এলেম হচ্ছে শাসক এবং ধন সম্পদ তার অধীনে শাসিত


মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
এলেম শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জানা। কিন্তু প্রত্যেকটি বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত জানা বা বুঝার শ্রেণিভেদ এবং মনীষার প্রকারভেদ পৃথক পৃথক হয়ে থাকে। আর আম্বিয়ায়ে কেরামের সহযোগে যখন এর ব্যবহার হয়, তখন প্রকৃতই আল্লাহর তৌহিদ, জাত ও সিফাত, দ্বীন ও শরীয়তের আহকাম এবং চারিত্রিক শিক্ষাকে বুঝানো হয়। জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমান পুরুষ ও নারীর অবশ্য কর্তব্য। (ইবনে মাজাহ) হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, বিদ্যা লাভের জন্য যদি সুদূর চীনেও যেতে হয় তবে সেখানে যাও।

ধন সম্পদ এটাও আল্লাহ্ তা’য়ালার নেয়ামত। এলম এটাও আল্লাহ্ তা’য়ালার নিয়ামত। তবে ধনসম্পদের চেয়েও এলম হলো অনেক উত্তম নেয়ামত। কারণ ধনসম্পদ দিয়েছেন আল্লাহ্ তা’য়ালা ফেরআউনকে, নমরুদকে আর কারুনকে আর এলম দিয়েছেন আল্লাহ্ তা’য়ালা সম্মানিত নবী রাসূলগনকে। এ ছাড়াও সম্পদের কিছু খারাপ প্রভাব আছে- এলেম মানুষকে দয়াবান বানায় কিন্তু সম্পদ মানুষকে জালেম বানায়।এলম মানুষকে দানশীল বানায় কিন্তু সম্পদ মানুষকে কৃপন বানায়। এলম মানুষকে সততা শিখায় কিন্তু সম্পদ মানুষকে ধোকাবাজী শিখায়। এলেম মানুষকে ভদ্রতা শিখায় কিন্তু সম্পদ মানুষকে অভদ্রতা শিখায়। এলম মানুষকে জান্নাতী বানায় কিন্তু সম্পদ মানুষকে জাহান্নামী বানায়।

অনেক আম্বিয়া সম্পর্কে এলেমের হুকুমদানের বিষয়টিরও উল্লেখ রয়েছে। হুকুমের আভিধানিক অর্থ ফায়সালা করা এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করা। উর্দু ভাষায় যার অর্থ বুঝ-জ্ঞানের ফল বলে ধরে নেয়া যায়। ইমাম রাগেব ইস্পাহানী মুফরাদাতুল কোরআনে লিখেছেন, কোনো বস্তুর ওপর হুকুম করা, এই ফায়সালা করা যে এই বস্তুুটি এরূপ অথবা এরূপ নয়, চাই এই ফায়সালাকে তুমি অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে পার অথবা না পার। আরবী অভিধানের বিখ্যাত কিতাব ‘লিসানুল আরবে’ আছে, হুকুমের অর্থ হচ্ছে, জ্ঞান-বুদ্ধি এবং ন্যায়ানুগ ফায়সালা করা।

এলেম অর্জন এর গুরুত্ত্ব ও ফজীলত অপরিসীম। ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (আল-কোরআন)। এ পড়ার আদেশ মহান আল্লাহ তা’য়ালা দিয়েছেন। সর্বপ্রথম ঐশীবাণী,পবিত্র আল-কোরআন মাজীদের সর্ব প্রথম আয়াতের মধ্যে মহান আল্লাহ তা’য়ালা প্রথমে বললেন, ‘পড়’। তারপর বললেন ‘তোমার প্রভুর নামে’ তারপর সেই মহান প্রভুর পরিচয় তুলে ধরলেন যিনি সৃষ্টি করেছেন তাহলে এখানে পড়ার আদেশ হয়েছে আল্লাহর নামে। আল্লাহ কোন আল্লাহ? এর জবাবে আল্লাহ বলে দিলেন বা জানিয়ে দিলেন যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। হিন্দু-খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মের লোকেরা একাধিক আল্লাহতে বিশ্বাসী। তাই তাদের উদ্দেশ্যেও বললেন যে, যার সারমর্ম হলো তোমাদের প্রতিমাকে তোমাদের হাতে বানিয়েছ কিন্তু সে প্রতিমা তোমাদেরকে সৃষ্টি করে না। তাই এ জগতের সৃষ্টিকারী প্রভু, রিযিকদাতাসহ এক আল্লাহ ,দ্বিতীয় কোনো খোদা বা উপাস্য নেই। এ আল্লাহ সর্ব শক্তিমান। তাই প্রথমে আমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হবে। অন্য আয়াতের মাঝে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন ‘পরম দয়াময় আল্লাহ যিনি পবিত্র কোরআনের শিক্ষা দান করেছেন, মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। তার মনের কথা ব্যক্ত ও ব্যাখ্যা করার শক্তি দান করেছেন এবং চন্দ্র-সূর্য তারই হিসেব ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আপন আপন গতিতে নিয়োজিত রয়েছে এবং তারকারাজি- ও তরুলতা সবই তাঁর সেজদায় রত। (সূরা আর রহমান)।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আল্লাহ তা’য়ালা আমার নিকট ওহী পাঠিয়েছেন, যে ব্যক্তি এলেম তলবের উদ্দেশ্যে কোনোপথ অবলম্বন করবে, তার জন্য আমি জান্নাতের পথ সহজ করে দিব এবং যে ব্যক্তির দুই চক্ষুআমি নিয়ে গিয়েছি, তাকে এর পরিবর্তে আমি জান্নাত দান করবো। এবাদত অধিক হওয়া অপেক্ষা এলেম অধিক হওয়া উত্তম। দ্বীনের (তথা এলেম ও আমলের) আসল হচ্ছে -সন্দেহের জিনিস হতে বাঁচিয়ে থাকা। (বায়হাকী, আবুল ঈমান)
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এলমে দ্বীন হাসিল সবচেয়ে উত্তম ইবাদত। বরং এটি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার তুল্য। বিশেষতঃ আমাদের বর্তমান সময়ে যে সময় মুসলিম সমাজে বিদআতের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবং ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হচ্ছে। এলেম ছাড়া ফতোয়া দেয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক লোক না জেনে তর্কে লিপ্ত হচ্ছে। মুসলিম যুব সমাজের ওপর এ তিনটি কারণ এলম অর্জনে এগিয়ে আসাকে অনিবার্য করে দেয়।

বস্তুত এলম হচ্ছে আল্লাহ তা‘য়ালার সিফাত বা অনন্য গুণাবলিসমূহের একটি, যা ইলমের মর্যাদাকে সমুন্নত করেছে। এলেমের আভিধানিক ও পারিভাষিক সংজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পূর্বসূরীগণ এর অন্তর্নিহিত একটি সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন। যেই সংজ্ঞায় এলেমের প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং প্রকৃত এলেমের আলামত ফুটে ওঠে। যেমন, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বলতেন,‘বেশি বর্ণনা করা ও অধিক পরিমাণ আক্ষরিক জ্ঞান হাসিল করার নাম এলেম নয়, বরং এলেম হচ্ছে আল্লাহ তা‘য়ালার ভয়ের নাম।’ ইমাম মালেক (রহ.) বলতেন, ‘হেকমত ও আমল হচ্ছে একটি নূর। যা দ্বারা আল্লাহ তা‘য়ালা যাকে ইচ্ছা তাকে পথ দেখান। আর বেশি বেশি মাসআলা জানার নাম এলেম নয়। এর একটি আলামত আছে। তা হচ্ছে, এলেমের বদৌলতে প্রতারণার এই জগত থেকে নিজেকে দূরে রাখা এবং চিরস্থায়ী জগতের দিকে ধাবিত হওয়া।’ ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলতেন,‘এলেম হচ্ছে আমলের নাম। আর আমল হলো স্থায়ী জগতের স্বার্থে ক্ষণস্থায়ী জগত পরিহার করা।’

যে সকল আম্বিয়াদের ওপর কিতাব নাযিল হওয়ার প্রমাণ নেই তাদেরকে এলেম এবং হুকুমদান করা হয়েছিলো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, অহীয়ে কিতাব ছাড়া অন্য কোনো উপহার এলেম এবং হুকুমের প্রতিই ইঙ্গিতবহ। সুতরাং হযরত ইউসুফ (আ:)-এর শানে বলা হয়েছে, “এবং যখন ইউসুফ (আ:) যৌবনে পদার্পণ করলেন, তখন আমি তাকে হুকুম এবং এলেম দান করলাম।” (সূরা ইউসুফ : রুকু-৩) হযরত লুত (আ:) সম্পর্কে বলা হয়েছে, “লুতকে আমি হুকুম এবং এলেম দান করেছি।” (সূরা আম্বিয়া : রুকু-৯)
হযরত ইবরাহীম (আ:) তৌহিদের ওপর প্রমাণ উপস্থাপন করে স্বীয় পিতাকে বললেন, হে আমার পিতা! আমার কাছে এলেমের ঐ অংশ এসেছে, যা আপনার কাছে নেই। (সূরা মরিয়াম : রুকু-৩) হযরত খিজির (আ:) সম্পর্কে বলা হয়েছে, আমি নিজের নিকট হতে তাকে শিক্ষা দিয়েছি। (সূরা কাহাফ : রুকু-৯)

মহান আল্লাহ পাকের নিকট হতেই সবকিছু নির্বাহ হয়। তাহলে নিজের নিকট হতে শিক্ষা দেয়ার অর্থ কি? প্রতিটি বস্তু যা মানুষের স্বকীয় পরিশ্রম, চেষ্টা গবেষণা ইত্যাদি মামুলী উপকরণাদি ছাড়া অর্জিত হয়, সেগুলোকে আল্লাহর নিকট হতে প্রাপ্ত বলা হয়। অনুরূপভাবে আল্লাহর নিকট হতে এলেম দান করার অর্থ হচ্ছে, সে জাতীয় জ্ঞানলাভ করা যা মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞানোপকরণ, প্রমাণ উপস্থাপন এবং চিন্তা ও পরিশ্রম ছাড়া অর্জিত হয় এবং তাই আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান। আর একারণেই সুফিয়ায়ে কেরামের পরিভাষায় একে এলমে লাদুন্নী বলা হয়। আর হযরত দাউদ (আ:) ও সুলাইমান (আ:) সম্পর্কে বলা হয়েছে, “এবং আমি দাউদ ও সুলাইমান (আ:)-কে জ্ঞানদান করেছি।” (সূরা নমল: রুকু-২)

হযরত ইউসুফ (আ:)-এর নবুওতের শুভলগ্নে এরশাদ হয়েছে, “এবং এভাবেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে মর্যাদাশীল করবেন, এবং তোমাকে স্বপ্ন-রহস্য সংক্রান্ত বাক্যাবলী শিক্ষা দিবেন এবং তোমার উপর স্বীয় পুরস্কার পরিপূর্ণ করবেন।” (সূরা ইউসুফ : রুকু-১০) তবে এই আয়াতে এই এলেমের কথা উল্লেখ নেই যার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে সময় নির্ধারিত অহী। কেননা এখানে কালামের পূর্বানুসৃতির দ্বারা একবারেই এলেম দান করার কথা ব্যক্ত হয়েছে যা সব সময় নির্ধারিত অহীর শান হতে পারে না। বিশেষ করে আয়াতের শেষাংশে বাক্যাবলীর বিশ্লেষণসূচক জ্ঞান একবারে দেয়ার কথাই ব্যক্ত হয়েছে। এ জন্য হযরত ইউসুফ (আ:) একটি স্বপ্নের তাবীর বয়ান করে অপর একস্থানে বলেছেন, এটা ঐ জ্ঞান, যা আমার প্রতিপালক আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন। (সূরা ইউসুফ : রুকু-৫) একথা কোথাও বলা হয়নি যে, স্বপ্নের ব্যাখ্যা করার সময় তাঁর উপর অহী অবতীর্ণ হয়ে এর হাকীকত বিশ্লেষণ করে দিয়ে ছিলো। বরং ঐ সময়ে জন্য তার মাঝে সেই জ্ঞানশক্তি আল্লাহ অর্পণ করেছিলেন। এটা ঐ শ্রেণির জ্ঞান যার সম্পর্কে কোনো কোনো আম্বিয়াকে শৈশব অবস্থায়ই আলীম বা জ্ঞানী বলে সম্বোধন করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, “এবং ফেরেশতাগণ তাঁকে এক বড় জ্ঞানী সন্তানের খোশ-খবরী দান করলেন।” (সূরা যারিয়াত : রুকু-২)

এলেমের ফজিলত অপরিসীম। যদিও এ সামান্য কলম খোচায় লেখা সম্ভব নয়। তবুও একটু স্মরণ করে দেয়া ছাড়া আর কি? আল্লাহর নবী (সা.)-এর অমূল্য বাণী যদি কেহ জানে তাহলে সে বানী অপরের কাছে পৌঁছে দেয়ার তাগিদ দিয়ে নবী(সা.)বলেছেন, ‘আমার পক্ষ হতে মানুষকে পৌঁছাতে থাক, যদিও একটি মাত্র আয়াত হয়।’

হাদিস শরীফ লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো রাসূল (সা.) এলেমের কতটুকু গুরুত্ব প্রদান করেছেন-মেশকাত শরীফের ২০৭ নং হাদিসে ইবনে মাজাহ শরীফ থেকে সংগৃহীত হাদিসে এসেছে হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন; এলেম তলব করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। এলেম কোন এলেম ? এ এলেম হচ্ছে দ্বীনি এলেম। দ্বীনের জ্ঞান তলব করা যেমন আল্লাহ রাসূল, ফেরেশতা, পরকাল, কবর, হাশর, নামাজ, রোযা, হজ্জ, যাকাত, তাহারাতসহ ইসলামের প্রয়োজনীয় বিষয়ে এলেম তলব করা ফরয। এলমে দ্বীনের গুরুত্ব যদি আমরা অনুধাবন করি তাহলে দেখা যাবে একজন মুসলমানের এলমে দ্বীন তাদের জীবনের প্রতিট্ িক্ষেত্রে বিদ্যমান। এক্ষেত্রে এলেমকে দুই ভাগে ভাগ করি। (১) এলমে দ্বীন (২) এলমে দুনিয়া। এলমে দ্বীন বলতে দ্বীনের জ্ঞান। আর এলমে দুনিয়া বলতে দুনিয়াতে জীবন-যাপনের জন্য যে সকল বিদ্যার প্রয়োজন, যেমন ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিসহ দুনিয়াবী কাজ-কর্ম। এখানে এলমে দুনিয়া তলব করা হারাম নয়। তবে হারাম কাজের জ্ঞান শিক্ষা করাও হারাম। এলমে দুনিয়া তলব করে সে হিসেবে চলতে গেলে দেখতে হবে সে যেন দুনিয়ার না হয়ে পড়ে। সকল ক্ষেত্রে এলমে দ্বীনের গুরুত্ব অপরিসীম।

আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর কল্যাণ কামনা করেন তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন। আর এ জ্ঞানের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তা’য়ালা আর নবী (সা.) হচ্ছেন সে জ্ঞান বণ্টনকারী। এ প্রসঙ্গে হাদিসে উল্লেখ হযরত মুআবিয়া (রা.) বলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তা’য়ালা যার কল্যাণ কামনা করেন, তাকে দিনের সুষ্ঠু জ্ঞান দান করেন এবং আমি হচ্ছি বণ্টনকারী আর দান করেন আল্লাহ। (বুখারী ও মুসলিম শরীফ)

অন্যত্র বর্ণিত আছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, একজন ফকীহ (আলেম) শয়তানের কাছে হাজার আবেদ অপেক্ষাও মারাত্মক। (তিরমিজী ও ইবনে মাজাহী) এ হাদিসের মাঝে অপাত্রে ইলম স্থাপন-এর অর্থ হচ্ছে বেয়াদব কায়দায় যারা তারা ঐ শূকরের মত যার গলায় স্বর্ণের হার পরানো হবে। আর শূকর যেমন স্বর্ণের হারের মর্যাদা বুঝবে না ঠিক তেমনি এ জাতীয় মানুষও তাই। এলেম অর্জনকারীর ফজীলত অফুন্ত।

হযরত আবু সাইদ (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, মু’মিন কখনো এলেম শ্রবণে তৃপ্তি লাভ করতে পারে না যে পর্যন্ত না তার পরিণাম বেহেশত হয়। (অর্থাৎ, সে আমরণ এলেম তলব করে আর ইহা তাকে বেহেশতে নিয়ে পৌঁছায়) (তিরমিজী শরীফ) মেশকাত শরীফ, হাদিস নং- ২১১)

হযরত হাসান বসরী (র.) হতে ম্যুরসাল রূপে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যার মৃত্যু এসে পৌঁছেছে এমন অবস্থায় যখন সে ইসলামকে জিন্দা করার উদ্দেশ্যে এলেম তলবে মশগুল আছে, বেহেশতে তাহার ও নবীদিগের মধ্যে মাত্র এক ধাপের পার্থক্য থাকবে। (অর্থাৎ সে নবীদিগের অতি নিকটে থাকবে। (দারেমী শরীফ)

এলমের গুরুত্ব অপরিসীম এবং এলেমের ফজীলত ও অত্যাধিক। তবে এলেমের পাহারাদার তারাই হলেন আলেমরা। আর আল্লাহ তা’য়ালা ও আলেমের ব্যাপারে বলেন যে, আলেমরা আমাকে বেশি ভয় করে। আল্লাহ তা’য়ালাও আলেমদের মর্যাদা দিয়েছেন। এলেমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে আদব। কেননা আদবের মাধ্যমে অনেক কিছু অর্জন করা যায়। আর বেয়াদবির কারণে জীবনের সকল বিষয় বরবাদ হয়ে যাবে।

হযরত ওয়াসেলা ইবনে আসকা (রঃ) বলেন, রাসূলুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এলেম তলব করেছে এবং উহা লাভ করতে পেরেছে তার জন্য দুইগুণ পারিশ্রমিক (সওয়াব) রয়েছে। আর যদি উহা লাভ করতে না পেরেও থাকে তাহলেও তার জন্য একগুণ পারিশ্রমিক রয়েছে। (অর্থাৎ, চেষ্টার সওয়াব) দারেমী শরীফ, মেশকাত শরীফ, হাদিস নং- ২৩৬)

আল্লাহ তা’য়ালার মহান সত্তা হইতে সরাসরি উপকৃত হওয়ার জন্য আল্লাহ তা’য়ালার হুকুমসমূহ মুহাম্মদ (সা.) পদ্ধতিতে পালন করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’য়ালার এলেম অর্জন করা চাই । অর্থাৎ এই বিষয়ে যাচাই করা যে, আল্লাহ তা’য়ালা বর্তমান অবস্থায় আমার নিকট কি চাহিতেছেন । আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন, যেমন, আমি পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্যে একজন রাসূল, যিনি তোমাদের নিকট আমার বাণীসমুহ পাঠ করবেন এবং তোমাদের পবিত্র করবেন; আর তোমাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব ও তাঁর তত্ত্বজ্ঞান এবং শিক্ষা দেবেন এমন বিষয় যা কখনো তোমরা জানতে না। (সূরা বাকারা) আল্লাহ আপনার প্রতি ঐশী গ্রন্থ ও প্রজ্ঞা অবতীর্ণ করেছেন এবং আপনাকে এমন বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন, যা আপনি জানতেন না। আপনার প্রতি আল্লাহর করুণা অসীম। (নিসা)
ফরযে আইন ইলমের প্রথম বিষয় হলো আকীদাতুল ইসলাম। দ্বিতীয় কথা ‘ফারায়েযুল ইসলাম’। কোরআন-হাদীসে আল্লাহ আমার ওপর কী কী জিনিস ফরয করেছেন, একজন মুসলিমের ওপর কী কী জিনিস ফরয এগুলো জানতে হবে। তৃতীয়ত, ইসলাম তার অনুসারীদের ওপর কী কী জিনিস হারাম করেছে? সগীরা গুণাহ, কবীরা গুণাহ সবই তো গুণাহ। হারাম, মাকরূহে তাহরীমী, মাকরূহে তানযীহী সবই তো বর্জনীয়। কিন্তু বর্জনীয়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ কী? হারাম এবং মাকরূহে তাহরীমী। এগুলোর তালিকা আমার জানা থাকতে হবে না? তা হলো- আকীদাতুল ইসলাম, ফারায়েযুল ইসলাম, মাহারিমুল ইসলাম এই বিষয়গুলো। আরেকটি শিরোনাম হচ্ছে ‘আদাবুল ইসলাম’-ইসলামের আদব। কোন ক্ষেত্রে কী আদব-কায়েদা ইসলাম জানিয়েছে এগুলো শিখে ফেলতে হবে।

প্রথমেই ঈমান, ইসলাম শিখতে হবে। এই শেখাটার প্রথম স্তর হলো ফরযে আইন এলেম। আপনি যদি বলেন ঈমান শিখব, ইসলাম শিখব- এর মানেই হল যতটুকু এলম ফরযে আইন ততটুকু শিখতে হবে। শেখার দুটি স্তর আছে। এক হচ্ছে, জ্ঞান অর্জন করা, আরেকটা হলো প্রায়োগিক শিক্ষা। যা শিখবেন ওটার প্রয়োগ করার অনুশীলন করতে হবে। শুধু জ্ঞান অর্জন করলাম তাহলে এই শেখা পরিপূর্ণ হলো না। ফরযে আইন যতটুকু এলম, এর মধ্যেও দুটি স্তর আছে। একটা হলো, জ্ঞান অর্জন আরেকটা হলো, সেটার প্রায়োগিক শিক্ষা-অনুশীলন। তাহলে ফরয আদায় হবে।

আল্লা তা’য়ালা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একটি মহান উদ্দেশ্যে। আর তা হলো, মানুষ কেবল এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং গাইরুল্লাহর ইবাদত বর্জন করবে। আর আল্লাহর ইবাদত করতে এবং গাইরুল্লাহর ইবাদত বর্জন করতে হলে বান্দাকে জানতে হবে যে, কোনটি আল্লাহর আর কোনটি গাইরুল্লাহর ইবাদত। পাশাপাশি দুনিয়ার জীবনে মানুষের জন্য হক ও বাতিল, হেদায়েত ও গোমরাহির মাঝে পার্থক্য করে হককে গ্রহণ ও হেদায়েতের ওপর অটল-অবিচল থাকা অত্যন্ত জরুরি ও আবশ্যকীয়। আর এ আবশ্যকীয়তা ও প্রয়োজন পুরা করার জন্য প্রত্যেকের যথেষ্ট পরিমাণ দীনের এলম বা জ্ঞান থাকা দরকার।

কোরআনের পাশাপাশি অসংখ্য হাদিসের মাঝে এলেমের গুরুত্বের কথা বিবৃত হয়েছে। এলেম অর্জনের সীমাহীন গুরুত্বের কারণে মহানবী (সা.) তাঁর সব উম্মতের ওপর এলেম অর্জন বাধ্যতামূলক ও আবশ্যক করে দিয়ে এরশাদ করেছেন, ‘এলমে দীন শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরয।’ (বুখারি শরিফ )

আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কোরআনে এ এলম অর্জনের প্রতি জোর তাকিদ দিয়েছেন। এরশাদ করেছেন, ‘আর মু’মিনদের সবার জন্য একসঙ্গে বেরিয়ে পড়া যেহেতু সম্ভব নয়, তাই প্রত্যেক বড় দল থেকে একটি উপদল কেনো বের হয় না, যাতে তারা এলমে দীন শিক্ষা করবে এবং (শিক্ষা সমাপ্ত করে) ফিরে এসে তারা তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করবে, যাতে তারা বিরত থাকে।’ (সুরা তওবা : আয়াত-১২২)

অন্য এক হাদিসে এলম অর্জনের নির্দেশ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা এলমে ফরায়েজ ও কোরআন শিক্ষা করো। কেননা আমাকে উঠিয়ে নেওয়া হবে।’ (তিরমিজি) এলমের গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্গে এলেমের ফজিলতও সীমাহীন।
আল্লাহ তা’য়ালা অন্যত্র আরও এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ যাকে চান হিকমত দান করেন। আর যাকে হিকমত দান করা হয়েছে, তাকে প্রভূত কল্যাণ দেওয়া হয়েছে।’ সুরা বাকারা : ২৬৯।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.)বলেন, ‘মানুষ যখন মারা যায় তখন তিনটি আমল ছাড়া তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়। আমল তিনটি হচ্ছে চলমান সাদাকা, এমন এলম, যা দ্বারা (অন্যরা) উপকৃত হয় তথা এলমে নাফে‘ এবং নেক সন্তান, যে মৃতের জন্য দু‘আ করে।’ (মুসলিম: ১৬৩১)

দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ীত্ব, আখেরাতের অবশ্যম্ভাবিতা এবং করণীয় সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত বলে স্বয়ং আল্লাহ তা‘য়ালাই তাদেরকে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। কারূনের সীমাহীন ধন-সম্পদ দেখে সাধারণ মানুষের চোখ যখন ধাঁধিয়ে গিয়েছিলো এবং সবাই এই পাপীর মতো সম্পদের প্রাচুর্য্য কামনা করছিল তখন বিচক্ষণ আলেমগণ নিজেদেরকে এই ঘৃণিত কামনা থেকে বিরত রাখলেনই, সেই সঙ্গে সাধারণ লোকদের এই কামনাকে চরম ধিকৃত বলে প্রকাশ করলেন। এরশাদ হয়েছে,‘আর যারা জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছিলো, তারা বললো, ‘ধিক তোমাদেরকে! আল্লাহর প্রতিদানই উত্তম যে ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তার জন্য। আর তা শুধু সবরকারীরাই পেতে পারে।’ (সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৮০)

আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মৃত্যুর পর মু’মিনের সঙ্গে যেসব আমল যুক্ত হবে সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে এলম, যা সে অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে এবং যার প্রচার-প্রসার করেছে; পুণ্যবান সন্তান যে সে রেখে গিয়েছে; কোরআন যার সে উত্তরাধিকারী বানিয়েছে; মসজিদ যা সে বানিয়েছে; মুসাফিরদের আশ্রয়কেন্দ্র যা সে নির্মাণ করেছে; নদী যা সে খনন করেছে এবং সাদাকা যে সে নিজ জীবদ্দশায় ও সুস্থতাকালে আপন সম্পদ থেকে দান করেছে-এসব তার মৃত্যুর পর তার সঙ্গে যুক্ত হবে।’ (ইবন মাজাহ্: ২৪২; সহীহ ইবন খুযাইমা: ২৪৯০, শায়খ আলবানী হাদীছটিকে হাসান বলেছেন) ইলমের পথকে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান, দামি ও জান্নাতের পথ বলে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন: আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, (দীর্ঘ হাদীছের অংশ) ‘যে ব্যক্তি এলম অন্বেষণের পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তা‘য়ালা তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।’ (মুসলিম: ২৬৯৯)

কোরআন ও এলেমের মজলিসকে আল্লাহ তা‘য়ালার রহমত অবতীর্ণ হওয়ার কেন্দ্র বলে সুষ্পষ্ট ঘোষণা এসেছে। এ হাদিসেরই পরের অংশে বর্ণিত হয়েছে, আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর যে ঘরে মানুষ একত্রিত হয় এবং তাঁর কিতাব তিলাওয়াত করে এবং পরস্পরে এলেমের দরসে লিপ্ত হয় সেই ঘরে রহমত অবতীর্ণ হয়, ফেরেশতারা সেই ঘরকে বেষ্টন করে নেন এবং আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর আশেপাশে যারা আছেন (ফেরেশতারা) তাদের কাছে তাদের প্রশংসা করেন। (মুসলিম: ২৬৯৯)
ইলমের রাস্তা এমন এক বরকতময় রাস্তা যে, এখানে ব্যর্থতা বলতে কোনো কিছু নেই। এমনকি কোনো ব্যক্তি যদি এলম হাসিল করতে এসে কোনো কারণে ব্যর্থও হয়, তথাপি তার জন্য সাওয়াব রয়েছে। বস্তুত এলমের গভীরতা ও সূক্ষ্ম এলেম হাসিল করতে হলে কষ্ট স্বীকার করতেই হবে।হযরত ওসমান (রা.) বলেন,আমল না থাকলেও এলেম দ্বারা পার্থিব ফায়দা হাসিল করা যায়। কিন্তু এলেম ছাড়া আমল তেমন ফায়দা দেয় না। হযরত আলী (রা.) বলেন, ‘‘সম্পদ পাহারা দিয়ে রাখতে হয়,বিদ্যা বা জ্ঞানকে পাহারা দিতে হয় না,বরং জ্ঞানই তোমাকে রক্ষা করতে পারে।’’ এলেম হচ্ছে শাসক এবং ধন সম্পদ তার অধীনে শাসিত।

প্রজ্ঞা উদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রবৃত্তি মানুষের দাসে পরিণত হয়। আর প্রজ্ঞা যখন মুখ ফিরিয়ে নেয়,তখন মানুষ প্রবৃত্তির গোলামে পরিণত হয়। মু’মিন হতে হলে এলেম জরুরী। অনেকের ধারণা, এলেমের বিষয়টি কেবল ফযীলতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ এলেম হাসিল করা ভালো এবং সওয়াবের কাজ আর না করা দোষণীয় নয় তবে ছাওয়াব ও ফযীলত থেকে বঞ্চিত হওয়ার নামান্তর মাত্র। কিন্তু বিষয়টি কি আদৌ এমন? ফযীলতের মধ্যেই কি এলেম সীমাবদ্ধ নয় বরং একজন মানুষের প্রকৃত মু’মিন হওয়া নির্ভর করে এলেম হাসিলের ওপর। কারণ কোনো ব্যক্তি এলেম হাসিল করা ছাড়া প্রকৃতি মু’মিনই হতে পারে না। কেননা মু’মিন হওয়া নির্ভর করে দুটি বস্তুর ওপর। এক. সে আল্লাহ তা‘য়ালা ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না। দুই. শরীয়ত নির্দেশিতপন্থা ছাড়া ইবাদত করবে না। আর এ দুটিই হচ্ছে তাওহীদের মর্মবাণী।

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,লেখক,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট


শিরোনাম