মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (সা.)

 

মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রবর্তক বিশ্ব মানবতার দূত হযরত মুহাম্মাদ (সা.) হলেন ইসলামের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব এবং ইসলামী বিশ্বাস মতে আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল। যাঁর ওপর ইসলামী প্রধান ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে,হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক,সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা। তাঁর এই বিশেষত্বের অন্যতম কারণ হচ্ছে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় জগতেই চূড়ান্ত সফলতা অর্জন। তিনি ধর্মীয় জীবনে যেমন সফল তেমনই রাজনৈতিক জীবনেও। সমগ্র আরব বিশ্বের জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে তিনি অগ্রগণ্য বিবাদমান আরব জনতাকে একীভূতকরণ তাঁর জীবনের অন্যতম সফলতা।
বিশ্বনবী (সা.)’এর আবির্ভাব ঘটেছিলো মানব জাতির এক চরম দুঃসময়ে যখন বিশ্বজুড়ে বিরাজ করছিলো হানাহানি,জাতিগত সংঘাত, কুসংস্কার,অনাচার এবং জুলুম ও বৈষম্যের দৌরাত্ম্য। নারী জাতির ছিল না কোনো সম্মান। শির্ক ও কুফরির অন্ধকারে গোটা পৃথিবী হয়ে পড়েছিলো আচ্ছন্ন। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.) তাঁর শুভ জন্মের ৪০ বছর পর নবুওতি মিশন তথা ইসলামের বৈপ্লবিক নানা বাণী নিযে অজ্ঞ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং সব ধরনের উন্নত নৈতিক গুণ-বিবর্জিত মূর্তি পূজারী বর্বর আরব জাতির মধ্যে এমন পরিবর্তন সৃষ্টি করেন যে তারা মানব জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নৈতিকতাসহ নানা ক্ষেত্রে সবচেয়ে উন্নত সভ্যতা উপহার দিতে সক্ষম হয়।
হয়রত মুহাম্মাদ (সা:) বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের বানু হাশিম গোত্রে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। প্রচলিত ধারণা মোতাবেক, তাঁর জন্ম হয় ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট বা ১২ই রবিউল আওয়াল। বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতা আমেনা। মাতৃগর্ভে থাকাকালীন তাঁর পিতাকে হারান। শৈশবে মাতাকে হারিয়ে এতিম হন এবং প্রথমে তাঁর পিতামহ আবদুল মুত্তালিব ও পরে পিতৃব্য আবু তালিবের নিকট লালিত-পালিত হন। হেরা পর্বতের গুহায় ৪০ বছর বয়সে তিনি নবুওয়াত লাভ করেন। জিবরাঈল ফেরেশতা এই পর্বতের গুহায় আল্লাহর তরফ থেকে তার নিকট ওহী নিয়ে আসেন। তিন বছর পর ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মাদ প্রকাশ্যে ওহি প্রচার করেন এবং ঘোষণা দেন “আল্লাহ্ এক” ও তার নিকট নিজেকে সঁপে দেওয়ার মধ্যেই জাগতিক কল্যাণ নিহিত এবং ইসলামের অন্যান্য নবিদের মতো তিনিও আল্লাহর প্রেরিত দূত।
মুহাম্মদ (সা.) হলেন মহান চরিত্রের অধিকারী ও আদর্শের জীবন্ত প্রতীক। জন্মের পর হতেই তাঁর মাঝে বিরাজ করছিলো সর্বোত্তম চরিত্র মাধুরী, সর্বোত্তম আদর্শ,সর্বোত্তম মহৎ মানুষ ও সর্বোত্তম প্রতিবেশী ইত্যাকার মহত্তম গুণ। বাল্যকাল থেকেই তাঁর স্বভাব ছিলো কলুষতা,কাঠিন্য,কর্কশতা ও অহমিকামুক্ত। অনুক্ষণ তিনি ছিলেন দায়শীল,শ্রদ্ধাশীল সহানুভূতিশীল ও ঔদার্যশীল এবং নিষ্কলুষ নির্ভেজাল সোনা। তাইতো অতি অল্প বয়সেই আল-আমিন’ উপাধিতে বিভূষিত হন। অধিকন্তু পরনিন্দা, অশ্লীল ও অশিষ্ট বাক্য কখনোই তার পবিত্র মুখ হতে নিঃসৃত হয়নি। এক কথায় তিনি হলেন, সকল গুণের আঁধার। বিশ্ববাসী সকলের নিমিত্ত নমুনা ও মহান আদর্শ। প্রিয়নবী (সা.)-এর সর্বজনীন কল্যাণমুখী আচরণ ও কর্মকান্ড অভেদ মানবিক একাত্মতার সর্বোচ্চ উদাহরণ হিসেবে নন্দিত হয়েছে। শ্রেষ্ঠ রাসূলরূপে অনুপম চরিত্র মাহাত্ম্য ছিলো তাঁর মহিমার ভূষণ। এ জন্য আর্দশিক কারণে তাঁর শত্রু বা ভিন্ন মতাবলম্বীরাও তাকে বিশ্বস্ততার শ্রেষ্ঠ,অতুলনীয় প্রতীক হিসেবে সম্মান জানিয়েছে তাঁর সময়ে এবং পরবর্তী সময়ে দেশ-বিদেশে। রাসূল (সা.)- এর আগমন যে গোটা মানবজাতির তথা সৃষ্টি জগতের জন্য কল্যাণবহ,এ কথাটি ভিন্ন মতের তাত্ত্বিক কিংবা মূল্যায়নকারীরা কোনো-না-কোনো পর্যায়ে বলতে বাধ্য হয়েছেন। এ এক অনিবার্য অর্জন,বিজয়।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি নবীদের সর্দার। কিয়ামত পর্যন্ত আগত সব মানুষ ও জিনের জন্য নবী। তিনি শেষ নবী। তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবেন না। তাঁর সম্মান ও মর্যাদার সাক্ষ্য পবিত্র কোরআনসহ সব আসমানি গ্রন্থে রয়েছে। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে সৃষ্টিজগতের জন্য কল্যাণস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর চরিত্র মাহাত্ম্যের অত্যুজ্জ্বল আলোকমালায় উদ্ভাসিত হয়েছিলো আরববিশ্ব তথা সারাজাহান। যে মহামানবের সৃষ্টি না হলে এ ধরাপৃষ্ঠের কোনো কিছুই সৃষ্টি হতো না, যাঁর পদচারণে লাখ পৃথিবী ধন্য হয়েছে; আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা, অন্তরের পবিত্রতা, আত্মার মহত্ত্ব, ধৈর্য্য, ক্ষমতা, সততা, নম্রতা, বদান্যতা, মিতাচার, আমানতদারি, সুরুচিপূর্ণ মনোভাব, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা ও কঠোর কর্তব্যনিষ্ঠা ছিলো যাঁর চরিত্রের ভূষণ; যিনি ছিলেন একাধারে ইয়াতিম হিসেবে সবার স্নেহের পাত্র, স্বামী হিসেবে প্রেমময়, পিতা হিসেবে স্নেহের আধার, সঙ্গী হিসেবে বিশ্বস্ত; যিনি ছিলেন সফল ব্যবসায়ী, দূরদর্শী সংস্কারক, ন্যায়বিচারক, মহৎ রাজনীতিবিদ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে সংস্কারক, সফল রাষ্ট্রপ্রধান,প্রথম সংবিধান প্রণেতা শ্রেষ্ঠ মহামানব ও মানবতার মুক্তির জন্য আজীবন কঠোর সংগ্রামকারী প্রভৃতি সকল দিক দিয়ে তিনি সবারর জন্যই মডেল।
সততা উত্তম চরিত্রের পূর্বশর্ত, সততা উত্তম আদর্শ। সততার মাঝেই নিহিত আছে ইহকালিন সাফল্য ও পরকালের নাজাত। বলা বাহুল্য, জন্ম হতে মৃত্যু অবধি রাসূল (সা.) হলেন সততার মূর্ত প্রতীক। যার দরুণ মক্কার কাফির-মুশরিক সকলের সকাশে তিনি আস-সাদিক তথা সত্যবাদী নামে পরিচিত।
সৃষ্টির সেরা মানুষ হয়েও তিনি বিলাসতামুক্ত অত্যন্ত সাদা-মাটা ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) গাছের লতা-পাতা দিয়ে তৈরি করা বিছানায় ঘুমাতেন। এতে তাঁর শরীর মুবারকে দাগ হয়ে যেতো। সাহাবারা ভালো কোনো বিছানার ব্যবস্থা করার আবদার জানালে তার প্রতিউত্তরে তিনি বলতেন, ‘আমার দুনিয়ার প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই। আমি দুনিয়াতে একজন পথচারী ছাড়া আর কিছুই নই। যে পথচারী একটা গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে একটু পরে সেটা ছেড়ে চলে যায়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩৭৭)
বদান্যতা-দানশীলতা একটি মহৎ গুণ। এর পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিফলন মহানবী (সা.)-এর মাঝেই ঘটেছিলো। প্রিয়নবী (সা.) নিতান্তই দরিদ্র্য ও অসহায়ের ন্যায় দিনাতিপাত করতেন। তথাপি পৃথিবীর কোনো রাজা-বাদশাহের দান-দক্ষিণা তার ধারে কাছে পৌঁছতে পারেনি। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ মিলে তিরমিজি শরিফে। নবীজি (সা.)-এর কাছে একবার নব্বই হাজার দিরহাম আসলে তিনি একটি মাদুরের ওপর উপবেশ করে সেখান থেকে সমুদয় দিরহাম বণ্টন করে দিলেন। বণ্টন শেষ হওয়ার পরক্ষণেই এক ভিখারি এসে হাজির। নবী কারিম (সা.) বললেন, ‘আমার কাছে এখন কিছুই নেই। তাই আমার নাম বলে কারো কাছ থেকে কিছু নিয়ে নাও। পরে আমি তা পরিশোধ করে দিবো।’(খাসায়েলে নববী)
ইসলামপূর্ব সময়ে রাসূল (সা.) ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রবর্তন করে আমাদের ন্যায় বিচারের পথ দেখিয়েছেন। তাঁর বিচারব্যবস্থার লক্ষ্য ছিলো মানুষের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন: মানুষের মাঝে যখন বিচার করবে তখন ইনসাফের সাথে করবে।” (সূরা: আন নিসা : ৫৮) মদিনা নামক মডেল রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ছিলেন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন: আল্লাহ তা’য়ালার নাযিল করা বিধান মতে তাদের মধ্যে বিচার করুন”। (সূরা আল মায়িদাহ : ৪৮) তাঁর বিচারব্যবস্থায় ছিলো না কোনো দলীয়করণ,আত্মীয়প্রীতি,স্বজনপ্রীতি। তিনি ছিলেন সকল মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে।
প্রিয়নবী (সা.)-এর অনুপম বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে একটি বিশেষ গুণ হলো, উদারতা। ইসলাম আবির্ভাবের পর দুনিয়ার বুক থেকে এ গুণটি নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য বিধর্মীরা কোনো প্রচেষ্টাই বাদ রাখেনি। এমনকি প্রিয় নবীজির উপর নৃশংস নির্যাতনও চালিয়েছে তারা। তৎসত্ত্বেও সবসময় তিনি তাদের প্রতি ছিলেন উদার, ছিলেন মহৎপ্রাণ। মহানবী (সা.)-এর ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার অবস্থা এমন ছিলো যে, সমস্ত সাহাবায় কেরামদের ধৈর্য্যও একত্রে তার সমকক্ষ হবে না। এর একটি নমুনা হযরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর বর্ণনায় পরিলক্ষিত হয়। তিনি বলেন, ‘একবার এক বেদুঈন মসজিদে পেশাব করে দিলো। সাহাবিরা এ কান্ড দেখে রাগে রোষে তেড়ে এলেন। রাসূল (সা.) তখন তাদের থামিয়ে বললেন,‘তাকে তোমরা ছেড়ে দাও। যেখানে সে পেশাব করেছে, তাতে পানি ঢেলে দাও। স্মরণ রেখো, তোমাদের আসানী সৃষ্টিকারী হিসেবে পাঠানো হয়েছে। দুর্বিষহ বিড়ম্বনা সৃষ্টিকারী হিসেবে নয়।’ (বোখারি,কিতাবুল অজু)
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.) হলেন কালজয়ী জীবন ব্যবস্থা ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক। যেহেতু ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান তাই স্বাভাবিক ভাবে মানবাধিকারের বিষয়টি ইসলামের অন্তর্ভুক্ত। জনগুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকারের মতো সংবেদনশীল একটি বিষয় সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী, আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। তিনি কথা ও কাজে সারাটি জীবন মানবাধিকার সংরক্ষণে আপোষহীন সংগ্রাম করে গেছেন। এমনকি নবুওত প্রাপ্তির পূর্বেও মানবাধিকার প্রশ্নে তাঁর সোচ্চার কণ্ঠ আজও নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের প্রেরণার উৎস।
মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি উপাধি সাইয়্যিদুল আম্বিয়া বা নবীদের সর্দার। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে সব নবী-রাসূলের ওপর নেতৃত্বের মর্যাদা দান করেন।
জীবনের সবক্ষেত্রেই মহানবীর (সা) অনুসরণ করতে মহান আল্লাহ মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের ভাষায় জীবনে চলার পথ, মত ও স্বভাব বা আচরণের দিক থেকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন শ্রেষ্ঠ আদর্শ বা উসওয়াতুন হাসানাহ। জীবনের সব ক্ষেত্রে এবং কখন কোথায় কী করতে হবে তা জানার শ্রেষ্ঠ উৎস হলেন মহানবী (সা)। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইনি ও রাষ্ট্রীয় জীবনসহ জীবনের সব ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক ছিলেন মহামানব মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। যার পরশে বর্বর আরব জাতি পেয়েছিলো একটি আদর্শ সমাজ ও আদর্শ রাষ্ট্র। আর এ দিকে লক্ষ্য করেই ঐতিহাসিক বেমন্ডলাজ বলেন,’প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসে উেেল্লখযোগ্য প্রথম সামাজিক বিপ্লবের সূচনাকারি হলেন ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’। আজকের এই যুগের চিত্র এবং মুসলমানদের অবস্থা পর্যালোচনা করলে সোনালী সেই যুগ আমাদের কাছে আকাশ কুসুম মনে হবে। তবে সেই যুগ আর সেই সোনালী যুগের মানুষের ব্যক্তিগত জীবন,সামাজিক জীবন,রাষ্ট্রীয় জীবন,দাম্পত্য জীবন সবই আমাদের জন্য প্রেরণার বাতিঘর। এই বাতিঘর থেকে কিছু আলো সঞ্চয় করতে পারলেই আমাদের জীবন, আমাদের সমাজ, আমাদের রাষ্ট্র সবই সেই সোনালী যুগের আলোর ধারায় প্রবাহমান হবে।
বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে কাজ করে যেতে হবে সবাইকে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,‘আপনি তাদের বলে দিন হে রাসূল! তোমরা কাজ করে যাও, অচিরেই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং মুমিনগণ তা দেখবেন।’ তাই আমাদের কাজ করে যেতে হবে। সন্ত্রাস কোনো কাজ নয়, এটা হচ্ছে অপকর্ম। ক্রুদ্ধ হয়ে শক্তি প্রদর্শন করা কোনো বীরত্ব নয়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ক্রোধের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে সেই প্রকৃত বীর।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘মুসলিম তো সে-ই, যার হাত ও মুখ থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ একজন মুসলমান যদি প্রকৃতই তাঁর নবীর অনুসারী হয়, তাহলে অন্যায়ভাবে সে কোন মানুষ এমনকি পশুপাখিরও এতটুকু ক্ষতি করতে পারে না।
মহান আল্লাহ তা’আলা মানুষ সৃষ্টি করেছেন ইবাদতের জন্য; মানুষকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন খলিফা হিসেবে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)কে দুনিয়ায় পাঠানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহাগ্রন্থ কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে: ‘তিনি মহান আল্লাহ, যিনি পাঠিয়েছেন তাঁর প্রেরিত রাসুল (সা.)কে হিদায়াত (পথনির্দেশ) ও সত্য দ্বীন (জীবনবিধান) সহকারে; যাতে প্রকাশ্য বিজয়ীরূপে স্থাপন করতে পারেন দ্বীন ইসলামকে সব দ্বীনের (বিধান ও মতবাদ) ওপর; আর সাক্ষী ও সাহায্যকারী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা-৪৮ আল ফাত্হ, আয়াত: ২৮)।
মহানবী (সা.) যেসব লোককে তাঁর অনুপম আদর্শে উজ্জীবিত করে সোনার মানুষ করেছিলেন, তারা এক সময় ছিলো দাগী সন্ত্রাসী ও জঘন্য অপরাধী। নিজের শিশু কন্যাদের তারা নিজ হাতে যেন্ত কবর দিতো, তারা লুণ্ঠন করে জীবিকা নির্বাহ করতো, খুন আর ব্যাভিচার ছিলো তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সমাজে যদি বিচারপ্রার্থীকে নাজেহাল হতে না হয়, মজলুমের হক যদি ফিরে পাবার ব্যবস্থা হয়, উৎকোচের মাধ্যমে যদি নিরপেক্ষতা বিঘ্নিত না হয়, সর্বোপরি কারো ন্যায্য অধিকার যদি নিজস্ব শক্তিতেই প্রতিষ্ঠা পায়, তাহলে পেশী শক্তির প্রদর্শনী বন্ধ হয়ে যাবে।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কে দুনিয়ায় পাঠানোর উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে মহাগ্রন্থ আল কোরআন কারিমে বিভিন্ন সুরা ও আয়াত নাজিল করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন: ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সত্যসহ,সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী হিসেবে।’ (সুরা-২ আল বাকারা, আয়াত: ১২৯)। ‘আমি আপনাকে সুসংবাদ প্রদানকারী ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি।’(সূরা: ১৭ আল ইসরা/বনি ইসরাঈল, আয়াত: ১০৫ ও সুরা-২৫ আল ফুরকান, আয়াত: ৫৬)। ‘হে নবী (সা.)! নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সাক্ষী, শুভ সংবাদ প্রদানকারী ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি।’(সূরা-৩৩ আল আহযাব, আয়াত: ৪৫)। ‘অবশ্যই আপনাকে আমি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ (সুরা-৩৫ আল ফাতির, আয়াত: ২৪)। ‘নিশ্চিতরূপেই আপনাকে আমি সাক্ষী, শুভ বার্তাবাহক ও সাবধানকারী হিসেবে পাঠিয়েছি।’ (সূরা-৪৮ আল ফাত্হ, আয়াত: ৮)। এসব আয়াতে কারিমায় নবীজি (সা.)-এর আগমনের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দাওয়াতি কর্মপদ্ধতি সম্পর্কেও নির্দেশনা রয়েছে। তা হলো অসুন্দর, অন্যায়, অপরাধ ও মন্দ কাজের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করা এবং সুন্দর, ন্যায়, পরোপকার, কল্যাণকামিতা ও সৎকাজের শুভ পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করে মঙ্গল ও কল্যাণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা। যাতে মানুষ ইহজগতে চিরশান্তি, পরজগতে চিরমুক্তি, চিরকল্যাণ ও চিরমঙ্গল লাভ করতে পারে। স্বয়ং প্রিয় নবী (সা.) বলেন: ‘আমি প্রেরিত হয়েছি মানবজাতির চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনের নিমিত্তে।’ (তিরমিজি শরিফ)। এ জন্য প্রয়োজন ষড়রিপুকাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য নিয়ন্ত্রণ করা। প্রিয় নবী (সা.) নিজে আরো বলেন: ‘আমি আসলে শিক্ষকরূপেই প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসলিম)। তাই তিনি হলেন বিশ্বশিক্ষক।
বিশ্বনবী (সা.) কে আল্লাহ তা’য়ালা শুধু দু-একটি ছোটখাটো মামুলি উদ্দেশ্য নিয়ে দুনিয়ায় পাঠাননি; বরং বিশ্বমানবতার পরিপূর্ণ কল্যাণের মহতী উদ্দেশ্যেই মহানবী (সা.)কে এই জগতে পাঠানো হয়েছে। কোরআন মজিদে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা দিয়েছেন: ‘হে নবী (সা.)! আমি আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা-২১ আল আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)।
মহানবী হযরত মুহম্মাদ (সা.) ছিলেন সব শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য এক অনুপম আদর্শ। তিনি ছিলেন শিশুর আদর্শ, যুবকের আদর্শ, সৈনিকের আদর্শ, সেনাপতির আদর্শ, স্বামীর আদর্শ, পিতার আদর্শ, নানার আদর্শ, ব্যবসায়ীর আদর্শ, শিক্ষকের আদর্শ ও রাষ্ট্রনায়কের আদর্শ। পৃথিবীর অন্যকোনো মহামানবের ভেতরে এমন অপুর্ব দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না, যার সমাহার ও সংমিশ্রণ শুধু এই মহামানবের জীনাদর্শেই বিদ্যমান। তাঁর অনুসরণ-অনুকরণ করার মধ্যে মানব জীবনের ঐকান্তিক সফলতা নিহিত। রাসুল (সা.)পৃথিবীতে আগমন করেছেন সচ্চরিত্রের বিকাশ সাধনের লক্ষে। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আমাকে সচ্চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের নিমিত্তই প্রেরণ করা হয়েছে।’ (জামেউল আহাদিস : ৬৭২৯) জাগতিক উভয় জগতেই চূড়ান্ত সফলতা অর্জন।
মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন সৃষ্টির সেরা মানুষ। নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকরাও অকপটে স্বীকার করেছেন যে মুহাম্মাদ (সা.) সর্ব কালের, সর্ব যুগের শ্রেষ্ঠ মহামানব। রাসুল (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা কালাম, আয়াত : ৪)। অর্থাৎ নৈতিক চরিত্রের সর্বোচ্চ মানের ওপর আপনি অধিষ্ঠিত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নৈতিক চরিত্রের মান নিয়ে মক্কার মুশরিকদেরও অভিযোগ ছিলো না। তাঁর বিশ্বস্ততা ও উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাদের ছিলো না কোনো দ্বিমত।
মানবজাতিকে সঠিক পথ ও মুক্তির দিশা দেয়ার জন্য আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে দুনিয়াতে পাঠান। আল্লাহ বলেন, হে নবী! আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শকরূপে। আর আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী ও আলোকদীপ্ত প্রদীপ হিসেবে। (সূরা:আহযাব ৪৫-৪৬)।
বর্তমান বিশ্বে জাতিতে জাতিতে হানাহানি, রাহাজানি এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ড যে হারে বিস্তার লাভ করছে তা থেকে পরিত্রাণ লাভের একমাত্র উপায় হলো তাঁর প্রদর্শিত পথে চলা। তাঁর এই মহান অনুপম পূর্ণাঙ্গ সত্তার সান্নিধ্যে এসেই গোত্রে- গোত্রে,বর্ণে-বর্ণে,জাতিতে-জাতিতে, শ্রেণীতে-শ্রেণীতে বিভক্ত ও বিপর্যস্ত পৃথিবী এককালে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের সন্ধান পেয়েছিলো। কায়েম হয়েছিলো প্রেম প্রীতিময়, সাম্য-সৌহার্দ্যরে এক অতুলনীয় সমাজ ব্যবস্থা। বর্তমানেও শান্তির সন্ধান করতে হলে মানুষের ব্যক্তিগত জীবণ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক জীবন এবং রান্নাঘর থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত সবকিছুতেই তার আদর্শের সন্ধান করতে হবে। পারিবারিক জীবনেও তিনি যে আদর্শ স্থাপন করেছেন তা সকলের জন্য অনুসরণীয়।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) হলেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল। পৃথিবীর বুকে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবীর আবির্ভাব হবে না। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) গোটা মুসলিম জাতিকে উদ্দেশ করে বলে গিয়েছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে গেলাম। যতো দিন তোমরা এ দুটি জিনিসকে আঁকড়ে রাখবে ততো দিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হলো আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ কোরআন আর অপরটি হলো আমার সুন্নাহ অর্থাৎ হাদিস।’ উইলিয়াম মুরই বলেছেন,হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাকে শুধু সে যুগেরই একজন মনীষী বলা হবে না, বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী। শুধুমাত্র ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুরই নন,পৃথিবীর বুকে যত মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছে প্রায় প্রত্যেকেই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে তাঁদের মূল্যবান বাণী পৃথিবীর বুকে রেখে গেছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’(সূরা-আহযাব, আয়াত-২১)।
ব্যতিক্রমের প্রতি আকর্ষন মানুষের স্বভাবজাত,অন্যদিকে অলৌকিকত্বের প্রভাব আমাদের লৌকিক জীবনে সুদূর প্রসারী। আরবী মু’জেযা শব্দের অর্থ আসাধারন বিষয়, অলৌকিকত্ব। মুহাম্মদের (সা.) অসংখ্য মু’জেযার মধ্যে প্রকাশ্য মু’জেযার সংখ্যা দশ হাজারেরও অধিক। ব্যাখ্যাকারীগণ মুহাম্মদের (স.) মু’জেযাগুলোকে তিনভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করেছেন,প্রথমত যা তাঁর দেহ হতে বহির্ভূত। যথা- চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়া, বৃক্ষ নিকটে আসা,ঊট ও হরিনের অভিযোগ ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত যা তাঁর দেহস¤পৃক্ত যথা-‘মহরে নবুওয়াত’ যা হলো দুই কাঁধের মাঝখানে আল্লাহর রাসূল মোহাম্মাদ (সা.) বাক্যটি লেখা ছিলো মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। তৃতীয়ত তাঁর নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী যথা- নির্ভিক, অকুতোভয়া, দানশীল, সত্য ভাষণকারী, দুনিয়াবিমুখ ইত্যাদি।
আল কোরানের সুরা ক্বামারে মুহাম্মদের (সা.) আংগুল দ্বারা চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়ার কথা বলা আছে। বদর যুদ্ধের আগের দিন বদর নামক স্থানে পৌঁছে মুহাম্মদ (সা.) বললেন‘এটা আমুকের শাহাদাতের স্থান,এটা অমুকের (কাফেরের) হত্যার স্থান। সাহাবীরা (রা.) বলেন ‘রাসূলুল্লাহ! যার জন্য যে স্থান দেখিয়েছেন, তার সামান্য এদিক সেদিক হয়নি।’(মুসলিম) বিভিন্ন যুদ্ধে আকাশের ফেরেশতাগন অংশগ্রহণ করতো। যা আল্লাহর সাহায্য ও নবী করিম (সা.) এর মু’জেযার প্রমান।
জীবনের সফলতা পেতে হলে নবী করিম (সা.) এর আদর্শের পূর্ণ অনুসারী হতে হবে। তাঁর আদর্শ বাদ দিয়ে অন্য কারো আদর্শ অনুসরণ করে জীবনে সফল হওয়া যাবে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে,সে অবশ্যই মহাসাফল্য লাভ করবে।’ (সুরা আহযাব, আয়াত : ৭১)। জান্নাত প্রাপ্তির পূর্বশর্ত হিসেবে রাসুল (সা.)-এর অনুকরণের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, আল্লাহ তাকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশ দিয়ে নদী প্রবাহমান। আর সেটিই প্রকৃত সফলতা।’ (সূরা: নিসা, আয়াত : ১)।্
মহানবী (সা.)সৎ স্বভাব,সত্যনিষ্ঠা,সৌজন্যবোধ, বিনয় ও নম্রতার যে অনুপম শিক্ষা দিয়েছেন,তা আমরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পারস্পরিক সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারি। তাঁর সাধারণ জীবনযাপন, বিনম্র আচার-আচরণ, উপদেশাবলি অনুশীলন করলে এবং আদর্শ গুণাবলি নিজেদের জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে অনুশীলন করে চললে মানুষ ইহকালীন কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তি লাভে ধন্য হতে পারে। মানবজাতির আদর্শ হযরত মুহাম্মদ (সা.)। দুনিয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পরকালে মুক্তির জন্য তিনি জীবনভর মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বান করেছেন। হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে শ্রেণিবৈষম্যকে অতিক্রম করে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব জাগ্রত করেছেন।
বিশ্বে যারা রাসূল (সা.)-এর রেখে যাওয়া আদর্শ ও শিক্ষা অনুযায়ী বিভিন্ন গবেষণা কাজ করেছেন অথবা জীবনকে পরিচালিত করেছেন তাদের সবাই জীবনে সফল হয়েছেন। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্ব শান্তির আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে বিদায় হজ্বে দ্বীন তথা জীবন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গতার ঘোষণা দিয়ে গেছেন। সুতরাং জীবন ব্যবস্থাকে পূর্ণাঙ্গ ঘোষণা দেওয়ার পর নতুন করে কোনো জীবন পদ্ধতি অবলম্বন করার কোনো প্রয়োজন নেই কিন্তু এ কথা ভুলে মুসলমানসহ মানবজাতি রাসূলের জীবনাদর্শ থেকে বিমুখ হয়ে নতুন পদ্ধতির দিকে ঝুঁকে পড়ায় বিশ্ব অশান্তির দাবানলে জ্বলছে।
নবী মুহাম্মদ (সা.) জীবনের সকল দিক ও বিভাগে অনুসরণযোগ্য আদর্শ রেখে গেছেন। তাঁর আদর্শের মধ্যেই নেতা, কর্মী, শাসক, শাসিত সকলের জন্য পথের দিশা তথা হেদায়েতের আলো রয়েছে। রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, কূটনীতি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। পবিত্র কোরআনে যতো সুন্দর, সত্য, সততা, মানবতা ও কল্যাণময় গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে, তার নিখুঁত নিখাদ ও পরিপূর্ণ চিত্রায়ন ঘটেছিলো রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শে। মানব সমাজের উন্নতি, সামাজিক,সাংস্কৃতিক,আর্থিক ও চারিত্রিক সকল ক্ষেত্রে গৌরবময় উত্তরণের পথই হলো অনুসরণীয় আদর্শ। আদর্শহীন কোনো জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে সমাদৃত হতে পারে না। তাই আজকের এই করুণ ও অবক্ষয় মুহূর্তেও যদি মুসলিম উম্মাহ ফিরে পেতে চায় তাদের হারানো অতীত, তাহলে তাদের অনুসরণ করতে হবে প্রিয়নবী (সা.)-এর পবিত্র জীবনাদর্শ।
বহু শতাব্দী অতীত হয়ে যাওয়ার পরেও আজকের সমাজ ও সভ্যতা যতোটুকু অবশিষ্ট আছে তা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অবদান। আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর আগমন হয়েছিলো অন্ধকার পৃথিবীকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য। মহান আল্লাহর পরিকল্পনায় তিনি এলেন এবং পৃথিবীর কদর্যতাকে বদলে দিলেন। সভ্যতার বুনিয়াদ সুদৃঢ় করে গড়ে তুললেন এক সুরম্য প্রাসাদ। কায়েম করলেন শান্তি, সমৃদ্ধি ও অনুপম মানবসভ্যতা। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতিটি কর্ম ও পদক্ষেপ মানবতার অনুসরণযোগ্য। সফলতা ও কামিয়াবির মাধ্যম রাসূল (সা.) তাঁর প্রিয় সাহাবিদের ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ প্রত্যেক বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন। পৃথিবীতে যে সকল মহাপুরুষ দৃষ্টান্ত কালের ইতিহাস অক্ষর স্বাক্ষর রেখে গেছেন তার মধ্যে সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্ব মানবতার অগ্রদূত হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। তাঁর কর্মপদ্ধতি ও জীবন আদর্শ অনুসরণ করলে মু’মিনের জীবনে বয়ে যাবে প্রশান্তির ফল্গুধারা হবে জীবনপথের পাথেয়। সময়ের বালুকারাশির মধ্যে মহামানব হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যে পদচিহ্ন রেখে গেছেন তা স্মরণ করে আমাদের জীবনকে মহান ও মহিমাময় করে গড়ে তুলতে পারি।
বিশ্ব মানবতার দূত হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ১২ রবিউল আওয়াল, ১১ হিজরি মোতাবেক ৭ জুন, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। নবী মুহাম্মদ (সা.) ইন্তেকাল করলেও বিশ্ব ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন। সততা, ধৈর্য,সহনশীলতা ও ন্যায়পরায়ণতাসহ সব সদগুণাবলীর সমন্বয় ঘটেছিলো মহানবী (সা.)-এর জীবনে। লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষসহ মানবিক কোনো দুর্বলতা স্পর্শ করেনি তাঁকে। সারাজীবন কাটিয়েছেন সত্য ও ন্যায়ের পথে। তিনি অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে লড়েছেন কঠিন বিপদ আর প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও।

লেখকঃ গবেষক,সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,
চেয়ারম্যান গ্রীণ ক্লাব,মানিকগঞ্জ,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম