মো. আলতাফ হোসেন ঃঃ
অবিরাম সৌন্দর্যে আঁকা নদীমাতৃক দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। এককালের প্রায় হাজার নদীর দেশ। জোয়ারভাটার দেশ। সমভূমি আর সবুজ বন-বনানী ও পাহাড়-পর্বত ঘেরা। রূপ-মাধুর্যে সমৃদ্ধ আমাদের প্রাণপ্রিয় এই মাতৃভূমি বাংলাদেশ। নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন নদ-নদী। শাখা প্রশাখাসহ প্রায় ৮০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪,১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বাংলাদেশের নদীগুলোকে সংখ্যাবদ্ধ করেছে এবং প্রতিটি নদী একটি পরিচিতি নম্বর দিয়েছে। এর ফলে তাদের হিসাব অনুয়াযী বাংলাদেশে এখন নদীর সংখ্যা এখন ৪০৫টি। দেশের মধ্যে থাকা বিভিন্ন নদ-নদীর মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলার চেলা নদীটি অন্যতম।
সুনামগঞ্জ জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। উপজেলার সংখ্যানুসারে সুনামগঞ্জ বাংলাদেশের একটি “এ” শ্রেণীভুক্ত জেলা। কিংবদন্তি এবং ঐতিহাসিক তথ্যাবলি থেকে অনুমান করা হয় যে, সুনামগঞ্জ জেলার সমগ্র অঞ্চল প্রাচীন কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্যের অন্তর্গত ছিলো। জনৈক মোঘল সিপাহি সুনামুদ্দির নামে সুনামগঞ্জের নামকরণ করা হয়। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে সুনামগঞ্জকে মহকুমায় এবং ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে জেলায় উন্নীত করা হয়। প্রাচীনকাল থেকে বহু ভাষাভাষী জাতি, বর্ণ ও ধর্ম নিয়ে বেড়ে উঠেছে সার্বভৌম বাংলাদেশের বর্তমান সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ অঞ্চল। পৌরাণিক যুগে প্রাচীন কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জের লাউড় পর্বতে কামরূপ রাজ্যের উপরাজধানী স্থাপন করেছিলেন রাজা ভগদত্ত।রাজা ভগদত্তের শাসনামলে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলাসহ বাংলাদেশের ঢাকা এবং ময়মনসিংহ জেলার মধ্যবর্তী অঞ্চল লাউড় রাজ্যের অধীন শাসিত হত। সুনামগঞ্জ জেলায় রয়েছে বহুসংখ্যক নদ-নদী। অনেক নদীই আজ বিলিনের পথে তার মধ্যে চেলা নদীটি অন্যতম।
চেলা নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। নদীটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুনামগঞ্জ জেলার একটি নদী।নদীটির দৈর্ঘ্য ১০ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৮৯ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক চেলা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদী নং ২৯।
বর্ষায় নদীতে উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সোনালী চেলা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। ওই সময় নদী পারাপারে জনসাধারণের নৌকাই হয় একমাত্র ভরসা। আর শুকনো মওসুমে এটি মরা নদীতে পরিণত হয়। নদী পারাপারে তৈরি করা হয় একটি বাঁশের সেতু। তখন বাঁশের সেতুই হয় নদী পারাপারে একমাত্র ভরসা। এই চিত্র সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী নরসিংপুর ইউনিয়নের পাহাড়ি সোনালী চেলা নদী। শুকনো মওসুমে সোনালী চেলার মোহনায় চার দিকে বালুর বিশাল চর জেগে ওঠে। আবার বর্ষায় উজান থেকে নেমে আসা প্রবাহমান পানির প্রচন্ড স্রোতধারার নয়নাভিরাম দৃশ্য মন জুড়িয়ে যায়। বর্ষায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত পারাপার হতে হয় প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সব শ্রেণী-পেশার মানুষদের। তবে শুকনো মওসুমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের দূর-দূরান্ত থেকেও অনেকেই এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে বেড়াতে আসেন। শুকনো মওসুমের দিনগুলোতে সোনালী চেলা নদীর পানি শুকিয়ে তলদেশ দিয়ে পানির প্রবাহ দৃশ্যমান থাকে।
দোয়ারাবাজার উপজেলার খরস্রোতা চেলা নদীর চিত্র পাল্টে যায় প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে। ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি এই নদী ছাতকে সুরমা নদীতে মিলিত হয়েছে। নদীতে এখন হাঁটু পানি। নদীর এক তীরে চর জেগে উঠে ১৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত প্রস্থ রেখার সৃষ্টি হয়েছে। সীমান্তের জিরো পয়েন্টে ওই নদীর মোহনায় বিশাল চর জেগেছে। ফলে প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছে নৌপথ। ওই নদীপথ দিয়ে প্রতিনিয়ত বারকি নৌকা ভারত হতে চুনাপাথর শিল্পশহর ছাতকে নিয়ে আসে। পানি শুকিয়ে যাওয়ায় নৌ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। দুই তীরে পারাপারের জন্য স্থানীয়রা বাঁশবেতের চাঁটাই দিয়ে সাঁকো তৈরি করেছেন। নৌকা চলাচলের ঘাট না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে পায়ে হেঁটেই নদী পার হতে হয়।
সোনালী চেলা নদী ক্রমেই নাব্যতা হারাচ্ছে। শুষ্ক ও বর্ষা দুই মৌসুমে ভোগান্তির শেষ থাকে না। বর্ষায় সহজেই ঢলের পানি প্লাবিত করেন নদী তীরবর্তী এলাকা। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় অসহায় হয়ে পড়েন সীমান্ত এলাকার শ্রমজীবী মানুষ। অতীতে প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে জেলেরা মাছ শিকার ও স্থানীয় শ্রমিকরা ওই নদীর তলদেশ হতে নুড়ি-পাথর কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। এখন আর তা করতে পারছেনা। এই অবস্থায় নদীটি ড্রেজিং করা জরুরি তাছাড়া উভয় তীরে পরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন।
চেলা নদীর মোহনা। বর্ষায় উত্তাল তরঙ্গ আর শুষ্ক মৌসুমে চারদিকে বিশাল চর। এ যেন নদী নয় ধু-ধু মরুভ’মি। উত্তরে দাঁড়িয়ে আছে ভারতের সুউচ্চ কালো পাহাড়। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ওই নদী দোয়ারাবাজার উপজেলার বুক চিরে ছাতক উপজেলার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুরমা নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। পড়ন্ত বিকালে সোনালী চেলার মোহনার নয়নাভিরাম দৃশ্য পর্যটকদের আরো প্রাণবন্ত করে তোলে। তাই জেলার অন্যান্য নদীর মতো প্রাণ ফিরে পাক চেলা নদী দাবি এলাকাবাসীর।
দোয়ারাবাজার উপজেলাধীন নরসিংপুর ইউনিয়নের সোনালী চেলার ভয়াবহ নদী ভাঙ্গনের কবলে অর্ধশত ঘর বাড়ী,স্ত্রী সন্তান পরিবার পরিজন নিয়ে কোথায় হবে তাদের মাথা গুজার ঠাই,সেই চিন্তায় চিন্তিত ভুক্তভোগী পরিবারগুলো! দখল দূষণ ও বালু উত্তোলনের কারণে শুধু ভিটে মাটি নিয়েই শান্ত হয়নি সর্বনাশী নদীটি,নিয়েছে জানমাল নিয়েছে কৃষকের ফসলী জমি। বালি নদী ইজারা হওয়ার কারণে এবং নদীর গভীরতা বৃদ্ধি হওয়ার কারণেই এমন ভয়াবহ নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। সর্বশান্ত হতে হয়েছে অর্ধশত পরিবারের,বিলিন হয়েছে অর্ধশত ঘর বাড়ী,তাই যথ দ্রুত সম্ভব,ঘটনাস্থল পরিদর্শনের মাধ্যমে,নদী ভাঙ্গনরোধ করার জন্য জোরদাবি এলাকাবাসীর।
সুনামগঞ্জ জেলায় অনেক নদ-নদী রয়েছে। এ জেলার অনন্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ভৌগলিক অবস্থান সমগ্র বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল হতে এ জেলাকে দিয়েছে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। জেলার বেশির ভাগ অঞ্চলই হাওর, বাওর, ও অপেক্ষাকৃত নীচু অঞ্চল নিয়ে গঠিত এবং বৎসরের প্রায় ৭/৮ মাস জলমগ্ন থাকে। বর্ষার সময় এখানে সমুদ্রের মত ঢেউ খেলে এবং গ্রামগুলোকে মনে হয় এক একটি ছোট ছোট দ্বীপ। অনেক ছোট ছোট নদী ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে উৎপন্ন হয়ে জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুরমা- কুশিয়ারায় পতিত হয়েছে। পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপাত অঞ্চল চেরাপুঞ্জি এ জেলার উত্তর প্রান্ত থেকে মাত্র প্রায় ৩৫ কি.মি. দূরে। তাই এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেশি।
ছাতকের চেলা নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলনে চলছে ড্রেজার মেশিনের তান্ডব। হাওরাঞ্চলের অনেকাট নির্জন এলাকায় ড্রেজার মেশিন দিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিনই বালু উত্তোলন ও বিক্রি করছে একটি চক্র। পাশাপাশি নদীতে ভ্রাম্যমান চাঁদাবাজ চক্রও রয়েছে সক্রিয়। ডেজার মেশিন দিয়ে সরাসরি নৌকা বোঝাই কওে বালু বিক্রি করায় এক দিকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব থেকে অন্যদিকে বালু ব্যবসার সাথে যাদের জীবিকা নির্বাহ হয় তারা বেকার হয়ে পড়ছে। নদী দখল-দূষণরোধসহ বালু উত্তোলন বন্ধে প্রদক্ষেপ নেওয়া জরুরী।
সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলাধীন চেলা নদী বালুমহালের পার্শ্ববর্তী হাদা টিল্লা সংলগ্ন ক্যাম্পের টিল্লার নিচের অংশে অর্ধশতাধিক অবৈধ বোমা মিশিন দ্বারা একটি শক্তিশালী পাথর চক্র স্থানীয় জনপ্রতিনিধিবৃন্দের নাম ব্যবহার করে কিছু অসাধু ব্যক্তিবর্গ পাথর ও বালু উত্তোলন করছে। এতে পরিবেশ ধ্বংসের পাশাপাশি খনিজ সম্পদ ও সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অব্যাহত ভাবে লুটপাট চলছে। এমতাবস্থায় নদী ভাঙ্গনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এবং ফসলি জমি ধ্বংস হচ্ছে। এইভাবে যদি চলতে থাকে ছাতকের চেলা নদী বালুমহাল একদম ধ্বংস হয়ে যাবে এবং বেকার হয়ে পড়বে কয়েক লক্ষ শ্রমিক। দেশের বিভিন্ন এলাকায় শুকনো মৌসুমে নদীর চিহ্ন মুছে যায়। দেখা যায় শুধু মঙ্গল গ্রহের মতো পানি শূন্য। ধূ-ধূ সরবর কিংবা মরে যাওয়া নদীগুলোর অন্তিম অস্তিত্ব। এভাবে চলতে থাকলে নদ-নদীর পানি সম্পদ,শস্য ও মৎস সম্পদসহ সকল প্রাণীকূল ও বনভূমি ভবিষ্যতে ধ্বংস বা বিলুপ্ত কিংবা বিলিন হয়ে যাবে কালের অতল চলে। সে সাথে পরিবেশসহ সব কিছুর ওপর বিষণভাবে প্রভাব পড়বে ।
নদ-নদী দখল আর নদীর পার কেটে বালু উত্তোলন যেকোনো অপরাধই শাস্তিযোগ্য। হাজার হাজার বছর নদ-নদীকে কোনো মানুষের রক্ষা করার প্রয়োজন হয়নি। আজ তারা অগণিত শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত। নদী ছিলো আপন বেগে পাগলপারা। তাকে আক্রমণ বা বাধা দেওয়ার সাধ্য ছিলো না কারও। নদ-নদী ছিলো অজাতশস্ত্র,কালের বিবর্তনে হারিয়েছে এসব নদীর নাব্যতা। অন্যান্য নদ-নদীর মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলার অনেক ছোট-বড় নদ-নদী এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। তার মধ্যে চেলা নদী একটি।
পৃথিবীতে প্রাণী জগৎ বেঁচে ধমনীতে যেমন রক্ত প্রবাহ জরুরি তেমনি দেশকে বাঁচাতে হলে সে দেশের বুকের ভেতর নদী প্রবাহ জরুরি। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় নদ-নদী ও তার পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে দিতে দাবি সচেতনমহলের। তাই চেলা নদীসহ দেশের অন্যান্য নদ-নদীর সঠিক নাব্যতা বজায় রেখে নদীকে বাঁচানো সরকারের পাশাপাশি আমাদের সকলের কর্তব্য।
নদী বাাঁচাও দেশ বাঁচাও। সমাজ সচেতন ও মানবতাবাদীর ভূমিকায় থেকে কবি নারী ও নদী উভয়ের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দাবি করেন। নদী কিংবা নারী বিপন্ন হলে সভ্যতা ও সৃজনশীলতা সংকটাপন্ন হয়। তাতে নারীত্বের কোনো হানি হয় না। কারণ নদী ও নারীর সৃজনক্ষমতা প্রশ্নাতীত, নির্বিকল্প, অবিনাশী। উভয়ের নিরাপদ অস্তিত্ব এবং অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সকলের।
লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ(কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান),সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক, গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট