মো. আলতাফ হোসেন ঃঃ
ইসলামে নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম। সালাতের আভিধানিক অর্থ হলো দোয়া, রহমত ইস্তিগফার ইত্যাদি। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, কুফরি এবং মুমিনের মধ্যে পার্থক্য হলো নামাজ। নামাজ আদায়ের বহু উপকারিতা ও ফজিলত রয়েছে। যেমন: ১. আত্মিক ২. শারীরিক ৩. সামাজিক ৪. পারলৌকিক। উপরে বর্ণিত সব ফজিলত ও উপকার নফল ও ফরজ উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সতেরো রাকাত ফরজ নামাজ, তিন রাকাত ওয়াজিব বিতির নামাজ চার ওয়াক্তে বার রাকাত সুণ্নতে মুআক্কাদা নামাজ, দুই ওয়াক্তে আট রাকাত সুন্নতে জায়েদা নামাজ ছাড়া অন্যান্য নামাজ হলো নফল। নফল নামাজের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত হলো নির্ধারিত নফল নামাজ। যথা: তাহাজ্জুদ নামাজ, ইশরাফ নাজাজ, চাশত নামাজ, জাওয়াল নামাজ, আওয়াবিন নামাজ। এছাড়া রয়েছে আরো কিছু অনির্ধারিত নফল নামাজ। যেমন: সলোতুল তাসবিহ, তাহির্যাতুল ওজুর নামাজ দুখুলিল মাসজিদের নামাজ সালাতুস সফর এবং দুখলিল মানজিল ও খুরুজুল মানজিলের নামাজ; সালাতুল হাজাত সালাতু কাজায়িদ দাঈন বা ঋণ পরিশোধের নামাজ, সালাতুল ফাকা, সালাতুল শোকর সালাতুত তাওবা, সালাতুল মাতার, সালাতুল নাউম, সালাতুল সাকরাতুল মউত ইত্যাদি।
আমরা মুসলমান। সেই হিসেবে আমাদের ফরজ নামাজ অবশ্যই পড়তে হয়। কিন্তু এমন কিছু নফল নামাজ আছে যা পড়লে উভয় জাহানে ব্যাপক কল্যাণ অর্জন করা যায়। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, রমজান মাসের নফল নামাজ অন্য মাসের ফরজের সমতুল্য।
আল্লাহর নিকট অন্যান্য নফল নামাজের মধ্যে তাহাজ্জুদ নামাজই অধিক পছন্দনীয়। আর কামিলিয়াত লাভের প্রথম সোপানই হলো তাহাজ্জুদ নামাজ। প্রিয় পাঠক আসুন আমরা তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে জেনে নেই: এশার নামাজের পরে গিয়ে গভীর রাতে জেগে নামাজ পড়াকে তাহাজ্জুদ নামাজ বা ‘সালাতুল লাইল’ বলা হয়। আর এ নামাজ সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যায়। নফল নামাজের মধ্যে এই প্রকার নফল অর্থাৎ তাহাজ্জুদের ফজিলত সবচেয়ে অধিক। হাদিস শরীফে সমস্ত নফলের চেয়ে তাহাজ্জুদ নামাজের বেশি ফজিলত ও ছওয়াব বর্ণিত আছে। এমন কি অনেক আলেম তাহাজ্জুদকে সুন্নতে মোয়াক্কাদা বলেছেন।
তাহাজ্জুদ শব্দটি আরবি। এর ব্যবহার পবিত্র কুরআনে আছে। তাহাজ্জুদ শব্দটিট নিদ্রা যাওয়া ও জাগ্রত হওয়া এই পরস্পর বিরোধী দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাহাজ্জুদ শব্দের অর্থ হলো রাত জাগা, ঘুম থেকে ওঠা, আল্লাহ্পাক এরশাদ করেন, “নিশ্চয় রাত্রে ওঠা কঠোর সাধনা এবং সরল খাটি হওয়ার উপযুক্ত সময়।” (সূরা মুজাম্মিল: আয়াত-৬)
এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন: আর রাতের কিছু অংশ আপনি তাহাজ্জুদ পড়তে থাকুন। এটা আপনার জন্য আল্লাহ্র অতিরিক্ত ফজল ও করম। আশা করা যায়্ আপনার প্রতিপালক আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে। (সূরা বনি ইসমাইল-৭৯)
তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত। প্রিয় নবী (সাঃ) এ নামাজ পড়ার জন্য উৎসাহ দিতেন। তাহাজ্জুদ নামাজ ও তাহাজ্জুদ নামাজ পড়নেওয়ালাদের উদ্দেশ্যে থাকবে সেদিন প্রস্রবণ বিশিষ্ট জান্নাতে। উপভোগ করবে তা যা তাদের প্রতিপালক তাদের দেবেন। কারণ পার্থিব জীবনে তারা ছিলো সৎকর্ম পরায়ন। তারা রাতের অতি অল্প অংশ অতিবাহিত করতো নিদ্রায় এবং শেষ রাতে ইস্তিগফার (তাহাজ্জুদ নামাজ) পড়তো (সূরা জারিয়াত: ১৫-১৮)। রাসূল (সাঃ) থেকে তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (সাঃ) বলেন, “ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নামাজ হচ্ছে তাহাজ্জুদ নামাজ’ (মুসলিম)।
হযরত সালমান ফারসি (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন, তোমরা তাহাজ্জুদ নামাজের ব্যবস্থা করো; এটা নেক লোকদের স্বভাব; মুমিনের পরিচয়, এটা তোমাদেরকে আল্লাহ্র নিকটবর্তী করে দেবে। গুণাহগুলো মিটিয়ে দেবে, গুণাহ থেকে বাঁচিয়ে দেবে। শরীর থেকে রোগ দূর করে দেবে এবং মনে প্রশান্তি ও সম্মানজনক রিজিকের ব্যবস্থা করবে (মুসলিম)। এভাবে কুরআন ও হাদিস শরিফে বহু ফজিলতের কথা বর্ণিত আছে। কেননা তাহাজ্জুদ নামাজ হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার সান্নিধ্য লাভের বিশেষ মাধ্যম। কেউ সফলতার উচ্চ শিকরে পৌঁছাতে চাইলে তাহাজ্জুদ নামাজ তাকে পড়তেই হবে। রাসূল (সাঃ) এশার নামাজ শেষে ঘুমিয়ে যেতেন এবং অর্ধরাত বা তার কিছু পরে ওঠে হাজাত পূর্ণ করে মিসওয়াক করে অজু করতেন এবং চার থেকে বারো রাকাত নামাজ পড়তেন। তাই তাহাজ্জুদ নামাজ বারো রাকাত পড়াই উত্তম। তবে দুই রাক’আত আদায় করলেও তাহাজ্জুদের মধ্যে গণ্য হবে।
তাহাজ্জুদ নামাজ হলো কবরের আলো বা জ্যোতি। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়কারীর মৃত্যুর পর তার কবর সত্তর গজ প্রশস্ত হবে এবং আশাতীতভাবে আলোকোজ্জল থাকবে। অন্য হাদিসে আছে, অর্থ রাতের দুই রাক’আত নামাজ যমীন ও যমীনের মতো সম্পদ আছে তা হতে অধিক মূল্যবান। কঠিন মনে না করলে রাতের এই নামাজ উম্মতের প্রতি ফরজ করে দিতাম। তাহাজ্জুদ নামাজ হচ্ছে আল্লাহ্ রাসূল আলামীনের করুণ লাভের মহা উৎস। বোখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে শেষ রাতে যখন তাহাজ্জুদ নামাজের সময় উপস্থিত হয় তখন আল্লাহ গফুরুর রহীম প্রথম আসমানে অবতারণ করেন। এবাদতকারীদের নিজ নিজ অভিলাষ প্রার্থনা করতে বলেন। বাান্দার অন্তঃকরণে যত প্রকার না পাওয়ার ব্যথা আছে ঐ সময়ে আল্লাহ্ তা’আলা তৎসমূদয় পুরা করে দেয়ার সংকল্প বার বার ঘোষণা করেন। আল্লাহ্ পুনঃপুনঃ বলতে থাকেন; “কে আছো অনুতপ্ত গুনাহগার? আমার দরজা হতে অফুরন্ত ক্ষমা চেয়ে নাও। কে আছো কাঙ্গাল? অনন্ত ধনৈশ^র্য গ্রহণ কর। কে আছো গৃহহীন, রোগী, পাপী? স্ব-স্ব মকছুদ বর্ণনা কর তা এ মুহুর্তে দরাজ হস্তে বিতরণ করবো।
অন্য এক হাদিসের মর্মে জানা যায়, নবী করিম (সাঃ) কখনো তাহাজ্জুদ নামাজ পরিত্যাগ করতেন না। যদি কোনো রাতে কোনো কারণবশত: পড়তে অক্ষম হতেন, তবে পরবর্তী রাতে তার কাযা আদায় করে নিতেন। তাহাজ্জুদ নামাজের কাযা নেই, তবে রাতে পড়তে না পারলে পরের দিন দুপুরের পূর্বে অনুরূপ পরিমাণ নফল পড়ে নেয়া উত্তম। তাহাজ্জুদ নামাজ যে কোনো সূরা দিয়ে পাঠ করা যায়। তবে কিরাত লম্বা হওয়া উত্তম। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন, যে আমার কোনো ওলির সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা প্রদান করেছি। আমার বান্দা কোনো পুণ্যের মাধ্যমে আমার নৈকট্য লাভ করতে পারবে না ফরজ ব্যতীত। আর ফরজের পর সে সর্বদা নফল আদায় করলে আমার অধিক নৈকট্য অর্জন করতে পারবে। অবশেষে আমি তাকেই ভালবাসতে থাকি। অতঃপর আমি তার কান হয়ে যাই যার দ্বারা সে শুনতে পায়। আমি তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখতে পায়, আমি তার হাত হয়ে যাই, যা দ্বারা সে পাকড়াও করে, আমি তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলাফেরা করে। আর সে যদি আমার নিকট কিছু প্রার্থনা করে, আমি তাকে অবশ্যই তা প্রদান করি। আর যদি সে আমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে, আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় প্রদান করি। (বুখারি) আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে ফরজের পাশাপাশি তাহাজ্জুদ সহ আরো বেশি নফল ইবাদতের তৌফিক দান করুন।
ইবাদতের মধ্যে শেষ্ঠ হলো নামাজ। সুতরাং নফল ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো নফল নামাজ আর নফল নামাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো তাহাজ্জুদ নামাজ। হাদিসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি নফল নামাজ আদায় করে, সে ব্যক্তি নামাজের মাধ্যমে তার পালন কর্তার অতি ঘনিষ্ঠতা লাভ করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা কোরআনে কারীমে ইরশাদ করেন, “সিজদা কারো আর আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য লাভ করে।” নফল নামাজের ক্ষেত্রে মনে রাখবেন; নামাজটা যেনো একটু দীর্ঘ করা এবং সিজদায় দীর্ঘ কাটানো। এ বিষয়ে হাদিসে বর্ণনা পাওয়া যায়। অন্য এক জায়গায় বর্ণিত আছে, রাত্রে ওঠে যদি কেউ অজু করে ২ রাক’আত নফল নামাজে কম পক্ষে ১০টি আয়াতও পাঠ করে সে গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হবে না।
হযরত আবু ওমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, তোমার রাত্রে জাগিয়া তাহাজ্জুদ নামাজ পড়াকে বাধ্যতামূলক করিয়া লও। কারণ- ইহা তোমাদের পূর্বকর নেক লোকদের নিয়ম বা অভ্যাস এবং তোমাদের জন্য তোমাদের প্রভুর নৈকট্য লাভের উপায় গুনাহ সমূহের কাক্কার এবং অপরাধ হতে প্রতিরোধকারী (তিরমিযী)। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ্ রহমত বর্ষণ করেন সেই ব্যক্তির উপর যে ব্যক্তি রাত্রে ঘুম হতে উঠেছে এবং নামাজ পড়েছে অতঃপর নিজের স্ত্রীকেও জাগিয়ে দিয়েছে এবং সেও নামাজ পড়েছে আর যদি সে উঠতে অস্বীকার করে বা অনিহা প্রকল্প করেছে তখন তার চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়েছে। অনুরূপভাবে আল্লাহ্ তা’আলা রহমত বর্ষণ করেন সেই মহিলার প্রতি যে রাত্রে ঘুম হতে জেগেছে এবং তাহাজ্জুদ নামাজ পড়েছে এবং নিজের স্বামীকেও জাগিয়েছে। ফলে সেও নামাজ পড়েছে। আর যদি সে ওঠতে অস্বীকার করেছে তখন তার চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়েছে। (আবু দাউদ নামাইদ)
তাহাজ্জুদ নামাজ ঘরে পড়া উত্তম। তবে মসজিদে পড়লেও ক্ষতি নেই। রমজান ছাড়া মাঝে মাঝে জামাতে পড়া জায়েজ আছে। তবে নিয়মিত নয়। কিরাত আস্তে অথবা জোরে পড়া জায়েজ আছে। তবে কারো কষ্ট হলে আস্তে পড়া ভালো। তাহাজ্জুদ নামাজ হলো আল্লাহ্র দিদায় লাভের সর্বোত্তম উপায়। যুগে যুগে যত মানুষ আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের প্রধান আমল ছিলো রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া। অতএব, আমাদের সবার উচিত তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব দেয়া। সময় অর্ধ রাতের পরে। রাতের শেষ তৃতীয়াংশে পড়া উত্তম।
তাহাজ্জুদ নামাজের প্রচলন ঠিক কখন থেকে শুরু হয়েছিলো তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা না গেলেও তাহাজ্জুদ নামাজের নির্দেশ সর্ব প্রথম পাওয়া যায় সূরা মূজাম্মিলের প্রথম দিকের আয়াত নাযিল হওয়ার পর। আর সূরা মুজ্জাম্মিল যেহেতু ইসলামের শুরুতে কুরআন অবতরণের প্রাথমিক যুগে অবর্তীণ হয়েছে। তাই বলা যায়, ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেইে তাহাজ্জুদের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু শুরু থেকে তাহাজ্জুদ নামাজ ফরজ ছিলো। হযরত আয়েশা (রাঃ) ও বাগভী (রহঃ) বলেন, সূরা মুজাম্মিলের নির্দেশ অনুযায়ী তাহাজ্জুদ তথা রাতের নামাজ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ও সমগ্র উম্মতের ওপর ফরজ ছিলো। ওই আয়াত দ্বারা তাহাজ্জুদ নামাজ কেবল ফরজ করা হয়নি, বরং তাতে রাতের কমপক্ষে এক চতুর্থাংশ মশগুল থাকাও ফরজ করা হয়েছিলো। কারণ আয়াতের মূল আদেশ হচ্ছে কিছু অংশ বাদে সারারাত নামাজে মশগুল থাকা। ইমাম বাগভী (রহঃ) বলেন, এ আদেশ পালনার্থে রাসূল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম অধিকাংশ রাত তাহাজ্জুদ নামাজে ব্যয় করতেন, ফলে তাদের দু’পা ফুলে যেতো এবং আদেশটি বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। এভাবে পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর সূরা মুজাম্মিলের শেষ আয়াত নাযিল হওয়ায়, দীর্ঘক্ষণ নামাজে দন্ডায়মান হওয়ার বাধ্যবাধকতা রোহিত করে দেয়া হয় এবং হয় যে, যতক্ষণ নামাজ পড়া সহজ মনে হয়, ততক্ষণ নামাজ পড়াই তাহাজ্জুুদের জন্য যথেষ্ট। এ বিষয়বস্তু আবু দাউদ ও নাসাঈতে হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তাহাজ্জুদ নামাজের এ বিধান বলবৎ ছিলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, মেরাজের রাতে ৫ ওয়াক্ত। নামাজ ফরজ হওয়ার আদেশ অবতীর্ণ হলে তাহাজ্জুদ নামাজের ফরজ, হুকুম রোহিত হয়ে যায়। তবে তার পরও তাহাজ্জুদ সুন্নত রয়ে যায়। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরাম সর্বদা নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তেন। (মাজহারি) এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলঅ এরশাদ করেন।
হাদিসে কুদসিতে রয়েছে, যে বান্দা আমাকে ভালবাসার বাদী করে অথচ সারা রাত ঘুমিয়ে কাটায় সে তার দাবিতে মিথ্যাবাদী। এজন্য যে, সে কেমন প্রেমিক যে, তার মাহবুবের মহব্বত কামনা করেন। অথচ আমি তার অপেক্ষায় থাকি। সে যদি তার দাবিতে সত্যবাদী হতো তাহলে অবশ্যই আমার ডাকে সাড়া দিতো। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, হযরত আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) যখন মদিনায় তাশরিফ আনেন, তখন প্রথম যে কথাগুলেঅ তার মুখ থেকে শুণি তা হলো- হে লোকজন! ইসলামের প্রচার প্রসার করে। মানুষকে আহার দান করো। আত্মীয়তা অটুট রাখো, আর যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকবে তখন তোমরা রাতে নামাজ পড়তে থাকবে। তাহলে তোমরা নিরাপদে বেহেস্তে যাবে। (হাকেম, ইবনে সাবাহ, তিরমিযী) পবিত্র কুরআনে আরো এসেছে, রহমানের বিশিষ্ট বান্দাগণ হচ্ছেন- তারা, যারা সিজদা ও দন্ডায়মান (তাহাজ্জুদ) অবস্থায় রাত্রি যাপন করে। সূরা ফোরকান-৬৫ সূরা মুজাম্মেলে এরশাদ হয়েছে, “ হে চাঁদর আবৃত রাসূল। রাত্রিকালে দন্ডায়মান হোন। (তাহাজ্জুদ পড়ুন) সূরা মুজাম্মিল-১/২ আরো এসেছে, নিঃসন্দেহে আপনার প্রভু অবগত আছেন। আপনি এবং আপনার একদল মুমিন সাথী তাহাজ্জুদের জন্য (কখনো) রাত্রির প্রায় দুই তৃতীয়াংশ (কখনো অর্ধ রাত্রি আবার (কখনো) রাত্রির এক তৃতীয়াশ দন্ডায়মান থাকেন। (সালাতে তাহাজ্জুদ আদায় করেন) সূরা মুজাম্মিল-২০
একটি হাদিসে রাসূল (সাঃ) বলেন, তোমরা তাহাজ্জুদ নামাজ অনিবার্য করো। কারণ এটি তোমাদের পূর্ববর্তী আল্লাহ্ওয়ালাগণের বৈশিষ্ট্য, তোমাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের মাধ্যমে। তোমাদের গুনাহসমূহের কাফ্ফারা ও তোমাদেরকে গুণা থেকে নিবৃতকারী (তিরমিযী)। তাহাজ্জুদ দিন প্রচারকারীদের বিস্ময়কর রুহানী শক্তি: মহানবী (সাঃ) সাহাবায়ে কেরাম এবং যুগ যুগান্তরের আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা, গাউসী কুতুব, ওলী, আবদাল ও দ্বীনের মকবুল প্রচারগণের জীবনচরিত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা নিয়মিত তাহাজ্জুদ ও জিকির আজকারের মাধ্যমে দ্বীনের সুকঠিন দায়িত্ব পালনে অলৌকিক শক্তি ও ক্ষমতা অর্জন করতেন।
আল-কুরআনে মহানবী (সাঃ)কে তাহাজ্জুদের নির্দেশ দেয়ার পর বলা হয়েছে, আমি (আল্লাহ্) তোমার প্রতি অনেক কঠিন দায়িত্ব অর্পন করবো (সূরা মুজাম্মিল)। তাহাজ্জুদ আল্লাহ্ প্রেমিকদের প্রিয় আমল: যুগ যুগান্তরে আল্লাহ্ প্রেমিকদের বিশেষ আমল হচ্ছে সালাতে তাহাজ্জুদ।আল্লাহ্র সামনে দাঁড়াতে হলে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন শর্ত। মোট কথা হলে নফল ইবাদত। নফল ইবাদত হলো আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের উৎসপন্থা। আল্লাহ্কে পাওয়ার জন্য অনেকগুলো সাধন রয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মোরাকাবা। সুতরাং তাহাজ্জুদ নামাজ শেষে মোরাকাবা এর মাধ্যমে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝের ও রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব।
তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আরো অনেক সুস্পষ্ট আয়াতে কারিমা ও হাদিস শরীফে রয়েছে যা সীমিত পরিসরে আলোচনা করে শেষ করা যাবে না। উক্ত আয়াত ও হাদিস শরীফসমূহ থেকে এটি পরিষ্কার হয় যে, তাহাজ্জুদ নামাজ আল্লাহ্র সাথে বান্দার কথোকথনের এক মহান অবলম্বন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে সেতুবন্ধন রচনা করে। তাহাজ্জুদের বদৌলতে মানুষ মহান মর্যাদার অধিকারী হয়। রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ হলো আম্বিয়া আলাইহিস সালামদের সুন্নাত, আল্লাহ্ তা’আলার মাহাবুব বান্দাদের অভ্যাস আর আল্লাহ্র সঙ্গে বান্দার গভীর সম্পর্ক স্থাপন তথা নৈকট্য ও সন্তোষ অর্জনের অন্যতম পন্থা। তাহাজ্জুদ নামাজ নফলের রিয়াজাত ও তারবিয়াতের এক বিশষ মাধ্যম। কারণ প্রভুর প্রেমে গভীর রাতে সুখ শয্যা ত্যাগ করেই আল্লাহ্র ইবাদতে মশগুল হতে হয়। এ নামাজ মন ও চরিত্রকে নির্মল ও পবিত্র করা এবং সত্য পথে অবিচল রাখার জন্য অপরিহার্য ও অতীব কার্যকর পন্থা।
লেখক: সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক,গবেষক,সাংবাদিক,কলামিস্ট