মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
নদীমার্তৃক দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভূ-রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়, পূর্ব সীমান্তে আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরাম, দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে মায়ানমারের চিন ও রাখাইন রাজ্য এবং দক্ষিণ উপকূলের দিকে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। ভৌগোলিকভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপের সিংহভাগ অঞ্চল জুড়ে বাংলাদেশ ভূখন্ড অবস্থিত।
নদীমাতৃক বাংলাদেশ ভূখন্ডের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বে টারশিয়ারি যুগের পাহাড় ছেয়ে আছে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন ও দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সৈকত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশে অবস্থিত। জীবন-জীবিকা ও সভ্যতার অগ্রগতিও ঘটেছে নদীর তীরে। নদী যেমন ভূগঠনের মুখ্য ভূমিকা পালন করছে তেমনি,মানব সভ্যতার ক্রম-বিকাশেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে বিকশিত নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের অনেক নদী-তীরে গড়ে উঠেছে বন্দর, নগরী হাট বাজার ইত্যাদি। ভূমিগঠন, জনবসতি স্থাপন,শস্য উৎপাদন,জলপথে যোগাযোগ,ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ডে এবং নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশে নদ-নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের মধ্যে প্রবহমান অনেক নদীই কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। বিপন্ন হয়ে মরতে বসেছে একসময়ের খরস্রোতা দেলুতি নদীটি।
১৭৮৩ সালে জেমস রেনেল অংকিত বাংলাদেশের মানচিত্র যে,নদী-নালাগুলোর বিবরণ রয়েছে বর্তমানে সেগুলি চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য। নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে এবং পরিত্যক্ত গতিপথ ভরাট হয়ে পুরানো নদীপথের চিহৃ মুছে গেছে। আবার একই নদীর গতিপ্রবাহ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত।
দেলুতি নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা জেলার একটি নদী।নদীটির দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৫৮ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক দেলুতি নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ৪৩।
দেলুতি নদীটি খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নে প্রবহমান ভদ্রা নদী হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। অতঃপর এই নদীর জলধারা একই জেলা এবং একই উপজেলার দেলুটি ইউনিয়ন ও লতা ইউনিয়নের সীমান্ত বরাবর প্রবাহিত হয়ে শিবসা নদীতে নিপতিত হয়েছে। এই নদীর একমাত্র উপনদী গুনাখালি নদী যা একই জেলা ও একই উপজেলার লতা ইউনিয়নে এই নদীর সাথে মিশেছে। নদীতে সারাবছর পানিপ্রবাহ থাকে এবং ছোটবড় নৌযান চলাচল করে। নদীটির উজানের তুলনায় ভাটির দিক অধিক প্রশস্ত। সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় প্রবাহিত হওয়ায় নদীটি জোয়ার ভাটার প্রভাবে প্রভাবিত। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ যার অর্থনীতি কৃষি নির্ভর। জাতিসংঘের শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী এটি একটি স্বল্পোন্নত দেশ। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে বাংলাদেশের মাথাপিছু ছিলো ১২.৫৯৯২ মার্কিন ডলার। ২০২০ সালের আগষ্ট মাসে মাথাপিছু বেড়ে ২০৬৪ ডলারে এসে দাঁড়ায়। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১.৯০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে নদীর ভূমিকা অপরিসীম।
খুলনা বিভাগ বাংলাদেশের আটটি বিভাগের মধ্যে একটি এবং এটি দেশের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে অবস্থিত। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী, বিভাগটির আয়তন ২২,২৮৫ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ১৫,৫৬৩,০০০ জন। খুলনা বিভাগের সদর দপ্তর খুলনা শহর। এই বিভাগের সদর দপ্তর খুলনা শহর হলো ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের পরে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। খুলনা বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে রূপসা নদী এবং ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত। বাংলাদেশের প্রাচীনতম নদী বন্দরগুলোর মধ্যে খুলনা অন্যতম। নাব্যতা হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে খুলনার বেশিরভাগ নদ-নদী। এরমধ্যে ১৬টি নদীর বিভিন্ন স্থান খনন না করলে এসব নদী দিয়ে নৌযান চলাচল করতে পারবে না।জানা গেছে, খুলনা বিভাগের ৭৮টি নদীর মধ্যে খুলনার হাড়িয়া, ময়ূর, হামকুড়া, কচা, শেলা ও বাগেরহাটের ভোলা, হাওড়া, সড়া, চুনা, যমুনা, রামসাগর, সাতক্ষীরার সোনাই, কুষ্টিয়ার টেকা, নড়াইলের চিত্রা, মাদারীপুরের নিম্ন কুমার, মরাগাঙ ভদ্রাসহ ২৫টি নদী এরই মধ্যে মরে গেছে। এছাড়াও ১০টি নদী শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তিনদশক আগেও এসব নদী দিয়ে এ অঞ্চলের পণ্য ও যাত্রী আনা-নেয়া করত। তবে এখন আর এসব নদীতে বড় কোন নৌযান চলাচল করে না। এছাড়া খুলনা মংলা নৌপথ রূপসা ও পশুর নদীর বুকে জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ চর। বটিয়াঘাটা উপজেলা সংলগ্ন কাজীবাছা নদীতে চর জেগে ওঠায় মংলা বন্দর থেকে মালবাহী কার্গো ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। পাইকগাছার দেলুটি থেকে পাইকগাছা গড়ইখালিমুখী শিবসা নদীতে বিশাল চর জেগে উঠেছে। ভাটায় এ নদী দিয়ে ইঞ্জিন চালিত নৌকাও চলতে পারে না। খুলনা থেকে এখন মাত্র খুলনা-মদিনাবাদ, খুলনা-নীলডুমুর, খুলনা-জোড়সিং রুটে লঞ্চসহ ভারি নৌ চলাচল অব্যাহত রয়েছে। দেড় দশক আগেও অন্তত ১৫টি রুটে লঞ্চসহ ভারি নৌযান চলাচল করত। খুলনার উত্তরে অভয়নগর-নওয়াপাড়া ছাড়া অন্য কোন রুটে কার্গো বা মালবাহী নৌযান চলাচল করে না।
পৃথিবীর ইতিহাস খুঁজতে গেলে দেখা যায় প্রায় সকল বড় বড় মানবসভ্যতা গড়ে ওঠেছিলো নদী তীরে। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নগর, বন্দর,শহর,গ্রাম, জেলেপাড়া, বাণিজ্যকেন্দ্র প্রভৃতি। এই নদীকে ঘিরেই ছিলো আদিকালের যাতাযাতের সকল ব্যবস্থা। জাহাজে, নৌকায় চড়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত মানুষ ঘুরে বেড়িয়েছে। কৃষি, মৎস্য, জেলেদের পেশা এবং সংস্কৃতির পাশাপাশি মানুষের নিত্যদিনের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ সকল কিছুর একমাত্র উৎস ছিলো নদী। নদী আজ দখল, দূষণ আর ভরাটের প্রেিযাগিতায় বিপন্ন অনেকাংশে বিলুপ্ত। বিলুপ্ত প্রায় দেলুতি নদী।
আদিকাল থেকে জীবন ও জলের প্রবাহ একাকার, অবিচ্ছিন্ন। নদী ও জীবন পরস্পরের সবচেয়ে সার্থক উপমান এবং এতোটাই সঙ্গত যে,ক্রমাগত পুনরাবৃত্ত হয়েও নতুন জীবনের অনিঃশেষ বহমানতা, পরিক্রমণ,বিবর্তন, সবকিছু একই সঙ্গে নদীতে দৃশ্যমান। দেশ,সুজলা-সুফলা,শস্য-শ্যামলা এই বাংলা মায়ের শিতল বক্ষ চিরে বয়ে চলেছে অসংখ্য নদ ও নদীর অববাহিকা।এ দেশের অর্থনীতিও নদীনির্ভর। নদী প্রকৃতির দান। নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নদী-নালার ওপর নির্ভরশীল। নদীকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের কোনো সৌন্দর্য কল্পনা করা যায় না। নদীর গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। নদীর গুরুত্ব অপরিসীম।দখল-বেদখলে নদীর দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। এক সময়ের খরস্রোতা দেলুতি নদী আজ তৃষ্ণার্ত।
নদ-নদী মানবজীবনে ও মানবসভ্যতায় এক অনবদ্য সংযোজন। কালের বিবর্তনে খুলনা জেলার দেলুতি নদীতে এখন আর পালতোলা নৌকার বহর দেখা যায় না। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পানিশূন্য নদীর বুকে চলে চাষবাস। খনন না করা ও দখলদারদের থাবায় নদীর নাব্যতা যেমন কমছে, ঠিক একইভাবে কমছে নদীর সংখ্যাও। দেশের নদ-নদী হারিয়ে যাচ্ছে ফলে ইকোসিস্টেম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, পরিবেশ বিপর্যয়ের মারাত্মক পর্য্যায়ে উপনীত। মাছ, পশুপাখি, গাছপালা, বন্য ও জলজপ্রাণী, উদ্ভিদ, ফ্লোরা-ফনা প্রভৃতি তাদের জীববৈচিত্র্য হারিয়ে অস্তিকত্বের সঙ্কটে ভূগছে, শহরের বায়ু নিশ্বাস গ্রহণের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। এদেশে বিরাজমান প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশের কাতারে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন অঞ্চলভিত্তিক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং কেন্দ্রমুখী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে অঞ্চলভিত্তিক অবকাঠামো উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলই ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিক দিয়ে স্বকীয় বা অনন্য। অন্যান্য জেলার মত খুলনা জেলায়ও রয়েছে কিছু স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য।
নদ-নদী এ দেশের সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। নদ-নদী যোগাযোগব্যবস্থায় রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। চাষাবাদের পানি সেচে নদ-নদীর ভূমিকা অসামান্য। নদ-নদী থেকে আহরিত মাছ দেশবাসীর আমিষ চাহিদার এক বড় অংশ মেটায়। নদ-নদী সুরক্ষা নিয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে এখনো তৎপরতা দেখা যায় না অনেকেরই।দেশকে বাঁচাতে আমাদের সকলের গণসচেতনতা জরুরি।তাছাড়া নদ-নদী উদ্ধারে সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনায় দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ফিরে পাচ্ছে প্রাণ। এভাবে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সকলের এগিয়ে আসতে হবে। দেশের অন্যান্য নদীর মতো খুলনা জেলার দেলুতি নদীকে বাঁচানোই এখন সময়ের দাবি। ছবি-প্রতিকী
লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ(কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান),সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক, গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট