মো. আলতাফ হোসেন ঃঃ
মানুষ কবে থেকে ধুমপান শুরু করে তার সুনির্দিষ্ট তারিখ কারো জানা নেই। তবে এটুকু ধারণা করা হয় যে প্রথম বিশ^যুদ্ধ চলাকালে ১৯১৪-১৯১৮ সালে মানুষ ধুমপানের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ১৯৭০ এর মাঝামাঝি ধুমপানের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তুঙ্গে ওঠে। মহিলারা ধুমপান শুরু করে ১৯৩৯-১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ চলাকালে। ক্রমে ধুমপান নেশায় জানতো না ধুমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে। এই ধুমপান বা তামাকের ব্যবহারের কারণে মৃত্যুমুখী হচ্ছে পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ এটা মানুষের জানা ছিল না।
তামাক গাছ বামন জাতের স্বল্পজীবি উদ্ভিদ। পরিপূর্ণ তামাক গাছের পাতাকে বিশেষবাবে শুকিয়ে সেই পাতাকে উদ্দীপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তামাক পাতা দিয়ে সিগারেট, বিড়ি, চুরুট, জর্দা, গুল, নস্যি ও অন্যান্য উদ্দীপক দ্রব্য তৈরি করা হয়। তামাক মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তামাক ব্যবহারে স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। এটি ক্যান্সার ও হৃদরোগসহ নানা ধরনের কঠিন রোগ সৃষ্টি করে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। তামাকের এতো ক্ষতি থাকা স্বত্ত্বেও বিশে^ তামাক সেবির সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে তামাকজনিত কারণে মৃত্যু।
গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারে বছরের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা ব্যয় হয় ধুমপানজনিত রোগের চিকিৎসায়। আর ধুমপানজনিত অসুস্থতার কারণে জাতীয় উৎপাদনশীলতার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
এনবিআরের দেয়া হিসেব অনুযায়ী, সিগারেট উৎপাদনের পর স্থানভেদে টর্ণেও ভারের সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত সম্পূরক শুল্ক ও ১৫ শতাংশ হারে মূসকসহ প্রায় ৭৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয় তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে গত ২০১৬ সালের অর্থ বছরে রাজস্ব বাবদ ১১ হাজার ৮৪ কোটি টাকা দিয়েছে বিএটিবিসিএল। যা এনবিআরের ভ্যাট বাবদ মোট রাজস্বের ১৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এমনকি গেল অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেও ৭ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে কোম্পানিটি। ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ঢাকা টোব্যাকো। গেল বছর অর্থ বছরের ঢাকা টোব্যাকো ৩ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা ভ্যাট প্রদন করেছে, যা গেল বছরে এ খাতের মোট রাজস্বের ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। গেল বছরের প্রথম সাত মাস ১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা ভ্যাট পরিশোধ করে তৃতীয় স্থানে রয়েছে কোম্পানিটি। এছাড়া অন্যান্য ছোট ছোট কোম্পানির ভ্যাট কিংবা সকল কোম্পানির আয়কর বিবেচনা করলে সরকারের ঘরে রাজস্বের পাল্লা আরো একটু ভারি হবে বটে। পরিসংখ্যানে যা দেখলেন, তা সাময়িক লাভের। কারণ তামাকজাতও পণ্যে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি আরো ব্যাপক এবং ভয়াবহ।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুসারে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি তামাক ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশে ৪ কোটি ৬০ লাখ মানুষ সিগারেট, বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করেন, যা দেশের ৪৩ শতাংশ। বছরে প্রায় ১ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগের মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে ধুমপানজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এছাড়া ক্যান্সারজনিত মৃত্যু ৩৮ শতাংশ, যক্ষায় ৩৫ শতাংশ ও শ^াসরুদ্ধজনিত রোগে ২৪ শতাংশ মারা যায় যা অত্যন্ত উদ্বেগের। উদ্বেগ আরো বৃদ্ধি করে যখন বিশ^ব্যাপী তামাক ব্যবহারের ভয়াবহতার চিত্র পাওয়া যায়।
বিশ^ স্বাস্থ্যে সংস্থা বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭ কোটি ৫০ লাখ মানুষ তামাক গ্রহণের কারনে মারা যেতে পারে। সংস্থার মতে, ৭০ ভাগ তামাকের উৎপাদনও বিক্রি হয় উণ্নয়নশীল দেশগুলোতে। এই উণ্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সরে কিশোর-কিশোরী তামাক পণ্যে বেশি তামাক হচ্ছে যা ভবিষ্যত কর্মক্ষম জনশক্তির জন্য আশানি সংকেত।
এর প্রধান কারণ হিসেবে বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা যায় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য যেমন: দুধ, ডিম ও চালের তুলনায় তামাকপণ্যে দাম আমাদের মতো দেশে অনেক কম। এর সঙ্গে রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন ও নির্মাণ বিনোদনের অভাব এবং সামাজিক অবক্ষয়। এসব পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণ শেষে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, তামাক জাতীয় পণ্যের বিস্তার রাজস্বের বিবেচনায় সরকারের জন্য যতটা না অর্জন। তার চেয়ে নেতিবাচক প্রভাবের দিক থেকে বিসর্জনের পাল্লা ঢের বেশি। বিশেষ করে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও কর্মক্ষম ভবিষ্যৎ প্রজননের বিবেচনায় তামাকের প্রভাব ভয়াবহ। তাই এখনই তামাকের লাগাম টেনে ধরা দরকার। নইলে যা হারাবে তা অর্থ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।
বিদ্যমান তামাক কর কাঠামো অত্যন্ত জটিল হওয়ার এ খাতে কর ফাঁকির সুযোগ থেকে যাচ্ছে। আবার একই সঙ্গে তামাক পণ্যের ধরণ ও ব্র্যান্ডভেদে ব্যাপক মূল্য পর্যন্ত থাকায় ভোক্তা তুলনামূলক সস্তায় তামাক পণ্য ক্রয় করতে পারছে, যা তামাক করের কাট কারিত্য হ্রাস করছে। এমতাবস্থায় জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও টেকসই। উণ্নয়নের জন্য কার্যকর তামাক করের দাবি জানিয়েছে অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা)। গত ৬ মে ২০১৮ রোববার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় সংগঠনটি এ দাবি জানায়। এনবিআর চেয়ারম্যান মোঃ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আলোচনা সভায় আত্মার প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহানাজ মুন্নী, মর্তুজা হায়দার লিটন, নাদিরা কিরণ, মিজান চৌধুরীসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এ
সময় এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, যেহেতু তামাক পণ্য স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, সেহেতু এটি খেতে হলে কর দিয়েই যেতে হবে। এ বছর সিগারেট বিড়িসহ সব তামাক পণ্যে যৌক্তিক হারে কর বাড়াতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে কম দামি সিগারেটের দাম না বাড়ানোর চাপও এনবিআরের ওপর আছে বলে, তিনি উল্লেখ করেন। অনুষ্ঠানে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে তামাক পণ্যে করারোপের জন্য বাজেট প্রস্তাবে নিম্নোক্ত দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো, সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যার দুটিতে (নিম্ন এবং উচ্চ) নামিয়ে আনা; নিম্ন স্তরের সিগারেটে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভাজন তুলে দেয়া এবং উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরকে একত্রিত করে একটি মূল্য স্তরে (উচ্চ স্তর) নিয়ে তামাক নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের সর্বনিম্ন ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং উচ্চ স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের সর্ব নিম্নমূল্য ১০০ টাকা নির্ধারণ করে ৬৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; সব ক্ষেত্রে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটে ৫ টাকা সুনির্দিষ্ট করে আরোপ করবে ফিল্টার এবং নন ফিল্টার বিভাজন বাতিল করে প্রতি ২৫ শলাকা বিড়ির সর্বনিম্ন মূল্য ৩০ টাকা নির্ধারণ; প্রতি ২৫ শলাকা বিড়ির সর্বনিম্ন মূল্য ৩০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫ ভাগ সম্পূরক শুল্ক এবং ৬ টাকা সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্যের (জর্দা ও গুল) এক্স-ফ্যাক্টরি প্রাইস প্রথা বিলুপ্ত করে সিগারেট ও বিড়ির মতো খুচরা মূল্যের ভিত্তিতে করারোপ করা; প্রতি ২০ গ্রাম ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের সর্বনিম্ন মূল্য এবং ১০ টাকা সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করা এবং সব তামাক পণ্যের খুচরা মূল্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা। ওইসব প্রস্তাবসমূহ গ্রহণ করা হলে প্রায় ৬.৪২ মিলিয়ন প্রাপ্ত বয়স্ক ধুমপায় ধুমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবে এবং সিগারেটের ব্যবহার ২.৭ শতাংশ ও বিড়ির ব্যবহার ২.৯ শতাংশ হ্রাস পাবে। এছাড়াও ৭৫ থেকে ১০০ বিলিয়ন টাকা (অথবা জিডিপির ০.৪ শতাংশ) অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে বলে উল্লেখ রয়েছে ওই প্রস্তাবনায়।
তামাক বা সিগারেটের সবচেয়ে ক্ষতিকর উপাদান হলো কার্বন মনোক্সাইড, নিকোটিন, টার। কার্বন মনোক্সাইড গাড়ির পাইপ দিয়ে নির্গত গ্যাসের মতোই এবং ফুসফুসে সে প্রবেশ করে অক্সিজেনের ক্ষমতা কমিয়েছে চাহিদামাফিক শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ যদি অনিয়মিত থাকে তখন হৃদয়স্পন্দন বৃদ্ধির মাধ্যমে আরো অধিক চাপ বৃদ্ধি করে। নিকোটিন মিশ্রিত কার্বন মনোক্সাইড ধুমপায়ীর শরীরে কর্বোবিব থ্রমবসিস এবং সেরিব্রোভাসকুলার রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। টার ফুসফুসে ক্যান্সার স্পাইসিমা এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্রং ফাইটিস সৃষ্টিতে সাহায্য করে। ধুমপান যে কেবল ধুমপায়ীদের জন্য ক্ষতিকর, তা নয়। একজন অধুমপায়ী যদি তামাকের ধোয়া নিঃশ^াসে নিতে বাধ্য হন তবে তিনিও ধূমপায়ীর মতো সমান ক্ষতিগ্রস্ত হন। সুইডেনের একটি আদালত ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে এ ধর্মে রায় প্রদান করেন যে সহকর্মী কর্তৃক ধুমপান আর অধুমপায়ী সহকর্মীর ফুসফুসের ক্যান্সার মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ এবং এটা একটা পেশাগত অপরাধ।
ধুমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে এখন বিশ^বাসীর ভালো করেই জানা। তবুও ধুমপায়ীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০০ খ্রিস্টাব্দের রিপোর্ট অনুযায়ী উণ্নয়নশীল দেশে ধুমপায়ীয় ৪২% পুরুষ ৬% মহিলা। তামাক দ্রব্য গ্রহণের কারণে প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করে
৩৫ লাখ লোক। তার মধ্যে ১০ লাখ উণ্নয়নশীল দেশে। ধুমপানের কারণে ২৫ কোটি শিশু-কিশোর অপরিণত বয়সে মৃত্যুবরণ করে, যার তিন ভাগের এক ভাগ উণ্নয়নশীল দেশে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে তামাক মানুষের মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের প্রধান কারণ হিসেবে পরিণত হবে। বিশ^ব্যাপী ধুমপানের ফলে মৃত্যুর হার বেড়ে তিনগুণ হবে। উল্লেখ্য আজ পর্যন্ত তামাকজনিত রোগের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫। বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে গড়ে ওঠেছে সামাজিক প্রতিরোধ, প্রতিবছর সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী পালিত হয় বিশ^ তামাক মুক্ত দিবস। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয় দিবসের স্লোগানে। আর এ বছর বিশ^ তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য হল- “তামাক করে হৃৎপৃন্ডের ক্ষয়: স্বাস্থ্যকে ভালবাসি, তামাককে নয়।”
লেখক: সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক,গবেষক,সাংবাদিক,কলামিস্ট