কালের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা পাবিজুড়ি নদী

মো.আলতাফ হোসেনঃ
পৃথিবী জুড়ে কৃষি সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিলো নদীকে ঘিরে। এ অর্থে কৃষি সভ্যতার সমার্থ শব্দ হতে পারে নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা।নদীর গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। এক সময় নদীকে কেন্দ্র করে সভ্যতা ও শহর গড়ে উঠেছে।বাংলাদেশের প্রবাহিত প্রায় সব নদ-নদীই আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করেছে। হিমালয় থেকে উৎপত্তি হয়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমা অতিক্রম করে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সর্বশেষ বঙ্গোপসাগরে মিশে গেছে। আজ কোনো কোনো নদীর অস্তিত্ব মানচিত্রে আছে অথচ বাস্তবে নাই। উত্তর-পূর্র্বাঞ্চলের এমনি একটি নদীর নাম পাবিজুড়ি নদী।

পাবিজুড়ি নদী বা কুশি গাং বা কুশিয়া নদী বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৩৮ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৪ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক পাবিজুড়ি নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদী নং ৪৮।

সিলেট জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল সিলেট। এটি সিলেট বিভাগের অধিক্ষেত্রভুক্ত একটি জেলা। উপজেলার সংখ্যানুসারে সিলেট বাংলাদেশের একটি “এ” শ্রেণীভুক্ত জেলা। সিলেট বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনপদ। বনজ, খনিজ ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত এ জেলা দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী ও বিশ্বের দ্বিতীয় লন্ডন হিসেবে খ্যাত। সিলেট বিভাগ উত্তর ও দক্ষিণ হতে পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত। অভ্যন্তরীণ সীমানার ভূমি বেশির ভাগ সমতল। বৈশাখ হতে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়। বৃহৎ জলপাতের কারণে পাহাড় হতে ঢল নেমে ক্ষুদ্র নদী গুলোর ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। যার ফলে প্রতি বছরই মৌসুমি বন্যায় কবলিত হয় বেশির ভাগ নিম্নাঞ্চল। দক্ষিণ এশিয়ার অন্তর্গত একটি ছোট নদীবহুল বাংলাদেশের শাখা-প্রশাখাসহ সবগুলো নদনদী নামের তালিকা এখানে প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশের এসব নদনদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪,১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকাই এই সহস্রপাধিক নদীর মাধ্যমে বয়ে আসা পলি মাটি জমে উৎপন্ন হয়েছে। নদীবহুল বাংলাদেশে অসংখ্য নদনদীর মধ্যে অনেকগুলো আকার এবং গুরুত্বে বিশাল।

সুরমা-কুশিয়ারাসহ সিলেট বিভাগের অর্ধশতাধিক নদ-নদী বিপন্নের পথে। জেলার পাবিজুড়ি নদীটি বিপন্ন প্রায়। এসব নদ-নদীর উৎসমুখসহ বিভিন্ন স্থানে ভরাট হয়ে গেছে। এতে ভাটির জনপদে নৌপথ বন্ধ, চাষবাসে সংকট,অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। নদী হারাচ্ছে তার বৈশিষ্ট্য,অন্যদিকে দূষণের মাত্রাও বাড়ছে। বিশেষ করে পানিতে বর্জ্য মিশ্রণের ফলে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ভাটির জনপদের নদীগুলো। তীরবর্তী জনপদের জীবন-জীবিকা বদলে যাচ্ছে। বিলীন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। হ্রাস পাচ্ছে মাছের উৎপাদন। বিভিন্ন স্থানে গতিপথ পরিবর্তন, নাব্য হারিয়ে নদীভাঙন ও ব্যাপক হচ্ছে।

সিলেট বিভাগের প্রধান নদী সুরমা,কুশিয়ারা,খোয়াই, মনু, ধলাই, পিয়াইন, সারি, সুতাং, রত্না, সোনাই, করাঙ্গী, ঝিংড়ি, ভেড়ামোহনা, রক্তি, কালনী, বৌলাইসহ বেশকিছু নদ-নদীর নাব্য হারিয়ে গেছে। নদী ভরাটের কারণে বোরো চাষীরা হাহাকার করেন এই মৌসুমে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য সুরমা ও কুশিয়ারা এখন যৌবনহারা। যৌবন হারিয়ে গেছে পাবিজুড়ি নদীর। তাছাড়া ভাঙনের কবলে বদলে গেছে সিলেটের কয়েকটি অঞ্চলের নদ-নদীর মানচিত্র।

বাংলাদেশে ছোট বড় অসংখ্য নদ-নদী জালের মতো ছড়িয়ে আছে। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার মানুষের জীবন ও জীবিকার অন্যতম অবলম্বন এদেশের নদ-নদী। তবে নদী ভরাট, নাব্যতা হ্রাস ও দূষণের কারণে ছোট-বড় অনেক নদী বর্তমানে বিপন্ন। আমাদের দেশের বুক চিরে বয়ে চলা অসংখ্য নদ-নদীর কারণে বাংলাদেশ বিশ্বে নদীমাতৃক দেশ হিসেবে সুপরিচিতি। এসব নদীকে কেন্দ্র করেই বাংলার বুকে গড়ে উঠেছে শহর-নগর-বন্দর।এদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকাও নদীর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিস্তীর্ণ নদীপথ যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। তাছাড়া সিলেটের পরিবেশ বিপর্যয়ে আন্তঃসীমান্ত নদীরও ভূমিকা রয়েছে।

বৃহত্তর সিলেটে চিরকাল খরস্রোতা নদী হিসেবে বহমান থেকেছে ভারতের পাহাড় থেকে নেমে আসা সুরমা, কুশিয়ারা, সারি, লোভা পিয়াইন, বৌলাই, রক্তি, যাদুকাটা, মনু, খোয়াই, সুতাংসহ অনেক নদী। কিন্তু এসব নদী আজ তার বৈশিষ্ট্য ও যৌবন হারাতে বসেছে। ভয়াল করাল গ্রাসে রক্ষায় পায়নি খরস্রোতা পাবিজুড়ি নদীটি। এ নদী অনেক স্থানে পলি-বালি পড়ে হারিয়ে গেছে নদী। কোথাও নদী পরিণত হয়েছে আবর্জনার ভাগাড়ে। নদীর বাঁচা-মরার ওপর বাংলাদেশের অস্তিত্ব জড়িত। বাঁচলে নদী বাঁচবে দেশ, বাঁচবে প্রিয় বাংলাদেশ।

নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিলো হিমালয় থেকে ছুটে আসা অসংখ্য নদ-নদীর প্রবাহ থেকে। যে প্রবাহের সাথে বহমান বিন্দু বিন্দু পলিমাটি হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে তুলেছিলো পৃথিবীর বৃহত্তম এই ব-দ্বীপ। এ দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা সবকিছুতেই রয়েছে নদীর প্রভাব। একসময় এই নদীর বুকেই ভেসে গিয়েছে বড় বড় বানিজ্যিক জাহাজ।নদীর পাড়ে মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে তৈরি হয়েছে গান, কবিতা, উপন্যাস ও চলচ্চিত্র। তবে সেসব এখন অতীত। বাংলাদেশ এখন নদী বিপর্যয়ের দেশ। দেশের আড়াই শতাধিক ঐতিহ্যবাহী,নান্দনিক নদ নদী মরে গেছে। অনেকগুলো বেদখল হয়েছে। অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে। এভাবেই দেশের প্রায় ৯৯% নদী তাদের নাব্যতা, গভীরতা, আকার আকৃতি হারাচ্ছে। বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ। হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য।

নাব্যতা সংকট, স্বাভাবিক গতিপথে কৃত্রিম বাঁধার সৃষ্টি, বুকে পলি জমা, অবৈধ দখলধারীর আগ্রাসন, আবর্জনা ফেলে দূষণ, পাড় ভরাট, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণসহ নানা কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বৃহত্তর সিলেট জেলার অর্ধশত নদ-নদী। ইতোমধ্যেই দৃশ্যপট থেকে বিলিনের পথে পাবিজুড়ি নদীটি। অধিকাংশ নদীই নানা সংকটে মৃত্যুর দুয়ারে দাড়িয়ে অন্তিম যাত্রার প্রহর গুণছে। আবার শেষ মূহুর্তে সভ্যতাকে আরও কিছু সেবা দিয়ে যাবার প্রত্যাশায় যেনো বাঁচার আকুতিও জানাচ্ছে নদীগুলো।
নদীকে ঘিরেই বিশ্বের প্রতিটি শহর,বন্দর,গঞ্জ,বাজার প্রভৃতি গড়ে উঠেছে। মালামাল পরিবহন ও যোগাযোগের সহজ উপায় হলো নৌকা। মালামাল পরিবহনে খুবই স্বল্প খরচে নৌকার জুড়ি মেলা ভার। যিনি নৌকা চালান তিনি মাঝি হিসেবে চিহ্নিত। একসময় নৌকায় পাল তোলা থাকতো। সময়ের বিবর্তনে এর স্থান দখল করেছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা।

দেশের নদীগুলো যে হারে দখল ও দূষণের শিকার হচ্ছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে একটি ঊষর প্রান্তরে পরিণত হবে। পৌষেই খাল শুকিয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে শুকাতে থাকে নদী ও বিল। এ অবস্থায় দেশীয় মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে বোরো ধানের চাষে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। আবার অনেকস্থানে ভরাট হয়ে অস্তত্বি হারিয়ে ফেলছে নদী। আবার শিল্পবর্জ্য প্রবেশের কারণেও অনেক নদীর বিপন্নদশা।

দেশের বেশির ভাগ মানুষের জীবন, জীবিকা ও সার্বিক উন্নতি নির্ভর করে নদীর ওপর।এ কারণে নদী সমস্যাকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ দেশের নদী বাঁচলে,মানুষ বাঁচবে। অর্থাৎ দেশের মধ্যে প্রবহমান অন্যান্য নদ-নদীর মতো পাবিজুড়ি নদীকে বাঁচাতে সরকারের পাশাপাশি সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। নদীকে ঘিরেই শুরু হয়েছে আমাদের এই বঙ্গে বসবাস। এই বঙ্গের নদীকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে আমাদের জীবনের বেঁচে থাকার আবাসভূমি।যুগে যুগে এই নদীর তীরে গড়ে ওঠেছে আমাদের এই সভ্যতা,সাংস্কৃতিক গড়ন ও কৃষিপত্তন। মানব সভ্যতার বেশিরভাগ পটভূমির পত্তন ঘটেছে নদ-নদীর শুশ্রুষায়। প্রাচীন সভ্যতা মাত্রই নদীকেন্দ্রিক।অর্থাৎ সভ্যতামাত্রই বিকাশ ও বিস্তার লাভ করেছে নদ-নদীর জলধারাকে কেন্দ্র করে। কারণ প্রধানত জীবনধারণের জন্য এবং কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজন পানি। তাই দেশের অন্যান্য নদীর মতো বাথাইল নদীকে বাঁচাতে আমাদের সকলের তৎপর হতে হবে। কারণ নদী বাঁচলে বাচবে দেশ,গড়বো সোনার বাংলাদেশ। উন্নতি হবে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ(কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান),সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব, গবেষক,শিক্ষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম