বনী ইসরাঈলের অন্যতম প্রধান নবী হযরত যাকারিয়া (আ.)

মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
আল্লাহ তা’য়ালা পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। যার সঠিক সংখ্যার কোনো সুস্পষ্ট তথ্য নেই। কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী ২৫ জন্য নবী ও রাসূলের কথা বিদ্যমান। কোরআনের বর্ণনা মতে এ সকল নবী-রাসূলদের মধ্যে তিনি যাদেরকে নবুয়ত দানের পাশাপাশি হিকমত প্রদান করেছেন তাঁদেরে মধ্যে হযরত যাকারিয়া (আ.) অন্যতম।

নবী-রাসূলরা আল্লাহর মনোনীত ও প্রেরিত পুরুষ। পৃথিবীর বুকে আল্লাহর একত্ববাদের প্রতিষ্ঠা ও তাঁর দ্বীন প্রচারের জন্য আল্লাহ তাঁদের নির্বাচিত করেছেন। পৃথিবীতে আল্লাহ তা’য়ালা অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁদের ভেতর ২৫ জনের নাম পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে। নবী রাসূলদের মধ্যে ১৮ জনের নাম সূরা আনআমের ৮৩ থেকে ৮৬ নম্বর আয়াতে একত্রে বর্ণিত হয়েছে এবং বাকিদের নাম অন্যত্র এসেছে। প্রথম মানুষ আদম (আ.)-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে নবী আগমনের ধারাক্রম শুরু হয় এবং মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) এর মাধ্যমে তা শেষ হয়। ঐতিহাসিকরা কোরআন-হাদিসে বর্ণিত নবী-রাসূলদের আগমনের একটি ধারাক্রম বর্ণনা করেন। এই ধারাক্রম যতটা না কোরআন-হাদিস নির্ভর তার চেয়ে বেশি ইতিহাস-আশ্রিত।
যাকারিয়া ও ইয়াহইয়া সোলায়মান পরবর্তী দুই নবী পরস্পরে পিতা-পুত্র ছিলেন এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অধিবাসী ছিলেন। ইয়াহইয়া ছিলেন পরবর্তী নবী ঈসা (আ.)-এর আপন খালাতো ভাই এবং বয়সে ছয় মাসের বড়। তিনি ঈসার ছয় মাস পূর্বেই দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। হযরত যাকারিয়া ও ইয়াহ্ইয়া (আ.) সম্পর্কে ৪টি সূরার ২২টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে সূরা আন‘আমে কেবল ১৮জন নবীর নামের তালিকায় তাঁদের নাম উল্লেখিত হয়েছে। বাকী অন্য সূরাগুলিতে খুবই সংক্ষেপে কেবল ইয়াহ্ইয়ার জন্ম বৃত্তান্ত সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। যাকারিয়া (আ.) সম্পর্কে কোরআনে কেবল এতটুকু বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি মারিয়ামের লালন-পালনকারী ছিলেন। এ বিষয়ে আল্লাহ সূরা আলে-ইমরানে যা বলেন, তার সার-সংক্ষেপ এই যে,ইমরানের স্ত্রী মানত করেছিলেন যে, আমার গর্ভের সন্তানকে আমি আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে দিলাম। তিনি ধারণা করেছিলেন যে, তাঁর একটি পুত্র সন্তান হবে এবং তাকে তিনি আল্লাহর ঘর বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমতে নিয়োগ করবেন কিন্তু পুত্রের স্থলে কন্যা সন্তান অর্থাৎ মারিয়াম জন্মগ্রহণ করলে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। আল্লাহ তাকে সান্ত¦না দিয়ে বলেন,‘এই কন্যার মত কোনো পুত্রই নেই’ (আলে-ইমরান ৩/৩৬)।

হযরত যাকারিয়া (আ.) ছিলেন বনি ইসরায়েল বংশোদ্ভূত। তাঁর স্ত্রীর নাম ইতিহাস বা তাফসির গ্রন্থে উল্লেখ হয়নি। তবে খতিব আল উমারি তাঁর নাম ‘ইশা’ বলে উল্লেখ করেন। আর জাকারিয়া (আ.)-এর স্ত্রী ছিলেন মারিয়ামের মা ও ইমরান (আ.)-এর স্ত্রী হান্নাহর বোন। আল্লাহ তা’য়ালা যাকারিয়া (আ.)-কে একজন সুসন্তান দান করেন। আর জন্মের আগেই সন্তানের নবী হওয়ার সুসংবাদ দেন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘অতঃপর তাঁর (মারিয়াম) রব তাঁকে কবুল করেন এবং উত্তমরূপে গড়ে তোলেন, যাকারিয়া তাঁর তত্ত্বাবধান করেন, যখনই মারিয়ামকে জাকারিয়া দেখতে আসতেন তাঁর কাছে খাদ্যসামগ্রী দেখতেন,তখন তিনি বলতেন, হে মারিয়াম,তোমার কাছে এগুলো কোত্থেকে এলো? মারিয়াম বলতেন, তা আল্লাহর কাছ থেকে,আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে অগণিত রিজিক দেন।’ (সূরা: আলে ইমরান,আয়াত :
৩৭-৪১)
সূরা আলে ইমরানে বলা হয়েছে,সেখানে যাকারিযয়া তার রবের কাছে প্রার্থনা করেছিলো,সে বলল,‘হে আমর রব, আমাকে আপনার পক্ষ থেকে উত্তম সন্তান দান করুন। নিশ্চয় আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী’। অতঃপর ফেরেশতারা তাকে ডেকে বলল,সে যখন কক্ষে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিল,‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে ইয়াহইয়া সম্পর্কে সুসংবাদ দিচ্ছেন,যে হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে বাণীর সত্যায়নকারী, নেতা ও নারী সম্ভোগমুক্ত এবং নেককারদের মধ্য থেকে একজন নবী’। সে বলল,‘হে আমার রব, কীভাবে আমার পুত্র হবে? অথচ আমার তো বার্ধক্য এসে গিয়েছে, আর আমার স্ত্রী বন্ধা’। তিনি বললেন,‘এভাবেই আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন’। সে বলল,‘হে আমার রব, আমাকে দেন একটি নিদর্শন’। তিনি বললেন, ‘তোমার নিদর্শন হলো,তুমি তিন দিন পর্যন্ত মানুষের সাথে ইশারা ছাড়া কথা বলবে না। আর তোমার রবকে অধিক স্মরণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যা তার তাসবীহ পাঠ করো’।

হযরত যাকারিয়া (আ.) সম্পর্কে লোকমুখে শুনা যায় যে,তাকে কাফেররা হত্যার জন্য ঘিরে নিলে তিনি নিরুপায় হয়ে গাছের কাছে আশ্রয় চাইলে গাছ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। তিনি ঐ গাছের মধ্যে আশ্রয় নেন। গাছ পূর্ববৎ হয়ে যায় কিন্তু তাঁর জামার আচল বের হয়ে থাকায় কাফেররা চিনে ফেলে এবং অস্ত্র দিয়ে গাছ চিরে, এতে নবীও দুই ভাগ হয়ে যান। এরূপ একটি কাহিনী শুনা যায়। এটা কতটুকু সত্য? বর্ণিত ঘটনাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সহীহ হাদীসে তা পাওয়া যায় না। ইবনে কাছীর রাহ. আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া(২/২২৮-২২৯) গ্রন্থে এই ঘটনাটি খুবই আপত্তিকর বলে মন্তব্য করেছেন। সুতরাং তা বর্ণনা করা যাবে না। হযরত যাকারিয়া (আ.) ও অন্যান্য নবীদের সম্পর্কে করআন মজীদ ও সহীহ হাদীসে যতটুকু বর্ণনা আছে ততটুকু জানাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তাই হযরত যাকারিয়া (আ.)-এর সম্পর্কে কোরআন মাজীদের কয়েকটি আয়াতের তরজমা ও একটি সহীহ হাদীসের অনুবাদ পেশ করা হলো। (তরজমা) আপনার পালনকর্তার অনুগ্রহের বিবরণ, তার বান্দা যাকারিয়া (আ.)-এর প্রতি, যখন তিনি নিজ পালনকর্তাকে গোপনে আহবান করেছিলেন। তিনি প্রার্থনা করলেন, হে আমার পালনকর্তা! আমার অস্থিসমূহ দুর্বল হয়ে পড়েছে। বার্ধক্যে মস্তক সুশুভ্র হয়ে গেছে। (মাথার সমস্ত চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে)। হে আমার পালনকর্তা! আপনাকে ডেকে আমি কখনো বিফল মনোরথ হইনি। আর আমি আমার পরে স্বজনবর্গ হতে আশঙ্কা করছি ( যে,তারা শরীয়তের এবং ধর্মের সেবা করবে না।) এবং আমার স্ত্রী বন্ধ্যা। অতএব আপনি বিশেষভাবে আপনার পক্ষ থেকে আমাকে একজন ওয়ারিশ (পুত্র) দান করুন। সে আমার এবং ইয়াকুব-এর বংশের উত্তরাধিকারী হবে। হে আমার পালনকর্তা! তাকে আপনি সন্তোষজনক করুন। (আল্লাহ তা’য়ালা বললেন,) যে যাকারিয়া! আমি তোমাকে একটি পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি। তার নাম হবে ইয়াহইয়া। ইতিপূর্বে আমি এ নামে কারো নামকরণ করিনি। তিনি বললেন, হে আমার পালনকর্তা! কেমন করে আমার পুত্র হবে, অথচ আমার স্ত্রী যে বন্ধ্যা। আর আমিও যে বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে উপনীত। তিনি বললেন, এমনিতেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলে দিয়েছেন, এটা আমার জন্য সহজ। (সূরা মারইয়াম : ১-১১) সহীহ মুসলিমে (২/২৬৮) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি নিজ হাতে জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং পেশায় তিনি ছিলেন একজন ছুতার। [শরহুন নববী মুসলিম ১৫/১৩৫] কোরআন মজীদের নিম্নোক্ত সূরাগুলোতেও তার সম্বন্ধে আলোচনা আছে। [সূরা আল ইমরান : ৩৭-৪১; সূরা আম্বিয়া : ৯০-৯৮; সূরা আনআম : ৮৫; সূরা হুদ : ৭২-৭৩।
পবিত্র কোরআনে যেসব নবী-রাসূলের বর্ণনা এসেছে হযরত যাকারিয়া (আ.)তাঁদের অন্যতম। মহান আল্লাহর এ প্রেরিত পুরুষের জীবন ছিলো অলৌকিক ঘটনাবলিতে বর্ণিল। যার অন্যতম বার্ধক্যে সন্তান লাভ। বনি ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান নবী ছিলেন যাকারিয়া (আ.)। ঈসা (আ.)-এর মা মারিয়াম (আ.)-এর তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন তিনি। তাঁর প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ দেখে আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্তির আশা জেগে যাকারিয়া (আ.)-এর অন্তরে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে,‘এটি আপনার রবের বান্দা যাকারিয়ার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহের বর্ণনা। তিনি গোপনে তাঁর রবকে ডাকেন। তিনি বলেন, হে রব,আমার অস্থি দুর্বল হয়ে পড়ে। বার্ধক্যে আমার মাথা শুভ্রজ্জ্বল হয়েছে। হে আমার প্রতিপালক, আপনাকে ডেকে আমি কখনো ব্যর্থ হইনি। আমি আশঙ্কা করি আমার পর আমার স্বগোত্রীয়দের সম্পর্কে। আমার স্ত্রী বন্ধ্যা। সুতরাং আপনি আপনার পক্ষ থেকে আমাকে উত্তরাধিকারী দান করুন।’ (সুরা মারিয়াম,আয়াত : ২-৫)।

যাকারিয়া (আ.)-এর স্ত্রী বন্ধ্যা ছিলেন। বয়সও অনেক হয় কিন্তু তাঁদের কোনো সন্তান ছিলো না। তবে আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি তাঁরা হতাশ ছিলেন না। তাই গোপনে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকেন তিনি। এরশাদ হয়েছে,‘আর যাকারিয়া মহান রবকে ডাকতে শুরু করে,‘হে আমার রব, আমাকে একাকী ছেড়ে দেবেন না, আপনি সর্বোত্তম উত্তরাধিকারক। আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিই, ইয়াহইয়া নামে একজন সন্তান দিই এবং তাঁর স্ত্রীকে উপযুক্ত করে তুলি,তাঁরা কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী ছিলেন, আমাকে তাঁরা আগ্রহ ও ভয়ে ডাকত, আসলেই তাঁরা আমাকে অনুগত ছিলো।’ (সূরা: আম্বিয়া, আয়াত : ৮৯-৯০) আল্লাহর কাছে গোপনে দোয়া : যাকারিয়া (আ.) ও তাঁর স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন ছিলো আনন্দে ভরপুর।

হযরত যাকারিয়া (আ.) বনী ইসরাঈলের নবী। হাদীছে নবীদের মাঝে লুকিয়ে আছে অমূল্য জ্ঞানভান্ডার। যাতে মানুষের জন্য রয়েছে অনুপম উপদেশ ও জীবন চলার পথের অনন্য দিক নির্দেশনা। এমনই একটি হাদিস হলো হারেছ আশ‘আরী (রা.) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন, আল্লাহর নবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘য়ালা ইয়াহ্ইয়া ইবনু যাকারিয়া (আ.)-কে পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেনো তিনি সে অনুযায়ী আমল করেন এবং বানী ইসরাঈলকে সে অনুযায়ী আমল করার নির্দেশ দেন। তিনি তদনুযায়ী আমল করতে বিলম্ব করছিলেন, তখন ঈসা (আ.)তাকে বললেন, আল্লাহ তা‘য়ালা আপনাকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছেন যাতে আপনি সে অনুযায়ী আমল করেন এবং বানী ইসরাঈলকে সে অনুযায়ী আমল করার নির্দেশ দেন। আপনি তাদেরকে নির্দেশ দেন অন্যথা আমি তাদেরকে নির্দেশ দিব। তখন ইয়াহইয়া (আ.) বললেন,আপনি যদি আমার পূর্বে নির্দেশ দেন তাহলে আমি আমাকে মাটির নিচে দাবিয়ে দেওয়ার অথবা আমাকে শাস্তি দেওয়ার আশঙ্কা করছি। অতঃপর তিনি লোকদেরকে বায়তুল মাক্বদাসে সমবেত করলেন। মসজিদ ভরে গেলে তারা বারান্দায় বসল। তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘য়ালা আমাকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছেন,যাতে আমি সে অনুযায়ী আমল করি এবং তোমাদেরকে সে অনুযায়ী আমল করার নির্দেশ দেই। তন্মধ্যে প্রথমটি হলো তোমরা কেবল আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপনকারীর উদাহরণ সে ব্যক্তির ন্যায়, যে তার সম্পদের খাঁটি সোনা ও রূপা দিয়ে একটি দাস ক্রয় করে তাকে বলল,এটা আমার ঘর আর এগুলো আমার কাজ। তুমি এ কাজগুলো করবে এবং এর প্রাপ্য আমাকে বুঝিয়ে দিবে। সে কাজ করতে থাকল এবং মালিক ব্যতীত অন্যকে এর সুফলাদি দিতে থাকল। তোমাদের কে খুশি হবে যে তার দাস এরূপ হোক? কারণ আল্লাহ তা‘য়ালা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তোমাদেরকে রিযিক দেন। অতএব তোমরা তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। ২. আল্লাহ তোমাদেরকে ছালাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব তোমরা ছালাত আদায়কালে এদিক-সেদিক তাকাবে না। কেননা আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর মুখমন্ডল বান্দার মুখমন্ডলের দিকে নিবিষ্ট করে রাখেন যতক্ষণ না বান্দা এদিক-সেদিক তাকায়। ৩.আমি তোমাদেরকে ছিয়াম পালন করার নির্দেশ দিচ্ছি। ছিয়াম পালনকারীর উদাহরণ ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে একটি দলের সাথে অবস্থান করছে আর তার সাথে রয়েছে সুগন্ধিযুক্ত একটি থলে। সবাই সেটির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে অথবা সেটি সবাইকে তার প্রতি আকৃষ্ট করছে। আর ছিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ মিশকে আম্বরের সুগন্ধি অপেক্ষা আল্লাহর নিকট অতি পবিত্র। ৪. আমি তোমাদেরকে ছাদাক্বা করার নির্দেশ দিচ্ছি। ছাদাক্বাকারীর উদাহরণ ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যাকে শত্রুরা পাকড়াও করে তার ঘাড়ের সাথে হাত বেঁধে ফেলেছে এবং তাকে হত্যার জন্য বদ্ধভূমিতে নিয়ে যাচ্ছে। তখন সে বলল, আমি আমার প্রাণের বিনিময়ে আমার কম-বেশি সমস্ত সম্পদ তোমাদেরকে দিচ্ছি। অতঃপর সে মালের বিনিময়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল (অনুরূপ ছাদাক্বাকারী ছাদাকা করার মাধ্যমে নিজেকে বিপদমুক্ত করে)। ৫. আমি তোমাদেরকে আল্লাহর যিকির করার নির্দেশ দিচ্ছি। যিকিরকারীর উদাহরণ ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যার শত্রুরা দ্রুততার সাথে তার পিছু ধাওয়া করেছে অতঃপর সে একটি সুরক্ষিত দুর্গে গমন করে নিজেকে তাদের থেকে রক্ষা করল। তদ্রুপ কোনো বান্দা আল্লাহর যিকর ব্যতীত নিজেকে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না। নবী করীম (সা.) বলেন,‘আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি, যা আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন (১) জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন করা (২) আমীরের নির্দেশ শ্রবণ করা (৩) তাঁর আনুগত্য করা (৪) প্রয়োজনে হিজরত করা ও (৫) আল্লাহর পথে জিহাদ করা। যে ব্যক্তি জামা‘আত হতে এক বিঘত পরিমাণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তার গর্দান হতে ইসলামের গন্ডি ছিন্ন হলো যতক্ষণ না সে ফিরে আসে। যে ব্যক্তি মানুষকে জাহেলিয়াতের দাওয়াত দ্বারা আহবান জানাল,সে ব্যক্তি জাহান্নামীদের দলভুক্ত হলো। যদিও সে ছিয়াম পালন করে,সালাত আদায় করে এবং ধারণা করে যে,সে একজন মুসলিম। অতএব তোমরা আল্লাহর আহবান দ্বারা আহবান কর, যিনি তোমাদেরকে আল্লাহর বান্দা মুমিন-মুসলিম হিসাবে নামকরণ করেছেন। (তিরমিযী হা/২৮৬৩; হাকেম হা/১৫৩৪; আহমাদ হা/১৭৮১৩; ছহীহুল জামে‘ হা/১৭২৪; ছহীহ তারগীব হা/১৪৯৮)। অতএব আসুন,আমরা ইয়াহইয়া বিন যাকারিয়া (আ.)-এর সুন্দর পাঁচটি উপদেশ এবং মুহাম্মাদ (সা.)-এর পাঁচটি উপদেশ আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করি। এ উপদেশগুলো আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করলে আমরা পৃথিবীতে সফলতা অর্জন করতে পারব এবং পরকালে সুখময় জান্নাত লাভ করতে পারব।

হযরত যাকারিয়া (আ.) এর সময় বনী ইসরাঈল সম্প্রদায় মারাত্মকভাবে আল্লাহ পাকের অবাধ্য হয়ে দ্বীন-শরীয়তকে সম্পূর্ণরূপে তরক করলো। হযরত যাকারিয়া (আ.) তাদেরকে হেদায়াত করার জন্য যতই চেষ্টা করছিলেন,তারা ততোই তাঁর কথার বিরুদ্ধচারণ করছিলো। এমনকি তারা তাঁর প্রাণনাশ করতে বদ্ধপরিকর হলো কিন্তু আল্লাহর নবী তা সত্ত্বেও তাঁর দায়িত্ব পালন করে চললেন।

একদিন তিনি কিছু লোকের এক মজলিসে ওয়াজ-নসিহত করিছিলেন। এমন সময় বের হতে একদল দুর্বৃন্ত মারাত্মক অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে যাকারিয়া (আ.)কে হত্যার করার জন্য সামনে আসতে লাগল। শত্রুদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য দৃষ্টির অন্তরাল হওয়ায় তারা তাঁকে জঙ্গলের ভিতরে তালাশ করতে লাগলো। পাপিষ্ট শত্রুগণও তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করল। তারা একেবারে নিকটবর্তী হলে হযরত যাকারিয়া (আ.) একটি বড় গাছের নিকটবর্তী হয়ে বললেন গাছ! তোমার ভিতর আমাকে আশ্রয় দান কর। গাছ হযরত যাকারিয়া (আ.) গাছের ভিতর আত্মগোপন করলেন বটে কিন্তু হযরত যাকারিয়া (আ.) এর একটি আচল গাছের বাহিরে ছিলো।

বর্ণিত আছে যে,একপর্যায়ে শত্রুদের করা উপর হতে গাছটিকে চিরিতে চিরিতে যখন হযরত যাকারিয়া (আ.) এর মাথায় গিয়ে ঠেকলো এবং মাথা চিরিতে আরম্ভ করল, তখন হযরত যাকারিয়া (আ.) প্রবল যন্ত্রণায় আহ্-উহ ও হা-হুতাশ করতে লাগলেন,ঠিক এ মুহূর্তে তাঁর নিকট ফেরেস্তা জিব্রাইল হাজির হয়ে বললেন হে আল্লাহর নবী! গাবধান! আপনি কোনো রকম শব্দ বা চিৎকার করবেন না। ধৈর্য ধরে থাকবেন। নুতবা এখনি আল্লাহ তা’য়ালা আপনার নাম নবুয়াতের দপ্তর হতে কেটে ফেলবেন। পক্ষান্তরে,আপনি ধৈর্য ও শোকরের ফজিলত হতেই বঞ্চিত হবেন। তখন আপনার সবকিছুই বরবাদ হতে যাবে।

আপনি আল্লাহর নবী হয়ে মুসীবতে পড়ে আল্লাহর দরবারে আশ্রয় প্রার্থনা না করে একটি গাছের কাছে আশ্রয় চাইলেন। এ আপনার জন্য একটি মারাত্মক ভুল হয়েছে,আপনাকে কোনো গাছ রক্ষা করতে পারে না। আপনি গাছের কাছে আশ্রয় চেয়ে যে ভুল করেছেন,তার শাস্তিস্বরূপ কাফের দুশমনগণ আপনাকে করাত দিয়ে চিরিয়ে দ্বিখন্ডিত করবে। এ সময় আপনি যদি ধৈর্যাবলম্বন করতে পারেন তা হলে আল্লাহ আপনার ভুলের অপরাধ ক্ষমা করবেন। করা দ্বারা চিরিত অবস্থায় তিনি আল্লাহর নাম যিকির করতে করতে শাহাদাতবরণ করলেন,কিন্তু এতটুকু আহ-উহ শব্দ করলেন না।

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম