মো. আলতাফ হোসেন ঃঃ
তিতুমীর,যাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী। তিনি ওয়াহাবী আন্দোলন এর সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি জমিদার ও ব্রিটিশদের বিররুদ্ধে সংগ্রাম ও তাঁর বিখ্যাত বাঁশের কেল্লার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিতুমীর চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়া থানার হায়দারপুর গ্রামে (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে) জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ মীর হাসান আলী এবং মাতার নাম আবিদা রোকেয়া খাতুন। তিতুমীরের প্রাথমিক শিক্ষা হয় তাঁর গ্রামের বিদ্যালয়ে।পরবর্তীকালে তিনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসাতে লেখাপড়া করেন। ১৮ বছর বয়সে তিতুমীর কোরআনে হাফেজ হন এবং হাদিস বিষয়ে পান্ডিত্য লাভ করেন। একই সাথে তিনি বাংলা, আরবি ও ফার্সি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।
১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে যান। তিনি সেখানে আরবের স্বাধীনতার অন্যতম পথপ্রদর্শক সৈয়দ আহমেদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ও ওয়াহাবী মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। সেখান থেকে এসে তিতুমীর তাঁর গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে ‘তাহ্বান্দ’ নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান শুরু করেন। তিতুমীর হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক মুসলমানদের ওপর বৈষম্যমূলকভাবে আরোপিত ‘দাঁড়ির খাজনা’ এবং মসজিদের করের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিতুমীর ও তার অনুসারীদের সাথে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হতে থাকে। আগেই তিতুমীর পালোয়ান হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং পূর্বে জমিদারের লাঠিয়াল হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
তিতুমীরের অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলেন। তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে এক সময় ৫,০০০ গিয়ে পৌঁছায়। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়। ১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাসতের কাছে বাদুড়িয়ার ১০ কিলোমিটার দূরে নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে তারা বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন। বাঁশ এবং কাদা দিয়ে তারা দ্বি-স্তর বিশিষ্ট এই কেল্লা নির্মাণ করেন। তিতুমীর বর্তমান চব্বিশ পরগনা, নদীয়া এবং ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার পরাজয় বরণ করে। তন্মধ্যে বারাসাতের যুদ্ধ অন্যতম। উইলিয়াম হান্টার বলেন, ঐ বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষকসেনা তিতুমীরের পক্ষে যুদ্ধ করেন।
তিতুমীর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারেন যে, ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে প্রয়োজন সমর প্রস্তুতি ও উপযুক্ত সেনা-প্রশিক্ষণ। সেনাবাহিনীর আত্নরক্ষার প্রয়োজনে তিনি একটি দুর্গ নির্মানের প্রয়োজনীতা গভীরভাবে অনুভব করেন। সময় এবং অর্থাভাবে তিনি আপাতত কলিকাতার নিকটবর্তী নারিকেলবাড়িয়া নামক স্থানে একটি বাশের কেল্লা বা দুর্গ নির্মান করেন। ইতিহাসে এ কেল্লাই নারিকেলবাড়িয়া বাঁশের কেল্লা নামে বিখ্যাত।
১৮৩১ সালের ১৩ নভেম্বর ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তিতুমীর স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন, “ভাইসব, একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াইতে হার-জিত আছেই, এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যদা অনেক। তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এ দেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে। আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে। কর্নেল হার্ডিং-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের আক্রমণ করে। তাদের সাধারণ তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তার সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারেন নি। ১৪শে নভেম্বর তিতুমীর ও তার চল্লিশ জন সহচর শহীদ হন। তার বাহিনীর প্রধান মাসুম খাঁ বা গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বাশেঁর কেল্লা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
অনেক ঐতিহাসিক তিতুমীরের লড়াইকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় আখ্যা দেন কারণ মূলত হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে তিতুমীর যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। একথা সত্য তিতুমীর প্রজাদের একজোট করেছিলেন ধর্ম এবং জেহাদের ডাক দিয়ে। ঐতিহাসিক বিহারীলাল সরকার, নদীয়া কাহিনীর রচয়িতা কুমুদ নাথ মল্লিক তিতুমিরকে ধর্মোন্মাদ ও হিন্দু বিদ্বেষী বলেছেন। অত্যাচারী হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায়কে আক্রমন, দেবনাথ রায় হত্যা, গো হত্যা ইত্যাদির উদাহরণ হিসেবে টানা যায়। অপরপক্ষে অমলেন্দু দে’র ভাষায় তিতুমীরের লক্ষ্য ও পথ ছিলো ইসলামে পূর্ন বিশ্বাস এবং হিন্দু কৃষকদিগকে সাথে নিয়ে ইংরেজ মদতপুষ্ট জমিদার ও নীলকরদের বিরোধিতা। তিতুমীরের আক্রমের লক্ষ্যবস্তু হিন্দুদের পাশাপাশি ধনী মুসলমানও ছিলো। তার বক্তৃতা শোনার জন্যে দলে দলে হিন্দু মুসলিম কৃষক জমা হতো। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের ভাষায় তিতুমীরের এই সংগ্রাম ছিলো প্রকৃত কৃষক বিদ্রোহ যার অভিমুখ ছিলো অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর সাহেবরা।
বিপ্লবী,বিদ্রোহী মীর নিসার আলী বেশি পরিচিত শহীদ তিতুমীর হিসাবে। তিনি শুধু ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধেই লড়াই করেননি, তিনি বাংলার জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করেছিলেন, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তাঁর বাঁশের কেল্লা থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মীর নিসার আলী তিতুমীরের নাম উজ্জল হয়ে আছে। নীলচাষীদের বিদ্রোহের পিছনে ছিলো অর্ধ শতাব্দী ধরে নীল চাষীদের ওপরে ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচার ও নিপীড়ন। ভারতীয় উপমহাদেশের মাটি নীল চাষের উপযোগী হওয়ায় ব্রিটিশ নীলকররা এতে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করেছিলো। প্রথমদিকে নীলচাষ একচেটিয়া ছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। তিনি সর্বপ্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
সৈয়দ মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর, ওয়াহাবীবাদ বা ওয়াহাবী আন্দোলন নামে ইসলাম ধর্মের এক ধর্মীয় আন্দোলনের সাথে যুক্ত ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী নামেই ইতিহাসে জায়গা করে আছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন, কাজেই, বুঝতে পারছেন, তার জন্ম হয়েছিলে ব্রিটিশ আমলে, ১৭৮২ সালে। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলাসহ সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী তিনি এক সুসংগঠিত স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ছিলেন। তাঁর এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিলো বাংলা ও ভারতে একটি অখন্ড ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তৎকালীন ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের অন্ধ প্রদেশ থেকে শুরু করে মর্দান পর্যন্ত, বিশাল অঞ্চলে সৈয়দ আহমেদ ব্রেলভী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ইসলামী শাসনব্যবস্থা চালু করেছিলেন।
মুসলিম সমাজে শিরক ও বিদআতের অনুশীলন নির্মূল করা এবং মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের অনুশাসন অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করাই ছিলো তিতুমীরের আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য। কিন্তু পরবর্তীতে তিতুমীরের শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে অত্যাচারী জমিদারগণ তাঁর বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ সৃষ্টি এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইংরেজদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করলে তিতুমীরের আন্দোলন রূপ নেয় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে।
মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালেই তিতুমীর পালোয়ান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান কুস্তিগীর। একসময় তিনি জমিদারের লাঠিয়াল হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। তাই আন্দোলন শুরূ করলে, অত্যাচারী জমিদারদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে তিনি তার অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলেন। জমিদারদের অত্যাচার মোকাবিলা এবং কৃষকদের নিরাপত্তা দানের লক্ষ্যে তিতুমীর এক মুজাহিদ বাহিনী গঠন করেন। এবং তাদের লাঠি ও অপরাপর দেশিয় অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ দান করেন।
তিতুমীর, বিপ্লবের অপর নাম। বাংলার প্রজাদের ওপর স্থানীয় জমিদার এবং ইউরোপীয় নীলকরদের অত্যাচার প্রতিরোধ এবং ব্রিটিশ শাসন থেকে বাংলাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত আন্দোলনের নেতা শহীদ তিতুমীর। প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য ছিলো সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার। মুসলিম সমাজে শিরক ও বিদআতের অনুশীলন নির্মূল করা। মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের অনুশাসন অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করাই ছিলো তাঁর আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য।
১৮০১ সালে কোরআনে হাফেজ হন এবং হাদিস বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করেন। সেই সঙ্গে বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষা, দর্শন ও কাব্যশাস্ত্রে সমান দক্ষতা অর্জন করেন। এর আগে ও পরে তিনি বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। ১৮০৮-১৮১০ সালের দিকে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতা শহরে যান। সেখানেও কুস্তি প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিতেন। কুস্তি লড়াইয়ে প্রথম হলে কলকাতার মির্জাপুর এলাকার জমিদার মির্জা গোলাম আম্বিয়ার নজরে পড়েন। তার সাহায্যে সামরিক কৌশল আয়ত্ব করেন। কর্মজীবন শুরুর আগেই তিতুমীর চব্বিশ পরগণার বাদুড়িয়ার খালপুর গ্রামের হযরত শাহ সূফী মুহম্মদ রহীম উল্লাহ সিদ্দিকীর মেয়ে মায়মূনা খাতুনকে বিয়ে করেন।
শহীদ তিতুমীর একটি ইতিহাস ও একটি নাম যা মানুষকে আজও অনুপ্রেরণা দেয়। পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের কাছে অতিপ্রিয় নাম শহীদ তিতুমীর। স্বাধীনচেতা পালোয়ান তিতুমীরকে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠী অসম্ভব ভয় পেতো। ব্রিটিশের পালিত স্থানীয় জমিদাররা তাঁর নাম শুনে হতো আতঙ্কিত। ব্রিটিশ বেনিয়ার অত্যাচার থেকে এ দেশের অসহায় মানুষকে মুক্তির জন্য তিনি আপসহীন সংগ্রাম করেছেন। সাহসী তিতুমীর ইসলামের ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার সাধন এবং শিরক-বিদয়াত থেকে মুসলমানদের মুক্তির জন্য আজীবন লড়াই করেছেন। তিতুমীরের এ লড়াই পাক-ভারত মুসলিম ইতিহাসের এক অনন্য বীরত্বগাঁথা এবং এক গৌরবময় অধ্যায়।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নখরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত এ দেশকে মুক্ত করার সংকল্প নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন অমিত তেজি বীর সিংহ পুরুষ তাঁর নাম সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর। শৈশবেই পিতৃহীন হলে দাদার আদর-যত্নে লালিত-পালিত হন নিসার আলী। পাঁচ বছর বয়সে স্থানীয় মক্তবে ভর্তি হন। জনৈক স্বাধীনচেতা শিক্ষকের সাহচর্য লাভ করে তিনি রাজনীতি ও মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে সচেতন হন। তাঁর শিক্ষার ফলে তিতুমীরের মনে স্বাধীনতার স্পৃহা জন্মে। ইসলামী পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা তার মনে স্থান লাভ করে।যুবক তিতুমীর স্বদেশ ও স্বজাতির জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। হজ¦ পালন করার উদ্দেশ্যে মক্কা গেলে সেখানে অগ্নিপুরুষ ভারতবর্ষের মুসলমানের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর আদর্শ তাঁকে অনুপ্রেরণা জোগায়। কয়েক বছর তাঁর সঙ্গে কাটানোর পর কলকাতায় ফিরে আসেন। ইংরেজ সরকার মুসলমানদের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানরা ভীতসন্তস্ত্র। খাওয়া-পরা, চিকিৎসা, বাসস্থানের সামান্য সুযোগ থেকেও তারা বঞ্চিত। ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের ওপর একদিকে শোষণ করছে অন্যদিকে একশ্রেণীর হিন্দুদের ওপর তোষণ এই দ্বিমুখী নীতি চালাচ্ছে। এতে করে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুসলমান শ্রমিক-কৃষক ও নিম্নবিত্ত শ্রেণি তাদের অত্যাচারে, অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তিতুমীর ইসলামী আদর্শকে সামনে রেখে এক বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করলেন। বাঙালি কৃষক-মজুরসহ মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন। তিনি বললেন, হে ভাইয়েরা! মুসলমানরা এক আল্লাহর গোলামি ছাড়া অন্যের গোলামী করবে না। আমরা আমাদের গৌরব ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে যাব। কিশোর যুবকসহ শত শত মানুষ এসে সমবেত হলো তিতুমীরের আহ্বানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার সংকল্প নিয়ে বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের সেনানায়ক সিপাহসালার সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর ১৮৮২ সালে নারকেল বাড়িয়ায় একটি মজবুত বাঁশের কেল্লা তৈরি করলেন তাঁর বিপ্লবী বাহিনী নিয়ে। ইংরেজ সাম্রাজ্য লোভীদের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ।
কুটিল বুদ্ধির স্টুয়ার্ট হঠাৎ করে যুদ্ধের কৌশল হিসেবে সন্ধির প্রস্তাব দিলেন। ইসলামের বীর সৈনিক বাঙালি মুসলিম সেনানায়ক তার প্রস্তাব মেনে নেন এবং স্টুয়ার্টের দিকে অগ্রসর হন। এ সময় কাপুরুষ স্টুয়ার্ট অকস্মাত গুলি চালান তিতুমীরের ওপর। বঙ্গশার্দুল তিতুমীর রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়েন। শাহাদতবরণ করেন বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী পুরুষ আধ্যাত্মিক নেতা সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর। কামানের গোলায় বাঁশের কেল্লা উড়িয়ে দেয়া হয়। সেনাপতি গোলাম মাসুমকে ধরে নিয়ে গিয়ে মিথ্যাবিচারের প্রহসন করে ফাঁসি দেওয়া হয়। এছাড়া শত শত কর্মীকে ও সিপাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য তিতুমীর জীবন দান করে যে, পথ নির্দেশ দিয়ে গেছেন পাক-ভারতীয় মুসলমান তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আজ স্বাধীনতা লাভ করেছে। বিশেষকরে বাঙালি মুসলমানের স্বাধীকার ও স্বাধীনতার পথিকৃত বলে আমরা মহান নেতা তিতুমীরকে চিহ্নিত করতে পারি।
ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের অন্যতম একটি স্মরণীয় দিন। এদিন ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা, বাংলার বীর মীর নেসার আলী তিতুমীরের শাহাদাত দিবস। সেদিন ইংরেজ সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় এজেন্ট অত্যাচারী জমিদারদের সম্মিলিত গুলিবর্ষণে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন তিতুমীরসহ ৫০ জন স্বাধীনতাকামী বীরযোদ্ধা। গ্রেফতার করা হয়েছিলো আরও ৩৫০ জনকে। যাদেরকে পরে বিচারের নামে ফাঁসি ও যাবজ্জীবন কারাদন্ডসহ বিভিন্ন শাস্তি দেয়া হয়েছিলো দেশের গরীব কৃষকদের পক্ষে কথা বলার জন্য। শহীদ তিতুমীরসহ নিহত মুসলমানদের লাশগুলিকেও প্রকাশ্যে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে কজন বাঙালি বিপ্লবী সাড়া জাগিয়েছিলেন তাদের মধ্যে শহীদ তিতুমীরের অবস্থান সামনের কাতারে। সমরশক্তি ছাড়া শুধুমাত্র মানসিক পরাক্রম দ্বারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর সাহসিকতার স্ফুলিঙ্গ তাঁকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। নিজের জীবনের বিনিময়েও অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি কখনো। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ছিলেন সকলের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার পাত্র। চেষ্টা করেছেন সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব করবার। পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন সশস্ত্র বিপ্লব। শেষ পর্যন্ত দেশের পক্ষে লড়াই করে জীবন দিয়েছেন, তবুও ইংরেজদের হাতে ধরা দেননি। স্বাধীন করতে পারেননি দেশকে, তবে দেখিয়ে গেছেন সাহসিকতার নমুনা। তাঁকে দেখে আগ্রহী হয়েছে মুক্তিকামী আরো হাজারো তরুণ। আজো তিনি আমাদের ইসলামী আন্দোলনের পথিকৃৎ। তিতুমীর ও তাঁর আন্দোলন সাময়িকভাবে ব্যর্থ হয় কিন্তু তিতুমীর উপমহাদশের মুসলিমদের বুকে যে সাহস জাগিয়ে দিয়েছেন তার সুফল আজো ইসলামপন্থী মানুষেরা পাচ্ছে।
১৮২৭ সালে তিনি চব্বিশ পরগনা ও নদীয়া জেলায় পুরোদস্তর ইসলাম প্রচার শুরু করেন। সর্বস্তরের জনগণকে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। এবং একইসাথে ব্রিটিশবিরোধী প্রচারও করতে থাকেন। তিনি জানতেন যে অধিকাংশ জমিদাররা ব্রিটিশদের ছায়াতলে থেকে বাংলার মানুষের ওপর অত্যাচার নিপীড়ন চালাচ্ছে। তাই অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা খুব দ্রুতই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে। এভাবে তার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং এক সময় প্রায় ৪০০ জনের একটি দল তিনি গড়ে তুলতে সমর্থ হন।
ব্রিটিশ বেনিয়ার অত্যাচার থেকে এ দেশের অসহায় মানুষকে মুক্তির জন্য তিনি আপসহীন সংগ্রাম করেছেন। সাহসী তিতুমীর ইসলামের ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার সাধন এবং শিরক-বিদয়াত থেকে মুসলমানদের মুক্তির জন্য আজীবন লড়াই করেছেন। তিতুমীরের এ লড়াই পাক-ভারত মুসলিম ইতিহাসের এক অ নন্য বীরত্বগাঁথা এবং এক গৌরবময় অধ্যায়। মুসলিম মানসপটে শিহরণসঞ্চারী এক স্বাপ্নিক পুরুষ ছিলেন তিতুমীর। তাঁর অসীম সাহস ও ক্ষিপ্রতা আমাদের হৃদয়াবেগ প্রাণিত করে। দেশের পক্ষে লড়াই করে জীবন দিয়েছেন, তবুও ইংরেজদের হাতে ধরা দেননি। স্বাধীন করতে পারেননি দেশকে, তবে দেখিয়ে গেছেন সাহসিকতার নমুনা; তাকে দেখে আগ্রহী হয়েছে মুক্তিকামী আরো হাজার তরুণ।
তিতুমীর কলকাতায় সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর পরামর্শ সভা সমাপ্তের পর নিজ গ্রাম চাঁদপুরে ফিরে এসে কিছুদিন বিশ্রাম প্রহণের পর দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। তিতুমীরের দাওয়াতের মূলকথা ছিলো ইসলামে পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন এবং প্রত্যেকটি কাজেকর্মে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ পালন। হিন্দু জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার উৎপীড়নকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না। তাই বলেন যে, কৃষক সম্প্রদায়ের হিন্দুদের সাথে একতাবদ্ধ হয়ে তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সারফরাজপুর নামক গ্রামবাসীর অনুরোধে তিনি তথাকার শাহী আমলের ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রচারের জন্যে তাঁর একটি খানকাহ স্থাপন করেন। এখানে জুমার নামাজের পর তিনি সমবেত হিন্দু-মুসলমানকে আহবান করে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। যারা মুসলমান নয় তাদের সাথে শুধু ধর্মের দিক দিয়ে পৃথক বলে, বিবাদ বিসম্বাদ করা আল্লাহ ও তাঁর রসূল কিছুতেই পছন্দ করেন না। তবে ইসলাম এ কথা বলে যে, যদি কোন প্রবল শক্তিশালী অমুসলমান কোনো দুর্বল মুসলমানের ওপর অন্যায় উৎপীড়ন করে, তাহলে মুসলমানরা সেই দুর্বলকে সাহায্য করতে বাধ্য। তিনি আরও বলেন, মুসলমানদেরকে কথাবার্তায়, আচার-আচরণে প্রকৃত মুসলমান হতে হবে। তারা যদি অমুসলমানের আচার-আচরণ, চাল-চলন ও কাজকর্ম পছন্দ করে তাহলে শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাদেরকে অমুসলমানদের সাথে স্থান দিবেন। তিতুমীর বলেন, ইসলামী আদর্শেই রয়েছে আমাদের ইহকাল পরকালের মুক্তি। এর প্রতি কেউ উপেক্ষা প্রদর্শন করলে আল্লাহ তাকে কঠোর শাস্তি দিবেন। নামাজ পড়া, রোজা রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছাঁটা মুসলমানদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। যারা অমুসলমানদের আদর্শে এসব পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিবেন।
এই বাংলার বুকে সুদূর অতীতে জন্ম হয়েছিলো স্বনামধন্য এক বীরের। যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সারা বাংলায় দূর্ভেদ্য প্রতিরোধ ও গণ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ইংরেজরা যার নামে শঙ্কিত ও ভীত হয়ে পড়তো। আমি সেই বাংলার বীর তিতুমীরের কথাই বলছি। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি সর্বপ্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে শহীদের মর্যাদা লাভ করেন। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তিতুমীরের নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে। আজ থেকে প্রায় পৌনে ২০০ বছর আগে তিতুমীর পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে বীর তিতুমীরই হলেন বাংলার প্রথম শহীদ।
জীবনের বিনিময়ে তিতুমীর সত্যের পথে লড়াই করেছেন। তাঁর এই দৃঢ়তা ও অনবদ্য প্রেরণা আজও বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানকে অনুপ্রাণিত করে, আবেগতাড়িত করে। সত্যপথের যাত্রীরা তিতুমীরের আদর্শ নিয়ে আজও কাজ করছে। দুনিয়ার দেশে দেশে দীন প্রতিষ্ঠার কাজে তারা জীবন উৎসর্গ করছে। নারকেলবাড়িয়ার কেল্লার সেই বিপ্লবের আগুন নির্বাপিত হয়নি, বরং সে আগুন ছড়িয়ে গেছে সারা বিশ্বে। যেখানেই অন্যায়, সেখানেই আছে তিতুমীরের মতো সাহসী ও আপসহীন সৈনিক।
তিতুমীর বাংলার প্রজাকুলের ওপর স্থানীয় জমিদার এবং ইউরোপীয় নীলকরদের অত্যাচার প্রতিরোধ এবং ব্রিটিশ শাসন থেকে বাংলাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত আন্দোলনের নেতা। প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য ছিলো সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার। মুসলিম সমাজে শির্ক ও বিদআতের অনুশীলন নির্মূল করা এবং মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের অনুশাসন অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করাই ছিলো তাঁর আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য।
তিতুমীর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। ১৯৭১ সালে মুহাম্মদ জিন্নাহ কলেজ কে তাঁর নাম অনুসারে সরকারী তিতুমীর কলেজ নামকরণ করা হয়। তাঁর নামে বুয়েট এ একটি ছাত্র হলের নামকরণ করা হয় তিতুমীর ‘হল’। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি জাহাজের নামকরণ করা হয় বিএনএস তিতুমীর। ২০০৪ চার সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো-সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? ত্রিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত। বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ ২০জন বাঙালির তালিকায় ১১ তম স্থানে আসেন মীর নিসার আলী তিতুমীর। তিতুমীর ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অন্যতম প্রেরণার উৎস। তাঁর দুঃসাহসিক সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দিয়েছিলো এক নতুন শক্তি। নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রেরণার উৎস হিসেবে তিনি যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন বাংলার মাটি ও মানুষের হৃদয়ে।
লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি,শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক,গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট