নাব্য হারিয়ে মরতে বসেছে খরস্রোতা লাবুন্ধা নদী

মো.আলতাফ হোসেনঃ
নদীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক চিরকালের। জীবন-জীবিকা ও সভ্যতার অগ্রগতিও ঘটেছে নদীর তীরে। নদী যেমন ভূগঠনের মুখ্য ভূমিকা পালন করছে তেমনি,মানব সভ্যতার ক্রম-বিকাশেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে বিকশিত নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের অনেক নদী-তীরে গড়ে উঠেছে বন্দর, নগরী হাট বাজার ইত্যাদি। ভূমিগঠন, জনবসতি স্থাপন,শস্য উৎপাদন,জলপথে যোগাযোগ,ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ডে এবং নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশে নদ-নদীর গুরুত্ব অপরিসীম।

১৭৮৩ সালে জেমস রেনেল অংকিত বাংলাদেশের মানচিত্র যে,নদী-নালাগুলোর বিবরণ রয়েছে বর্তমানে সেগুলি চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য। নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে এবং পরিত্যক্ত গতিপথ ভরাট হয়ে পুরানো নদীপথের চিহৃ মুছে গেছে। আবার একই নদীর গতিপ্রবাহ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত।

দক্ষিণ এশিয়ায় অন্তর্গত আমাদের বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। শাখা প্রশাখাসহ প্রায় ৮০০ নদ নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪,১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকাই শত শত নদীর মাধ্যমে বয়ে আসা পলি মাটি জমে তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা পাউবো বাংলাদেশের নদীগুলোকে সংখ্যাবদ্ধ করেছে এবং প্রতিটি নদীর একটি পরিচিতি নম্বর দিয়েছে। এর ফলে তাদের হিসাব অনুযায়ি বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা এখন ৪০৫টি। পাউবো কর্তৃক নির্ধারিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী (১০২টি), উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী (১১৫টি), উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদী (৮৭টি), উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী (৬১টি), পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের নদী (১৬টি) এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নদী (২৪টি) হিসেবে বিভাজন করে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
গাজীপুর জেলা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের ঢাকা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। অবস্থানগত কারণে এটি বাংলাদেশের একটি বিশেষ শ্রেণীভুক্ত জেলা। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সংশ্লেষে কালোত্তীর্ণ মহিমায় আর বর্ণিল দীপ্তিতে ভাস্বর অপার সম্ভাবনায় ভরপুর গাজীপুর জেলা। গাজীপুর জেলার উপর দিয়ে প্রবাহমান বর্তমান দখলমুক্ত ও আংশিক দখল নদীর সংখ্যা ১৫টি। ঢাকার নদীমাতৃক বৈশিষ্ট্য দেখে বলা যায়, তুরাগে প্রচুর মাছ ছিলো কিন্তু বর্তমানে র্তীব পানি দূষণে ভুগছে। জেলার বিভিন্ন নদ-নদীর মতো কালের করাল গ্রাসে রক্ষা পায়নি খরস্রোতা লাবুন্ধা নদীটি। দখল -দূষণে মরতে বসেছে নদীটি।
লাবুন্ধা নদী বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের গাজীপুর জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ২৩ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৫ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক লাবুন্ধা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী নং ৫৩।

দখল আর দূষণে গাজীপুর জেলার অধিকাংশ নদী এককালের অপরূপ সৌন্দর্য্যের প্রশন্ত ও খরস্রোতা নদী এখন পরিণত হয়েছে মরা খালে। মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে একসময়ের খরস্রোতা লাবুন্ধা নদীটি। অন্যান্য জেলার মতো গাজীপুর জেলায় রয়েছে বহুসংখ্যক নদ-নদী। উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদীগুলোর মধ্যে ১. আইমান-আখিলা নদী, ২. আইমান-মোবারি নদী, ৩. আড়িয়াল খাঁ নদী, ৪. ইছামতি নদী (মানিকগঞ্জ), ৫. ইছামতি নদী (সিরাজদিখান), ৬. ইলিশমারী নদী, ৭. এলংজানী নদী, ৮. কাটাখালী নদী, ৯. কালিগঙ্গা নদী (মানিকগঞ্জ), ১০. খিরো নদী (ত্রিশাল), ১১. খিরো নদী (ভালুকা), ১২. গাংডুবি নদী, ১৩. গাজীখালী নদী, ১৪. গোল্লার খাল নদী, ১৫. চাতাল নদী, ১৬. চাপাই নদী, ১৭. চিলাই নদী, ১৮. জয়পাড়া খাল নদী, ১৯. ঝারকাটা নদী, ২০. জিঞ্জিরাম নদী, ২১. ঝিনাই নদী, ২২. টঙ্গী খাল নদী, ২৩. টংকি খাল নদী, ২৪. তালতলা খাল নদী, ২৫. তুরাগ নদী, ২৬. তুলসীখালী খাল নদী, ২৭. ধলেশ্বরী নদী, ২৮. নাগদা খাল নদী, ২৯. নাঙ্গলা নদী, ৩০. নালজুরি খাল নদী, ৩১. নাংলী নদী, ৩২. পদ্মা নদী, ৩৩. পাগারিয়া-শিলা নদী, ৩৪. পারুলি খাল নদী, ৩৫. পাহাড়িয়া নদী, ৩৬. পুরনো ধলেশ্বরী নদী, ৩৭. পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী, ৩৮. পুংলী নদী, ৩৯. বংশী নদী, ৪০. বংশী নদী (সাভার), ৪১. ব্রহ্মপুত্র নদী (নরসিংদী-মুন্সীগঞ্জ), ৪২. বাকসাতরা নদী, ৪৩. বাজ্জা-মেধুয়া নদী, ৪৪. বানার আপার নদী, ৪৫. বানার লোয়ার নদী, ৪৬. বালু নদী, ৪৭. বুড়িগঙ্গা নদী, ৪৮. বৈরান নদী, ৪৯. বোশখালীর খাল নদী, ৫০. মরা জিঞ্জিরাম নদী, ৫১. মাহারি নদী, ৫২. মিনিখালী নদী, ৫৩. লাবুন্ধা নদী, ৫৪. লৌহজং নদী, ৫৫. শীতলক্ষ্যা নদী, ৫৬. সালদা নদী, ৫৭. সুতী নদী, ৫৮. সুতিয়া নদী, ৫৯. সোনাখালী নদী, ৬০. হাই নদী, ৬১. হাড়িদোয়া নদী।

বাংলাদেশের নদী এখন ভয়ানকভাবে বিপন্ন। সংখ্যা, আয়তন ও গুণমান—সব দিক থেকেই। তাই অবশ্যম্ভাবীরূপে নদীর প্রাণবৈচিত্র্যও এখন ভীষণভাবে সংকটাপন্ন। একসময় যেসব নদী ছিল প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ, আজ সেসব নদী পরিণত হয়েছে প্রায় প্রাণশূন্য সংকীর্ণ স্রোতধারায় কিংবা বিষাক্ত নর্দমায়। একসময়ের বিস্মৃত অতল জলরাশি ভরা নদী এখন দেখা যায় অবিস্তীর্ণ অগভীর বালিয়াড়ি ভরা এক শীর্ণকা হিসেবে। আবার কোনো কোনো জায়গায় নদী সম্পূর্ণভাবে মুছে গিয়ে তৈরি হয়েছে ফসলের ক্ষেত কিংবা স্থাপনা। ফলে নদীর প্রাণবৈচিত্র্যের সেই ঐশ্বর্যময় জৌলুস আর আগের মতো নেই। জলজ অনেক প্রাণ প্রজাতি বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আর বহু প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হওয়ার প্রহরও গুনছে।

একাদশ শতকে বাংলাদেশে প্রায় দেড় হাজার নদী ছিল। পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে সেই নদীর সংখ্যা অর্ধেকে অর্থাৎ ৭০০তে নেমে আসে। বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সেই সংখ্যা কমতে কমতে বর্তমানে ৩৫০-এর মতো দাঁড়িয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে প্রায় ২৫ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিলো। আর বর্তমানে বাংলাদেশের সব নদ-নদী, ক্ষুদ্র জলস্রোত, খাঁড়ি, খাল ইত্যাদির সম্মিলিত দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার কিলোমিটার। এই পরিসংখ্যান থেকে সহজেই ধারণা করা যায় যে বাংলাদেশ থেকে বহু নদী হারিয়ে গেছে। আর হারিয়ে যাওয়া সেসব নদীর সঙ্গে হারিয়ে গেছে অনেক জলজ জীব।

পরিতাপের বিষয়, বড় কিছু প্রাণী ছাড়া হারিয়ে যাওয়া সেসব জলজ জীবের অনেক নামই আমাদের অজানা। মেরুন্ডী, সে-ও অতি অল্পসংখ্যক সন্ধিপদ কিছু প্রাণী ছাড়া, নদীতে বসবাসকারী অসংখ্য জলচর প্রাণীর কোনো পরিসংখ্যান আগেও করা হয়নি, এখনো নেই। আমাদের দেশে অমেরুন্ডী প্রাণীদের ওপর উল্লেখযোগ্য কিংবা নির্ভরযোগ্য জরিপের বড়ই অভাব। বলা বাহুল্য নদীগুলো বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে কোনো কোনো জীব আমাদের দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে কিংবা বিদায় নেবে।
কিছু গবেষণার প্রকাশিত ফলে দেখা গেছে যে কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশে কিছু মাছ বিরল হতে হতে দেশ থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আইইউসিএন বাংলাদেশের প্রায় ৫৪টি মাছকে অতি ও মহাবিপন্ন, বিপন্ন, সংকটাপন্ন ইত্যাদি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশে এখন শতাধিক মত্স্য প্রজাতি সংকটাপন্ন। এসবের মধ্যে, বালিতোরা, নান্দিনা, তিলা খোকসা, নিপাতি, দারকিনা, মাইটাভাঙা, ভোল, কাজুলি, নলুয়া চান্দা, পিপলা শোলসহ আরো অনেক নাম উল্লেখ করা যায়।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে নদীগুলো আছে তার অনেক কটি কোনো রকমে বেঁচে আছে। বেশ কটির নাব্যতাও হ্রাস পেয়েছে। তবে নদীজ জীববৈচিত্র্যের জন্য সব থেকে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে নদীদূষণ। ঘর-গৃহস্থালির বর্জ্য, কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার এবং কলকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত বর্জ্য নদীর পানিতে মিশে পানিকে করে তুলছে দূষিত। দূষণে দূষিত হয়ে মরে গেছে দেশের অনেক নদ-নদী। বাংলাদেশে ছোট বড় অসংখ্য নদ-নদী জালের মতো ছড়িয়ে আছে। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার মানুষের জীবন ও জীবিকার অন্যতম অবলম্বন এদেশের নদ-নদী। তবে নদী ভরাট, নব্যতা হ্রাস ও দূষণের কারণে ছোট-বড় অনেক নদী বর্তমানে বিপন্ন। বিপন্ন প্রায় লাবুন্ধা নদীটি।

আমাদের দেশের বুক চিরে বয়ে চলা অসংখ্য নদ-নদীর কারণে বাংলাদেশ বিশ্বে নদীমাতৃক দেশ হিসেবে সুপরিচিতি। এসব নদীকে কেন্দ্র করেই বাংলার বুকে গড়ে উঠেছে শহর-নগর-বন্দর। এদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকাও নদীর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিস্তীর্ণ নদীপথ যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। কালের বিবর্তনে বিপন্ন হচ্ছে নদী ও নদীর প্রতিবেশ। তাই বাংলাদেশের বিপন্ন নদ-নদী রক্ষায় দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ঠিক রাখা ও ক্ষতিকর কর্মকান্ড বন্ধ করার মাধ্যমে যেমন রক্ষা পাবে নদ-নদী, তেমনি টিকে থাকবে হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত বাঙালি সংস্কৃতি। আবহমানকাল ধরেই এ উপমহাদেশের নদীর সঙ্গে জীবন জড়িত। নদীকে কেন্দ্র করে যুগে যুগে রচিত হয়েছে কালজয়ী সব গান। বারবার লেখক-কবির লেখায় স্থান পেয়েছে নদী। রচিত হয়েছে নদী ও নদীপারের মানুষের জীবনসংগ্রাম নিয়ে পদ্মানদীর মাঝির মতো কালজয়ী উপন্যাস। কিন্তু দখল-দূষণ,ভরাট ও বালু উত্তোলনের কারণে আজ নদী বিলুপ্ত ও নজরদারির অভাবসহ নানা কারণে নদীমাতৃক দেশের আজ করুণ অবস্থা। দেশের মধ্যে প্রবহমান অন্যান্য নদ-নদীর মতো লাবুন্ধা নদীকে বাঁচানোই এখন সময়ের দাবি।ছবি-প্রতিকী

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ(কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান),সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব, গবেষক,শিক্ষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম