জনপ্রিয় বাঙালি চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন

মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
জয়নুল আবেদিন বিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত বাঙালি চিত্রশিল্পী। পূর্ববঙ্গের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের পুরোধা ব্যক্তিত্ব জয়নুল আবেদিন। তিনি ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার কেন্দুয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা তমিজউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। মা জয়নাবুন্নেছা গৃহিণী। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে জয়নুল আবেদিন ছিলেন সবার বড়। খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। পাখির বাসা, পাখি, মাছ, গরু-ছাগল, ফুল-ফল এঁকে মা-বাবাকে দেখাতেন। ছেলেবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিলেন শুধু গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য। তাঁর মা জয়নুল আবেদিনের আগ্রহ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতার তখনকার আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে সাহায্য করেন। জয়নুল আবেদিন ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে পড়েন। ১৯৩৮ সালে ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের ছবির জন্য তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর চিত্রকমের মধ্যে অন্যতম নৌকা (১৯৫৭), সংগ্রাম (১৯৫৯), বীর মুক্তিযোদ্ধা (১৯৭১), ম্যাডোনা (১৯৭১) প্রভৃতি। তাঁর দীর্ঘ দুটি স্ক্রল ১৯৬৯-এ অঙ্কিত ‘নবান্ন’ এবং ১৯৭৪-এ অঙ্কিত ‘মনপুরা-৭০’ জনপ্রশংসিত দুটি শিল্পকর্ম। ১৯৩৮ সালে চিত্র প্রদর্শনীতে তিনি নিখিল ভারত স্বর্ণপদক লাভ করেন।

১৯৪৭ সালে ভারতভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে একটি চিত্রকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তিনি। তাঁর উদ্যোগে ১৯৪৮ সালে পুরান ঢাকার জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুলের একটি জীর্ণ কক্ষে গভর্নমেন্ট আর্ট ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়। তিনি এর প্রথম শিক্ষক ছিলেন। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর একই প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’।

জয়নুল আবেদীন ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় লোকশিল্প জাদুঘর ও ময়মনসিংহে জয়নুল সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠিত হয়। অনুমান করা হয়, তাঁর চিত্রকমের মোট সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি।

তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালা,সংগ্রাম, সাঁওতাল রমণী, ঝড়, কাক, বিদ্রোহী ইত্যাদি। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে গ্রামবাংলার উৎসব নিয়ে আঁকেন তাঁর বিখ্যাত ৬৫ ফুট দীর্ঘ ছবি নবান্ন। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংগৃহীত তার শিল্পকমের সংখ্যা ৮০৭। বেঙ্গল ফাউন্ডেশানের সংগ্রহে আরো প্রায় পাঁচশত চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে। তাঁর পরিবারের কাছে এখনো চার শতাধিক চিত্রকর্ম সংরক্ষিত। এছাড়া পাকিস্তানের বিভিন্ন সংগ্রহশালায় তাঁর বিপুল পরিমাণ চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে।

পূর্ববঙ্গে তথা বাংলাদেশে চিত্রশিল্প বিষয়ক শিক্ষার প্রসারে আমৃত্যু প্রচেষ্টার জন্য জনসাধারণ্যে তিনি শিল্পাচার্য অভিধা লাভ করেন। বাংলাদেশের চিত্রকরদের মধ্যে তিনি শিল্পগুরু বিবেচিত। তাঁর নামে চারুকলা অনুষদে একটি গ্যালারি রয়েছে। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ৩৫ সংখ্যক গ্যালারীটিতে শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন চিত্রশালা হিসাবে সজ্জিত করে।

জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালায় প্রথমে ৭০ টি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছিল যার বেশিরভাগই ছিল তৈলচিত্র। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আছে – বিভিন্ন দেশ ভ্রমনকালে শিল্পাচার্যের অঙ্কিত ছবি, গুণটানা, নদী পারাপারের অপেক্ষায় পিতা-পুত্র এবং দুর্ভিক্ষ। বর্তমানে এখানে মোট ৬৩ টি চিত্রকর্ম রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে শিল্পাচার্যের ব্যবহৃত জিনিস এবং তার কিছু স্থিরচিত্র। স্থিরচিত্রগুলো ভবনের দোতলার বারান্দায় শোভা পায়।

এখনতো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোন ছবি হয়না।” এটি বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত একটি উক্তি।
ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কর্তৃক ৯ জুলাই, ২০০৯ বুধ গ্রহের একটি জ্বালামুখ তাঁর মানবসভ্যতায় মানবিক মূল্যবোধ ও উপলদ্ধিকে গভীরতর করার প্রেক্ষিতে আবেদিন জ্বালামুখ নামে নামকরণ করা হয়। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উৎসব হয় ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালায় (আর্ট গ্যালারি) শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।

পূর্ববঙ্গের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের পুরোধা ব্যক্তিত্ব জয়নুল আবেদিন। দুর্ভিক্ষের ছবি চিত্রমালার জন্য তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তার চিত্রকর্মের মধ্যে অন্যতম ১৯৫৭-এ নৌকা, ১৯৫৯-এ সংগ্রাম, ১৯৭১-এ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ম্যাডোনা। তার দীর্ঘ দুটি স্ক্রল ১৯৬৯-এ অংকিত ‘নবান্ন’ এবং ১৯৭৪-এ অংকিত ‘মনপুরা-৭০’ জননন্দিত দুটি শিল্পকর্ম।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ শহরে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর পরিচালিত একটি সংগ্রহশালা যেখানে বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্মসমূহ সংরক্ষিত আছে। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে সাহেব কোয়ার্টার নলিনী রঞ্জন সরকারের বাড়িতে এ আর্ট গ্যালারীটি অবস্থিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত ময়মনসিংহ শহরের সার্কিট হাউজ সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন মিউজিয়াম এলাকায় বাঁধ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি পার্ক। প্রতিদিনই সকাল-সন্ধ্যা পর্যন্ত এ পার্কে ঘুরে বেড়ায় শহরবাসী ও দূর-দূরান্ত থেকে আসা লোকজন। এখানে এসে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবাহমান সুন্দর্যের পাশাপাশি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এর আঁকা ছবি দেখা সম্ভব।

জয়নুল আবেদিন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অসাধারণ প্রতিভাবান শিল্পী। ইনস্টিটিউট অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফ্টস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে আধুনিক শিল্প আন্দোলনের তিনিই পুরোধা। জয়নুল আবেদিন ও তাঁর কিছু শুভাকাক্সক্ষী সহকর্মীর অক্লান্ত চেষ্টায় মাত্র এক দশকের
মধ্যেই বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলা তাঁর স্থান করে নেয়। জয়নুল আবেদিনের অসাধারণ শিল্প- মানসিকতা ও কল্পনাশক্তির জন্য তিনি শিল্পাচার্য্য উপাধিতে ভূষিত হন।

আবেদিনের কাছে প্রাচ্যের অঙ্কন ধারা অতিমাত্রায় রীতি নির্ভর ও অপরিবর্তনশীল মনে হয়েছে, যা তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি। অন্য দিকে ইউরোপীয় ধারা তাঁর কাছে সীমাবদ্ধ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। এসব কিছু মিলিয়ে তিনি রিয়ালিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন। রেখা চিত্রের ওপর তাঁর দুর্বলতা অবশ্য থেকেই যায় এবং দৈনন্দিন জীবনচিত্রের উপস্থাপনায় তিনি এর ব্যবহারে এনেছেন বহু বৈচিত্র্য।

১৯৫১ সালে তিনি লন্ডনের শ্লেড স্কুল অব আর্ট-এ দুবছরের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। লন্ডন থেকে প্রত্যাবর্তনের পর জয়নুলের চিত্রে নতুন একটি ধারা দেখতে পাওয়া যায়, যাকে বলা যায় ‘বাঙালি ধারা’। এ ধারায় প্রাথমিক রঙের ব্যবহার ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুপস্থিতিতে গ্রামীণ বিষয়বস্ত তাদের জ্যামিতিক আকারে, অনেক সময়ে আধা-বিমূর্ত আদলের উপস্থিতি লক্ষণীয় করে তোলে। ‘দুই মহিলা’ (গোয়াশ, ১৯৫৩), ‘পাইন্যার মা’ (গোয়াশ, ১৯৫৩) ও ‘মহিলা’ (জলরং, ১৯৫৩) হলো এ আমলের উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ধরে জয়নুল আবেদীনের কর্মে রিয়ালিজম, নান্দনিকতা, পল্লীর বিষয়বস্ত ও প্রাথমিক রঙের প্রতি তাঁর আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। তবে কর্মপরিধি বৃদ্ধির সাথে সাথে তিনি লোক শিল্পকলার সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করেন। এখানে ডাইমেনশনের অভাব, আলো আঁধারির ঘনিষ্ট সম্পর্কের অনুপস্থিতি এবং তাদের গতিময়তার অভাব লক্ষণীয়। এ সীমাকে অতিক্রম করতে জয়নুল আবার ফিরে যান প্রকৃতির কাছে গ্রামীণ জীবনে, জীবনের দৈনন্দিন সংগ্রামের মাঝে, সে সাথে রীতি বৈচিত্র্যের সমন্বয় ঘটিয়ে, যেখানে বাস্তবতা থাকবে মুখ্য কিন্তু অবয়ব হবে আধুনিক। জয়নুলের কাছে ‘আধুনিকতাবাদ’ বলতে শুধুই বিমূর্ততা ছিলো না,বরং তাঁর কাছে ‘আধুনিকতা’ শব্দটির ছিল এক সুগভীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য যেখানে সামাজিক উন্নয়ন ও ব্যক্তিক প্রকাশই মুখ্য। তাইপ্রাকৃতিক ও মানুষের তৈরী প্রতিবন্ধকতার বিরূদ্ধে সংগ্রামরত নর-নারীর বলিষ্ঠ শারীরিক গড়ন স্মরণ করিযায়ে দেয় ব্যক্তিক সীমাবদ্ধতার মাঝে আধুনিকতাবাদের গুরুত্বপূর্ণ ধারণাকে। জয়নুলের কর্ম কেন্দ্রায়িত হয়েছে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নর-নারীর শ্রম ও সংগ্রাম এবং সে সাথে তাদের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের মাঝে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের বিজয়কে ভিত্তি করে আঁকা ৬৫ ফুট দীর্ঘ স্ক্রল পেইন্টিং (চাইনিজ ইঙ্ক, জলরঙ ও মোম) ‘নবান্ন’ এবং ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়োণ হারানো হাজারো মানুষের স্মৃতির উদ্দেশ্যে আঁকা ৩০ ফুট দীর্ঘ ‘মনপুরা’ পেইন্টিংটির মাঝে তাঁর কর্মেরবচিত্য লক্ষ করা যায়।

বিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত বাঙালি চিত্রশিল্পী। বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ। বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে প্রথমেই যার নাম বলতে হয় তিনি হলেন জয়নুল আবেদীন। বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের জন্মদিন উপলক্ষে বিশেষ ডুডল তৈরি করেছে গুগল। অতুলনীয় এই শিল্পীর হাত দিয়েই বিশ্বাঙ্গনে পরিচিতি পায় দেশের চিত্রকলা।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালাঃ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন বাংলাদেশের আধুনিক ও সমসাময়িক শিল্প আন্দোলনের অগ্রগামী ছিলেন। সর্বকালের অন্যতম সেরা শিল্পী হিসেবে নন্দিত পাবলো পিকাসোর শিল্পকর্মে তাঁর স্পেনীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো বিশেষভাবে প্রতিভাত। এর অন্যতম ষাঁড়কে শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা এবং ঐতিহ্যবাহী বুলফাইটের প্রতি তাঁর আকর্ষণ। পিকাসোর চিত্রমালায় ও অসংখ্য রেখাচিত্রে ষাঁড় মূলত নিপীড়নকারী শক্তির প্রতীক, বিখ্যাত ‘গুয়ের্নিকা’ চিত্র এর সেরা উদাহরণ।

ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভালো, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার আশীর্বাদ-অভিশাপ। তাই ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সব সময় গুরুত্ব বহন করে। গৃহ থেকে গ্রহে জয়নুল আবেদিন চল্লিশের দশকে সায়েন্স ফিকশন লেখকদের প্রবল প্রভাব জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মহাকাশ গবেষণায় ব্যাপক অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলো। এরই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ১৯১৯ সাল থেকে চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহের গর্ত ও জ্বালামুখের নাম সায়েন্স ফিকশন লেখকদের নামে করার একটি রীতি প্রচলন করে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ইউনিয়ন (আইএইউ)। সেই কারণে জুলভার্ন, এইচ জি ওয়েলস, আলেক্সান্দার বেলায়েভসহ অনেক লেখকের নামেই চাঁদ ও মঙ্গলের জ্বালামুখের নাম রাখা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন এই ধারাকে আরও বিস্তত করে। শুধু সায়েন্স ফিকশন লেখক আর বিজ্ঞানীদের নামে নয়, যাঁরা মানবসভ্যতার মানবিক বোধ ও উপলব্ধিকে গভীরতর করেছেন, সেসব শিল্পী-সাহিত্যিকের নামেও করার একটি উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ অনুভব করে মানুষ। তাই আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো,বুধ গ্রহের গর্তগুলোর নাম করবেন বিখ্যাত শিল্পী ও সাহিত্যিকদের নামানুসারে।

জয়নুল আবেদীন বাংলাদেশের আধুনিক ও সমসাময়িক শিল্প আন্দোলনের অগ্রগামী একজন চিত্রকর। তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালা, সংগ্রাম, ঝড়, কাক, বিদ্রোহী ইত্যাদি। চিত্রশিল্পকর্মে উপমহাদেশে বিশেষকরে বাংলাদেশে শিল্পী জয়নুল আবেদিনের অবদান অবিস্মরণীয়। বিশ্বের প্রাচীনতম ও সর্ববৃহৎ ব্রিটিশ নিলামকারী প্রতিষ্ঠান বনহামসে তাঁর স্কেচ বিক্রয় হয়। তিনি ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সবচেয়ে বড় খেতাব হেলাল-ই-ইমতিয়াজ, ১৯৬৮ সালে ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্রদের তরফ থেকে ‘শিল্পার্চায’ উপাধি এবং ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে তিনি জাতীয় অধ্যাপকের সম্মানায় ভূষিত হন।
যদি শিল্পের মধ্যে বিদ্রোহ খুঁজতে চান তাহলে বাংলার ইতিহাসে বেশিদূর যেতে হবে না। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা গান ও কবিতার মধ্যেই যেমন বিদ্রোহ খুঁজে পাবেন, তেমনি খুঁজে পাবেন ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সকরুণ চিত্র এঁকে
বিশ্ববাসীর বিবেককে নাড়িয়ে দেওয়া এক বিদ্রোহী শিল্পী জয়নুল আবেদিনকেও। বাংলার এই প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী দেশের শিল্পকলা চর্চা ও বিকাশের পথিকৃৎ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায় ও সুস্থ মননসম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জীবনকর্মসহ দেশের অতীত ঐতিহ্য, চিত্রশিল্প গুরুত্ব বহন করে। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি শিল্পের পথে নিবেদিত ছিলেন। দীর্ঘ ছ’মাস ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে মাত্র ৬২ বছর বয়সে মৃত্যৃবরণ করেন পথিকৃৎ এই চিত্রকর।

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম