মো: আলতাফ হোসেন ঃঃ
বর্তমান বিশ্বের মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো দূষণ। আমরা পরিবেশের দূষণ বলতে সাধারণত তিন ধরনে দূষণ মনে করি। যেমন: বায়ু দূষণ পানি দূষণ এবং মাটি দূষণ। কিন্তু বর্তমানে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ভাষায় আরো কিছু দূষণ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেগুলো হলো আলোর দূষণ, শব্দ দূষণ, তাপমাত্রার দূষণ, প্লাস্টিক দূষণ, রেডিও অ্যাক্টিভ বর্জ্যরে দূষণ এবং মোবাইল ফোন ফ্রিক্যুয়েন্সির (মোবাইল নেট ওয়ার্ক) দূষণ ইত্যাদি। চলতি বছরের ৬ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা গেছে, ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক পরিবেশ দূষণের ফলে প্রতিবছর ৫ বছরের কম বয়সী প্রায় ১৭ লাখ শিশু অকাল মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। কারণ হিসেবে অনিরাপদ পানি, স্যানিটেশনের অভাব, দরিদ্র স্বাস্থ্যবিধির অনুশীলন ও পারিপাশির্^ক দূষণের পাশাপাশি আহত হওয়াকেও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে সংস্থাটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. মার্গারেট চ্যান এক বিবৃতিতে বলেন, বর্তমান সময়ে শিশুদের মৃত্যুর সবচেয়ে ভয়াবহ কারণ হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। দূষিত বাতাস ও পানি শিশুদের কোমল অঙ্গ, ইমিউন সিস্টেম এবং শ্বাসনালীর পরিপক্কতার বাধা দিয়ে তাদের শারীরিকভাবে দুর্বল করে দেয়। এছাড়া শিশুদের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও কমে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী গোটা বিশ্বের ১৫ বছরের নিচে প্রায় ১ কোটি শিশু বিভিন্ন পরিবেশ দূষণজনিত কারণ দূষিত পানি, খাবার এবং দুর্ঘটনায় মারা যায় এসব দুর্ঘটনার মধ্যে ইউনিসেফ পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট শিশুদের প্রায় ৪৫ শতাংশ দরিদ্র সীমার নীচে বাস করে। এদের সংখ্যা হবে প্রায় ৩ কোটির অধিক। এসব শিশুদের মাঝে আবার ৪১ শতাংশের কোনো আশ্রয় নেই। আবার ৬৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃসেবা থেকে বঞ্চিত। ৫৭ শতাংশ দৈহিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। ১৬ ভাগ স্বাস্থ্য সেবা এবং ৩ ভাগ শিশু সুপেয় পানীয় জল থেকে বঞ্চিত। আর এ সমস্ত বঞ্চনার সাথে যখন যোগ হয় পরিবেশ দূষণ; তখন হতোদরিদ্র সুবিধা বঞ্চিত পরিবারের শিশুরা মারাত্মকভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আক্রান্ত হয়। পরিবেশ দূষণের কারণে আমাদের বাংলাদেশের শিশুরা প্রতিনিয়ত মৃত্যু ছাড়াও বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া হচ্ছে অন্যতম।
গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবেশগত কারণ বিশেষত শিশু জন্মের পূর্বে ও পরে মায়ের দৈহিক স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি শিশু স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। তাই নবজাতককে জন্মপূর্ব এ সকল রোগ ও মৃত্যু ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন প্রসূতির জন্য শিশুর জন্ম পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টিকর খাবার এবং পরিবেশ সম্মত আবাসস্থল।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের অধিকাংশ এলাকার রাস্তা ও অলিগলিতে আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। খোলা ট্রাক ও কনটেইনারে আবর্জনা পরিবহনের ফলে পথে পথে ছড়িয়ে পড়ছে আবর্জনা ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধসহ নানা রোগ ব্যাধির জীবাণু। ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) এর এক কর্মকর্তা বলছেন, জাইকার সহায়তায় আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মহাপরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বেশ উন্নতি হবে। তারা বলছেন, ডিসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীরা নিজ দায়িত্ব পালনে যত্নবান না হলে রাজধানীর আবর্জনা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শহরে বেড়ে ওঠা শিশুরা মাঠের অভাবে খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে শিশুদের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাংঘাতিকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পরবর্তীতে এসব শিশুরাই নানা ধরনের অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। গ্রামের ধরনের অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। গ্রামের চেয়ে শহরের প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের পেছনে অনেকগুলো কারণ বলে মত দিয়েছেন চিকিৎসকরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরে মতে, শব্দ দূষণের ফলে ০-৫ বছর বয়সী শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। মাত্রাতিরিক্ত শব্দ বাচ্চাদের মেজাজ খিটখিটে করে তুলে। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়। শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দেয়। পরবর্তীতে পড়াশুনায় অমনযোগী হয়ে পড়ে তারা। তাদের আচরণেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এভাবে শব্দদূষণ চলতে থাকলে বাতাসের যে মরমর শব্দ ভবিষ্যতে সেটাও আর শুনতে পারবে না শিশুরা।
রাজধানীতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক জড়িপে দেখা যায়। নিরব এলাকার আওতাভুক্ত হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতের আশেপাশে দিনের বেলায় শব্দের মাত্রা ৭৫-৯৭ ডেসিবল যা আন্তর্জাতিক মাত্রার চেয়ে দেড় থেকে দুইগুণ বেশি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এ আর হাওলাদার বলেন, গাড়ির রং এ ব্যবহৃত থিনার এবং পুডিং তৈরিতে ব্যবহৃত ‘হার্ভেনার’ কেমিক্যালগুলোর গ্যাস খুবই প্রকট। চোখ জ্বালা পোড়া করে, মাথা ধরে। সর্দিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এর বিষাক্ত গ্যাসে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারেন।
তিনি আরো বলেন, জনস্বার্থ বিশেষ করে শিশুদের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে, তিনি ওয়ার্কশপ মালিকদের যত্রতত্র, গাড়ী মেরামতের কাজ বন্ধের পরামর্শ দেন। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছ। নীরব এলাকায় দিনে ৫০ ডেসিবল ও রাতে ৪০ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ রাতে ৪৫, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০, রাতে ৫০ এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ রাতে ৭০ ডেসিবল।
বর্তমান বিশ্বের মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো দূষণ। গোটা পৃথিবীর মানুষ এই দূষণ নিয়ে বড়ই উদ্বেগ প্রকাশ করছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানের উন্নতি সাধন হয়েছে, আমাদের জীবনযাত্রায় মান বেড়েছে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ বেড়েছে কিন্তু প্রকৃতির ক্ষতি করতে আমরা দ্বিধাবোধ করিনি। আমরা আমাদের ইচ্ছামতো নগরায়ন করেছি, শিল্প কারখানা তৈরি করেছি জমির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করেছি, নদী দূষণ ঘটিয়েছি, পাহাড় কেটেছি গাছ কেটেছি, নির্বিচারে, আকাশের নির্মল বায়ুকে করেছি দূষিত।
আমাদের দেশের মানুষ খাবারের দূষণ পাচ্ছে,যাকে আমরা বলি ভেজাল খাদ্য। এই দূষণ কতটা ভয়াবহ, তার একই পরিসংখ্যান আমি আপনাদের দিচ্ছি। জমির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করেছি, নদী দূষণ ঘটিয়েছি, পাহাড় কেটেছি গাছ কেটেছি নির্বিচারে, আকাশের নির্মল বায়ুকে করেছি দূষিত। আমাদের দেশের মানুষ খাবারের দূষণ পাচ্ছে, যাকে আমরা বলি ভেজাল খাদ্য। এই দূষণ কতটা ভয়াবহ তার একটা পরিসংখ্যান আমি আপনাদের দিচ্ছি।
গোটা পৃথিবীতে পানি দূষণের কারণ বিভিন্ন সংক্রামক রোগে প্রায় ১৪ হাজার লোক গেড়ে প্রতিদিন মারা যায়। অন্যদিকে বায়ু দূষণের অবস্থা ভয়াবহ। যুক্তবর্ণ ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ্ ইফেক্ট ্ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেল্থ মেট্রিকস এ্যান্ড ইভালুয়েশন বিশ্ব জুড়ে একযোগে প্রকাশিত বৈশি^ক বায়ু পরিস্থিতি ২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বের বায়ু দূষণের হার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত আর বাংলাদেশে।
বায়ু দূষণের শীর্ষে রয়েছে দিল্লী শহর আর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আমাদের ঢাকা শহর। তৃতীয় এবং চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তানের করাচি এবং চীনের বেইজিং বর্তমানে ঢাকা শহরের শব্দ দূষণের মাত্রা এতো বেশি যে, প্রিয় ঢাকা আজ আমাদের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। রাজধানীতে শব্দের মাত্রার যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তা সত্যি উদ্বেগের। এই শব্দ দূষণের ফলে মানুষের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। শব্দ দূষণের ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাত, রক্তচাপ বৃদ্ধি, মাংসপেশির সংকোচন ইত্যাদি দৈহিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে শব্দ দূষণের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। বিশ্ব ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তার একটি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে প্রতিবছর যতো মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ বিসুখের কারণে। কিন্তু গোটা বিশ্বের এ ধরনের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যানে তুলে ধরে বলেছে, শহরাঞ্চলে এই দূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে তারা বলছে, দূষণের কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পরিবেশ দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশে যেখানে ২৮ শতাংশ মৃত্যু হয় সেখানে মালদ্বীপে এই হার ১১ দশমিক ৫ শতাংশ আর ভারতে ২৬ দশমিক ৫।
লেখক: সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ(কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান) চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব
সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি, গবেষক,শিক্ষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট