এলমে লাদুনি বা তাসাউফ ব্যতীত মানবতার আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধিত হতে পারে না

মো. আলতাফ হোসেন ঃঃ
এলমে লাদুনি আরবি শব্দ। এলমে লাদুনি বলতে হচ্ছে আধ্যাত্মিক জ্ঞান, অন্তর্দৃষ্টি খুলে যাওয়া। দিব্য জ্ঞান। মানে আমি চোখ বন্ধ করছি, অন্ধকার। কিন্তু যারা এলমে লাদুনি প্রাপ্ত, এই জ্ঞানের ঐশ^রিক জ্ঞানের অধিকারী তারা চোখ বন্ধ করলে অন্ধকার না। তার কাছে অন্ধকার আর আলো বলে কিছু নেই। আমার আপনার ভাবনার, প্রকৃতির ভাবনার উর্ধ্বে সে। তার কাছে চোখ খোলা রাখলে অন্ধকার বা চোখ বন্ধ রাখলে আলো হতে পারে কিংবা সে যা ভাবছে তাই দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু আমরা তো তা পাচ্ছি না। আমাদের চোখ যে বস্তুর ওপরে আমরা শুধু সে বস্তই দেখছি, ভাবনা যাই থাক।

এলমে লাদুনি, ‘তাসাউফ’ বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান হচ্ছে এমন জ্ঞান যে জ্ঞানের দ্বারা আল্লাহ্কে চেনা যায়, আল্লাহ্কে পাওয়া যায়, আত্মাকে আলোকিত করা যায়। এটি এমন একটি জ্ঞান যে জ্ঞানের দ্বারা সৃষ্টার সাথে সৃষ্টির প্রেমের সম্পর্ক স্থাপিত হয় স্রষ্টাতে সৃষ্টি বিলীন হয়ে যায়, সৃষ্টি স্রষ্টার একত্বে মিশে যায়। ফলে এলমে লাদুনি ‘তাসাউফ’ বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি অজানাকে জানতে পারে অদৃষ্টকে দর্শন করতে পারে। এলমে লাদুনি এমন একটি জ্ঞান যা আল্লাহ্র নিকট থেকো কোনো মাধ্যম ছাড়া সরাসরি লাভ করা যায়। আল্লাহ্র সানিধ্য লাভের জন্য আত্মশুদ্ধি, আত্মত্যাগ ও অহংকারবোধ বিসর্জনের মাধ্যমে আমিত্বকে বিলীন করার শক্তি অর্জনই হচ্ছে এলমে লাদুনি; তাসাউফ বা সুফিবাদ। সুফিবাদ জীবন ধর্মী আধ্যাত্মিকতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে সুফিবাদ বা তাসাউফ অনুযায়ী জগৎ বাস্তব এবং জগত পরম সত্তার স্থান আছে, আল্লাহ্র রহস্য বোঝার সাধ্য মানুষের নেই। তাসাউফ অনুসারে আল্লাহ্ প্রেমময়। আল্লাহ্ মানবের প্রেমাস্পদ। ধর্মের অপর নাম প্রেম। সুতরাং মানব জীবনের পরম সম্পদ হচ্ছে আল্লাহ্র ভালোবাসা অর্জন। সকল মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত আল্লাহ্র প্রেমে শক্তিশালী হওয়া কেননা মানবের সাথে আল্লাহ্র সম্পর্ক হচ্ছে প্রেমের।

এই জ্ঞানের বলেই খাজা খিজির (আ.) যা জানতে পেরেছিলেন হযরত মূসা (আ.) এ জ্ঞানের অভাবে তা জানতে সক্ষম হন নি। (সূরা ফাহাফ) এ এলমে লাদুনি শক্তির আদেশ পালনকারীর সব প্রচেষ্টাই নিজেকে নিয়োজিত রাখে। মূলত তাদের জীবন আল্লাহ্র আদেশ এবং রাসূল (স.) এর আদর্শের উত্তম প্রকাশ।

স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও কুরআন হাদিসের জ্ঞানের মাধ্যমে জানার প্রচেষ্টাকে হলো সুফী দর্শন বা সুফীবাদ। হযরত ইমাম গাজ্জালী (র.) এর মতে, “আল্লাহ্র ব্যতীত অপর মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে কুরআন হাদিসের আলোকে তাজকিয়ামে নফস এর মাধ্যমে পবিত্র করে সর্বদা আল্লাহ্র আরাধনায়। নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্তে নিমগ্ন হওওয়ার নামই সুফীবাদ। “সুফ অর্থ পশম আর তাসাউফের অর্থ পশমী বস্ত্রে পরিধানের অভ্যাস অতঃপর কুরআন হাদীসের জ্ঞানের মাধ্যমে মরমীতত্ত্বর সাধনায় কারো জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাউফ। যে নিজেকে এই রূপ সাধনায় সমর্পিত করেন ইসলামের পরিভাষায় তিনি সুফী নামে অভিহিত হন। ইসলামি পরিভাষায় সুফীবাদকে তাসাউফ বলা হয়, যার অর্থ আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞান বা এলমে লাদুনি। তাসাউফ বা সুফিবাদ বলতে অনিশ^র আত্মার পরিশুদ্ধি বা তাজকিয়ামে নফস এর মাধ্যমে আল্লাহ্র সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বলেই হযরত মনসুর হাল্লাজ (র.) বলেছিলেন, “আনাল হক” আমি সত্য। এ এলমে লাদুনি শক্তিতে বলীয়ান হয়ে হযরত বায়োজীদ বোস্তামী (র.) বলেছিলেন, “আমার শান কত বড়।” এলমে লাদুনির সর্বশ্রেষ্ঠ বিকাশ প্রেমজ শক্তিতে বলিয়ান হয়ে রাসূল করীম (স.) এর দাঁত মোবারক শহীদ হবার খবর শুনে হযরত ওয়ায়েজ করণী (রহ.) তাঁর বত্রিশটি দাঁত উপড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।

ইসলামী শরীয়াতের দৃষ্টিকোণ থেকে এলমে তাসাউফের বা এলমে লাদুনীর গুরুত্ব অপরিসীম। তাসাউফ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একে অস্বীকার করা যায় না। কারণ- এলমে লাদুনি বা তাসাউফ ব্যতিত মানবতার আধ্যত্মিক উৎকর্ষ সাধিত হতে পারে না। তাসাউফ শব্দটি মূল কি এই নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। যেমন দায়েরাতুল মারেফাত গ্রন্থকার আল্লামা-বুসতানী (র.) বলেন, তাসাউফ শব্দটি আছছুফু- শব্দ থেকে নির্গত যার অর্থ হলো- পশম, লোম, ওল ইত্যাদি। আর তাদেরকে সুফী বলা হয়। এই কারণে যে, তারা অহংকারী পোশাক তথা নিজের বরত্ব বিলীন করে আল্লাহ্র সাধনাকে বুঝায়। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফির রাসূল তারপর ফানাফিল্লাহ আল্লাহ্র সঙ্গে অবস্থান করা এবং ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহ্র সঙ্গে স্থায়ীভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। যেহেতু আল্লাহ্ নিরাকার। তাই তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য নিরাকার শক্তির প্রতি প্রেমই একমাত্র মাধ্যম। তাসাউফ দর্শন অনুযায়ী এই সাধনাকে আমরা ‘তরিকত’ বা আল্লাহ্র প্রাপ্তির পথ বলা হয়। তরিকত সাধনায় একজন পথ প্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। এর পথের স্তর হলো ফানা ফিশ্শাইখ, ফানাফির রাসূল ও ফানাফিল্লাহ্। ফানাফিল্ল্হ্ াহওয়ার পর বাকাবিল্লাহ্ লাভ হয়। বাকাবিল্লাহ্ অর্জিত হলে একজন সুফি আল্লাহ্র প্রদত্ত বিশেষ নিয়ামত লাভ করেন আর এই অবস্থাই সুফির অন্তরে সর্বক্ষণিত শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে। হযরত মুহাম্মদ (স.) স্বয়ং এই দর্শনের প্রবর্তক। তিনি বলেন, মানব দেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে। সুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে। আর অসুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ অপরিশুদ্ধ হয়ে যায়। এটা আর কিছু নয় এটা হলো ‘কলব’ বা হৃদয়। আল্লাহ্র জিকির বা স্মরণে কলুষমুক্ত হয়। সার্বক্ষণিক আল্লাহ্র স্মরণের মাধ্যমে কলবকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহ্র প্রেমার্জন সুফিবাদের উদ্দেশ্য তবে এই জিকির জাগতিক সকল কাজে আল্লহ্র আদেশ নিষেধ মানার মাধ্যমে অর্জন করাই হলো সুফি দর্শন।

সুফিবাদ বা সুফি দর্শন একটি ইসলামিক এমন দর্শন যা আত্মা অবস্থা সম্পর্কিত আলোচনা মূখ্য বিষয়। আত্মার পরিশুদ্ধির বা তাজকিয়ামে নফল এর মাধ্যমে আল্লাহ্র সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মূল কথা। পরম সত্তা মহান আল্লাহ্কে জানার এবং চেনার আকাঙ্খা মানুষের চিরন্তন। সামশুল আরোফিন কিতাব অনুযায়ী জ্ঞান ২ প্রকার। অর্জিত জ্ঞান (এলমে হুছুলী) এবং দর্শন জ্ঞান (এলমে হুজুরী)। অর্জিত জ্ঞান হচ্ছে বুদ্ধির দ্বারা বস্তুর পরিচয় লাভ যা চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং দর্শন জ্ঞান কলবের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অর্জিত জ্ঞান দ্বারা কখনো খোদা পরিচিতি লাভ করা যায় না। এ প্রসঙ্গে রূহ সম্পর্কে আল্লাহ্র নিদের্শ বর্ণনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। মহান আল্লাহ্ বলেন, “হে রসূল! রূহ সম্বন্ধে আপনাকে জিজ্ঞাসা করবে, আপনি বলুন রূহ আল্লাহ্র হুকুম। তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞান দান করা হয়েছে।”

সুতরাং বুঝা যায়, অর্জিত জ্ঞানের দ্বারা রূহের প্রকৃত পরিচয় লাভ করা যেখানেই সম্ভব হয় না; উহা দ্বারা বে-মেছাল নিরাকার আল্লাহ্র দিদার লাভ করা সম্ভব নয়। উহার জন্য দর্শন জ্ঞান বা এলমে হুজুরী প্রয়োজন।যে জ্ঞানের দ্বার অনন্ত সৌভাগ্য লাভের উদ্দেশ্যে আত্মশুদ্ধি ও চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনের প্রক্রিয়া এবং মানুষের জাহির ও বাতিন গঠন করা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায় তাকে এলমে তাসাউফ, আধ্যাত্মিক জ্ঞান বা এলমে লাদুনি বলে।হযরত ইমাম গাজ্জালী (র.) বলেছেন: “আল্লাহ্ ব্যতীত অপর সবকিছু থেকে হৃদয়কে পবিত্র (তাজকিয়ায়ে নফস) করে সত্য আল্লাহ্র আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্তে নিমগ্ন হওয়ার নামই তাসাউফ।এখানে হযরত ইমাম গাজ্জালী (র.) ইসলামের মর্ম সঠিকভাবে উপলব্ধি করে ইসলামের তথ্য জীবনের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরিন দু’দিকের প্রতিই সমান গুরুত্ব আরোপ করে নৈতিকতাবোধ ও তাওহীদ প্রতিষ্ঠায় গ্লানি। আবর্জনা ও অন্তরায় সমূহকে পরিত্যাগের ইঙ্গিতে দিয়েছেন।

হযরত জুনায়েদ বোগদাদী (র.) বলেন, “জীবন ও মৃত্যুসহ সকল বিষয়ে আল্লাহ্র উপর পরিপূর্ণ নির্ভরতাই তাসাউফ। অন্যত্র হযরত বায়োজিদ বুস্তামী (র.) বলেছেন, “আরাম আয়েশ ত্যাগ করা এবং আল্লাহ্কে পাওয়ার উদ্দেশ্যে দুঃখ কষ্টকে বরণ করাই প্রকৃত তাসাউফ।
বিভিন্ন সংজ্ঞা হতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পবিত্র আত্মা লাভ এর জন্য সকল প্রকার কু-প্রবৃত্তি থেকে অহংবোধ বিনাশ করে কলুষমুক্ত ও সুন্দর মনোরম জীবন গড়ে তোলাই সূফি জীবনের প্রাথমিক কর্তব্য ও প্রয়োজন। অতঃপর যাহেরী ও বাতেনী উভয় জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের মাধ্যমে আল্লাহ্র সম্যক উপলব্ধি ও তাতে স্থিতিলাভজনিত পরম শান্তিই সুফি দর্শনের চরম লক্ষ্য।

অতএব বলা যায় যে, তাসাউফ একটা সাধারণ মানুষকে পরিপূর্ণ মানবতা দান করে আল্লাহ্র অনন্ত অসীম জ্ঞানে, জ্ঞানী করে তোলে, যাদেরকে আমরা সুফী বলি। সুফি দর্শনের শিক্ষা তাই পরিপূর্ণরূপে মানবতারই শিক্ষা পাশবিক স্তর হতে মানবতার স্তরে উণ্নীত হবার শিক্ষা। তাসাউফ তাই মনুষত্বের চরম শিক্ষা ও দর্শন।ভক্তি ও প্রেম ব্যতীত ইবাদতের এ অবস্থান সম্ভব নয়। তাই পরিপূর্ণ আত্ম সমপর্ণের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব অর্জনপূর্বক আল্লাহ্র উপলব্ধি জাত জ্ঞান লাভ করে পরম সত্তায় স্থিতিলাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করা সুফী সাধনার মূল বিষয়বস্তু।

মহান আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন, “যার ক্বলবে আমার যিকির জারি নেই সে নফসের অনুসরণ করে এবং তার আমলগুলো হয় শরীয়তের খিলাফ।” (সূরা কাহফ: ২৮) রসূল (স.) বলেছেন, জ্ঞান দুই প্রকার: উপকারী জ্ঞান বা ভাষাগত জ্ঞান এবং উপকারী জ্ঞান বা আধ্যাত্মিক জ্ঞান। (শিবয়াতুল ইসলাম কিতাব) ভাষাগত জ্ঞান হচ্ছে মানুষের জন্য আল্লাহ্র দলিল এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান হচ্ছে এলমে মারাফাত। হযরত হাসার (র.) সূত্রে এহয়াউল উলুম কিতাবের বর্ণনা করা হয়েছে, রসূল (স.) মতে জ্হান ২ প্রকার: ১। জাহেরী জ্ঞান, ২। লাভদায়ক জ্ঞান বা এলমে নাফে (বাতেনী জ্ঞান) বাতেনি জ্ঞান কবলবের মধ্যেই নিহিত।আল্লাহ্ পাক পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, “তোমরা সব আল্লাহ্ওয়ালা হয়ে যাও।” (সূরা আল ইমরান: ৩/৯)
ইসলামে তাসাউফ তথা শরীয়তের পাশাপাশি তরীকত হাকীকত ও মারেফাত অর্জন এবং সে জন্য পীর মুর্শিদের কাছে বাইয়াত গ্রহণ একটি অত্যাবশকীয় বিষয় যা কুরআন হাদিস ইজমাও ক্বিয়াস দ্বারা সাব্যস্ত।

মূলত: কুরআনের আয়াত শরীফে বিশেষভাবে ৪টি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তন্মধ্যে আয়াত শরীফ তেলাওয়াত করে শুনানো এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়া এ তিনটি বিষয় হচ্ছে এলমে জাহির বা এলমে ফিকাহ এবং এলমে মারাফাতের অন্তর্ভূক্ত। যা এবাদতে জাহের ও দ্বীনের যাবতীয় বাহ্যিক হুকুম আহকাম পালন করার জন্য ও দৈনন্দিন জীবন-যাপনে হালাল কামাই করার জন্য প্রয়োজন। আর চতুর্থ হচ্ছে তাজকিয়ামে “ক্বলব” অর্থাৎ অন্তর পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভ করা যায়।

মূলত: শরীয়ত, তরীকত হাকিকত ও মারাকত, এ সবের প্রত্যেকটি-ই কোরআন সূণ্নাহসম্মত এবং তা মানা ও বিশ^াস করে কার্যে পরিণত করা কুরআন-সুণ্নাহর ই নির্দেশের অর্ন্তভুক্ত।আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- “আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য একটি জীবন বিধান বা শরীয়ত অপরটি তরীকত সম্পর্কিত বিশেষ পথ নির্ধারিত করে দিয়েছি। (সূরা মায়িদা: ৪৮) আর হাদিস শরীফে এরশাদ হয়েছে- “শরীয়ত একটি বৃক্ষ স্বরূপ, তরীকত তার শাখা প্রশাখা, মারেফত তার পাতা এবং হাকীকত তার ফল। (সিনরুল আসরার) তরীকত যথাযথভাবে পালন করতে হলে দ্বীনী এলেম অর্জন করতে হবে যা ফরজ। এই এলেম ২ প্রকার। ১। এলমে ফিকাহ, ২। এলমে তাসাউফ।

ক্বলব শব্দের অর্থ অন্তর বা মন। এটি একটি মাংসের টুকরা। এর আকৃতি মসুর ডালের মতো। বুদ্ধিকেন্দ্র ও জ্ঞান কেন্দ্র বুঝাতেও কখনো কখনো ক্বলব শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এর স্থান মানুষের বাম স্তনের ১ (এক) ইঞ্চি নিচে। অনেকে ক্বলবকে হৃদপিন্ড মনে করেন। আসলে এটা হৃদপিন্ড বা মস্তিষ্ক নয় অন্য জিনিস।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিরাও মনে করেন অন্তর বা মন হচ্ছে মানুষের বাম স্তনের নিচে, পবিত্র কুরআনে ক্বলবের অবস্থান সম্পর্কে এরশাদ হচ্ছে, “বস্তুত চক্ষুতো অন্ধ হয় না। কিন্তু ঐ ক্বলব অন্ধ হয় যে ক্বলব হলো বুকের মধ্যে।” (সূরা হজ্জ¦: ৪৬)
রাসূল (স.) ফরমান, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাদের শরীর বা আকৃতির দিকে তাকান না বরং তিনি তোমাদের ক্বলবের (মন বা অন্তর) দিকেই তাকান।” অতঃপর রসূল (স.) ক্বলবকে দেখানোর জন্য স্বীয় আঙ্গুল দ্বারা নিজের বুকের দিকে ইশারা করলেন (মুসলিম শরীফ) রাসূল পাক (স.) আরো বলেন, “মানুষের ক্বলব আল্লাহ্ পাকের অতুলনীয় ও অলৌকিক ২ আঙ্গুলে মধ্যে। তিনি অন্তর সমূহকে (ক্বলব) যেমন ইচ্ছা তেমনি করে দেন।” আল্লাহ্র কাছে দোয়া করার সময় রাসূল পাক (স.) বলতেন “হে অন্তর (ক্বলব) আবর্তন ও বির্তনকারী আল্লাহ্। তুমি আমাদের ক্বলবকে তোমার আনুগত্যমুখী করে দাও। ক্বলব সম্পর্কে রাসূল পাক (স.) আরো বলেন, “ক্বলব হলো সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাদশা, (মেশকাত শরীফ পঞ্চম খন্ড পৃষ্ঠা- ৬২) অর্থাৎ একটি দেশের বাদশা ভালো হলে দেশের প্রজারাও যেমন ভালো হতো বাধ্য হয়, তদ্রুপ একটি মানুষের ক্বলব বা অন্তর ভালো হলে নিজের কাজ কর্মক্ত ভালো হয়ে যায়। অপর দিকে একটি মানুষের ক্বলব খারাপ হলে তায় কর্মকান্ডও খারাপ হয়ে যায়। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে।” তাদের ক্বলব সমূহের উপর ছাপ পড়ে গেছে। ফলে তারা বুঝে না।” (সূরা তওবা: ৮৭) (পবিত্র কুরআনে অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে”- আমি তাদের ক্বলব সমূহের ওপর ছাপ মেরে দিয়েছি ফলে তারা শুনতে পায় না (সূরা আরাফ: ১০০)

সুতরাং দেখা যাচ্ছে ক্বলব যতটুকু ভালো তার আমলও তত ভালো আর যার ক্বলব যত নষ্ট তার আমলত তত নষ্ট বা খারাপ। পবিত্র কুরআনে আরো এরশাদ হচ্ছে,” যে আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনবে আল্লাহ্ তার ক্বলবকে হেদায়েত দান করবেন, “(সূরা আনকাবুত: ৯১) অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে, যে রাসূল তাদের জন্য দুঃখ করবেন না যারা দৌঁড়ে গিয়ে কুফরে পতিত হয়। যারা মুখে বলে আমরা ঈমান এনেছি, অথচ তাদের ক্বলব ঈমান আনেনি। (সূরা মায়োদ: ৪১) অন্যত্র কালাম পাকে এরশাদ হচ্ছে, “কখনো না, বরং তারা যা কিছু (গোনাহ) উপার্জন করে তাই তাদের ক্বলবের ওপর মরিচা ধরিয়ে দিচ্ছে” (সূরা মুতাফিফীন: ১৩) ক্বলবের মধ্যে এই মরিচা পড়তে পড়তে ক্ললব কালো হয়ে যায়। তখন আর ভালো মন্দের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। রাসূল পাক (স.) ফরমান “তখন ভালো কে ভালো জানার এবং মন্দকে জানার ক্ষমতা রাখে না। (মুসলিম শরীফ: ১ম খন্ড, ৮২পৃষ্ঠা)। তওবা ও এস্তে-গফার করে নেয় তাহলে তার ক্বলব ছাফ হয়ে যায় আর যদি গুণাহ বাড়তে থাকে তাহলে দাগও বাড়তে থাকে ও অবশেষে এটা ক্বলবকে ঘিরে ফেলে। (তিরমিযি) সুতরাং ক্বলব থেকে ময়লা পরিষ্কার করতে হলে ক্বলব সংশোধন করা আবশ্যক। ক্বলব সংশোধন হয়ে গেলে গুণা করতে মন চাইবে না গুণার প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হবে। গুণাহ করতে খারাপ লাগবে ও কষ্টবোধ হবে। অপরদিকে ইসলামের দিকে চলতে মনে ভালো লাগবে ও উৎসাহ বোধ হবে।

মনুষ্য জীবন বিচিত্র চিন্তা ভাবনা দ্বারা চলমান। আজ জ্ঞানের কমতির কারণে মনুষ্য দুঃখ আর অশান্তির দাবানলে জ¦লছে। কিন্তু মানুষ আছে যারা তারা অর্থ কড়ি বিষয় বিভবকে বিনাশভাবে। কিন্তু পরিস্থিতি তাদের স্থিতিকে টাকা পয়সার বেড়াজালে বশীভূত হওয়ার কারণে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলোতে শ্রেষ্ঠতার ছোয়া থেকে অনেক দূরে। এর কারণ সৎ চিন্তা ভাবনার অধঃপতন। আবার কোনো কোনো মানুষ আছে যারা এই স্তল ধন ও বিষয় বৈভবকে বিনাশী ভেবে অবিনাশী প্রাপ্তির অর্থাৎ প্রকৃত সুখ ও শান্তি এর পেছনে ছুটে। কিন্তু প্রকৃত রাস্তা বা জ্ঞান না থাকার ফলে পেরেশান বা হয়রান হয়। আবার কেউ এই সৃষ্টি নাটকের নাট্যমঞ্চে অভিনয়কারী হিসেবে ভেবে নেয় অর্থাৎ নিজেকে মেহমান ভাবে ফলে তরা মহান বা অমর হয়ে যায়।

নিজেকে নিয়ে অধ্যায়ন করাই হলো এলমে লাদুনি বা অধ্যাত্মিক জ্ঞান। যে এমন চিন্তা ভাবনা করে সেই একদিন সত্য এর দুয়ায়ের সন্ধ্যান পায়। সক্রেটিস বলেছিলেন, নিজেকে জানো। নিজেকে জানার পেছনে নিজের কল্যাণের সাথে বিশ^ কল্যাণ নিহিত।
সুফিবাদ বা তাসাউফ কিংবা এলমে লাদুনির একমাত্র মূল বিষয় হলো, আপন নফসের সঙ্গে নিজ প্রাণের সাথে, নিজের জীবাত্মার সাথে পরমাত্মা আল্লাহ্ যে শয়াতনটিকে আমাদের পরীক্ষা করার জন্য দেয়া হয়েছে তার সাথে জিহাদ করে তার থেকে মুক্ত হয়ে এ জড় জগত থেকে মুক্তি পাওয়া। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহ্র সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মর্ম কথা।

সুফিবাদ উৎকর্ষ লাভ করে পারস্যে সেখানকার প্রখ্যাত সুফি দরবেশ, কবি সাহিত্যিক এবং দর্শনিকগণ নানা শাস্র, কাব্য ও ব্যাখাপুস্তক রচনা করে এই দর্শনকে সাধারণের নিকট জনপ্রিয় করে তোলেন। কালক্রমে বিখ্যাত ওলিদের অবলম্বন করে নানা তরিকা গড়ে ওঠে। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রধান তরিকা সর্বাধিক প্রসিদ্ধ লাভ করে।

১। বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (র.) প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া তরিকা; ২। হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতিয়া (র.) প্রতিষ্ঠিত চিশতিয়া তরিকা। ৩। হযরত বাহাউদ্দিন নকশাবন্দী (র.) প্রতিষ্ঠিত নকশাবন্দী তরিকা এবং ৪। ঐতিহাসিকভাবে মুসলমানেরা আধ্যাত্মিক সাধনাকে প্রকাশ করার জন্য তাসাউফ শব্দটি ব্যবহার করতো। ঐতিহাসিকে সুফিদের মতে, তাসাউফ ইসলামের একটি বিশেষ রূপ যা ইসলামিক শরীয়াহ আইন ও অনুরূপ। তাদের মতে বিশে^র সকল প্রকার মন্দ এবং গর্হিত কাজ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শরীয়াহ এই মনে করেন, তাসাউফ ইসলামের অবিচ্ছেদ্য এবং ইসলামিক বিশ^াস এবং অনুশীলনের আধ্যত্মিক- তাপসদের মরশীবাদ। এটি কোনো সম্প্রদায় নয় বরঞ্চ এটিকে ইসলামিক শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয় যা মানুষের স্বীয় অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধতার সাথে সর্ম্পকযুক্ত। পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহ্র সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মর্ম কথা।

৪। হযরত শেখ আহমদ মুজাদ্দিদ-ই আলফে ছানী সারহিন্দী (র.) প্রতিষ্ঠিত মুজাদ্দিদিয়া তরিকা। এছাড়াও সুহ্রাওয়ার্দিয়া, মাদারীয়া, আহমদিয়া ও কলন্দরিয়া নামে আরো কয়েকটি তরিকার উদ্ভব ঘটে।

লেখক: সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,শিক্ষক,গবেষক,সাংবাদিক,কলামিস্ট

শিরোনাম