভাব বা চরিত্রকে বোঝায়। আরবি শব্দ ‘খুলুকুন’ এর বহুবচন হলো আখলাক। এর অর্থ চরিত্র বা স্বভাব। মূলত মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্য দিয়ে যে আচার-আচারণ ও স্বভাব চরিত্রের প্রকাশ পায় তাকে আখলাক বলে।
আখলাক দ্বারা সাধারণত মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্য দিয়ে যে আচার-আচরণ ও স্বভাব-চরিত্রের প্রকাশ পায় তাকে বোঝায়। মানব জীবনের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক সকল দিকই আখলাকের অন্তর্ভুক্ত। আর মানব জীবনের উত্তম গুণাবলিকে আখলাকে হামিদাহ বা প্রশংসনীয় চরিত্র বলে। যেমন-ধৈর্য, সততা, দেশপ্রেম, সমাজসেবা প্রভৃতি।

আখলাক আরবি শব্দ। আখলাক দুই প্রকার। ১.আখলাকে হামিদাহ(সচ্চরিত্র)।২.আখলাকে যামিমাহ(অসচ্চরিত্র)।এটি বহুবচন। এক বচন খূলূকুন এর আভিধানিক অর্থ-স্বভাব চরিত্র ইত্যাদি। শব্দগত বিবেচনায় আখলাক বলতে সচ্চরিত্র ও দুশ্চরিত্র উভয়কেই বোঝায়। তবে প্রচলিত অর্থে আখলঅক শুধূ সচ্চরিত্রকেই বুঝায়। যেমন ভালো চরিত্রের মানুষকে আমরা চরিত্রবান বলি।আর মন্দ চরিত্রের মানুষকে বলি চরিত্রহীন।ব্যবহারিক বিবেচনায় আখলাক দ্বারা ভালো ও উত্তম চরিত্রবান বোঝানো হয়। মূলত আখলাক হলো মানুষের স্বভাবসমূহের সমন্বিত রুপ।মানুষের আচার–আচরণ, চিন্তাভাবনা, মানসিকতা, করুন্মপন্থা সবকিছুকে চরিত্র বা আখলাক বলা হয়।তা ভালো কিংবা মন্দ হতে পারে।এককথায় মানুষের সকল কাজ ও নীতির সমষ্টিকেই আখলাক বলা হয়।

আখলাক অর্থ চরিত্র স্বভাব। আর হামিদাহ অর্থ প্রশংসনীয় । সুতরাং আখলাকে হামিদাহ অর্থ প্রসংসনীয় চরিত্র, সচ্চরিত্র । ইসলামি পরিভাষায় যেসব স্বভাব বা চরিত্র সমাজে প্রশংসনীয় ও সমাদৃতম আল্লাহ তা’য়ালা ও তাঁর রাসুল (স) এর নিকট প্রিয় সেসব স্বভাব বা চরিত্রকে আখলাকে হামিদাহ বলা হয় । মানব চরিত্রের সুন্দর নির্মল ও মার্জিত গুণাবলিকে আখলাকে হামিদাহ বলা হয়। অর্থাৎ মানুষের সার্বিক আচার আচরণ যখন শরিয়ত অনুসারে সুন্দর, সুষ্ঠু ও কল্যাণকর হয় তখন সে স্বভাব চরিত্রকে বলা হয় আখলাকে হামিদাহ ।
মহানবি (সা.) এর হাদিসে বলা হয়েছে-অর্থ : আল্লাহ তা’য়ালার নিকট সেই লোকই অধিক প্রিয়, চরিত্রের বিচারে যে উত্তম । (ইবনে হিব্বান ) এ জন্য মানুষকে আখলাক শিক্ষা দেওয়াও নবি রাসূলগণের অন্যতম দায়িত্ব ছিলো ।আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী । সব ধরনের সৎগুণ তাঁর চরিত্রে পাওয়া যায় ।স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর প্রসঙ্গে বলেছেন, অর্থ : নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের ধারক ।(সূরা আল কালাম- আয়াত ৪) রাসুলুল্লাহ (স) ঘোষণা করেছেন, অর্থ : “উত্তম চারিত্রিক গুণাবলিকে পূর্ণতা দানের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি ।” (বায়হাকি )

আখলাকে যামিমাহ অর্থ নিন্দনীয় স্বভাব।মানুষের সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই ভালো নয়।বরং মানব চরিত্রে এমন কিছূ দিক রয়েছে যেটি অপছন্দনীয় ও নিন্দনীয়।মানব চরিত্রের এসব নিন্দনীয় স্বভাবগুলোকে আখলাকে যামিমাহ বলা হয়।আখলাকে যামিমাহ হলো আখলাকে হামিদাহ-র সম্পূর্ণ বিপরীত।আখলাকে যামিমাহ-র অন্য নাম আখলাকে সায়্যিআহ। আখলাকে সায়্যিআহ অর্থ অসৎচরিত্র, মন্দ স্বভাব ইত্যাদি।মানব চরিত্রে বহু নিন্দনীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে।যেমন মিথ্যা বলা,প্রতারণা,ঠাট্টাবিদ্রুপ,বিশ্বাসঘাতকতা,হিংসাবিদ্বেষ, লোভলালসা, পরনিন্দা,পরচর্চা,অপব্যয়,কৃপণতা, ক্রোধ,গর্ব,অহংকার ইত্যাদি।এসব স্বভাব আখলাকে যামিমাহ-র অন্তর্ভুক্ত।

মানব সমাজে আখলাকে যামিমাহর কুফল অত্যন্ত ভয়াবহ।এটি যেমন ব্যক্তি জীবনে অশান্তি ঢেকে আনে তেমনি সমাজ জীবনেও বিশৃখলা সৃষ্টি করে। অসৎ চরিত্র বা চরিত্রহীন ব্যক্তি পশুর চেয়েও অধম। তার মধ্যে নীতি নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের বিন্দুমাত্রও পাওয়া যায় না।সে শুধু গড়ন আকৃতিতে মানুষ কিন্তু তার স্বভাবচরিত্র হয় পশুর ন্যায়।নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য সে মানবিক আদর্শসমূহকে বিসর্জন দেয়।আখলাকে যামিমাহ-র ফলে সে সবরকমের অন্যায়, অত্যাচার ও অশালীন কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।এমনকি হত্যা-রাহাজানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদিতেও জড়িয়ে পড়ে।ফলে শান্তি, নিরাপত্তা, সামাজিক ঐক্য, সংহতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। সমাজে অরাজকতা ও অশান্তি বিস্তার লাভ করে।

স্বভাব পরিবতর্নশীল। চরিত্রের কোনো সূচক নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে আখলাকের গুরুত্ব অপরিসীম। সকল নবী-ই নিজ নিজ জাতিকে উত্তম চরিত্রের শিক্ষা দিয়েছেন। আর উন্নত চরিত্রকে পূর্ণতা দানের জন্য শেষ নবি মুহাম্মাদ (সা.)কে আল্লাহ তা’য়ালা পাঠিয়েছেন।
মন্দ চরিত্রের মানুষ সমাজে ঘৃণার পাত্র।কেউ তাকে ভালোবসে না, বিশ্বাস করে না।সকলেই তাকে ঘৃণা করে এড়িয়ে চলে।তার বিপদাপদেও কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না। অসৎ চরিত্র মানুষকে পরকালীন জীবনে শোচনীয় পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। চরিত্রহীন ব্যক্তি সকল প্রকার পাপাচারে লিপ্ত থাকে সে আল্লাহ তা’য়ালার অবাধ্য হয়।

প্রচলিত রীতি নীতির মাধ্যেমেই চরিত্র গঠন শুরু হয়।কঠিন সময়ের আখলাক হলো ইনফাকের আখলাক। নিজের যা কিছু আছে সব কিছুকে অপর ভাইয়ের সাথে শেয়ার করা। কঠিন সময়ের আখলাক হলো ক্ষমার আখলাক। সব সময় ক্ষমাশীল হওয়া, দয়াশীল হওয়া এবং গঠনকারী হওয়া। কঠিন সময়ের আখলাক হল ধৈর্যের আখলাক। কোরআনে এইভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থঃ যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সব অবস্থায়ই অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষ ক্রটি মাফ করে দেয়। আরএ ধরনের সৎলোকদের আল্লাহ অত্যন্ত ভালোবাসেন।

মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আখলাক বিস্তৃত। আমলনামা শুরু হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এটি পরিব্যপ্ত। সে দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের আখলাক তার প্রতিটি কাজই। ফলে মানুষের ভালো-মন্দ গুণাগুণের শেষ নেই। তথাপি কিছু ভালো বা মন্দগুণের কারণে সে সমাজে উত্তম চরিত্র বা মন্দ চরিত্রে অভিহিত হয়। এমন কিছু উল্লেখযোগ্য উত্তম চরিত্রের উপাদান হচ্ছে- তাক্বওয়া বা আল্লাহ ভীতি, বিনয়-নম্রতা, সত্যবাদিতা, মিতভাষিতা, দানশীলতা, ছবর বা ধৈর্য, ক্ষমা-উদারতা, শোকর ও যিকির-আযকার, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, আল্লাহর ওপর ভরসা করা, লজ্জাশীলতা, আমানতদারিতা, সুধারণা পোষণ, সৃষ্টিজীবের সকলের প্রতি সহনশীল হওয়া, আদল-ইনছাফ প্রভৃতি।

নবী করিম (সা.) কোমল আচরণ, নরম ব্যবহার, উদারতা, সহনশীলতা, ক্ষমাশীলতা এসব শুধু তাঁর সাহাবীদের সাথেই ছিলো না, সকল মানুষের সাথেই তাঁর এ আচরণ ছিলো। দেখুন, কুফর শিরকের সাথে তো কোনো সমঝোতা চলে না। ঈমান আর কুফরের মাঝে সন্ধিও হতে পারে না। ঈমান আলো আর কুফর অন্ধকার। ঈমান এসেছেই কুফরকে দূর করার জন্য। আর নবী করিম (সা.) তো আল্লাহর নবী। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। সর্বশেষ নবী। তিনি এসেছেন ঈমান ও তাওহীদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সুতরাং কুফর-শিরকের সাথে তাঁর কোনো সন্ধি বা সমঝোতার প্রশ্নই অবান্তর। কিন্তু এরপরও, এই সকল সীমারেখার মাঝেও রাসূলে কারীম (সা.)-এর ব্যক্তিগত আচরণ ছিলো কোমল।

মানুষের প্রকৃত স্বভাব তার কার্যকলাপে প্রস্ফুটিত হয়। প্রত্যেক মানুষের ভেতর তিনটি চরিত্র আছে ; যা সে প্রকাশ করে, আর যা সে ধারন করে ; আর যা সে চিন্তা করে। অর্থাৎ চরিত্র বেশির ভাগই স্বভাব থেকে গড়ে ওঠে।দৈনন্দিন জীবনের কার্যক্রম থেকেই চরিত্র গঠিত হয়। আখলাকে হাসানার বদৌলতে ব্যক্তি নিজে সমাজে সমাদর লাভ করে এবং তার সৎ স্বভাবের দ্বারা মানবসমাজ নানাভাবে উপকৃত হয়। ফলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলাম যেহেতু জাতির সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য আবির্ভূত হয়েছে তাই ইসলাম ব্যক্তিকে সৎ স্বভাবের অধিকারী করে সমাজ জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা সুপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইসলাম সচ্চরিত্রের যে ব্যাপক শিক্ষা দান করেছে, তা বিশ্বের যে কোনো জাতি ও সমাজের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। কোরআন মাজিদে আল্লাহ তা’য়ালা এ মর্মে এরশাদ করেন, ‘‘নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন অনুপম চরিত্রের অধিকারী।’’ (সূরা নূন-৪)

আল্লার রাসূল (সা.) সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন- অর্থাৎ আল্লাহ পাকের দয়ায় আপনি আপনার সঙ্গীদের প্রতি বিনম্র হয়েছেন,কোমল হয়েছেন। আপনি যদি কর্কশ স্বভাবের, কঠিন হৃদয়ের হতেন তাহলে তারা আপনার চারপাশ থেকে সরে পড়তো। কঠিনহৃদয় কর্কশ স্বভাবের মানুষের চারপাশে লোকজন থাকে না। মূলত আল্লাহ তা’য়ালা নবী করিম (সা.) এর উম্মতের শিক্ষায় একথা বলেছেন।

ইসলাম মানুষের চরিত্র গঠনে যেমন গুরুত্বারোপ করেছে, তার নজির বিরল। একজন মুসলমানের ওপর তার আচার-আচরণে আল্লাহর সঙ্গে, নবী করিম (সা.)-এর সঙ্গে, অন্য মানুষের সঙ্গে, এমনকি নিজের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা উচিত ইসলাম তার এক অভিনব চকমপ্রদ চিত্র অঙ্কন করে দিয়েছে। যখন একজন মুসলমান বাস্তবে ও তার লেনদেনে ইসলামি চরিত্রের অনুসরণ করে তখনই সে অভীষ্ট পরিপূর্ণতার অতি নিকটে পৌঁছে যায়, যা তাকে আরও বেশি আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও উচ্চমর্যাদার সোপানে উন্নীত হতে সহযোগিতা করে।
খাঁটি চরিত্রে কলঙ্কের দাগ বসে না। চরিত্রবান সব সময় সাহসী নির্ভীক। চরিত্র চিন্তা, ও জীবন যার উন্নত, যিনি সর্বাংশে নির্মল, উচ্চ মানবতা যার লক্ষ্য- তিনিই ভদ্রলোক।নবী করিম (সা.) মানুষকে আখলাকে হাসানা-সচ্চরিত্রের বাস্তব প্রশিক্ষণ দানের জন্য এ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস (রা.) বলেন, হযরত মুহাম্মদ (সা.) সবচেয়ে উত্তম চরিত্র মাধুরীর লোক ছিলেন। (বুখারি, মুসলিম)।

চরিত্র মানবের মহার্ঘতম বস্তু, শ্রেষ্ঠতম অলংকার। চরিত্র মানুষের ভাগ্য সৃষ্টি করে। চরিত্র হলো তাই যা তুমি সবার অলক্ষে করে থাকো। আচরণ দ্বারা একজন মানুষের বংশের পরিচয় পাওয়া যায়। অর্থাৎ স্বভাবের চেয়ে বেশি শক্তিশালী আর কিছু নেই। চরিত্র ছাড়া মানুষের গৌরব করার আর কিছু নেই। প্রিয় নবি (সা.) এরশাদ করেন , তোমাদের মধ্যে সেই ব্যাক্তি সর্বোত্তম যার চরিত্র বা আখলাক সর্বোৎকৃষ্ট (মিশকাত, ৪৩১ )। তাই দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনে কল্যান ও মঙ্গল লাভের জন্য প্রতিটি মানুষের সৎ চরিত্রবান হওয়া একান্ত কর্তব্য । অন্যথায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অপমান , অপদস্ত,জগ্লানি,লাঞ্ছনা বহন করতে হবে ।

আখলাকে হাসানার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্তে বিনয় প্রদর্শন করবে আল্লাহ তা’য়ালা তাকে মর্যাদার উচ্চাসনে সমাসীন করবেন। হযরত নাওয়াস বিন সামআন (রা.) বলেন, আমি নবী (সা.)কে ভালো কাজ এবং মন্দ কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এরশাদ করেন, সচ্চরিত্রের নাম নেকী-ভালো আর যে কাজটি তোমার নিকট অপছন্দ এবং অন্য কোন লোকে জানা তোমার কাম্যও নয় তা পাপ। (মুসলিম)

হাদিস শরীফে বর্ণিথ নবী করিম (সা.) বলেন, কিয়ামত দিবসে তোমাদের মধ্যে আমার নিকট সবচেয়ে বেশি প্রিয় এবং নিকটতম ওই ব্যক্তি হবে যার চরিত্র ভালো এবং ওই ব্যক্তি আমার নিকট বেশি ক্রোধ এবং দূরের হবে যে অনর্থক প্রলাপ বকে, মানুষের সঙ্গে ঠাট্টা ও অহংকার করে। (তিরমিযি)

ইসলামের দৃষ্টিতে আখলাকে হাসানা বলতে তাকওয়া, যিকর, শোকর, সবর, ইনসাফ, ইহসান, সহানুভূতি, পরোপকার ইত্যাদি বিষয় সমূহকে বুঝায়। মানবতার ইতিহাসে স্মরণীয় ও বরণীয় হওয়ার লক্ষ্যে সর্বপোরি দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতের মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে আখলাকে হাসানা তথা সৎচরিত্র ও সুন্দর স্বভাব অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন।

আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে দুটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন , একটি মানবিক অপরটি পাশবিক । মানবিক দিককে উন্নত চরিত্র বা আখলাকে হাসানা বলা হয় । এর দ্বারা মানুষ সৃষ্টি সেরা জীব হিসেবে সর্বোচ্চ শিখরে আরহন করে । উন্নত চরিত্র অর্জন না করে মানুষ যখন নসফ ও শয়তানের কুমন্ত্রনা অনুযায়ী জীবনকে পরিচালনা করে তখনই তারা চতুষ্পদ যন্তুর মতো হয়ে যায় এবং কখনো কখনো তার চেয়ে ও নিকৃষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে । যেমন এরশাদ হয়েছে – তারা চতুষ্পদ যন্তুর ন্যায় , বরং তারা পথ ভ্রষ্ট । (সুরা আরাফ,১৭৯ )
নবী কমির (সা.)কে আল্লাহ তা’য়ালা বলছেন, শয়তান যদি আপনার মনে ক্রোধ জাগ্রত করে- তাহলে আপনি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করুন। আল্লাহ আপনাকে আশ্রয় দিবেন। আপনার ডাকে সাড়া দিবেন। কারণ, তিনি সব শুনেন সব জানেন। যারা খাঁটি মনে ইখলাসের সাথে আল্লাহ তা’য়ালার কাছে আশ্রয় চায়, আল্লাহ পাক তাকে আশ্রয় দেন। তো রাসূল কারীম (সা.) সম্পর্কে যদি একথা হয় তাহলে আমাদের ব্যাপারে কী কথা হবে!

মূলতঃ উম্মতকে সাবধান করা হচ্ছে যে, এমন পরিস্থিতি আসবে যখন তোমার সীমালঙ্ঘন করতে ইচ্ছা হবে, জুলুম করতে ইচ্ছা হবে, একজন একটা কথা বলবে যার জন্য তোমার তিনটা কথা বলতে ইচ্ছা করবে, এমনও তো হয় যে, একজন একটা গালি দেয় যার কারণে তার পূর্বপুরুষকেসহ গালি দেয়া হয়। শয়তান এভাবে মানুষকে উস্কানি দেয়, জুলুমের প্রতিবাদে আরও বেশি জুলুম করার জন্য শয়তান মানুষকে প্ররোচিত করে। এই সময় করণীয় কী? এই সময় শয়তানের যিনি প্রভু শপ্রতানের যিনি মালিক তাঁর কাছে আশয় প্রার্থনা করা। তিনি যদি আশ্রয় দেন তাহলে শয়তান মানুষের কোনোই ক্ষতি করতে পারবে না। এখানে, কোরআন মাজীদের এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ পাক মানুষকে অনেক বড় আখলাকী শিক্ষা দান করেছেন। এই শিক্ষাকে যদি আমরা আমাদের বা¯স্তব জীবনে অনুসরণ করি তাহলে সুফল লাভ করবো।

উন্নত চরিত্র অর্জনের জন্য নিচের গুণাবলি অর্জন করা প্রয়োজন যেমন-ইমানের ক্ষেত্রে ইখলাস বা নিষ্ঠা । ইবাদতের ক্ষেত্রে শিরক মুক্ত হওয়া ও একাগ্রতা সৃষ্টি করা। ইহসান তথা যথা সময়ে , যথা নিয়মে ও সর্বোত্তমভাবে আত্মিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলিতে ভূষিত হওয়া।তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন। মন মানসিকতায় ভালো কাজের চেতনা সৃষ্টি করা। কৃত অন্যায় থেকে মুক্তি হওয়ার জন্য তওবা করা। অতীত কার্যক্রমের মুল্যায়ন করে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আত্মোপলব্ধি সৃষ্টি করা । চিন্তা গবেষনা সিদ্ধান্ত নেওয়া ও সম্পাদন করা। তাওয়াক্কুল বা প্রচেষ্টার পর সব কিছু আল্লাহর হাতে সদার্পন করা । সবর তথা সর্বাবস্থায় নীতি ও আদর্লে অবিচল থাকা । হায়া বা লজ্জাবোধ থাকো । সততা , সত্যবাদিতা ,আমানতদারি , বিনয় প্রকাশ করা ইত্যাদি মোলিক গুনাবলি অর্জন করা। আচরনের ক্ষেত্রে ভদ্রতা , শালিনতা , আদব রক্ষা করা। উন্নত চরিত্র অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো উন্নত চরিত্রের অধিকারী আদর্শ ও শিক্ষকের সহচর্যে থেকে সৎ গুণাবলি অনুশীলন ও চরিত্র সমূহকে অভ্যাসে পরিণত করা। সর্বোক্ষণ আল্লাহ ও রাসূলের যিকির ও ফিকিরে থাকা। অসচ্চরিত্র পরিহার করা। চরিত্র মানুষের অমূল্য সম্পদ। সম্পদ হারালে তেমন কিছু হয় না, স্বাস্থ্য হারালে কিছু সময়ের জন্য কিন্তু একবার যদি চরিত্র কারো নষ্ট হয়ে যায় তা আর ফেরত পাওয়া যায় না অর্থাৎ সে সবকিছুই হারায়। কারণ উত্তম চরিত্রের তুলনায় আর কোনো সৌন্দর্য নেই।

মানবীয় মৌলিক গুণাবলীর মধ্যে প্রশংসনীয় চরিত্র জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এর দ্বারাই মানুষ পূর্ণমাত্রায় মনুষত্বের স্তরে উপনীত হয়।মানবিকতা ও নৈতিকতার আদর্শ আখলাকে হামিদাহর মাধ্যমেই পরিপূর্ণতা লাভ করে। মানুষের ইহ ও পরকালীন সুখ, শান্তি উত্তম আখলাকের উপরই নিভরশীল। সৎ চরিত্রবান ব্যক্তি যেমন সমাজের চোখে ভালো, তেমনি মহান আল্লাহর নিকটও প্রিয় ।

লেখকঃ গবেষক,সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,
চেয়ারম্যান গ্রীণ ক্লাব, মানিকগঞ্জ,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম