মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। মূলত ঔপন্যাসিক হলেও বেশ কটি ছোটগল্প এবং কিছু সংখ্যক প্রবন্ধও রচনা করেছেন তিনি। তাঁর বেশ কিছু উপন্যাস নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র। বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতি জগতে শরৎ সাহিত্যের প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। তিনি বাংলার জনপ্রিয়তম কথা সাহিত্যিক।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক, ও গল্পকার। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় এবং বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। তাঁর অনেক উপন্যাস ভারতবর্ষের প্রধান ভাষাগুলোতে অনূদিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তার দরুন তিনি ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ নামে খ্যাত। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৩ খিষ্টাব্দে ‘জগত্তারিণী’ স্বর্ণপদক পান। এছাড়াও, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ‘ডিলিট’ উপাধি পান ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের প্রেসিডেন্সি বিভাগের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অলস আর স্বাপ্নিক ধরনের মানুষ। যিনি নিরবিচ্ছিন্নভাবে কোন কাজই শেষ করতে পারতেন না। তিনি অনেকগুলো গল্প আর উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু কোনটিরই সমাপ্তি টেনে যেতে পারেননি। কিন্তু তা৭র কল্পনানুভূতি আর সাহিত্যানুরাগ ছাপ ফেলেছিলো ছেলে শরৎচন্দ্রের জীবনে। শরৎচন্দ্রের পিতৃপুরুষের নিবাস ছিলো অধুনা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার কাঁচড়াপাড়ার নিকট মামুদপুরে।দেবানন্দপুর ছিলো প্রকৃতপক্ষে তাঁর পিতার মাতুলালয়।তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী।তাঁর মাতা উত্তর ২৪ পরগণা জেলার হালি শহরের রামধন গঙ্গোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্যা। গঙ্গোপাধ্যায়রা কালক্রমে ভাগলপুর নিবাসী হন। পাঁচ ভাই আর বোনের মধ্যে শরৎচন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর দিদি অনিলা দেবী ছাড়াও প্রভাসচন্দ্র ও প্রকাশচন্দ্র নামে তাঁর দুই ভাই ও সুশীলা দেবী নামে তাঁর এক বোন ছিলো। শরৎচন্দ্রের ডাকনাম ছিলো ন্যাঁড়া। দারিদ্র্যের কারণে মতিলাল স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভাগলপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন বলে শরৎচন্দ্রের শৈশবের অধিকাংশ সময় এই শহরেই কেটেছিলো।
শরৎচন্দ্রের পাঁচ বছর বয়সকালে মতিলাল তাঁকে দেবানন্দপুরের প্যারী পন্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন,যেখানে তিনি দু-তিন বছর শিক্ষালাভ করেন। এরপর ভাগলপুর শহরে থাকাকালীন তার মামা তাকে স্থানীয় দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তিতে ভর্তি করিয়ে দেন। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে শরৎচন্দ্র ভাগলপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৮৯ খ্র্রিষ্টাব্দে মতিলালের ডিহিরির চাকরি চলে গেলে তিনি তার পরিবার নিয়ে দেবানন্দপুরে ফিরে গেলে শরৎচন্দ্র জেলা স্কুল ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই সময় তিনি হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে দারিদ্র্যের কারণে স্কুলের ফি দিতে না-পারার কারণে তাঁকে এই বিদ্যালয়ও ত্যাগ করতে হয়। এই সময় তিনি ‘কাশীনাথ’ ও ‘ব্রহ্মদৈত্য’ নামে দুটি গল্প লেখেন।
১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে মতিলাল পুনরায় ভাগলপুর ফিরে গেলে প্রতিবেশী সাহিত্যিক তথা তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষালাভের প্রতি শরৎচন্দ্রের আগ্রহ লক্ষ করে তাকে তার বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। এই বিদ্যালয় থেকে ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করে তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজে ভর্তি হন। এই সময় তিনি তার মাতামহের ছোটো ভাই অঘোরনাথের দুই পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে প্রতি রাতে পড়াতেন, তার বিনিময়ে অঘোরনাথ তার কলেজে পড়ার প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাতেন। এতদা-সত্ত্বেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না-পারার জন্য তিনি পরীক্ষায় বসতে পারেননি। তিনি বনেলী রাজ-এস্টেটে কয়েকদিন চাকরি করেন। কিন্তু পিতার ওপর কোনো কারণে অভিমানবশত তিনি সন্ন্যাসী সেজে ঘর ছেড়ে চলে যান। এই সময় তাঁর পিতার মৃত্যু হলে তিনি ভাগলপুর ফিরে এসে পিতার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন করে কলকাতা যাত্রা করেন, যেখানে তিনি কলকাতা উচ্চ আদালতের উকিল লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে হিন্দি বইয়ের ইংরেজি তর্জমা করার জন্য মাসে ত্রিশ টাকা বেতনের চাকরি পান। এই সময় তিনি ‘মন্দির’ নামে একটি গল্প লিখে ‘কুন্তলীন’ প্রতিযোগিতায় পাঠালে তা বিজয়ী ঘোষিত হয়।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে শরৎচন্দ্র এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে ফিরে এলে ‘যমুনা’ নামে পত্রিকার সম্পাদক ফনীন্দ্রনাথ পাল তাকে পত্রিকার জন্য লেখা পাঠাতে অনুরোধ করেন। সেই অনুযায়ী, শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে ফিরে গিয়ে রামের সুমতি গল্পটি পাঠিয়ে দেন, যা যমুনা পত্রিকায় ১৩১৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন ও চৈত্র্য সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার জন্যেও লেখা পাঠাতে শুরু করেন। ফনীন্দ্রনাথ পাল তাঁর উপন্যাস বড়দিদি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। এমসি সরকার অ্যান্ড সন্স ও গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স তাঁর উপন্যাসগুলো পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছুটি নিয়ে মনোমালিন্যের কারণে শরৎচন্দ্র চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে রেঙ্গুন বাংলায় ফিরে আসেন।
শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের এক জন অমর কাব্যশিল্পী। তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয় পল্লীর জীবন ও সমাজ। ব্যক্তিমানুষের মন পল্লীর সংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতার আঘাতে কতটা রক্তাক্ত হতে পারে তারই রূপচিত্র এঁকেছেন তিনি তাঁর রচনায়। তবে তাঁর উপন্যাসে ব্যক্তিবর্গের ইচ্ছাভিসার ও মুক্তি সর্বদাই সমাজ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয় বলে তাঁকে রক্ষণশীলও বলা হয়ে থাকে। তবে নারীর প্রতি সামাজিক নির্যাতন ও তার সংস্কারবন্দি জীবনের রূপায়ণে তিনি বিপ্লবী লেখক বিশেষত গ্রামের অবহেলিত ও বঞ্চিত নারীর প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ ও শ্রদ্ধা তুলনাহীন। সামাজিক বৈষম্য, কুসংস্কার ও শাস্ত্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ।
শরৎচন্দ্রের কাহিনী নির্মাণে অসামান্য কুশলতা এবং অতি প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষা তাঁর কাব্যসাহিত্যের জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির প্রধান কারণ। বাংলাসহ ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় তাঁর অনেক উপন্যাসের চিত্রনাট্য নির্মিত হয়েছে এবং সেগুলো অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে যা ‘দেবদাস’,’শ্রীকান্ত’, ‘রামের সুমতি’, ‘দেনাপাওনা’, ‘বিরাজবৌ’ ইত্যাদি। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্যই শরৎচন্দ্র কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্যপদ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন।
অধ্যয়নে বিরতি ঘটার পর শরৎচন্দ্র বনেলি স্টেটে সেটেলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এর পর তিনি কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক এবং বার্মা রেলওয়ের হিসাব দফতরের কেরানি পদে চাকরি করেন। এক সময় তিনি সন্ন্যাসী দলে যোগ দেন এবং গান ও নাটকে অভিনয় করেন। শরৎচন্দ্র কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কয়েক বছর বাদে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন এবং হাওড়া জেলা জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।
তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘বড়দিদি’ ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যজগতে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এর পর তিনি একে একে ‘বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য’,’পরিণীতা’,’বৈকুণ্ঠের উইল’,’পল্লীসমাজ’,’দেবদাস’, ‘চরিত্রহীন’,’নিষ্কৃতি’, ‘শ্রীকান্ত’,’দত্তা’, ‘গৃহদাহ’, ‘দেনাপাওনা’, ‘পথের দাবী’, ‘শেষ প্রশ্ন’ ইত্যাদি গল্প উপন্যাস এবং ‘নারীর মূল্য’, ‘স্বদেশ ও সাহিত্য’ প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলির মধ্যে ‘শ্রীকান্ত’, ‘চরিত্রহীন’ ‘গৃহদাহ’, ‘দেনাপাওনা’, ‘পথের দাবী’ খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর ‘পথের দাবী’ উপন্যাসটি বিপ্লববাদীদের প্রতি সমর্থনের অভিযোগে প্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে।
শরৎচন্দ্র বার্মা রেলের হিসাব পরীক্ষক হিসেবে পচাত্তর টাকা মাইনের কেরেনিগিরির চাকরি লাভ করেন ১৯০৫ সালে। রেঙ্গুনের উপকণ্ঠে বোটাটং পোজনডং অঞ্চলে কলকারখানার মিস্ত্রিদের পল্লিতে বসবাস করতেন। তাঁর বাসার নিচে শান্তি দেবী নামে এক ব্রাহ্মণ মিস্ত্রির কন্যা বসবাস করতেন। তাঁর পিতা তাঁর সঙ্গে এক মদ্যপের বিয়ের ঠিক করলে শান্তি দেবী শরৎচন্দ্রকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে অনুরোধ করায় শরৎচন্দ্র তাঁকে বিয়ে করতে বাধ্য হন। তাদের এক পুত্র সন্তানেরও জন্ম হয়,কিন্তু রেঙ্গুনের প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শান্তি দেবী ও তার এক বছরের সন্তান মৃত্যুবরণ করেন। এর অনেক কাল পরে শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে কৃষ্ণদাস অধিকারী নামে এক ভাগ্যান্বেষী ব্যক্তির অনুরোধে তার ১৪ বছরের কন্যা মোক্ষদাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি মোক্ষদার নাম রাখেন হিরন্ময়ী দেবী। তারা নিঃসন্তান ছিলেন।
অপরাজেয় কথাশিল্পী’ হিসেবে খ্যাত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় এবং বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। খ্যাতিমান বাঙ্গালী লেখক ও ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । অন্যান্য লেখক, ঔপন্যাসিক থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের
জীবনবোধ ছিলো অনেক বেশি গাঢ় এবং প্রাকৃত। তাঁর সাহিত্য গুণে সে সময়ের জীবন ও জীবনবোধ এতো সুন্দর করে ফুটে উঠেছে যে, যেকোনো চরিত্রের মাধ্যমে তা খুব সহজেই উপলব্দি করা সম্ভব। জীবন ও জীবনবোধ নিয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উক্তি ও বাণীর মাধ্যমে সহজ সরল জীবনের ছবি এঁকেছেন অত্যন্ত নিপুন হাতে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উক্তি হলো-“টিকিয়া থাকাই চরম সার্থকতা নয়, এবং অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে”।
বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি কথাসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক তথা জনপ্রিয় গল্পকার হিসাবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম সোনার অক্ষরে লেখা আছে। গল্প রচনায় প্রাণবন্ততা ও সাবলীল ভাষায় সেই সময়ের পল্লীসমাজকে গল্পে জীবন্ত করার কারণেই শরৎচন্দ্রের উপন্যাস এতো জনপ্রিয়। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ধারায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাঁর সমকালীন সময়ে ব্রাহ্মণ শাসিত এবং জমিদার শাসিত বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ কেমন ছিলেন তার নিখুঁত বর্ণনা আমরা তার লেখায় খুজে পাই। সমাজের সাধারণ মানুষই তাঁর রচনার নায়ক। তাঁর জীবন অনুসন্ধানী দৃষ্টি আমাদের আকর্ষন করে। গল্পের কাহিনি পাঠককে একাগ্র করে তোলে । নারী চরিত্র নির্মানে তার ভূমিকা স্মরণীয়। প্রেমের বিশ্লেষন, আচার- আচরণের বর্ণনা তার রচনায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এখানেই তার বিশেষত্ব।
যুগে যুগে যতো কবি,সাহিত্যিক ছিলো বা আছে, সকলের মাঝের প্রেমের বিস্তার ছিলো বেশ গাঢ়। বলা যায় প্রেমের মাধ্যমেই সকল কবি সাহিত্যিকের সাহিত্যে বিচরণ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁর প্রেম নিয়ে করা উক্তিগুলো বেশ গভীর অনুভূতি সম্পন্ন। প্রেম নিয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উক্তি সমূহের মধ্যে “বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না,দূরেও ঠেলে দেয়। সাহিত্যে মানুষ এবং মনুষ্যত্বের বেশ বড়সড় একটা ভূমিকা রয়েছে। এই অংশ ব্যতিরেকে কোনো সাহিত্যই হয়তো পরিপূর্ণতা পেত না। রুপকথার অনেক গল্পেও দেখা যায়, অন্যান্য রুপক চরিত্রেও মনুষ্যত্ব দেয়ার চেষ্টা করা হয়। মানুষকে বুঝা যেকোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজসাধ্য নয় যতটা সহজভাবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বুঝেছিলেন। মানুষ ও মনুষ্যত্ব নিয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উক্তি সমূহের কিছু অংশ হলো-“এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সমস্তটাই পরিপূর্ণ সত্য। মিথ্যার অস্তিত্ব যদি কোথাও থাকে, তবে সে মনুষ্যের মন ছাড়া আর কোথাও না”।
বাংলা সাহিত্য জগতের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক হলেন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন একাধারে যেমন ঔপন্যাসিক, সেইসাথে ছিলেন একজন প্রাবন্ধিক ও গল্পকারও। তাঁর বিখ্যাত কিছু উপন্যাস আজও বাঙালী পাঠকদের বিশেষভাবে মন কাড়ে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তার জন্য তিনি “অপরাজেয় কথাশিল্পী” নামেও বিখ্যাত।
ভারতীয় সাহিত্যে অমর কথাশিল্পী নামে খ্যাত এবং আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর রচিত গল্প উপন্যাসের জনপ্রিয়তা তুলনাহীন। তাঁর রচনা আর জনপ্রিয়তা এবং সমাদর আজও অম্লান রয়েছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা কয়েকটি নাটক হলো বিজয়া, রমা,ষোড়শী ,বিরাজ বৌ। কয়েকটি প্রবন্ধ হলো নারীর মূল্য ,তরুণের বিদ্রোহ ,স্বদেশ ও সাহিত্য সাধনায় নারী, শিক্ষায় বিরোধ, স্মৃতিকথা ,অভিনন্দন ,গুরু শিষ্য সংবাদ ,সাহিত্য ও নীতি ,ভারতে উচ্চ সঙ্গীত ইত্যাদি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা কয়েকটি গল্প হলো বিন্দুর ছেলে, রামের সুমতি, পথনির্দেশ, মেজ দিদি, দর্প চূর্ণ, আঁধারে আলো,কাশীনাথ, আলো ও ছায়া,মন্দির,বোঝা,অনুপমার প্রেম,বাল্যস্মৃতি, হরিচরণ,ছবি,বিলাসী, মামলার ফল, হরিলক্ষ্মী, মহেশ,অভাগীর স্বর্গ ,অনুরাধা ,সতী, পরেশ, ছোটবেলার গল্প লালু, ছেলে ধরা,পঞ্চাশ বছর পূর্বের একটা দিনের কাহিনী, দেওঘরের স্মৃতি প্রভৃতি।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিভিন্ন উক্তি বাণীর মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন সে সময়ের সমাজ, জীবন ও মনুষ্যত্ব এবং ভালোবাসার বিভিন্ন দিক। সেইসব শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উক্তি ও বাণী, আজকের সমাজেও সমানভাবেই খাপ খেয়ে যায় এবং আমাদের জন্য অনুসরণীয় রয়ে গেছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বেঁচে থাকবেন তাঁর উক্তি ও বাণী, বিভিন্ন উপন্যাসের চরিত্র এবং নানাবিধ জীবনমুখী সংলাপের মাধ্যমে।
তৎকালীন সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি, কুসংস্কার,ভন্ডামি ইত্যাদিকে তিনি তাঁর সাহিত্যে চিত্রিত করেছেন।সহজ সরল ভাষায় তিনি বিভিন্ন চরিত্রের দুঃখ-বেদনা,অভাব-অভিযোগ,মননশীলতার জটিল আবর্তে তিনি খুব সার্থকভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।তাঁর অসাধারণ কীর্তির জন্য বহু সম্মান লাভ করেছিলেন। তাঁর রচনার আজও বর্তমান সমাজে প্রাসঙ্গিক। প্রত্যেকটি চরিত্রকে তিনি রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি তার রচনায় চরিত্রে যে সংলাপ দিয়েছিলেন সেই সংলাপগুলো পড়লে নিজের অজান্তেই নিজের মনে দাগ কেটে যায়। অবহেলিত নারী সমাজের প্রতি তিনি মমত্ববোধ এবং সহানুভূতি ব্যক্ত করেছেন। সমাজে অবহেলিত দারিদ্র কিছু না পাওয়া মানুষদের হয়ে তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন নিজের লেখাতে। বাংলা সাহিত্য তথা ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর অবদান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় সাহিত্য তাঁর কাছে অনেকটাই ঋণী। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পরলোকগমন করেন।
লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট