মো : আলতাফ হোসেন ঃঃ
কামিনী রায় একজন প্রথিতযশা বাঙালি কবি,সমাজকর্মী এবং নারীবাদী লেখিকা। তিনি তৎকালীন ব্রিটশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক ডিগ্রিধারী ব্যক্তিত্ব। তিনি একসময় ‘‘জনৈক বঙ্গমহিলা’’ ছদ্মনামে লিখতেন। কামিনী রায় ১৮৬৪ সালের ১২ অক্টোবর বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জের বাসন্ডা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কামিনী রায় একাধারে ছিলেন প্রথিতযশা বাঙালি কবি, সমাজকর্মী এবং নারীবাদী লেখিকা। লেখালেখির শুরুতে তিনি ‘জনৈক বঙ্গমহিলা’ নাম ধারণ করে লিখতে শুরু করেন। কামিনী রায়ের এটিই ছিলো ছদ্মনাম।
‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।’ স্কুল জীবনের পাঠ্য বইয়ে ‘সুখ’ কবিতাটি আমরা সবাই পড়েছি। কবিতাটির লেখিকা কামিনী রায়। মাত্র ১৫ বছর বয়সে কবিতাটি লিখেছিলেন তিনি। অথচ তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেছেন তখন সমাজপতীদের চোখে নারী শিক্ষা ছিলো একটি জঘন্য অপরাধের সামিল। সে সময়ে নারী শিক্ষার প্রচলনই ছিলো না। কিন্তু তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম বাঙালি গ্র্যাজুয়েট। তিনিই এই বিদুষী বাঙালি কবি।
অতি শৈশবে তার পিতামহ নিমচাঁদ সেন কামিনী রায়কে কবিতা এবং স্তোত্র পাঠ করতে শিখিয়েছিলেন। এই জন্যই খুব কম বয়স থেকেই কামিনী রায় সাহিত্য রচনা শুরু করেন এবং কবিত্ব-শক্তির স্ফুরণ ঘটান। আঠারো শতকে যেখানে মেয়েদের লেখাপড়াকে একান্তই নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হতো সেখানে কামিনী রায়ের জননী তাকে গোপনে বর্ণমালা শিক্ষা দিতেন। মাত্র ৮ বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখতে শুরু করেন।
কামিনী রায় তাঁর কালজয়ী কবিতা ‘সুখ’ রচনা করেন কৈশোরকালে। এই কবিতা সম্পর্কে তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘সকলের ভালো লাগিয়াছে বলিয়া এটা রাখিয়া দিয়াছিলাম। নতুবা বয়সের অনুচিত পাকামি হইয়াছে বলিয়া কবে ছিঁড়য়িা ফেলিতাম। সাড়ে পনের বৎসর ছিল তখন আমার বয়স।” তিনি ছয় বছর বয়সে কলকাতার কেশবচন্দ্র সেনের ‘ভারত আশ্রম মহিলা বিদ্যালয়ে’ প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। পরে তিনি মাইনর পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ‘কুমারী এফ্রয়েডের হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে’ ভর্তি হন। এরপর পড়ালেখা করেন কলকাতার বিখ্যাত বেথুন স্কুলে।
১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিভাগে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৮৮৩ সালে এফএ পাস করেন। তিনি সংস্কৃত ভাষা সাহিত্য নিয়ে ১৮৮৬ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। যেটা ছিলো ভারতের প্রথম নারীর স্নাতক ডিগ্রি অর্জন। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর ১৮৮৬ সালেই তিনি বেথুন কলেজের স্কুল বিভাগে শিক্ষীকার পদে নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি ঐ কলেজে অধ্যাপনাও করেছিলেন। যে যুগে মেয়েদের শিক্ষাও বিরল ঘটনা ছিলো, সেই সময়ে কামিনী রায় নারীবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর অনেক প্রবন্ধেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি নারী শ্রম তদন্ত কমিশন (১৯২২-২৩) এর সদস্য ছিলেন। শৈশবে তাঁর পিতামহ তাঁকে কবিতা ও স্তোত্র আবৃত্তি করতে শেখাতেন। এভাবেই খুব কম বয়স থেকেই কামিনী রায় সাহিত্য রচনা করেন ও কবিত্ব-শক্তির স্ফূরণ ঘটান। তাঁর জননীও তাঁকে গোপনে বর্ণমালা শিক্ষা দিতেন। কারণ তখনকার যুগে হিন্দু পুরমহিলাগণের লেখাপড়া শিক্ষা করাকে একান্তই নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
মাত্র ৮ বছর বয়স থেকে তিনি কবিতা লিখতেন। রচিত কবিতাগুলোতে জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাক্সক্ষা, আনন্দ-বেদনার সহজ-সরল ও সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে। পনেরো বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ আলো ও ছায়া প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে। এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু প্রথমে এতে গ্রন্থকর্ত্রী হিসেবে কামিনী রায়র নাম প্রকাশিত হয় নাই। গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে তার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-আলো ও ছায়া (১৮৮৯) নির্মাল্য (১৮৯১) পৌরাণিকী (১৮৯৭) মাল্য ও নির্মাল্য (১৯১৩) অশোক সঙ্গীত (সনেট সংগেহ, ১৯১৪) অম্বা (নাট্যকাব্য, ১৯১৫) দীপ ও ধূপ (১৯২৯) জীবন পথে (১৯৩০) একলব্য দ্রোণ-ধৃষ্টদ্যুম্ন শ্রাদ্ধিকী অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত মহাশ্বেতা ও পুন্ডরীক তাঁর দুটি প্রসিদ্ধ দীর্ঘ কবিতা। এছাড়াও, ১৯০৫ সালে তিনি শিশুদের জন্য গুঞ্জন নামের কবিতা সংগ্রহ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ বালিকা শিক্ষার আদর্শ রচনা করেন। কামিনী রায় সবসময় অন্য সাহিত্যিকদের উৎসাহ দিতেন। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বরিশাল সফরের সময় কবি সুফিয়া কামালকে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করতে বলেন। তাঁর কবিতা পড়ে বিমোহিত হন সিবিলিয়ান কেদারনাথ রায় এবং তাঁকে বিয়ে করেন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে কামিনী রায়রে স্বামীর অপঘাতে মৃত্যু ঘটেছিলো। সেই শোক ও দুঃখ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে, যা তার কবিতায় প্রকাশ পায়। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সংস্কৃত সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
বাংলা সাহিত্যে এক প্রতিভাদীপ্ত নাম কামিনী রায়। বাঙালি নারী সমাজ যখন বৃত্তাবদ্ধ তখনকার সময় ও যুগ পরিবেশের তুলনায় তিনি ছিলেন অগ্রগামী। কবি হিসেবে বিখ্যাত হলেও অনুবাদ এবং নাট্যকাব্য রচনা করেছেন। তাঁর অনেক কবিতায় শোক ও গভীর বেদনাবোধের প্রভাব লক্ষ করা যায়। ‘মহাশ্বেতা’ ও ‘পুন্ডরিক’ নামে তাঁর দুটি দীর্ঘ কবিতা অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত। এ সব বিচিত্রধর্মী রচনা তাঁর অনন্য প্রতিভারই পরিচায়ক। উনিশ শতকের শেষ দিকে যে কজন বিশিষ্ট মহিলা কবির সাক্ষাত মেলে, তাদের মধ্যে কামিনী রায় অন্যতম । তাঁর কবিতা পড়ে বিমোহিত হন সিবিলিয়ান কেদারনাথ রায় এবং তাঁকে বিয়ে করেন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে কামিনী রায়রে স্বামীর অপঘাতে মৃত্যু ঘটেছিলো। সেই শোক ও দুঃখ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে, যা তাঁর কবিতায় প্রকাশ পায়।
কবি কামিনী রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সংস্কৃত সাহিত্য দ্বারা পভাবিত হয়ে খুব অল্প বয়স থেকে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত ‘আলো ও ছায়া’ কামিনী রায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ, যার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন পাঠকসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। কামিনী রায় কবিতা লেখার শুরুতেই মধ্যযুগের নৈতিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং মহাজগতকে পরস্পর বিরুদ্ধ শব্দ দ্বারা চিনতে শিখেছিলেন। পৃথিবীকে ও তার বস্তুসমূহকে সাদা-কালো,আলো-আঁধার, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি বিপরীত শব্দ দিয়ে তিনি বুঝেছিলেন এবং পরপর বিপরীত শব্দগুলো দ্বারা কবিতার বাক্য গঠন করেছিলেন। উদাহরণ যেমন ‘কেউ হাসে, কাঁদে কেউ/দুঃখে-সুখ রয়েছে বাঁচিয়া’,‘জীবন ও মরণের খেলা’,‘ভাসাইয়া ক্ষুদ্র তরী, দিবালোকে,অন্ধকারে’, জীবন-মরণ একই মতন’,‘মুক্তবন্দি’ ইত্যাদি অনেক ধরণের বাক্য তিনি ব্যবহার করেছেন। বাঙালি প্রায় সব কালেই সবকিছুকেই এরকম পরস্পর-বিরুদ্ধ ভাব দ্বারা ব্যাখ্যা করেছে যা দ্বান্দিক হলেও যান্ত্রিকতা-দোষে দুষ্ট ও অবৈজ্ঞানিক; সাদা-কালোর মাঝেও অনেক স্তর রয়েছে; মানুষ শুধু ভালো বা মন্দ নয়, সে আরো অনেক কিছু; আলো-অন্ধকার নিয়েই মানুষের জীবন নয়, জীবনের নানা দিকে রয়েছে বৈচিত্রের বর্ণিল সমাহার। এরকম বিস্তৃত জায়গাতে মানুষকে কামিনী রায় দেখেছেন সাদা চোখে একদেশদর্শি মানুষের চিন্তার মতো।
১৯০৫ সালে তিনি শিশুদের জন্য গুঞ্জন নামের কবিতা সংগ্রহ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ বালিকা শিক্ষার আদর্শ রচনা করেন। আলো ও ছায়া (১৮৮৯) কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ যাতে নিঃসঙ্গতা, জীবন সম্পর্কিত প্রশ্ন, জগতবোধ, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি খাপ ছাড়াভাবে ফুটে উঠেছে। এ-বইটিতে কবি অত্যন্ত জটিল ও অদৃশ্য অনেক কিছুকে নিয়ে ভাবিত থেকে কবিতা লেখার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কামিনী রায়রে কবিতা বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দ যেমন আশা-নিরাশা, হর্ষ-বিষাদ, অবসাদ, আর্তনাদ, সুখ-দুঃখ, স্বর্গ-মর্ত, ভয়, আলো-আঁধার, অশ্রু,জীবন-মরণ,মলিন,শোক,বেদনা,লাভ-ক্ষতি ইত্যাদির দিকে তাকালেই বোঝা যায় তিনি জীবনের ইতি ও নেতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং কবিতার বিষয়বস্তুর দিকে নজর দিলে দেখা যাবে যে তিনি জীবনের ব্যর্থতা, হতাশা, দুঃখ, বিষাদকেই প্রধান বিষয় করে তুলেছেন।কামিনী রায়ের ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েনের কারণেই তাঁর কবিতায় এসেছে হতাশার সুর যা শোকাশ্রয়ি অশ্রুসংগীত হয়ে বেজে উঠেছে; একদিকে মধ্যযুগ প্রভাবিত পরমাত্মার সংগে জীবাত্মার মিলনের চেতনা, অন্যদিকে স্বামী বা প্রভু নামক ভাতারের পদতলে নিজেকে বিলীন করে ধন্য হবার বোধ, মা নামক ধারণার নিচে বলি হওয়ার আকাক্সক্ষা,সন্তানের মঙ্গলের জন্য সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকা; এই চারটি ক্ষেত্রে বাস্তবিক ব্যর্থতাই কামিনী রায়কে করে তোলে মর্ষকামি।
দেশপ্রেম অবশ্যই প্রযোজন এবং তা হওয়া উচিত যুক্তিপূর্ণ কিন্তু বাঙালির দেশপ্রেমের সংগে যুক্তিহীন আবেগের আধিক্য ও অতিরিক্ত আত্মত্যাগের প্রবণতা বাঙালির ক্ষতির কারণ হয়েছে। বাঙালি আত্মত্যাগ করেছে প্রচুর, কিন্তু সংগ্রামের অর্জনগুলোকে নিজেদের কাছে রাখতে পারেনি। এরকম সীমাবদ্ধতার চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার কিছু কবিতায়। তিনি নিজেকে ‘জগতের পায়ে বিসর্জন’ দিতে চাইলেও বিসর্জনের শক্তি তাকে চাইতে হয়েছে দেবতার কাছে। একটি ক্ষুদ্র ব্রত সম্পন্ন করার ‘আকাঙ্খা’ তিনি সারা জীবন করতে চেয়েছেন, কিন্তু চরিতার্থতার পথ খুঁজে পাননি। ১৮৯১ সালে প্রকাশিত নির্মাল্য কাব্যের যে ‘আকাঙ্খা’ সেটিই সুস্পষ্ট হয়েছে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত ‘দীপ ও ধূপ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে। তার বহু আগেই প্রথম গ্রন্থের ‘সুখ’ কবিতাটিতে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন নিজের স্বার্থ বলি দিয়ে ‘পরের কারণে’ ‘এ-জীবন মন সকলি দাও’ এবং নিজের কথা ভুলে যাওয়াকেই ঘোষণা করেছেন সর্বোচ্চ সুখ বলে। তার ‘দীপ ও ধূপ’ কাব্যগ্রন্থের নামটিই প্রকাশ করে শুধু আলো জ্বালালেই হবে না, সুগন্ধও ছড়াতে হবে। সেই সুগন্ধই ‘নব জাগরণ’-এর গান হয়ে ঘোষণা করে ‘জীবনের ইহকুলে যাহা করণীয়/ কর আজ মান দাও মানবেরে সে যে বরণীয়/মনে তার দাও জ্ঞান,অন্ন মুখে তার’।
উনিশ শতকে বাংলা ভাষা হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে, এমনি সময়ে এসেছে জাতি গঠনের প্রসঙ্গ। তখন দেশ গঠনের জন্য প্রয়োজন হাজার হাজার বঙ্গ-সন্তানের; সেই দামাল সন্তানদের মায়েদেরকে উদ্দেশ্য করে কামিনী রায় বলছেন হে মায়েরা, তোমাদের সন্তান শুধু তোমাদের নয়, শতেক মায়ের ছেলে সে, ‘দেশের তরে, দশের তরে’ সেই সন্তান। সেই সন্তানের জয় মানেই উঠন্ত একটি জাতির জয়। অতএব সন্তানকে দেশের কাজে পাঠাতে কোনো মাযেরই দ্বিধা কাম্য নয়। তাই তো আমরা বিশ শতকে পাচ্ছি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু (১৮৯৭-১৯৪৫)-কে যিনি ভারত মাতাকে মুক্ত করতে সারা পৃথিবীর পথে ছিলেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ও চিত্তরঞ্জন দাস (১৮৭০-১৯২৫)-কে কারাগারে দেখে স্বপ্নের দেশের কল্পফুল দিয়ে কবি কামিনী রায় লেখেন কবিতা ‘বন্দিমুক্তি’।‘নব সূর্যোদয়’ দেখা যায় বাঙালির দুটি মহত মানুষের কারা প্রকোষ্ঠের সহাবস্থানে। বাঙালির প্রাণের সস্তানেরা লড়ছে, ভবিষ্যত আসছে ভারতের সামনে, সাহসে অটল সেই নেতাই তো প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনে দেবার; আর কবি জনগণের কাতারে নেমে লেখেন ‘মাঝি-মাল্লা, তাঁতি জোলা সবাই আমার’।
কামিনী রায়ের চিন্তার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে মধ্যযুগিয় অলৌকিকতা,ঈশ্বরমুখিনতা,আধ্যত্মিকতা; সকল কর্মের কেন্দ্রে তিনি আকাশের ওইপারের অদৃশ্য শক্তির প্রকাশ দেখেছেন; যেমন ‘তুমি শক্তিমান/দিতে পার, নিতে পার;’, ‘দুঃসহ এ জ্যোতির মাঝার অন্ধবত ঘুরিয়া বেড়াই’; এসেছে পুনর্জন্মের কথাও, ‘ক্ষুদ্র দীপ যদি নিভে যায়,কে বলিতে পারে,জ্বলিবে না সে যে পুনরায়?’ ‘কোথায়’ কবিতায় জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে ঈশ্বর,পৃথিবীতে ঘন আঁধার, তাঁর ওপরে দুঃখের বিধান; পরবাসি কবি তাই ভাবেন ঈশ্বর পার করবে তাঁকে দূর্বল হাত ধরে, নিয়ে যাবে তাকে ‘আলোকধামে’। ‘হাসিবার কাঁদিবার অবসর নাহি আর, দুঃখিনী জন্মভূমি,মা আমার,মা আমার এই দুঃখিনী জন্মভূমির জন্য যে আত্মত্যগের ব্রত, তাই বারবার প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। মৃত্যুকে তিনি জীবনের অংশরূপেই দেখেন এবং তাই নির্ভীকভাবে কামনা করেন; লিখেছেন ‘মরিব জন্মভূমির জন্যই’।
আধ্যাত্মিকতা দ্বারা প্রভাবিত হবার কারণে সর্বদাই কামিনী রায় সহজ আশাবাদি,যদিও দুঃখে তিনি যথেষ্ট পুড়েছেন। স্বপ্ন দেখেছেন, একতায় বলিয়ান ভারত সন্তান আসছে, নারী-শিশুরা ‘উন্নত কামনা ভরে’ উল্লাসে গাইছে বিজয়ের গান। বাঙালির সহজ-সরল অনুভূতি যেমন অভিমান,সুখ,দুখ,আনন্দ, বেদনা,অন্ধকার,বিষাদ,বিসর্জন,অশ্রু,সংকীর্ণতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কবিতা লেখা শুরু করলেও তিনি শেষ দুটি গ্রন্থে আশাবাদি হয়ে গেছেন এবং সেই বই-দুটোর কবিতাগুলোতে সমাজ ও রাজনীতিমনস্কতা তুলে ধরেছেন।
তৎকালীন কামিনী রায় অত্যন্ত আধুনিক মনসিকতার প্রতীক ছিলেন। তিনি নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিয়েও আন্দোলন করেন। এমনকি তিনি ব্রিটিশ শাসিত সময়ে নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন। সেই আন্দোলনের ফলেই তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে বাঙালি নারীর ভোটাধিকার প্রদান করে।
আজকের ভোগবাদী দুনিয়ার আমরা যারা পণ্য পৃথিবীতে সুখ খুঁজে মরি, তাদের নোটেগাছটি কিছু অক্সিজেন যোগাবার ছলে বলে যায়,” সুখ সুখ করি কেঁদোনা আর/যতই কাঁদিবে যতই ভাবিবে/ততই বাড়িবে হৃদয় ভার। রবীন্দ্র সমকালের মানুষ কামিনী রায়। কবির সঙ্গে দিব্য একটা অম্লমধুর সম্পর্ক ছিলো। ১৯০০ সালে ৫ অক্টোবর প্রিয়নাথ সেনকে লেখা একটি চিঠিতে কামিনী রায়ের ‘আলো ও ছায়া’,‘পৌরাণিকী ‘কাব্যগ্রন্থ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আলোচনা করেছেন। তাঁর মনে হয়েছিলো,“লেখিকার ভাব, কল্পনা এবং শিক্ষা আছে, কিন্তু তাঁর লেখনীতে ইন্দ্রজাল নেই, তাঁর ভাষায় সঙ্গীতের অভাব।” আর কামিনী রায়ের মনে হয়েছিলো রবি ঠাকুরের কবিতা পড়ে, কিছু যেনো একটা নেই তাঁর কবিতায়। সেকথা লিখেছিলেন মন্মথ ঘোষকে “কিন্তু কেবল এইগুলি দিয়াই হৃদয় পরিতৃপ্ত হয়না, আরও কিছু চাই”। এই পারস্পরিক চাওয়া এবং না পাওয়ার নিস্পত্তিটা কিন্তু বড় মধুর।
কামিনী রায় আজীবন সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অনেকগুলো কাব্যগ্রন্থ।কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আলো ও ছায়া’, ‘গুঞ্জন’,‘মাল্য নির্মাল্য’,‘অশোক সঙ্গীত’,‘অম্বা নাট্য কাব্য’, ‘ঠাকুমার চিঠি’,‘দীপ ও ধূপ’,‘জীবন পথে’ প্রভৃতি। শেষ কালে কী তিনি সংশয়ী হয়ে উঠেছিলেন? ‘দুর্বলের ক্রন্দন’ কবিতায় তিনি লিখছেন ‘তুমি নাকি ধর্মরাজ?/ দূর্বৃত্তের দিবে মান সম্ভার,/পুণ্যাত্মারে দিবে লাজ? পক্ষপাতী ধর্মরাজ’। এখানে মনে হবে ধর্মরাজের প্রতি আস্থা দৃঢ় থাকেনি; কিন্তু প্রকৃত ব্যাপারটি তা নয়। তিনি সেই নিদ্রিত দেবতাকে জাগতে বলেছিলেন? অনেকটা রামপ্রসাদ সেনের (১৭২০-১৭৮০) মতো, মা কালীর প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না, আবার তাকে অবিশ্বাসও করতে পারছেন না; শেষ পর্যন্ত দেবতার পদতলেই আত্মসমর্পণ করছেন। ‘বিশ্বের পালক’ যে কাজের জন্য দেশ সেবককে পৃথিবীতে এনেছেন সেই কাজ সুচারুরূপে করিয়ে নেয়ার জন্য ঈশ্বরের কাছেই প্রার্থনা করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য অসাধারণ কবি কামিনী রায়। যে সময় বাঙালি মেয়েরা লোকালয়ে আসতে পারতো না,তখন তিনি সাহিত্য রচনা করতেন, লিখতেন কবিতা। রবীন্দ্র যুগে জন্ম নিয়েও কামিনী রায় সম্পূর্ণ নিজস্ব ঢং-এ লিখতেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য অনেকে ভুলতে বসেছে এই কবিকে। শেষ জীবনে কবির স্বামী কেদারনাথ রায় ও সন্তানরা মারা যান। আপনজনদের হারিয়ে একা হয়ে পড়েন কবি কামিনী রায়। শেষ জীবনে কবি ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যে বাস করতে থাকেন। কামিনী রায় যে এলাকায় থাকতেন তার নাম হাজারীবাগ। এখানেই কবির জীবনাবসান ঘটে। সাহিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে”জগত্তারিণী পদকে” সম্মানিত করেন। ১৯৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ৬৯ বছর বয়সে কবি কামিনী রায় মৃত্যুবরণ করেন।
লেখকঃ গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট