গীতিকবিতার স্বর্ণযুগে ব্যতিক্রমধর্মী মহাকাব্য রচয়িতা মহাকবি কায়কোবাদ


মো. আলতাফ হোসেন ঃঃ
কবি কায়কোবাদ বা মুন্সী কায়কোবাদ বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য কবি যাকে মহাকবিও বলা হয়। তাঁর প্রকৃত নাম কাজেম আল কোরায়শী। মীর মশাররফ, কায়কোবাদ, মোজাম্মেল হকের মধ্যে কায়কোবাদই হচ্ছেন সর্বতোভাবে একজন কবি। কাব্যের আদর্শ ও প্রেরণা তাঁর মধ্যেই লীলাময় হয়ে ওঠে। সেজন্য একথা বেশ জোরের সঙ্গে বলা যায় যে,কবি কায়কোবাদই হচ্ছেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি।

কবি কায়কোবাদ বাঙালি মুসলিম কবিদের মধ্যে প্রথম সনেট রচয়িতা। তিনি ১৮৫৭ সালে (বর্তমানে বাংলাদেশের) ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার অধীনে আগলা-পূর্বপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ঢাকা জেলা জজ কোর্টের একজন আইনজীবি শাহামাতুল্লাহ আল কোরেশীর পুত্র। কায়কোবাদ সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে অধ্যয়ন করেন। পিতার অকালমৃত্যুর পর তিনি ঢাকা মাদ্রাসাতে (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ) ভর্তি হন যেখানে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা পর্যন্ত অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি পরীক্ষা দেননি, বদলে তিনি পোস্টমাস্টারের চাকরি নিয়ে তার স্থানীয় গ্রামে ফিরে আসেন,যেখানে তিনি অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত কাজ করেছেন। ১৯৩২ সালে, তিনি কলকাতাতে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলন-এর প্রধান অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।

মুসলমান কবি রচিত জাতীয় আখ্যান কাব্যগুলোর মধ্যে সুপরিচিত মহাকবি কায়কোবাদ রচিত ‘মহাশ্মশান’ কাব্যটি। কায়কোবাদের মহাকবি নামের খ্যাতি এই মহাশ্মশান কাব্যের জন্যই। কাব্যটি তিন খন্ডে বিভক্ত। প্রথম খন্ডে ঊনত্রিশ সর্গ,দ্বিতীয় খন্ডে চব্বিশ সর্গ, এবং তৃতীয় খন্ডে সাত সর্গ। মোট ষাট সর্গে প্রায় নয়শ’ পৃষ্ঠার এই কাব্য বাংলা ১৩৩১, ইংরেজি ১৯০৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়; যদিও গ্রন্থাকারে প্রকাশ হতে আরো ক’বছর দেরী হয়েছিলো।পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধযজ্ঞকে রূপায়িত করতে গিয়ে কবি বিশাল কাহিনী,ভয়াবহ সংঘর্ষ, গগনস্পর্শী দম্ভ,এবং মর্মভেদী বেদনাকে নানাভাবে চিত্রিত করেছেন। বিশালতার যে মহিমা রয়েছে তাকেই রূপ দিতে চেয়েছিলেন এই কাব্যে। সেদিন কায়কোবাদ এক নির্জিত সমাজের প্রতিনিধি-প্রতিভূ কিংবা মুখপাত্র হিসেবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর স্বসমাজের লোক পেয়েছিলো প্রাণের প্রেরণা ও পথের দিশা। এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন বলেই আমরা এই মুহূর্তেও শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি মহাশ্মশানের কবিকে।

বাংলা মহাকাব্যের অস্তোন্মুখ এবং গীতিকবিতার স্বর্ণযুগে মহাকবি কায়কোবাদ মুসলিমদের গৌরবময় ইতিহাস থেকে কাহিনী নিয়ে ‘মহাশ্মশান’ মহাকাব্য রচনা করে যে দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছেন তা তাঁকে বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় আসনে স্থান করে দিয়েছে। সেই গৌরবের প্রকাশে ১৯৩২ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের মূল অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন কবি কায়কোবাদ। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি। বাংলা কাব্য সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯২৫ সালে নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ তাকে ‘কাব্যভূষণ’, ‘বিদ্যাভূষণ’ ও ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

কবি কায়কোবাদ এর পিতার নাম শাহমত উল্লাহ আল কোরেশী ওরফে এমদাদ আলী এবং মাতার নাম জোমরাত উন্নেসা ওরফে জরিফুন্নেসা খাতুন। জানা যায়,কবির পিতৃপুরুষগণ বাদশাহ শাহজাহানের রাজত্বকালে বাগদাদের কোনো এক অঞ্চল থেকে ভারতে আসেন। তাদের মধ্যে মাহবুব উল্লাহ আল কোরেশী ফরিদপুর জেলার গোড়াইলে বসবাস শুরু করেন। কায়কোবাদ মাহবুব উল্লাহ আল কোরশীর প্রপৌত্র। কবির পিতামহের নাম নেয়ামত উল্লাহ আল কোরেশী। কবির বাবা ঢাকায় ওকালতি করতেন। কায়কোবাদের বয়স যখন এগারো তখন তার মা এবং এক বছর পরেই বাবা মারা যান। ফলে পড়াশোনায় তেমন একটা এগোতে পারেননি কবি। কায়কোবাদের কবি জীবন শুরু সেই বাল্যকালে মাদরাসার ছাত্রাবস্থায়।

কায়কোবাদ বাংলার অপর দুই মহাকবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেনের ধারায় মহাকাব্য রচনা করেন। তবে নবীনচন্দ্রই ছিলেন তাঁর প্রধান আদর্শ। কায়কোবাদের মহাশ্মশান হচ্ছে মহাকাব্য। তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ অবলম্বনে রচিত এ কাব্যে জয়-পরাজয় অপেক্ষা ধ্বংসের ভয়াবহতা প্রকট হওয়ায় এর নাম হয়েছে ‘মহাশ্মশান’। এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা এবং এর দ্বারাই তিনি মহাকবিরূপে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর গীতিকবিতায় প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ ও আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ পেয়েছে।

কবি কায়কোবাদ আধুনিক বাংলা মহাকাব্য ধারার শেষ কবি। তাঁর প্রকৃত নাম মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী, ‘কায়কোবাদ’ তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম। অতি অল্পবয়স থেকে কায়কোবাদের সাহিত্য-প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। মাত্র তেরো বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্য বিরহবিলাপ (১৮৭০) প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে: কুসুম কানন (১৮৭৩), অশ্রুমালা (১৮৯৫), মহাশ্মশান (১৯০৪), শিব-মন্দির (১৯২২), অমিয়ধারা (১৯২৩), শ্মশান-ভস্ম (১৯২৪) ও মহরম শরীফ (১৯৩২)। কবির মৃত্যুর বহুদিন পরে প্রেমের ফুল (১৯৭০), প্রেমের বাণী (১৯৭০), প্রেম-পারিজাত (১৯৭০), মন্দাকিনী-ধারা (১৯৭১) ও গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ (১৯৭৯) প্রকাশিত হয়। বাংলা একাডেমী কায়কোবাদ রচনাবলী (৪ খন্ড, ১৯৯৪-৯৭) প্রকাশ করেছে।

কায়কোবাদের কাব্যসাধনার মূল উদ্দেশ্য ছিলো পশ্চাৎপদ মুসলমান সম্প্রদায়কে তাঁর অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করা এবং তা পুনরুদ্ধারে উদ্বুদ্ধ করা। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী, যার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর বিভিন্ন রচনায়। তিনি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। ১৯৩২ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের মূল অধিবেশনে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মহাকবি কায়কোবাদ বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র যা আজও সমানতালে আলো বিলিয়ে চলেছে আপন গরীমায়। মহাকবি কায়কোবাদের মহাকাব্যে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেনের রচনা ধারার প্রভাব সুস্পষ্ট। তিনি ১৯৩২ সালে “বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সন্মেলন” অনুষ্ঠানে মহাকবি অলংকৃত করেন সভাপতির আসন।

‘অধরে রক্তিম রেখা মুখে মৃদু হাসি, পাগল করিলো মোরে ঐ রূপরাশি কারে ভালোবাসি’ এই পঙক্তি বাংলা কবিতার মহাকবি কায়কোবাদের রচিত কাব্যের অংশ। ‘সুখ সুখ বলে তুমি, কেনো করো হা-হুতাশ/সুখ ত পাবে না কোথা, বৃথা সে সুখের আশ।’ এই মহান উক্তিটিও তাঁর। এমনি অসংখ্য কাব্য সৃজনের কারিগর তিনি। মুহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী ওরফে কায়কোবাদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলমান সাহিত্যধারার সূচনা পাঠের শ্রেষ্ঠ কবি। মূলত, কায়কোবাদ ছিলেন একজন প্রেমিক কবি, বেদনার কবি, একজন আধ্যাত্মিক সাধক কবি। স্বদেশ প্রেম, সত্যনিষ্ঠা আর ইতিহাস ঐতিহ্য প্রীতি ছিলো তাঁর কবি প্রতিভার মৌল বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথেরও বয়োজ্যেষ্ঠ কবি কায়কোবাদ গীতি কবি হিসাবেই সাহিত্য ক্ষেত্রে আবির্ভূত হন এবং রবীন্দ্রযুগেই মহাকাব্য রচয়িতা রূপে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। মূলত গীতিকবি হলেও মহাকাব্য রচনায় তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্যই তিনি সকলের প্রশংসা ও বিস্মিত দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

সময়ের বিপরীতে গিয়ে কায়কোবাদ একটি অতুলনীয় সাম্যবাদের আনন্দ লোক নির্মাণ করেছিলেন। যেখানে হিন্দু মুসলমান একই দেশবাসী এবং একই প্রকৃতির মানবীয় গুণাগুণে বিভূষিত। তিনি তার কাব্যে যে আবেগে মুসলমানদের মনোবেদনা বর্ণনা করেছেন, অনেক ক্ষেত্রে অধিকতর নিষ্ঠায় হিন্দুদের মনোবেদনা বর্ণনা করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, হিন্দুদের দুর্বল করে অঙ্কন করলে শক্তিমান মুসলমানের কোনো গৌরব নেই।কেননা,শৃগালের সঙ্গে যুদ্ধে সিংহের কোনো গৌরব নেই। কায়কোবাদ বাংলার অপর দুই মহাকবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেনের ধারায় মহাকাব্য রচনা করেন। তবে নবীনচন্দ্রই ছিলেন তাঁর প্রধান আদর্শ।

মাত্র তেরো বছর বয়সে তার প্রথম কাব্য বিরহবিলাপ (১৮৭০) প্রকাশিত হয়। পনের বছর বয়সে ১৮৭৩ সালে তিনি রচনা করেন তার দ্বিতীয় কাব্য ‘কুসুম কানন’। কবি জীবনের প্রথম পর্যায়ের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কাব্য ‘অশ্রুমালা’ প্রকাশিত হয় ১৮৯৪ সালে। এরপর তিনি মহাকাব্য রচনায় মনোনিবেশ করেন এবং ১৯০৪ সালে তার বিপুল আয়তনের মহাকাব্য ‘মহাশ্মশান’ প্রকাশিত হয়। ১৯১৪ সাল পর্যন্ত কায়কোবাদ কাব্যটির নানা আকৃতি ও প্রকৃতিগত পরিবর্তন সাধন করেন। ‘মহাশ্মশান’ এর পরে তিনি রচনা করেন ‘শিব মন্দির’ (১৯২১), ‘আময় ধারা’ (১৯২৩), ‘মহররম শরীফ’ (১৯৩৩) এবং ‘শ্মশান ভসন’ (১৯৩৮) কাব্য। ‘মহররম শরীফ’ কবির মহাকাব্যোচিত বিপুল আয়তনের একটি কাহিনি কাব্য।

কালের লিপিতে ‘মহাকবি কায়কোবাদ’ নামে তিনি উৎকীর্ণ হয়ে থাকলেও তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম কাজেম আল-কোরায়েশি। যমুনার তীরবর্তী ছোট্ট একটি গ্রাম রসপাল। প্রায় ১৩২ বছরের পুরনো ভগ্নপ্রায় মসজিদের ছাঁয়াঢাকা বারান্দায়, বহুকাল আগে লেখা হয়েছিলো একটি অনন্য জাগরণী কবিতা। কবিতাটির নাম ‘আজান’ ‘‘কে অই শুনালো মোরে,আজানের ধ্বণি,মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সুমধুর,আকুল হইলো প্রাণ বাজিল ধমণী,কি মধুর আজানের ধ্বণি!’’ লিখেছিলেন কায়কোবাদ নামে পরিচিত কাজেম আল কোরায়শী নামক ক্ষনজন্মা এক কবি। আমি তো পাগল হয়ে সে মধুর তানে, কি যে এক আকর্ষণে, ছুটে যাই মুগ্ধমনে কি নিশীথে, কি দিবসে মসজিদের পানে। হৃদয়ের তারে তারে, প্রাণের শোণিত-ধারে, কি যে এক ঢেউ উঠে ভক্তির তুফানে- কত সুধা আছে সেই মধুর আযানে। নদী ও পাখির গানে তারই প্রতিধ্বনি। ভ্রমরের গুণ-গানে সেই সুর আসে কানে কি এক আবেশে মুগ্ধ নিখিল ধরণী। ভূধরে, সাগরে জলে নির্ঝরণী কলকলে, আমি যেন শুনি সেই আযানের ধ্বনি। আহা যবে সেই সুর সুমধুর স্বরে,ভাসে দূরে সায়াহ্নের নিথর অম্বরে, প্রাণ করে আনচান, কি মধুর সে আযান, তারি প্রতিধ্বনি শুনি আত্মার ভিতরে। নীরব নিঝুম ধরা, বিশ্বে যেন সবই মরা, এতটুকু শব্দ যবে নাহি কোন স্থানে, মুয়াযযিন উচ্চৈঃস্বরে দাঁড়ায়ে মিনার ‘পরে কি সুধা ছড়িয়ে দেয় উষার আযানে! জাগাইতে মোহমুদ্ধ মানব সন্তানে। আহা কি মধুর ওই আযানের ধ্বনি। মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সমধুর আকুল হইল প্রাণ,নাচিল ধমনী।

‘কে ঐ শোনালো মোরে আজানের ধ্বনি, মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিলো কি সুমধুর, আকুল হইলো প্রাণ, নাচিলো ধমনি। কি-মধুর আযানের ধ্বনি’। মহাকবি কায়কোবাদ এরূপ অসংখ্য কবিতাসহ অসাম্প্রদায়িক আধুনিক শুদ্ধ বাংলায় গীতিকাব্য ও কাহিনীকাব্য রচনা করে গেছেন। তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি এবং মুসলমান। বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক অবদানের জন্য মহাকবি কায়কোবাদ সারা দেশের মানুষের কাছে সমাদৃত।

কায়কোবাদের কাব্যচর্চাকে মোটামুটি ছটি ভাগে ভাগ করা যায়- গীতিকাব্য বা খন্ডকাব্য ও মহাকাব্য বা কাহিনী কাব্য। তবে মহাকাব্য বা কাহিনী কাব্য অপেক্ষা গীতি কবিতা বা খন্ড কবিতা রচনাতেই তিনি ছিলেন অপেক্ষাকৃত সাবলীল, স্বতঃস্ফূর্ত ও অধিকতর সিদ্ধহস্ত। তার শ্রেষ্ঠ গীতিকাব্য ‘অশ্রুমালা’ই তার বড় প্রমাণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও কায়কোবাদের যাবতীয় খ্যাতি এবং পাঠক সমাজের যত সব বিমুগ্ধ বিস্ময় তা তার ‘মহাশ্মশান’ কাব্যকে ঘিরে। কাব্যটিকে তিনি মহাকাব্য বলে দাবি করেছেন। কিন্তু বাস্তব কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে কবির দাবি অনুযায়ী কাব্যটি যথার্থ মহাকাব্য না হলেও নানা বৈশিষ্ট্যের কারণে কায়কোবাদের এই মহাকাব্যিক প্রয়াসকে কোন অবস্থাতেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। সে সময়কার প্রেক্ষাপটে এরূপ উদার মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, সত্যনিষ্ঠ এবং বিশাল আয়তনের কাব্য প্রয়াস সত্যি আমাদেরকে যুগপৎ ও মুগ্ধ করে।

ঊনিশ শতকের যুগস্রষ্টা বিপ্লবী কবি মাইকেল মধুসূধন দত্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মহাকাব্য রচয়িতা। পরবর্তীকালে তার ধারা অনুসরণ করে যারা মহাকাব্য রচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কায়কোবাদ ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রমধর্মী মহাকাব্য রচয়িতা। বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনি হিংসা, বিদ্বেষ ও সংকীর্ণতার যে পরিপ্রেক্ষিত পেয়েছিলেন, তাকে তিনি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মহাশ্মশান সম্প্রীতির এক নবপ্রেক্ষিত নির্মাণে প্রয়াসী ছিলেন।

মূলত গীতিকবি হলেও মহাকাব্য রচনায় তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্যই তিনি সকলের সুপশংস ও বিস্মিত দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কায়কোবাদ ছিলেন মূলত একজন প্রেমিক কবি, বেদনার কবি, একজন আধ্যাত্মিক সাধক কবি। স্বদেশ প্রেম, সত্যনিষ্ঠা আর ইতিহাস ঐতিহ্য প্রীতি ছিলো তাঁর কবি প্রতিভার মৌল বৈশিষ্ট্য। তিনি ছিলেন সৌন্দর্যের একজন মস্তবড় উপাসক। স্বভাব কবির ন্যায় তিনি তাঁর কাব্যে অপূর্ব শিল্পচাতুর্যে প্রকৃতি ও নারীর স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছেন। সঙ্গীত রচনায়ও তাঁর হাত ছিলো দক্ষ। তাঁকে যেমন দেখি একজন মুসলিম দরদী জাতীয় কবিরূপে, সেইরূপ তাকে দেখি ধর্ম, বর্ণ নিরপেক্ষ বাংলাদেশের একজন সাম্যবাদী অসাম্প্রদায়িক জাতীয় কবিরূপে।

কবি কায়কোবাদ এতো দীর্ঘ জীবন লাভের সৌভাগ্য খুব কম লেখকের জীবনেই ঘটে। কিন্তু তাঁর এই দীর্ঘ জীবন পরিসরে পরিবর্তনশীল জগত ও সাহিত্যোদর্শের অনিবার্য বিবর্তনকে তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি বা করতে চাননি। বিশ শতকের পরিবর্তিত পরিবেশে অবস্থান করেও তিনি ছিলেন ঊনিশ শতকীয় সাহিত্যাদর্শ ও সাহিত্য রীতির অনুসারী। তাঁর কবি মানসের এই সীমাবদ্ধতা তাঁর মহাশ্মশান কাব্যের মহাকাব্যিক প্রয়াসকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তা সত্ত্বেও সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর বিপুল অবদান, তার উদার মানসিকতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা,তাঁর সত্যনিষ্ঠা এবং আধুনিক বাংলা সাহিত্যচর্চায় পশ্চাদপদ মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের অভয়দান ও অনুপ্রাণিত করার জন্য তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন চিরকাল।

কবির বাড়ির পশ্চিমে ১৯৮৩ সালে আগলা মাছপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত করা হয় কায়কোবাদ যুব ক্লাব ও গণপাঠাগার। বাংলা সাহিত্যে অনন্য অবদান রেখেছেন এ কবি। তৎকালীন সমাজে তো বটেই এখন পর্যন্ত তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা সর্বজনবিদিত। মহাশ্মশান তার জ্বলন্ত উদাহরণ। দেশপ্রেমের জন্য তাঁর তুলনা মেলা ভার। মহাশ্মশান এর পূর্ণ মূল্যায়ণ করেই এর সারাংশ থেকে মুনীর চৌধুরীর লেখা নাটক ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’। ধর্মীয় চেতনায় তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তাঁর আজান কবিতাটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ আমি মনে করি তাকে যথাযথ মূল্যায়নের সময় এখনই।

কবি কায়কোবাদ দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন। ঐতিহাসিক সিপাহী বিল্লবের বছরে সেই ১৮৫৭ সালে তাঁর জন্ম এবং তিনি বাংলাদেশ এর মহান ভাষা আন্দোলনের পূর্ব বছরে ১৯৫১ সালের ২১ জুলাই ৯৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় এবং আজিমপুর কবরস্থানে তিনি চিরশয্যায় শায়িত। তাঁর মতো দীর্ঘ জীবন লাভের সৌভাগ্য খুব কম লেখকের জীবনেই ঘটে। কিন্তু তাঁর এই দীর্ঘ জীবন পরিসরে পরিবর্তনশীল জগত ও সাহিত্যোদর্শের খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায়নি। বিশ শতকের পরিবর্তিত পরিবেশে অবস্থান করেও তিনি ছিলেন ঊনিশ শতকীয় সাহিত্যাদর্শ ও সাহিত্য রীতির অনুসারী ছিলেন। অনন্য সৃজন-সৃষ্টির জন্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অনন্তকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন কবি কায়কোবাদ। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট


শিরোনাম