গতি প্রকৃতি হারিয়ে ঢোলভাঙ্গা নদীর এখন মরণ দশা

মো. আলতাফ হোসেন ঃঃ
অবিরাম সৌন্দর্যে আঁকা নদীমাতৃক দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। এককালের প্রায় হাজার নদীর দেশ। জোয়ারভাটার দেশ। সমভূমি আর সবুজ বন-বনানী ও পাহাড়-পর্বত ঘেরা। রূপ-মাধুর্যে সমৃদ্ধ আমাদের প্রাণপ্রিয় এই মাতৃভূমি বাংলাদেশ। পাক-পাখালির দেশ, সুজলা-সুফলা,শস্য-শ্যামলা এই বাংলা মায়ের শিতল বক্ষ চিরে বয়ে চলেছে অসংখ্য নদ-নদী ও নদী অববাহিকা। আদিকাল থেকে এদেশের মানুষের জীবনের উৎস ছিলো নদী। এই নদীগুলো কৃত্রিম কারণে ও সময়ের ধারায় আজ বিপর্যয়ের সম্মুখিন। তার বড় প্রমাণ শুকনো মৌসুমে দেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলার নদ- নদীর অবস্থা ও অবস্থান। এসব অঞ্চলের জেলাগুলো ঘুরলে বুঝা যায় যে, দেশের নদীগুলোর অবস্থা আজ কতটা নাজুক।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন নদ-নদী। শাখা প্রশাখাসহ প্রায় ৮০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪,১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বাংলাদেশের নদীগুলোকে সংখ্যাবদ্ধ করেছে এবং প্রতিটি নদী একটি পরিচিতি নম্বর দিয়েছে। এর ফলে তাদের হিসাব অনুয়াযী বাংলাদেশে এখন নদীর সংখ্যা এখন ৪০৫টি। দেশের মধ্যে থাকা বিভিন্ন নদ-নদীর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ঢোলভাঙ্গা নদীটি অন্যতম।
ঢোলভাঙ্গা নদী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি নদী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সদরের পুরোনো সিনেমা হলের উত্তর পাশে ঢোলভাঙ্গা নদী দখল করে আড়াআড়ি বেড়া দিয়ে মাটি ভরাট করা হয়েছে। আড়াআড়ি বাঁশের বেড়া দিয়ে মাটি ভরাট করার জন্য নদীর প্রস্থ অনেক কমে গেছে। এ কারণে শুষ্ক মৌসুমে বোরো জমিতে সেচকাজ এবং বর্ষাকালে নৌযান চলাচল ব্যাহত হবে।
মেঘনা ও এর ৫টি শাখা নদী একসময় প্রবাহিত হতো ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও এর অভ্যন্তরীন উপজেলা নবীনগর,বাঞ্ছারামপুরের ভেতর দিয়ে। জালের মতো জড়িয়ে থাকত অসংখ্য খাল। ছিলো বড় বড় বিলও।মাছে মাছে সয়লাব থাকতো নদীগুলো। এসবই এখন মৃতপ্রায়। সবই যেনো স্বপ্ন। বেশ কয়েকটি নদী-খাল-বিলের অস্তিত্ব নেই। বাকিগুলোর অবস্থাও সংকটাপন্ন। সব মিলিয়ে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা কার্যত মরুভূমির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। হারিয়ে যাচ্ছে জেলার অন্যান্য নদীর মতো ঢোলভাঙ্গা নদী।
মেঘনা অববাহিকায় তিতাস নদী এবং তিতাস অববাহিকায় ঢোলভাঙ্গা নদীটি বাঞ্ছারামপুর উপজেলার জন্য ছিলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ।কি সামাজিকভাবে,কি অর্থনৈতিক-কৃষি,কি শিল্প বা পরিবহনের জন্য কিন্তু ঢোলভাঙ্গা নদীর গতিপথ বন্ধ করে দিয়ে সেখানে মাটি-বালি ভরাট করে মার্কেট নির্মান করেন বিত্তবান প্রভাবশালীরা। দূষণ ও দখল দারিত্ম্যের কারণে এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে জেলার নদীগুলো। হারিয়ে যাচ্ছে জেলার একসময়ের খরস্রোতা ঢোলভাঙ্গা নদীটি। কতিপয় গড়ফাদার ভাঙন ঠেকানোর নামে চকবাজারের কাছে বাঁধ দিয়ে ঢোলভাঙ্গা নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে এটি বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এই নদীর বেশির ভাগ স্থানে শুষ্ক মৌসুমে নৌকা চলাচলের মতো পানি থাকে না। কোথাও কোথাও একেবারে শুকিয়ে যায়। তাছাড়া ঢোলভাঙ্গার উপশাখা এই মড়াগাঙ্গ নামে খালটির বর্তমানে কোন অস্তিত্ব নেই।ইতিহাসের বই আর বয়স্ক মানুষের মুখেই শুধু এই নদীগুলোর নাম শোনা যায়।
নদ-নদী দেশের প্রাণ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ঢোলভাঙ্গা বন্ধ মানে নৌপথ বন্ধ।নৌপথ বন্ধ মানে ব্যবসায়ীরা মালামাল উচ্চ ভাড়ায় সড়ক পথে মালামাল আনছেন। যেটি আগে ছিলো না।আগে বাজারের ব্যবসায়ীরা নৌপথে নারায়নগঞ্জ-নরসিংদী হতে চাল,ডাল-আটা ময়দা,তেল-নুন সব আনতো। বন্ধ হওয়াতে বাড়তি খরচ যেয়ে বর্তায় সাধারন মানুষের ঘাড়ে।নদীটি যদি রক্ষা করা না হয়,একদিন বাঞ্ছারামপুরবাসী হারানো ঢোলভাঙ্গার জন্য কাঁদবে’’।
ব্রাহ্মবাড়িয়ার জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ঢোলভাঙ্গা নদী। পানি না থাকায় স্থানীয়ভাবে আমদানি করা বিভিন্ন জিনিস আটকে আছে। আটকে আছে যাত্রীবাহী নৌকাও। নদীর তীর দখল করে প্রভাবশালীরা গড়ে তুলেছেন অবৈধ স্থাপনা সহ বিভিন্ন আবাসসস্থান। এলাকাবাসী জানান,‘আমাদের আশে পাশের সকল ময়লা-আবর্জনা ফেলার কোনো নির্দিষ্ট স্থান না থাকার কারনে বর্তমানে নদীতে ফেলতে হচ্ছে আমাদের সকল বর্জ্য। তাই বর্তমানে আমাদের ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে ঢোলভাঙ্গা নদীর অবস্থা দিনে দিনে অনেকটইা নোংরা হয়ে যচ্ছে। ঢোল ভাঙ্গা নদীতে যেন ময়লা-আবর্জনা আর ফেলতে না হয় বাঞ্ছারামপুরের সকল মানুষের সুবিধার জন্য নদীর পাশে একটা খাস জায়গা বরাদ্দের জন্য আলোচনা চলছে ইতি মধ্যেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর পৌরসভার ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে ঢোলভাঙ্গা নদীতে। এ অবস্থায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী। বাড়ছে দূষণ। ছড়িয়ে পড়ছে রোগ-ব্যাধি। দূষণে নদীর পানি ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। দেখা যায়,বাঞ্ছারামপুর পৌর এলাকার প্রতাবগঞ্জ বাজারের মাংসপট্টি, পোলট্রি মুরগি বিক্রির দোকান এবং কাঁচা তরকারির দোকান রয়েছে। প্রতিদিন খোলা জায়গায় জবাই করা গরু-ছাগল, মুরগির রক্ত,বিষ্ঠা,পঁচা মাছ এবং তরকারি আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে রাখা হয়। ঢোলভাঙ্গা নদীটি মরিচাকান্দি,বাখরনগর,সোনারামপুর,দুলারামপুর, কদমতলী, দরিয়াদৌলত, দুর্গারামপুর, ভিটিঝগড়ারচর গ্রামে প্রবাহিত হয়ে উপজেলা পরিষদ ও প্রতাপগঞ্জ বাজারের মাঝ দিয়ে তিতাস নদে মিলিত হয়েছে। প্রতাপগঞ্জ বাজারের উত্তরপ্রান্ত থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় ৫০০ মিটার নদী প্রবাহমান। একসময় ঢোলভাঙ্গা নদীর পানি ব্যবহার করে দৈনন্দিন কাজসহ সবধরনের কাজ সম্পন্ন করতেন এলাকাবাসী। কালের বিবর্তনে নদীর নাব্যতা সংকট এবং আবর্জনা ফেলায় নদীটি যেমন সরু হয়েছে তেমনি পানির প্রবাহও একেবারেই কমে গেছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের মধ্য-পূর্বাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী তিতাস-বিধৌত জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নামকরণ নিয়ে একাধিক মতো রয়েছে। শোনা যায়, সেন বংশের রাজত্বকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অভিজাত ব্রাহ্মণকুলের অভাবে পূজা-অর্চনায় বিঘ্ন সৃষ্টি হতো। এ কারণে রাজা লক্ষণ সেন আদিসুর কন্যকুঞ্জ থেকে কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবারকে এ অঞ্চলে নিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে কিছু ব্রাহ্মণ পরিবার শহরের মৌলভী পাড়ায় বাড়ি তৈরি করে। সেই ব্রাহ্মণদের বাড়ীর অবস্থানের কারণে এ জেলার নামকরণ ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। অন্য একটি মতানুসারে দিল্লি থেকে আগত ইসলাম ধর্ম প্রচারক শাহ সুফী হযরত কাজী মাহমুদ শাহ এ শহর থেকে উল্লেখিত ব্রাহ্মণ পরিবার সমূহকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ প্রদান করেন , যা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় রয়েছে বহুসংখ্যক নদী। দেশের অন্যান্য নদীর মতো ঐতিহ্যবাহী তিতাস বিধৌত বাঞ্ছারামপুর উপজেলার প্রাণের নদী ঢোলভাঙা’র অবস্থা এখন মুমূর্ষু। উপজেলার প্রাণকেন্দ্র দিয়েই বয়ে গেছে এই নদী। বাঞ্ছারামপুরবাসীর জীবনযাত্রার সাথে এই ঢোলভাঙা নদী গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এক সময় নদীমাতৃক ও হাওরবিধৌত বাঞ্ছারামপুরের ব্যবসায়ীদের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম ছিল নদীটি। ড্রেজিংর অভাবে সেই নৌপথ আজ মৃতপ্রায়। অথচ নদীটির উপর ভর করেই গড়ে উঠেছে আজকের বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সদর।নদীটির মূল অংশের ত্রিমোহনায় মাটি ভরাট করে দখল করেছে কিছু প্রভাবশালী ভূমিদস্যূ। গড়ে তুলেছেন স’মিল, সুরম্য বানিজ্যিক মার্কেট, পাইকারী বিক্রির জন্য বিভিন্ন প্রকার বাঁশ বাজার। সে বাঁশ নদী পথ বন্ধ করে নৌ চলাচলে ব্যাহত করছে। বাজারের শত-শত ব্যবসায়ীরা নিত্যদিন ফেলছেন টন টন পলিথিনসহ বর্জ্য। ফলে দুষিত হচ্ছে পানি। ভরে যাচ্ছে নদীর তলদেশ।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় শুকনো মৌসুমে নদীর চিহ্ন মুছে যায়। দেখা যায় শুধু মঙ্গল গ্রহের মতো পানি শূন্য। ধূ-ধূ সরবর কিংবা মরে যাওয়া নদীগুলোর অন্তিম অস্তিত্ব। এভাবে চলতে থাকলে নদ-নদীর পানি সম্পদ,শস্য ও মৎস সম্পদসহ সকল প্রাণীকূল ও বনভূমি ভবিষ্যতে ধ্বংস বা বিলুপ্ত কিংবা বিলিন হয়ে যাবে কালের অতল চলে। সে সাথে পরিবেশসহ সব কিছুর ওপর বিষণভাবে প্রভাব পড়বে ।
নদ-নদী দখল আর নদীর পার কেটে বালু উত্তোলন যেকোনো অপরাধই শাস্তিযোগ্য। হাজার হাজার বছর নদ-নদীকে কোনো মানুষের রক্ষা করার প্রয়োজন হয়নি। আজ তারা অগণিত শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত। নদী ছিলো আপন বেগে পাগলপারা। তাকে আক্রমণ বা বাধা দেওয়ার সাধ্য ছিলো না কারও। নদ-নদী ছিলো অজাতশস্ত্র,কালের বিবর্তনে হারিয়েছে এসব নদীর নাব্যতা। অন্যান্য নদ-নদীর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অনেক ছোট-বড় নদ-নদী এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। তার মধ্যে ঢোলভাঙ্গা নদী একটি।
পৃথিবীতে প্রাণী জগৎ বেঁচে ধমনীতে যেমন রক্ত প্রবাহ জরুরি তেমনি দেশকে বাঁচাতে হলে সে দেশের বুকের ভেতর নদী প্রবাহ জরুরি। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় নদ-নদী ও তার পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে দিতে দাবি সচেতনমহলের। তাই ঢোলভাঙ্গা নদীসহ দেশের অন্যান্য নদ-নদীর সঠিক নাব্যতা বজায় রেখে নদীকে বাঁচানো সরকারের পাশাপাশি আমাদের সকলের কর্তব্য। নদী বাাঁচাও দেশ বাঁচাও। সমাজ সচেতন ও মানবতাবাদীর ভূমিকায় থেকে কবি নারী ও নদী উভয়ের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দাবি করেন। নদী কিংবা নারী বিপন্ন হলে সভ্যতা ও সৃজনশীলতা সংকটাপন্ন হয়। তাতে নারীত্বের কোনো হানি হয় না। কারণ নদী ও নারীর সৃজনক্ষমতা প্রশ্নাতীত, নির্বিকল্প, অবিনাশী। উভয়ের নিরাপদ অস্তিত্ব এবং অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের সকলের। প্রতিকী ছবি-সংগৃহীত

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ(কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান),সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক, গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম