মাতা-পিতার অধিকার পালন মুক্তি ও সৌভাগ্যের সোপান

মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
পৃথিবীতে কেউ শিক্ষিত হয়ে জন্মায় না। মানবসন্তানকে সোনার মানুষে পরিণত করতে শিক্ষার বিকল্প নেই। সন্তানের এই শিক্ষাজীবন শুরু হয় মাতা-পিতার মাধ্যমেই। তাই বলা হয়, ‘মাতা-পিতা হলেন আদর্শ শিক্ষক, আর পরিবার হলো আদর্শ বিদ্যালয়।’ মাতা-পিতা সন্তানের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেন, যে গুরুদায়িত্ব পালন করেন, তা তুলনাহীন। সন্তানের ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগ থেকে সন্তান স্বনির্ভর হওয়া পর্যন্ত মাতা-পিতা তার লালন-পালন, ব্যয়ভার বহনসহ সব সময় তাঁর পাশে থাকেন।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা মাতা-পিতার অধিকার সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনেও মাতা-পিতার অধিকার সম্পর্কে বিশেষ বর্ণনা রয়েছে। মহানবী (সা.) মাতা-পিতার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন। মাতা-পিতার সন্তুষ্টির ওপর পরকালে মুক্তির শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। মাতা-পিতার অধিকার পালন মুক্তি ও সৌভাগ্যের সোপান।
পৃথিবীতে মানবসন্তান জন্মগ্রহণ করে সম্পূর্ণ পরনির্ভরশীল হয়ে। সে পারে না চলতে, পারে না কিছু বলতে। মা বুকের দুধ পান করিয়ে তাকে বড় করেন। পিতা তার সেবার সব উপকরণ জোগান দেন। আদর-যত্ন, স্নেহ, মায়া-মমতায় তাকে বড় করে তোলেন। নিজেরা কষ্ট করে হলেও সব দিক থেকে সন্তানকে নিরাপদে রাখেন। মমতাময়ী মা মাতৃস্নেহে সন্তানকে বড় করেন। সন্তানকে কথা বলতে শেখান ও হাঁটাচলায় তাকে সাহায্য করেন। এভাবেই মাতৃস্নেহে একটি শিশু বড় হতে থাকে। সন্তান যেখানেই থাকে, মা তাকে চোখে চোখে রাখেন। সন্তানের কোনো সমস্যা বা রোগবালাই হলে সবার আগে মাতা-পিতা তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়ান, সন্তানের জন্য বিচলিত হয়ে যান। সন্তানের থাকা-খাওয়া, পড়ালেখা, খেলাধুলা, চলাফেরা ইত্যাদি এমন কোনো কাজ নেই, যাতে মাতা-পিতা অবদান রাখেন না।
হযরত মুগীরা (রা.) হতে বর্ণিত নবী করিম (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তা’য়ালা মায়েদের নাফরমানী করা, হকদারের হক না দেয়া এবং কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়া, তোমাদের ওপর হারাম করে দিয়েছেন। আর আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের জন্য গল্প-গুজবে মত্ত হওয়া, অতিরিক্ত সওয়াল করা এবং মাল-সম্পদ নষ্ট করাকে অপছন্দ করেছেন। (বুখারী)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন এক ব্যক্তি তার মাতা-পিতাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় ত্যাগ করে হিজরাতের উদ্দেশ্যে বায়াত করার জন্যে নবী করীম (সা.) এর খেদমতে এসে হাজির হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন ফিরে যাও তোমার মাতা-পিতার কাছে এবং তাদের খুশী করে এসো যেমনি তাদের কাঁদিয়ে এসেছিলে। (আদাবুল মুফরাদ)
মাতা-পিতার সঙ্গে করণীয় সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আমি মানুষকে তাদের মাতা-পিতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। (কেননা) তার মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে এবং দুই বছর পরে তার বুকের দুধ ছাড়ানো হয়। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমার কাছেই।’ (সূরা : লোকমান,আয়াত : ১৪)
মাতা-পিতা হৃদয়ে ব্যথা অনুভব করবেন এমন আচরণ প্রদর্শন করা নিষিদ্ধ। সন্তান যেকোনো প্রতিকূলতায় তাঁদের সঙ্গে সম্মানসূচক আচরণ দেখাতে বাধ্য। এরশাদ হয়েছে, ‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন তিনি ছাড়া অন্য কারো উপাসনা না করতে ও মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে। তাদের উভয়ই বা কোনো একজন তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে (কোনো কারণে বিরক্ত হয়ে) তাদের ‘উফ্’ বলো না। তাঁদের ধমক দিয়ো না। বরং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো।’ (সূরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৩)
সন্তান মাতা-পিতার খেদমত করবে, তাদের ভরণ-পোষণ দেবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সেটা অবশ্যই হতে হবে সম্মানসূচক। সন্তান যতো বড় শিক্ষিত হোক, জ্ঞানী-গুণী হোক আর সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হোক সে যদি তার মাতা-পিতাকে অবমূল্যায়ন করে, তাহলে তার কাছ থেকে দেশ ও সমাজ কিছুই আশা করতে পারে না। মাতা-পিতার অবমূল্যায়ন নিজের জন্মকে অস্বীকারের শামিল। যে তার জন্মকেই স্বীকার করে না, সে তার দেশ ও সমাজকে আর কী দেবে? সুতরাং মাতা-পিতার জন্য ভালোবাসা ও শ্রদ্ধামিশ্রিত খেদমত করতে হবে।
মাতা-পিতার অবাধ্যতার শাস্তি দুনিয়া থেকেই শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘সব গুণাহ থেকে আল্লাহ যা ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। তবে মাতা-পিতার নাফরমানির গুণাহ ক্ষমা করেন না। এর শাস্তি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মৃত্যুর আগে দুনিয়ায় দিয়ে দেওয়া হয়।’ (মুসতাদরাক হাকেম, খন্ড ৪,পৃষ্ঠা ১৫৬)
মাতা-পিতার ঘনিষ্ঠ ও স্বজনদের খবরাখবর রাখা তাঁদের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের অন্তর্ভুক্ত। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘মাতা-পিতার সঙ্গে সদাচরণের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।’’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৫২)
কোরআনের বাচনভঙ্গি থেকে বোঝা যায়, সন্তানের পক্ষ থেকে মাতা-পিতার জন্য আর্থিক সেবাই শেষ কথা নয়। মূলকথা হলো, মাতা-পিতা যেনো সন্তানের কথা ও কাজে ব্যথা অনুভব না করেন। অর্থাৎ তাঁদের সন্তুষ্টি বিধানই মুখ্য। সন্তানের কথা, কাজে ও খেদমতে মাতা-পিতা যেনো সম্মান অনুভব করেন ইসলাম মাতা-পিতার এমনই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। এটা সন্তানের কোনো অনুগ্রহ নয়, দয়া-দাক্ষিণ্য নয়। এটা মাতা-পিতার প্রাপ্য। এই প্রাপ্য না দিলে আল্লাহর আদালতে জবাবদিহি করতে হবে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘ওই ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হোক! ওই ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হোক। ওই ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত (অর্থাৎ সে ধ্বংস হোক)। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! কে সে? তিনি বলেন, যে ব্যক্তি মাতা-পিতা উভয়কে অথবা তাঁদের কোনো একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেলো,অথচ সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না, সে ধ্বংস হোক।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর : ২৫৫১)
আবু আসির মালেক ইবনে রবিয়া (রা.) বলেন, “আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে বসা ছিলাম, এমতাবস্থায় বনু সালামা গোত্রের এক লোক এসে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করে, ‘মাতা-পিতার মৃত্যুর পরও কি তাঁদের সঙ্গে সদাচরণের দায়িত্ব আমার ওপর রয়েছে?’ রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘হ্যাঁ, তাঁদের জন্য রহমত ও মাগফিরাতের দোয়া করা, তাঁদের জীবদ্দশায় কৃত ওয়াদাগুলো পূরণ করা, তাঁদের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের বন্ধুবান্ধবের সম্মান করা।’” (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৪২)
সন্তানের কাছে মাতা-পিতার প্রাপ্য অধিকারই তাদের হক। সৃষ্টি জগতে মানুষের প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহ প্রদর্শনকারী ব্যক্তি হচ্ছে মাতা-পিতা। তাই মাতা-পিতাই তার সর্বাপেক্ষা আপনজন। মাতা-পিতার প্রতিই সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য সর্বাধিক। সন্তানের জন্য অবধারিত মাতা-পিতার প্রতি অবশ্য পালনীয় এসব দায়িত্ব কর্তব্যই মাতা-পিতার হক রূপে আখ্যায়িত হয়। মাতা-পিতার হক সম্পর্কে পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহ বলেন : ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সঙ্গে কোনো বস্তুকে শরীক করো না এবং মাতা-পিতার প্রতি উত্তম আচরণ কর।’ (নিসা ৩৬)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমার সর্বোত্তম ব্যবহারের হকদার কে? হুজুর (সা.) বললেন তোমার মা। লোকটি পুনরায় প্রশ্ন করলো অতঃপর কে? হুজুর (সা.) বললেন তোমার মা। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল অতঃপর কে? হুজুর (সা.) এবার জবাব দিলেন তোমার মা। লোকটি পুনঃজিজ্ঞেস করলো অতঃপর কে? এবারে নবী করিম (সা.)জওয়াব দিলেন যে, তোমার বাবা।’(বুখারী, মুসলিম)
পৃথিবীতে মায়ের মতো আপন কেউ নেই। একটি নবজাতক সন্তান যখন ভূমিষ্ঠ হয়ে সর্বপ্রথম এই সুন্দর পৃথিবীর আলোর মুখ দেখে, শত কষ্ট ব্যথা-যন্ত্রণা সহ্য করার পরও তখন সর্বাধিক আনন্দিত হন মা। আদরের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ভুলে যান সব দুঃখ-যন্ত্রণা। সন্তান ভূমিষ্ঠের পর তার লালন-পালনের সার্বিক দায়িত্ব মাকেই বহন করতে হয়। কত রাত মা সন্তানের জন্য নির্ঘুম কাটিয়ে দেন। শত প্রতিকূলতার মাঝেও সন্তানকে বুকের মাঝে আগলে রাখেন। আর বাবা তো বটবৃক্ষের ন্যায় উভয়কে মমতার ছায়ায় আবৃত রাখেন এবং সর্বদা সচেষ্ট থাকেন তাদের প্রয়োজন পূরণে। পৃথিবীতে নিখাদ ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা একমাত্র মা-বাবার কাছেই পাওয়া যায়। যদি কেউ মা-বাবার চেয়ে অধিক ভালোবাসা দেখায় তবে বুঝতে হবে সেটা প্রকৃত ভালোবাসা নয়। মহান রাব্বুল আলামিন মাতা-পিতাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে তাঁর ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে মাতা-পিতার সেবা ও আনুগত্যের নির্দেশ প্রদান করেছেন। সুতরাং আল্লাহ তা’য়ালার ইবাদত করা যেমন ফরজ, মাতা-পিতার খেদমত করাও তেমন ফরজ।
সন্তানের ওপর পিতামাতার প্রতি ১৪টি হক বা দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। এর মধ্যে সাতটি তাঁদের জীবদ্দশায় আর সাতটি তাঁদের ইন্তেকালের পর। জীবিত অবস্থায় ৭টি করণীয় কর্তব্য হলো সম্মান ও শ্রদ্ধা করা, ভালোবাসা, মান্য করা, সেবাযত্ন করা, সুখশান্তির চিন্তা ও ব্যবস্থা করা, প্রয়োজন পূরণ করা ও দূরে থাকলে দেখাসাক্ষাৎ করা। ইন্তেকালের পর ৭টি করণীয় হলো তাঁদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনামূলক দোয়া করা, ইবাদতের মাধ্যমে সওয়াব রেসানি করা, তাঁদের বন্ধুবান্ধব ও নিকট স্বজনদের সম্মান করা, তাঁদের বন্ধুবান্ধব ও নিকট স্বজনদের সাহায্য সহযোগিতা করা, তাঁদের ঋণ থাকলে পরিশোধ করা ও তাঁদের কাছে কারও গচ্ছিত আমানত থাকলে তা প্রত্যর্পণ করা, বৈধ অসিয়ত পূর্ণ করা, কবর জিয়ারত করা।
পিতা–মাতার জন্য করণীয় বিশেষ কিছু আমল: পিতা-মাতার মৃত্যুর পর বা বার্ষিকীগুলোতে প্রচলিত নিয়মে খাওয়া মেজবানির আয়োজন না করে নগদ টাকা গরিব মিসকিনকে দান করা অধিক উপকারী। পিতামাতার জন্য ফরজ ও নফল বদলি হজ ও ওমরাহ করা যায় এবং তাঁদের পক্ষে কোরবানিও করা যায়।
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা কর; যে আগুনের ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম, কঠোরস্বভাবের ফেরেশতাগণ, যারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করে না। তারা যে কাজে আদেশপ্রাপ্ত হয়, তাই তারা করে। ’ (সূরা তাহরিম,আয়াত: ৬৬)
বিশ^ মানবতার দূত হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই অধীনস্থদের (দায়িত্ব) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। পুরুষ তার পরিবার-পরিজনের দায়িত্বশীল; তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। নারী তার স্বামীগৃহের কর্ত্রী; তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।’(বুখারি, হাদিস নং: ৮৯৩, মুসলিম, হাদিস নং: ১৮২৯) রাসূল (সা.) আরও বলেন, ‘আল্লাহ যে বান্দাকে কোনো জনসমষ্টির দায়িত্বশীল করেন; কিন্তু সে এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে, সে তার অধীনস্থদের ব্যাপারে খেয়ানত করেছে; আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন।’ (মুসলিম, হাদিস নং: ১৪২)
বর্তমানে পরিবার একক পরিবার, মা-বাবা আর তাদের এক জোড়া সন্তান। সাধারণত দেখা যায়, যৌবন প্রাপ্তির পর সন্তান-সন্ততিরা এক নিজস্ব মনোজগৎ সৃষ্টি করে নেয়। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক এক গতানুগতিক সৌজন্যতায় পরিণত হয়েছে। এমন সময় সমাজের অনেক ব্যক্তির জন্য বৃদ্ধাবস্থা হয়ে পড়েছে কষ্টকর সময়। বিশেষ করে পুরুষদের থেকে নারীরাই বৃদ্ধাবস্থায় কোনো কোনো পরিবারে বোঝাস্বরূপ হয়ে পড়েছেন বলে মনে হয়। যা হওয়া উচিত নয় বরং হয়ে থাকলে তার পরিবর্তন হওয়া বাঞ্চনীয়। লক্ষণীয় তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত সন্তানের দ্বারা মা-বাবারা বেশি অবহেলিত। ব্যক্তিগতভাবে আমি দেখেছি, সন্তান উচ্চ শিক্ষিত, ভালো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। কিন্তু পিতাকে তার ভরণপোষণ আদায়ের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। আবার অনেককে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়ে আপমানের গস্নানি নিয়ে শেষ জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। বৃদ্ধাশ্রম নয়, অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা নিজ পরিবারে।
সব ভালোবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধতা থাকে কিন্তু সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের ভালোবাসার মধ্যে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। জীবনের শেষ বিন্দু দিয়ে সন্তানদের সুখী করতে চান পিতামাতা। শিশুর বয়স বেড়ে ওঠার পর মাতা-পিতার দায়িত্ব হয়ে পড়ে তাদের সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। মা তার সন্তানদের লেখাপড়ার অভ্যন্তরীণ সর্বদিকে দৃষ্টি রাখেন আর বাবা তাদের শিক্ষার ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থসংক্রান্ত ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এতে তাদের যদি কিছু অসুবিধা হয়েও থাকে তা তারা সন্তানের মুখ পানে চেয়ে হাসিমুখে বরণ করে নেন। সন্তান বিপদগামী হয়ে পড়ছে কি-না, আদব-কায়দার বরখেলাপ করে কিনা এ সব দিকে তীক্ষè দৃষ্টি রাখেন। সন্তানের নিকট পিতা-মাতার চাওয়া-পাওয়ার শুধু একটাই যা হলো- সুসন্তান হয়ে পিতা-মাতার মুখ উজ্জ্বল করা। যদি কোনো সন্তান সুশিক্ষিত হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয় এবং সুনাম অর্জন করতে পারে তাহলে পিতা-মাতার আনন্দের সীমা থাকে না। সব পিতা-মাতাই চান তার সন্তান শিক্ষিত, আদর্শবান ও চরিত্রবান হয়ে সমাজে দশজনের মুখে প্রশংসিত হোক। সুতরাং এমন পরম হিতৈষীর জন্য আমাদেরও করণীয় রয়েছে। তাদের সেবাযত্নের বিন্দুমাত্র ত্রুটি করতে নেই। পিতা-মাতা যেনো নিজেদের উপেক্ষিত বলে মনে না করতে পারেন তার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। যাদের অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালোবাসায় আমাদের জীবন সার্থক হয়েছে বৃদ্ধ বয়সে তারা কর্মক্ষম হয়ে পড়েন। তখন তাদের প্রতি দৃষ্টি রাখা আমাদের কর্তব্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে,বর্তমানে পিতা-মাতাকে সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার জন্য আদালতে যেতে হচ্ছে। প্রবর্তিত জীবনযাত্রার মানুষের মানসিক মূল্য এবং চিন্তাধারার পরিসর সংকুচিত হচ্ছে। তাই যৌথ পরিবারের ধারণা আজকের জীবনযাত্রার এক অবাস্তব কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ পৃথিবীতে বস-বাসরত মানুষ পরস্পর বিভিন্ন সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। এর মধ্যে প্রথম ও প্রধান হলো পারিবারিক বা জন্মসূত্র সম্পর্ক, যা কেউ প্রাণান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনভাবে অস্বীকার করতে পারেনা। যেমন ১। মা-বাবার সাথে সন্তানের সম্পর্ক। ২। ভাই-বোন পরস্পর সম্পর্ক। এদেরকে বলে রক্তের সম্পর্ক। এরা হলো উত্তরাধিকার পরস্পরা। আর সর্বাপেক্ষা নিকটতম সম্পর্ক হলো, মাতা পিতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক। যে দিন এ সম্পর্ক বিলুপ্ত হবে, সেদিন থেকে পৃথিবী থেকে মানব সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটবে। মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বলতে হয়: জন্মের পর পিতা-মাতাই সন্তানের ভরণ পোষণ,সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ও তাকে যথোপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। তাই ধর্মীয় দৃষ্টিতে পিতা-মাতার ঋণ অপরিশোধ্য। আবার বার্ধক্যে মাতা-পিতা অক্ষম হয়ে সন্তাননের দয়া মায়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তখন আবার সামাজিক এবং ধর্মীয় বিধানে মাতা-পিতার ভরণ-পোষণ সেবা-যত্ন করা সন্তানের অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য।
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, মু’মিনের ওপর আল্লাহর পর সব চাইতে বড় অধিকার হলো মাতা-পিতার। এ জন্য আল্লাহর এবাদতের পরই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মাতা-পিতার সাথে ভালো ব্যবহারের। মাতা-পিতা বৃদ্ধ অবস্থায় রোগ-শোকের কারনে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়,তাই অনেক সময় তারা তোমাদের সাথে যদি খারাপ আচরণ করে তা হলে বিরক্ত হয়ে কখনো তাদের সামনে উহ্ শব্দটি উচ্চারণ পর্যন্ত নিষেদ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আরও বলা হয়েছে: তোমার জন্ম থেকে নিয়ে বড় হয়ে উঠা পর্যন্ত তোমার প্রতি তাদের যে ত্যাগ কষ্ট পরিশ্রম দিতে হয়েছে, তোমাদের সেবা আদর আপ্যায়ন ভালো ব্যবহার দিয়ে পরিশোধ করা কোন সন্তানের পক্ষে সম্ভব নয়। তা কেবল তার প্রতিদান শুধু বিশ্ব জাহানের মালিক যিনি তার পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। তাই প্রতিটি সময় তাঁদের সুখ শান্তির জন্য আল্লাহর নিকট “রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বাআনি ছগীরা” বলে তাদের জন্য দোয়া করতে বলা হয়েছে।
আল্লাহ তা’য়ালা সমস্ত সৎকাজের ফলাফল কিয়ামত পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখেন, কিন্তু মাতা-পিতার অবাধ্যতার ফল (শাস্তি) দুনিয়াতেই দিয়ে থাকেন (ইবনে হাকিম)। কোরআন এবং রাসূল (সা:)এর হাদিসে পিতার চেয়ে মাতার মর্যাদা তিনগুণ বেশি বলেছেন। কারণ হিসাবে বলেছেন:-মা সন্তানকে কষ্ট করে দশ মাস পেটে ধারণ করেছেন, মৃতুঝুঁকি নিয়ে প্রসব করেছেন । রাসুল (সাঃ) আরো বলেছেনঃ-“মায়ের পায়ের তলায় সন্তানের জান্নাত।”
রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী বাবা-মাকে ভরণপোষণ দিতে সন্তান বাধ্য থাকবে। না দিলে তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো মা-বাবা আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। অবহেলিত পিতা-মাতার দুঃখ-কষ্ট লাঘব করার জন্য সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে সরকার ২০১৩ সালে পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন প্রণয়ন করে।
পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সন্তান তার বাবা বা মাকে অথবা উভয়কে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবেন না। তা ছাড়া সন্তান তার মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেবেন ও পরিচর্যা করবেন।
আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী, মা-বাবার ভরণপোষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দাদা-দাদি, নানা-নানিরও ভরণপোষণ করতে হবে। তবে বাবা যদি বেঁচে থাকেন তাহলে সন্তানকে দাদা-দাদির এবং মা বেঁচে থাকলে নানা-নানির ভরণপোষণ করতে হবে না। ওই আইনের ৫ ধারার (১) অনুযায়ী, কোনো প্রবীণ ব্যক্তি তার সন্তানদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আনলে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ড দেওয়া হবে।
আইনে বলা হয়, কোনো সন্তানের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে বা নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেন, তাহলে তারাও একই অপরাধে অপরাধী হবেন। ফলে তাদেরও একই শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। সবশেষে বলব, শুধু আইন দিয়ে এ অমানবিক বিষয় রোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন ধর্মীয় অনুশাসনও মেনে চলা। আমাদের সবারই পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পরায়ণ হওয়া উচিত।
পৃথিবীতে হাজারও সম্পর্কের মাঝে সব থেকে তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্কের বন্ধন গড়ে ওঠে সন্তান এবং মাতা-পিতার মধ্যে। যারা আমাদেরকে এই পৃথিবীতে এনে এর অফুরন্ত সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ করে দিল তারা আমাদের শ্রদ্ধেয় বাবা-মা। খুব অসহায় অবস্থায় একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে। পৃথিবীতে এসে পিতা-মাতার যথাযথ লালন-পালন, আদর, স্নেহ, মমতা ও শিক্ষা-দীক্ষার মাঝে বেড়ে উঠে সন্তান। সুতরাং সন্তানের জীবনে পিতা-মাতার অবদান অনস্বীকার্য। পিতা-মাতার এই অবদান পরিমাপ করা বা এর মূল্য নির্ণয় করা কোনো সন্তানের পক্ষেই পুরোপুরিভাবে সম্ভব নয়। সন্তানের জন্য পিতা-মাতা একমাত্র নিরাপদ স্থান। সুতরাং প্রত্যেক সন্তানের উচিত মাতা-পিতার প্রতি তাদের যে কর্তব্য তা সঠিকভাবে পালন করা এবং সব সময় তাদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা।
পিতা-মাতার খেদমত যেমন ইবাদত, তাঁদের অনুপস্থিতিতে তাঁদের বন্ধু-বান্ধব ও সমবয়সীদের খেদমত করাও অনুরূপ ইবাদত। যেহেতু মেয়েরা স্বামীর সংসারে গেলে পিতা-মাতার সরাসরি খেদমত করার সুযোগ কম থাকে, তাই শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করলে পিতা-মাতার খেদমতের সওয়াবের অধিকারী হবে। পুত্রবধূর ওপর শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমত করা নফল। নফল ইবাদতে কাউকে বাধ্য করা যায় না বা জোর-জবরদস্তি করা যাবে না। যেহেতু সংসারের রীতি অনুযায়ী নারীদের নিজ পিতা-মাতা ছেড়ে স্বামীর সংসারে যেতে হয় এবং তার পিতা-মাতার সংসারে অন্য আরেকজন নারী বধূ হয়ে আসে; তাই প্রত্যেক নারী যদি শ্বশুর-শাশুড়িকে পিতা-মাতা জ্ঞান করে সেবা ও খেদমত করেন, তবে সব পিতা-মাতা ও সব শ্বশুর-শাশুড়ি সমানভাবে সেবা ও খেদমত পাবে। শ্বশুর-শাশুড়িরও উচিত পুত্রবধূকে মেয়ে মনে করা এবং সেইরূপ আচরণ করা। সবাই সবার আপন আপন দায়িত্ব পালন করলেই সবার নিজ নিজ অধিকার সংরক্ষিত হয়। মনে রাখতে হবে, ভালোবাসা দিলে ভালোবাসা পাওয়া যায়। স্নেহ করলে সম্মান ও শ্রদ্ধা পাওয়া যায় আর সেবা ও খেদমত করলে স্নেহাশীষ হওয়া যায়। এভাবেই সংসারজীবন ও দাম্পত্য জীবনে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি আসবে, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হবে, সমাজ স্থিতিশীল হবে। আজ যারা সন্তান,আগামি দিনে তারাই হবে পিতা-মাতা। আজ যারা বধূ বা জামাতা, আগামীকাল তারাই হবে শ্বশুর বা শাশুড়ি। সুতরাং, আজকের সন্তানেরা যদি তাদের পিতা-মাতার খেদমত করে, তবে তাদের সন্তানেরা তাদের থেকে দেখে শিখবে কীভাবে পিতা-মাতার খেদমত করতে হয় এবং তাদের বার্ধক্যেও তারা তাদের সন্তানের কাছ থেকে অনুরূপ খেদমত পাবে। আজকের বধূ ও জামাতারা যদি শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি দায়িত্ব পালনে যত্নশীল হয়, তবে পরবর্তী প্রজন্ম তা দেখে শিখবে এবং তারা যখন শ্বশুর-শাশুড়ি হবে, তখন সেইরূপ সেবা ও সম্মান পাবে। এভাবেই গড়ে উঠবে সুখী, সুন্দর ও আনন্দময় পারিবারিক পরিবেশ। জান্নাতি সুখে ভরে উঠবে দুনিয়ার পরিবেশ।
সদাচারের ক্ষেত্রে মাতা-পিতার স্থান হলো সকল মানুষের ঊর্ধ্বে। কেননা, মানব জন্মের মূল হলো মাতা-পিতা। সন্তানের নিকট তাদের চেয়ে বড় আপনজন পৃথিবীতে অন্য কেউ নেই। তাঁরাই হলেন সন্তানের প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহ ও দয়া প্রদর্শনকারী। তাঁদেরকে সম্মান করা, শ্রদ্ধা করা, ভক্তি করা, প্রত্যেকটি সন্তানের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। শুধু তাই নয়; বরং এগুলো তাঁদের হক বা অধিকার।

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,লেখক,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম