দখল ও ভাঙনের কবলে খরস্রোতা বামনী নদী

মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
বামনী নদী নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বুক চিরে বয়ে যাওয়া একটি নদী। বামনী নদীর অব্যাহত ভাঙনে অস্তিত্ব সঙ্কটে চর এলাহী ইউনিয়ন। নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকাসহ রাস্তাঘাট। ঘরবাড়ি আর ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর এলাহী ইউনিয়নে অব্যাহত রয়েছে বামনীয়া নদীর ভাঙন। রাক্ষুসে বামনীর অব্যাহত তান্ডবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি, স্কুল, মসজিদ, মক্তব ও বসতঘর। বামনীয়া নদীর ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পেতে জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন ভাঙনের শিকার স্থানীয় অধিবাসীরা।
বামনী নদীর ভাঙনের কবলে পড়েছে কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুর, চর পার্বতী, চর হাজারী, চর ফকিরা ও চর এলাহী ইউনিয়নের শত শত একর ফসলী জমি। পাশাপাশি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা। এ ছাড়া নদী ভাঙনের মুখে পড়েছে চর এলাহী ইউনিয়নের বসুরহাট থেকে মৌলবিবাজার পর্যন্ত সড়কের প্রায় ১ হাজার ৫শ’ মিটার এলাকা। সব হারিয়ে নদী পাড়ের অসহায় মানুষেরা এখন দিন কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নিচে।

শুকনো মৌসুমে তীব্র হচ্ছে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বামনী নদীর ভাঙন। ভাঙনের শিকার হয়েছে উপজেলার চরএলাহী ইউনিয়নের গাঙচিল ও চরপল্লবী শতাধিক বাড়িঘরসহ মাছের খামার, হাজার একর কৃষি জমি ও গাছপালা। বাস্তুচ্যুত হওয়ার হুমকিতে রয়েছে দক্ষিণ গাঙচিল সরকারি আশ্রায়ন প্রকল্পের ৩১০ পরিবারসহ দুই গ্রামের পাঁচশতাধিক পরিবার।
নদী যে অঞ্চলে উৎপত্তি লাভ করে তাকে নদীর উৎস এবং যে স্থানে সমুদ্রে বা হ্রদে মিলিত হয় সেই স্থানকে মোহনা বলে। নদীর চলার পথে কখনও কখনও ছোট ছোট অন্যান্য নদী বা জলধারা এসে মিলিত হয়ে প্রবাহ দান করে- এগুলো উপনদী নামে পরিচিত। একটি নদী এবং এর উপনদীসমূহ একত্রে একটি নদীপ্রণালী বা নদীব্যবস্থা গঠন করে। ভূ-পৃষ্ঠ কখনও পুরোপুরি সমতল নয়। ফলে বর্ষণসৃষ্ট জলধারা ঢালুতম পথে ভূ-পৃষ্ঠের একাধিক ঢাল পরিচ্ছেদনের ফলে সৃষ্ট অবতল-নিচু অংশে প্রবাহিত হওয়ার প্রবণতা প্রদর্শন করে। নদীভাঙন বাংলাদেশের একটি স্থানীয় ও পুনঃসঙ্ঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
এক হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট প্লাবনভূমির প্রায় ৫% প্রত্যক্ষভাবে নদীভাঙনের শিকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের ৪৮৯টি থানার মধ্যে প্রায় ৯৪টি থানায় নদীভাঙন ঘটছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এর সঙ্গে আরও ৫৬টি থানার সন্ধান পেয়েছেন যেখানে নদীভাঙনের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে প্রায় ১০০টি থানায় নদীভাঙন ও বন্যার দুর্ভোগ প্রায় নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৩৫টি থানা সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে ১৯৯৩ সালের জুন মাসে ১৬টি
জেলায় ২৫০০০-এর বেশি পরিবার নদীভাঙনের কবলে পড়ে বাস্তভিটাচ্যুত হয়েছে।

অন্যান্য নদীর মতো নোয়াখালীর বামনী নদীটি ভাঙনের শিকার। ভাঙনের তীব্রতায় নদী থেকে নদীতে দারুণ ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। কারণ এ ভাঙন নির্ভর করে কি পদার্থ দিয়ে নদীতীর গঠিত, পানির পৃষ্ঠদেশের ভিন্নতা, তীরবর্তী প্রবাহের তীব্রতা, নদীর পরিলেখ রূপ এবং নদীতে পানি ও অবক্ষেপের সরবরাহ ইত্যাদির ওপর। উদাহরণস্বরূপ, পলি ও মিহি বালুতে গঠিত আলগা বাঁধাই, সাম্প্রতিক মজুতকৃত তীরের পদার্থসমূহ ভাঙনের পক্ষে খুবই সংবেদনশীল। বন্যার পানির দ্রুত অপসারণ এ ধরনের পদার্থে তীর ভাঙনের হার ত্বরান্বিত করে। বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নদ-নদী দখলের অভিযোগ থাকলে তাকে সব ধরনের নির্বাচনে অযোগ্য করার ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। একই সাথে এমন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ না দেয়ার ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

আর্থ-সামাজিক প্রভাব নদীভাঙনের আর্থ-সামাজিক প্রভাব মারাত্মক। উল্লেখ্য, অধিকাংশ নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন একে প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে ধরে নেয়। আবার অনেকে গজব বলে এ দুর্যোগকে মেনে নিয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরিবর্তে দোয়া-মানৎ ইত্যাদির শরণাপন্ন হয়। আজ জাতীয় দারিদ্র্যের একটা বড় কারণ এ নদীভাঙন।
নদীভাঙনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত লোকের জমি, বসতভিটা, ফসল, গবাদি সম্পদ, গাছপালা, গৃহসামগ্রী সবকিছুই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। নিঃস্ব, রিক্ত, সর্বস্বান্ত মানুষ ভূমিহীনের কাতারে সামিল হয়ে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে দেশ-দেশারে ঘুরে বেড়ায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১০ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষভাবে নদীভাঙনের শিকার হয়। এর ফলে বার্ষিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক পঞ্চাশ কোটি ডলার। প্রায় ৩ লক্ষ গৃহহীন পরিবার উন্মুক্ত আকাশের নিচে, পথের পাশে, বাঁধ, ফুটপাথ ও সরকারের খাস জমিতে এসে আশ্রয় নেয়। গরীব, ধনী নির্বিশেষে সবাই এ নদীভাঙনের শিকার হয়। বড় ও মাঝারি জোতদার কৃষকরা বেশি জমির মালিক বিধায় তারা ভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষুদ্র ও ভূমিহীন চাষির ক্ষতির ভাগ কম। নদী তীরবর্তী অঞ্চলে ভাঙনের ফলে গ্রামীণ কৃষিকাজ দারুণভাবে ব্যাহত হয়। বসতভিটার সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজমি, অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। বিপন্ন জনগোষ্ঠীর কৃষি আয় কমে যায়। বড় বড় কৃষকরা এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর মাঝারি কৃষক ও প্রান্তিক চাষির দল। ক্ষতিগ্রস্ত লোকেরা সম্পদ হারিয়ে জমানো সঞ্চয়ের ওপর হাত বাড়ায় এবং প্রায়শই নতুন ঋণে জড়িয়ে পড়ে।

গবেষকদের মতে, ভাঙনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া ভূমির পরিমাণ নদীর তলদেশ থেকে জেগে ওঠা নতুন ভূমির পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি। এ নদী পয়স্তি ও নদী সিকস্তির ঘটনা বাংলাদেশের নদীর গতিপথ ব্যবস্থার একটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বৈচিত্র্য যা স্থানীয় রাজনীতির জন্ম দেয়।
নোয়াখালী জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। উপজেলার সংখ্যানুসারে নোয়াখালী বাংলাদেশের একটি “এ” শ্রেণীভুক্ত জেলা। নোয়াখালী জেলার মোট আয়তন ৪২০২.৭০ বর্গ কিলোমিটার। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে ২২ক্ক০৭’ থেকে ২৩ক্ক০৮’ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০ক্ক৫৩’ থেকে ৯১ক্ক২৭’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ জুড়ে নোয়াখালী জেলার অবস্থান। নোয়াখালী জেলায় রয়েছে বহুসংখ্যক নদ নদী তার মধ্যে বামনী নদীটি অন্যতম। দখল ও ভাঙনের কারণে বিলীনের পথে খরস্রোতা এই নদীটি।

নোয়াখালী জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর। আঞ্চলিক জিডিপির প্রায় ৪০% কৃষি খাত থেকে আসে এবং জেলার ৮০ ভাগ লোক এই পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট। কৃষির মধ্যে মূলত মৎস্য চাষ ও মৎস্য আহরণের সাথে সবচেয়ে বেশি মানুষ জড়িত। বছরজুড়ে নৌকা তৈরি ও মেরামত, মাছ ধরা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন, শুটকি উৎপাদন, জাল মেরামত এর সাথে প্রায় ৬০-৭০ ভাগ শ্রমজীবী জড়িত থাকে। নিম্নভূমি অঞ্চল হওয়াতে এই জেলায় প্রচুর মৎস্য চাষ হয়ে থাকে, যা এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা পালন করে। ফসল উৎপাদন মূলত বছরে একবারই হয়। শীত মৌসুমে জেলার সর্বত্র বিশেষ করে দক্ষিণের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে রকমারি ফসলের চাষ হয়। এছাড়াও বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে ও দ্বীপগুলোতে গরু, মহিষ, ছাগল এবং ভেড়া পালন ব্যাপকতা লাভ করেছে।

নদ-নদী দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। অর্থনীতির বড় একটি যোগান নদী থেকে আসে। অন্যান্য জেলার মতো নদ-নদী ব্যতীতোও নোয়াখালী জেলায় শিল্প কারখানা তেমনভাবে গড়ে উঠেনি, কিন্তু নোয়াখালী জেলার অনেক ব্যক্তি দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসাবে সুনাম অর্জন করেছেন। তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বড় বড় শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছেন। নোয়াখালীর মানুষ মূলত কাজের জন্য দেশে এবং বিদেশে ব্যাপকভাবে গমন করেন। জেলার বিপুল সংখ্যক মানুষ মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন। বাংলাদেশের শীর্ষ রেমিট্যান্স পাঠানো জেলাগুলোর মধ্যে নোয়াখালী জেলা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে।

নদীভাঙনের সবচেয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে স্থানচ্যুতি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ তাৎক্ষণিক স্থানবদল কাছাকাছি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকলেও দূর-দূরান্তে দেশান্তরি হওয়ার ঘটনাও খুব ব্যতিক্রমী নয়। ভাঙনপ্রবণ অঞ্চলে অধিকাংশ পরিবারই জীবদ্দশায় অন্তত একবার স্থানচ্যুতির শিকার হয়েছে। কারও কারও ক্ষেত্রে এ অনাকাক্ষিত বাস্তচ্যুতির ঘটনা দশ বা ততোধিকবার ঘটেছে।
দেশে প্রায় ৪০৫টি নদ-নদীর মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশে ছোট বড় সব মিলিয়ে ২৩০ থেকে ২৪০টির মতো নদ- নদী সরকারি হিসেব আছে। এসব নদীগুলোর মধ্যে ৫৭ টি হচ্ছে আন্তসীমান্ত নদী যার মধ্যে ৫৪টি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন এবং ৩টি বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে অভিন্ন। দেশের মধ্যে প্রবহমান একটি নদীর বামনী নদী। দখল ও ভাঙনের শিকার হয়ে আছে নদীটি। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই নদী রক্ষা করতে হবে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে নদীপথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধিত হবে এবং ব্যবসা বাণিজ্যে গতি আসবে। তাই দেশের মধ্যে থাকা অন্যান্য নদ-নদীর মতো বামনী নদীকে বাঁচানোই এখন সময়ের দাবি।

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ(কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান),সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক, গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম