কারাতে হলো একটি শিল্প কৌশল ও আত্মবিশ্বাস


মোঃ আলতাফ হোসেন ঃঃ
সমস্ত সম্পদের মধ্যে স্বাস্থ্য অন্যতম তাই একজন মলিন মুচি একজন রোগা রাজা অপেক্ষা অধিকতর ভালো। শরীরে কোনো রকম রোগ বা দুর্বলতা না থাকলেই তাকে স্বাস্থ্য বলে। স্বাস্থ্য মানুষের অমূল্য সম্পদ। স্বাস্থ্যহীন লোকের ন্যায় অসুখী জগতে আর কেউ নেই। নিস্তেজ ও কীটনাশক বৃক্ষ হতে যেরূপ কোনো সুফল লাভের আশা করা যায় না, সেরূপ দুর্বল ও রুগ্ন ব্যক্তির দ্বারা সংসারে কোনো হিত সাধন হয় না। সে সর্বদা নিজের শরীর নিয়েই ব্যস্ত থাকে। পক্ষান্তরে স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি পর্ণ কুটিরে বাস করে এবং তৃণ শয্যায় শয়ন করেও সুখী। সে সকল কাজে আনন্দ, উৎসাহ পায়। তার মন সর্বদা প্রফুল্ল থাকে। স্বাস্থ্যবান দরিদ্র ব্যক্তি স্বাস্থ্যহীন ব্যক্তির চেয়ে শত গুণে সুখী। ব্যক্তিকে নিয়েই সমষ্টি, ব্যক্তির সমবায়েই গড়ে ওঠে দেশ ও জাতি। কাজেই জাতীয় জীবন জীবনেরই সামগ্রিক যোগফল। একদল ব্যক্তির জীবনে খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, চিকিৎসা ও শিক্ষা জীবনধারণের অত্যাবশ্যকীয় বিষয় বলে বিবেচিত।

কিন্তু সভ্য মানুষ শুধু মাত্র দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে পরে কোনোমতে মাথা গুজে বেঁচে থাকতে চায়না। সে চায় জীবনে পরিপূর্ণ সুখ ও শান্তি, নির্মল আনন্দ। নিরুদ্বেগ প্রশান্ত সুন্দর জীবন খেলাধুলা মানুষের জীবনে এই আনন্দ ও সুখের অন্যতম নিয়ামক ও শরীর গঠনের রক্ষা কবজ ফুটবল ক্রিকেটের মতো জনপ্রিয় আরেকটি খেলার নাম কারাতে। প্রিয় পাঠক আসুন কারাত সম্পর্কে কিছু জেনে নেই-কারাত আর্ট খালি হাতে খেলার একটি পদ্ধতি। এই খেলায় খেলোড়াররা কোনো রকম অস্ত্র ব্যবহার করেন না। অর্থাৎ প্রতিযোগীকে খালি হাতে লড়তে হয়। খালি হাতে শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য কারাতে মানুষকে রক্ষা করে।

কারাতে শিক্ষা একজন খেলোড়ারকে অতিপটু করে তুলতে পারে বলেই খেলোড়ারদের মধ্যে গড়ে ওঠে অতিরিক্ত আত্মবিশ^াস।আর আত্মবিশ^াসই সাফল্যের অর্জনের রহস্য গৃঢ়তত্ত্ব। কারাতে খেলাটি শারীরিক যোগ্যতার সাথে সাথে মানসিক বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভরশীল। ধরে নেয়া হয় এই আত্মরক্ষামূলক কৌশলকে কাজে লাগাতে শরীরকে যোগ্যতার প্রয়োজন ৪০% এবং বুদ্ধির প্রয়োজন ৬০%।বিকেএসপিতে কারাতে বিভাগ শুরু হয় ২০১১ সালে। ১২ জন শিক্ষার্থী এবং ১ জন প্রশিক্ষক দিয়ে। এই খেলা বরিশাল আঞ্চলিক কেন্দ্রে শুরু হয়। ১ বছর অনুশীলন করার পর তারা বরিশাল বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয় । ভারতে শুরু হয় এ খেলা ৩য় শতাব্দীতে। কিন্তু এর শুরু এবং বিশ শতকের খেলার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এটি একটি আত্মরক্ষামূলক কৌশল। এটি চীনে শুরু হয়েছিল দু’জনের মধ্যে যুদ্ধ বা মারামারি করার কৌশল হিসেবে। এই মারামারির কৌশল থেকে কারাতে শিক্ষণের শুরু হয়েছিল, যেটির নাম বর্তমান নাম কংফু। ব্রুসলি এই কারাতে খেলার জন্য পৃথিবী বিখ্যাত ছিলেন। কারাতে শিক্ষার্থীর প্রশিক্ষণ শুরু হয় হোয়াাইট বেল্ট দিয়ে । এবং শেষ হয় ব্লাক বেল্ট দিয়ে। আর এ খেলায় ব্লাক বেল্ট হলো সর্বোচ্চ সম্মানসূচক বেল্ট। কারাতের ভেতর মোট সাতটি বেল্ট রয়েছে যা প্রশিক্ষণার্থী তার অনুশীলন, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে অর্জন করে নেয়।

একজন প্রশিক্ষার্থীর প্রশিক্ষণের শুরুতে প্রথমে ছালাম, বো ও কিবাডাসি এর মাধ্যমে ক্লাশে শুরু হবে। তার পর একটু ওয়ানআপ করে নিতে হয় । হাতও পায়ের ব্যায়াম করে নিলে ভাল। কিছুক্ষণ ব্যায়ামের পর তারপর শিক্ষার্থী তাঁর দক্ষতা ও কৌশল দিয়ে রপ্ত করে নেবে প্রতি লেসন কোমড়ের দু’পাশে হাত রেখে দু’পা হাটু ভেঙ্গে দাঁড়ানোর নাম কিবাডাসী। কিবাডাসী হলো কারাতের দাঁড়ানো একটি পজিশনের নাম। আর এ কিবাডাসী অবস্থায় অর্থাৎ হাটু ভেঙ্গে যখন দু’হাত কোমড়ের দু’পাশে থাকে তখন পায়ের এবং হাটুর শক্তি বৃদ্ধি পায় সেই সাথে যখন প্রতিপক্ষকে সোডনসখী অর্থাৎ সিঙ্গেল পাঞ্চ করে তখন ঘুসির ওজন অনেক বেড়ে যায়। অর্থাৎ স্বাভাবিক অবস্থায় একটি ঘুষি মারলে যতটুকু শক্তি না পাওয়া যাবে তার চেয়ে অধিক শক্তি তৈরি হবে যখন প্রশিক্ষণার্থী কিবাডিসী থেকে সোডনসখী মারবে। একজন প্রশিক্ষনার্থী কিবাডিসী থেকে সোডনসখী মারবে। আর সোডন সখীর মাধ্যমে একজন প্রশিক্ষার্থীর পেশীর শক্তি বৃদ্ধি পায়। সোডনসখী মারার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে হাতের ও পায়ের পজিশন ঠিক থাকে এবং বুক টান থাকবে, ঘাড় বা মাথা লড়বেনা সোজা থাকবে। যখন ডান হাত সোডন সখী মারা হবে তখন বাম হাত কোমড়ে মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায় থাকবে। আবার যখন বাম হাতে মারবে তখন ডান হাত কোমড়ে থাকবে। প্রথমে সোডন সখী অর্থাৎ সিঙ্গেল পাঞ্চ। হাতগুলো পুরোপুরি মুষ্টি করে বৃদ্ধা আঙ্গুলটি শাহাদত, মধ্যমা, অনামিকা, তর্জনির মাঝখানে থাকবে। তারপর মুষ্টিবন্ধ হাত দুটি কোমড়ের দু’পাশে রেখে প্রথমে ডান হাত সজোরে কোমড় থেকে সোজা বুক বরাবর মারতে হবে মুষ্টি দ্বারা। কোমড় থাকা হাতটি ঘুরে সোজা সজোরে পাঞ্চ করতে হবে।

এভাবে দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষনার্থী ধারাবাহিকভাবে রপ্তকেরণের প্রতিটি লেসন পর্যায়ক্রমে শিক্ষার্থীকে তার ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী সোডন সখী প্রতিনিয়ত অনুশীলনের মাধ্যমে বাড়ানো যেতে পারে। যত বেশি নিষ্ঠার সাথে প্রশিক্ষণ নেবে তত পারফেক্ট হবে তার প্রতিটি কৌশল। এ বিদ্যার দৈহিক শক্তি কৌশলের সাথে থাকা চাই উপস্থিত বুদ্ধি। যা বেশি উপকারে আসে। খেলা হিসেবে কারাতে দর্শকদের কাছে আকর্ষণীয় বটে। আর একজন খেলোয়াড়ের কাছে কারাতে হচ্ছে শারীরিক ফিটনেসের রক্ষা কবজ। একজন ভাল প্রশিক্ষক যতকানা প্রশিক্ষনার্থীর প্রতিটি কৌশল আয়ত্বে না আসবে অর্থাৎ পারফেক্ট না হবে ততক্ষণ প্রশিক্ষার্থীর পরবর্তী লেসন পাবে না।

একজন শিক্ষার্থী ব্লাক বেল্ট পেলেই তাকে প্রশিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ১৯৭০ সালে যখন মি. পারভেজ মিস্ত্রি জাপান থেকে ভারতে ফিরে আসেন তখনই ভারতে খেলাটি পুনজন্ম লাভ করে। তাঁর প্রশিক্ষণেই ভারতের ৯৫% খেলোয়াড় কারাতে খেলায় প্রশিক্ষিত হয় এবং তিনি এখনো ভারতে কারাতে জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। কারাতে খেলায় প্রধান কৌশলগুলো হলো স্ট্্রাইকিং কিকিং এবং পঞ্চিং এগুলো করা হয় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ দিয়ে, এখানে শরীরের বিভিন্ন অংশই অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধ করার প্রধান অস্ত্রই হলো হাত এবং পা। একজন ব্লাক বেল্ট প্রাপ্ত ব্যক্তি হাত অথবা পা দিয়ে ১৫০ কেজি ওজনের বরফের টুকরো অথবা একটির উপর একটি রাখা তিনটি ইট ভাঙতে পারবে। দর্শকরা এটাকে মনে করেন একটি কৌশল কিন্তু একজন প্রশিক্ষণার্থী কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমেই এই যোগ্যতা অর্জন করে থাকে। একজন প্রশিক্ষণরত কারাতে খেলোয়াড়দের কিছু সুবিধাও রয়েছে। সে নিজের ওপর আত্মবিশ^াস ও সাহস নিয়ে শহরে চলাফেরা করতে পারে। নিজেকে রক্ষা করার কৌশল হিসেবে অসংখ্য মহিলা সারা পৃথিবীতে এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। পুরুষের শক্তির সাথে পেরে ওঠার এটাই মহিলাদের একমাত্র উপায়। গোটা পৃথিবীতে পুলিশ ও আর্মিদেরকেও এখন কারাতে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

কারাতে ও অন্য খেলার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এখানে বয়সের বিষয়টি মোটেই বিবেচ্য নয়। অপেক্ষাকৃত বেশি বয়স্ক শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন কৌশল শিখতে পারে। এগুলো তারা তাদের বুদ্ধির মাধ্যমে সে অর্জন করে থাকে। কারাতে হলো একটি শিল্প কৌশল, আত্মবিশ^াস এবং প্রতিপক্ষকের আক্রমণ বা আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার একটি উপায়।আজ সারা বিশ^ জুড়ে কারাতে জয় জয়কার। বিশেষ করে আত্মরক্ষার কথা ভেবে সবাই এর প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। শুধু তাই নয়, শারীরিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এর কোনো জুড়ি নেই। কারাত হলো সুস্থ সবল ও সুন্দর শরীর গঠনের রক্ষাকবজ।

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট


শিরোনাম