মো.আলতাফ হোসেনঃঃ
নদী যেমন ভূগঠনের মুখ্য ভূমিকা পালন করছে তেমনি,মানব সভ্যতার ক্রম-বিকাশেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে বিকশিত নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের অনেক নদী-তীরে গড়ে উঠেছে বন্দর, নগরী হাট বাজার। পাউবো কর্তৃক সারা দেশে প্রায় ৪০৫টি নদ-নদীর মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশে ছোট বড় সব মিলিয়ে ২৩০ থেকে ২৪০টির মতো নদ- নদী সরকারি হিসেব আছে। এসব নদীগুলোর মধ্যে ৫৭ টি হচ্ছে আন্তসীমান্ত নদী যার মধ্যে ৫৪টি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন এবং ৩টি বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে অভিন্ন। দেশের মধ্যে প্রবহমান একটি নদীর নাম বগী নদী।
বগী নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৪ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১২০ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক বগী নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ৫৬।
বগী নদীটি বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার শরণখোলা রেঞ্জ ইউনিয়ন এলাকায় প্রবহমান ভোলা নদী হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। অতঃপর এই নদীর জলধারা একই জেলার একই উপজেলায় প্রবাহিত হয়ে বলেশ্বর নদীতে নিপতিত হয়েছে। নদীতে সারাবছর পানিপ্রবাহ পরিদৃষ্ট হয় এবং ছোটবড় নৌযান চলাচল করে। তবে বর্ষাকালে নদীটিতে স্বাভাবিকের চেয়ে পানির প্রবাহ অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। এ সময় নদীর তীরবর্তী অঞ্চল বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। নদীটি জোয়ার ভাটার প্রভাবে প্রভাবিত। তাছাড়া বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই শরণখোলার বেড়িবাঁধে ভাঙন। এখনও শুরু হয়নি বর্ষা মৌসুম বা অতিরিক্ত বৃষ্টি। কিন্তু, তার আগেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫-১ পোল্ডারের বাগেরহাটের শরণখোলা অংশে ভাঙন শুরু হয়েছে এবং বগী গ্রাম সংলগ্ন বাঁধের ৪০ মিটার নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
বাগেরহাট দক্ষিণ পশ্চিম বাংলাদেশের একটি জেলা।এটি খুলনা বিভাগ এর অন্তর্গত। উপজেলার সংখ্যা বিবেচনায় বাগেরহাট বাংলাদেশের একটি “এ” শ্রেণীভুক্ত জেলা। বাগেরহাটের নাম কে করে দিয়েছিলেন তা গবেষণা সাপেক্ষ হলেও আজ তা নিরূপন করা দুঃসাধ্য। কারো কারো মতে বাগেরহাটের নিকটবর্তী সুন্দরবন থাকায় এলাকাটিতে বাঘের উপদ্রব ছিলো, এ জন্যে এ এলাকার নাম হয়ত ‘‘বাঘেরহাট’’ হয়েছিল এবং ক্রমান্বয়ে তা বাগেরহাট-এ রূপান্তরিত হয়েছে। মতান্তরে হযরত খান জাহান আলী এর প্রতিষ্ঠিত ‘‘খলিফাত-ই-আবাদ’’ এর বিখ্যাত ‘‘বাগ’’ অর্থ বাগান, এ অঞ্চলে এতই সমৃদ্ধি লাভ করে যে, তা থেকেই হয়ে দুাঁড়িয়েছে বাগের আবাদ তথা ‘‘ বাগেরহাট’’। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি হচ্ছে শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ভৈরব নদীর উত্তর দিকের হাড়িখালী থেকে বর্তমান নাগের বাজার পর্যমত্ম যে লম্বা বাঁক অবস্থিত, পূর্বে সে বাঁকের পুরাতন বাজার এলাকায় একটি হাট বসত। আর এ হাটের নামে এ স্থানটির নাম হলো বাঁকেরহাট। কালক্রমে বাঁকেরহাট পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে বাগেরহাট নামে।
দড়াটানা,পানগুছি,মধুমতি,পশুর,হরিণঘাটা,মোংলা,বলেশ্বর,ভাংগ্রা,গোসাইরখালী ইত্যাদিনদীসমূহ বাগেরহাটকে করেছে নদী-বিধৌত। বাগেরহাট জেলার মানুষ প্রধানত কৃষি নির্ভর। এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে নারিকেল ও সুপারি জন্মে। ধান, মাছ ও বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনীতির প্রধান উৎস। তাছাড়াও সুন্দরবন উপকূলের কিছু মানুষ মধু ও গোলপাতা সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের ১৮ টি নদী মরে গেছে। এ জেলার ৯ টি উপজেলার বুক চিরে বহমান এসব নদীতে এখন আর লঞ্চ-স্টিমার ও কার্গো ভ্যাসেল চলাচল করতে পারছে না। নদীগুলোর অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, ভাটার সময় নদীতে হাটু পানিও থাকেনা।শুকিয়ে যাওয়া এসব নদী দেখে এ জনপদের মানুষ এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। বাগেরহাট জেলায় পলি জমে মরে যাওয়া ১৮টি নদী হচ্ছে, পুটিমারী, বিসনা, দাউদখালী, মংলা, ভোলা, ঘষিয়াখালী, কালিগঞ্জ-খোন্তাকাটা, রায়েন্দা, বলেশ্বর, ভৈরব, তালেশ্বর-ভাষা, বেমরতা-দোয়ানিয়া, কুচিবগা, ছবেকী, রাওতি, বেতিবুনিয়া, কলমী ও দোয়ানিয়া। এছাড়াও পলি জমে মরে গেছে এ জেলার দু’শতাধিক ছোট-বড় খাল। এসব নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে একদিকে মংলা বন্দরের সঙ্গে সারা দেশের সহজে কারগো ভ্যাসেলসহ নৌ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকা-খুলনা স্টিমার ও ঢাকা-বাগেরহাট লঞ্চ সার্ভিস। অন্যদিকে নদী ও খাল শুকিয়ে যাওয়ার ফলে শুস্ক মৌসুমে চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছে না কৃষকরা। আর বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতায় প্রতি বছরই কৃষকের ফসল পানিতে ডুবে নষ্ট হচ্ছে। এ জেলায় অনেক নদ-নদী মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। আবার বর্ষার শুরুতেই দেখা যায় ভাঙনে জর্জরিত অবস্থায়। এমনি একটি নদী বগী নদী।
বাগেরহাটের শরনখোলা উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলের এক সমকার প্রসিদ্ধ বগী বন্দরটির ভাঙনের কবলে পড়ে এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। বিগত ১০ বছরে বগী-শরণখোলা নদীতে বিলিন হয়েছে এলাকার ৫ শতাধিক বসতবাড়ি, মসজিদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্থ জেলার সর্ব দক্ষিনের উপজেলা শরনখোলা। পর পর দুটি প্রলংনকারী ঘুনিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ এ জনপদের মানুষ। এর পরও তাদের ঘুরে দাড়াবার চেষ্টায় চরম দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে র্তীব ভাঙন। অব্যহত ভাঙনের কারণে বর্তমানে উপজেলার বগী, খুড়িয়াখালী ও তেরাবাকা এলাকার প্রায় ৭/৮ হাজার মানুষের দিন কাটছে নদী ভাঙন আতঙ্কে। যে কোনো মুহূর্তে এসব এলাকার জনপদের বড় একটি অংশ ভাঙনে বিলিন হবার সঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাগেরহাট জেলায় রয়েছে বহুসংখ্যক নদ-নদী। তার মধ্যে বগী নদীটি অন্যতম। বগী নদীটি ভাঙনে আতঙ্কে গ্রামবাসী। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর পাড়ের বাসিন্দাদের কাছে এক আতঙ্কের নাম ভাঙন। অনেকের জীবন দুর্বিষহ হয়েছে এই ভাঙনে।কেউ হারিয়েছেন পরিবার, কেউ জীবিকা।নদীর ভাঙনের কারণগুলোর দিকে তাকালে কিন্তু মনে হয়, অনেককিছুই আমাদের হাতে রয়েছে।অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের কারণেই নদী ভাঙন ঘটছে। নদী ভাঙনের কয়েকটি মানবসৃষ্ট কারণের মধ্যে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নদীর গতি রোখার চেষ্টার কারণে নদীভাঙন ঘটতে পারে।অনেক সময় নদীর মাঝখান দিয়ে আড়াআড়িভাবে বাঁধ দেয়ার চেষ্টা করা হয়, যা ভাঙন সৃষ্টি করতে পারে। অবশ্য এই কাজ যদি একান্ত করতেই হয় তাহলে আগে নদীর পাড় যথেষ্ট মজবুত করে নিতে হবে।অপরিকল্পিতভাবে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের চেষ্টাও নদী ভাঙনের এক বড় কারণ।
প্রথাগতভাবে নদীকে পূর্ণতার ধাপ অনুসারে ‘যৌবন’, ‘পরিণত’ এবং ‘বার্ধক্য’ এ তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা হয়ে থাকে। যৌবন অবস্থায় নদীকে খাড়াপার্শ্ববিশিষ্ট উপত্যকা, খাড়া ঢাল এবং অসম তলদেশ দ্বারা শনাক্ত করা যায়।নদীর মধ্যগতিতে বা পরিণত অবস্থায় প্রশস্ত নদী উপত্যকা, প্রশস্ত নদীপাড়, উপনদীসমূহ দ্বারা অগ্রসরমাণ সম্মুখ ক্ষয়কার্য এবং সুষম নদীতলদেশ প্রভৃতি ভূমিরূপ পরিলক্ষিত হয়। বার্ধক্য অবস্থায় নদী ভিত্তি সমতলে উপনীত হয় এবং প্রশস্ত সমতল অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদীই বার্ধক্য পর্যায়ে পৌঁছে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।উৎস থেকে ভিত্তিতলে প্রবাহিত গতিপথে নদী সকল প্রকার বাধা ও অসমতা এড়িয়ে সুষম ও মসৃণ নতিমাত্রা অনুসরণ করে থাকে। সমতল ভিত্তিতে পৌঁছার পর নদীর তলদেশের ক্ষয় অপেক্ষা পার্শ্বক্ষয়ের পরিমাণ বাড়ে। ফলে নদীর তলদেশ এবং উপত্যকা প্রশস্ত হতে থাকে। এসময় গতিবেগ হ্রাস পাওয়ায় নদী আঁকাবাঁকা সর্পিল পথে প্রবাহিত হয় এবং নদীতে অসংখ্য বাঁকের সৃষ্টি হয়। বক্র গতিপথে নদীর সর্পিল বাঁকের মুখদুটি ক্ষয়ক্রিয়ার ফলে কাছাকাছি চলে এলে একপর্যায়ে নদী-ছেদনের ফলে বাঁকাপথ পরিত্যাগ করে নদী অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ সৃষ্টি করে নতুন সোজা পথে প্রবাহিত হয়।
নদী হলো খাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জলধারা। ১৭৮৩ সালে জেমস রেনেল অংকিত বাংলাদেশের মানচিত্র যে নদী-নালাগুলোর বিবরণ রয়েছে বর্তমানে সেগুলি চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য। নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে এবং পরিত্যক্ত গতিপথ ভরাট হয়ে পুরানো নদীপথের চিহৃ মুছে গেছে। আবার একই নদীর গতিপ্রবাহ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশর ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে শত শত নদী। নদী দখল,বাঁধ, নগরায়ন,ভরাটের কারণে দেশের নদ-নদী বিলুপ্ত। আবার ভাঙনের প্রভাবে প্রভাবিত অনেক নদ-নদী দিকহারা করেছে অনেক পরিবারকে। এমনি একটি নদী বগী নদী। নদীর গতিবেগ নদী কর্তৃক পরিবাহিত পলল ও শিলাখন্ডের আকৃতি নির্ণয় করে থাকে। ঢালের পরিবর্তন অথবা কোনো জলরাশি কিংবা সাগর বা হ্রদের সঙ্গে মিলনের ফলে নদীর গতিবেগ বাধাপ্রাপ্ত হলে অথবা নদীর জলরাশি দুকূল ছাপিয়ে প্রবাহিত হলে নদী কর্তৃক পরিবাহিত ভার বা বস্তকণার অংশবিশেষ নদী তলদেশে অথবা নদীখাতের দুই পাড়ে সঞ্চিত হয়। এভাবেই নদীর সঞ্চয়কাযের ফলে বদ্বীপ, প্লাবনভূমি, চর এবং পলিজ পাখা ও পলিজ কোণ প্রভৃতি ভূমিরূপ গড়ে ওঠে। খরস্রোতা বগী নদী এখন ভাঙনের শিকার। দেশের অন্যান্য জেলার মতো বাগেরহাট জেলার বগী নদীর ভাঙনরোধ ও নাব্য হারিয়েছে যেসব নদী দখল-দূষণ রয়েছে সেসকল নদ-নদীকে বাঁচাতে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সকলের এগিয়ে আসতে হবে।ছবি-প্রতিকী
লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ(কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান),সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক, গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট