মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
‘ফ্যাসাদ’ শব্দটি আরবি। এর অর্থ সত্যচ্যুতি, নৈরাজ্য, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, অন্তর্ঘাত, চক্রান্ত, বিপর্যয় প্রভৃতি। এই শব্দ পবিত্র কোরআনে পঞ্চাশের চেয়ে বেশি স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো কখনো বিশেষ অব্যয়যোগে এটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন ‘ফাসাদ ফিল আরদি’। ‘ফাসাদ ফিল আরদি’র প্রায়োগিক জায়গা মানুষের সামষ্টিক জীবন। এটি নৈরাজ্য থেকে বিপর্যয় পর্যন্ত উপর্যুক্ত শব্দগুলোর বিমূর্তভাব প্রকাশ করে।
ফিতনা একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। পবিত্র কোরআনে ফিতনা শব্দটি দ্বারা পরীক্ষা, বিপর্যয়, শাস্তি, অনিষ্ট, শিরক, জুলুম, বিবাদ এবং যুদ্ধকেও বুঝানো হয়েছে। সুরা বাকারার ১৯১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ফিতনা (বিপর্যয়) হত্যার চেয়েও জঘন্য। একই সূরার ১৯৩ আয়াতের অর্থ, ‘তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকো, যতক্ষণ না ফিতনা দূরীভূত হয়।’ এই আয়াতে ফিতনা বলতে শিরক বুঝানো হয়েছে।
মানুষের পাশবিক চরিত্র ফিতনা-ফ্যাসাদের জন্ম দেয়। এর বিস্তারের ক্ষেত্রে লোভ, হিংসা, জেদ, অহংকার, হঠকারিতা ও জিঘাংসার মতো নেতিবাচক স্বভাবগুলো অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। ইসলাম মানবজাতির শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তার লক্ষে হিংসা, জেদ ও অসহিষ্ণুতা থেকে বিরত থাকতে বলেছে। আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, ‘দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর এর মধ্যে বিপর্যয় ঘটাবে না।’ (সূরা : আরাফ, আয়াত : ৫৬)
মানুষ হত্যার চেয়ে বড় পাপ আর কী হতে পারে? আল্লাহ তা’য়ালা কোরআন মাজীদে বলেছেন, যে ব্যক্তি অপর কোনো মুসলমানকে হত্যা করে তার কোনো ক্ষমা নেই; তাকে চিরকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে। মুসলমান বলতে সেখানে শান্তিপ্রিয় বা নিরপরাধ মানুষ বোঝানো হয়েছে; কোনো সাম্প্রদায়িক ধারণার মাধ্যমে সেখানে মুসলিম-অমুসলিম ফারাক করার সুযোগ নেই।
মানুষ হত্যা আল্লাহর দৃষ্টিতে এবং মানবসভ্যতার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় পাপ। ভুলবশত কেউ নিহত হলে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের মধ্যেমে মুক্তিলাভের একটা ব্যবস্থা ইসলামে অনুমোদন করা হয়েছে। এছাড়া ইচ্ছাকৃত হত্যাকান্ডের দায় থেকে মুক্তির কোনো ব্যবস্থা নেই।
ইসলামের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিশেষ করে ধর্ম নিয়ে ফিতনা সৃষ্টি সম্পর্কে উম্মতকে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করেছেন। মহানবী (সা.) সারাজীবন তার সাহাবীদের নিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে বিরুদ্ধবাদী মুশরেক কাফেরদের বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়াই করে গেছেন। কিন্তু ধর্মের নামেও যে ফিতনা বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে-এ সন্দেহ থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন না। তাই তিনি পরবর্তী উম্মতকে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন এবং ফিতনার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে গেছেন। আজ মুসলিম সমাজ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। ইসলাম ধর্মের নামে চরমপন্থি জঙ্গিবাদী সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে বিশ্বের সর্বত্র এবং বাংলাদেশের মতো সহনশীল মুসলিম সমাজের ভেতরেও সৃষ্টি হয়ে গেছে ইসলামী জঙ্গিবাদী। আসলে এরা ইসলামী জঙ্গিবাদী নয় ইসলামবিরোধী জঙ্গিবাদী। ইসলামের অনুসারী কখনো জঙ্গিবাদী হতে পারে না। জঙ্গিবাদী যে হয় সে জন্মসূত্রে মুসলমান হলেও ইসলামবিরোধী। মুসলিম সমাজের এখন কর্তব্য হবে এদের ইসলাম থেকে খারিজ করে দেখা এবং ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করা।
আল্লাহ তা’য়ালা মানব সমাজকে আরো একটি বিপর্যয় সম্পর্কে হুঁশিয়ার করেছেন। বলা হয়েছে, ফিতনা হত্যার চেয়েও মারাত্মক। ফিতনা শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারে কলহ-দ্বন্দ্ব, বিভ্রান্তি, ভুল বোঝাবুঝি বা বিপথগামিতা। ফিতনা থেকে শুরু হয় অনৈক্য; বিশৃঙ্খলা, বিবাদ, সংঘর্ষ, হত্যাকান্ড ও সামাজিক বিপর্যয়।
বস্তুতঃ ফেতনা ফ্যাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ। আর তাদের সাথে লড়াই করো না মসজিদুল হারামের নিকটে যতক্ষণ না তারা তোমাদের সাথে সেখানে লড়াই করে। অবশ্য যদি তারা নিজেরাই তোমাদের সাথে লড়াই করে। তাহলে তাদেরকে হত্যা করো। এই হলো কাফেরদের শাস্তি। যারা আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের জন্য রয়েছে অভিশাপ। তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট আবাস। (সূরা : রাদ : আয়াত-২৫)
বর্তমান বিশ্বের প্রখ্যাত স্কলার জাস্টিস আল্লামা মুফতি তাকি উসমানি তাঁর একটি লেকচারে বিভিন্ন হাদিসের আলোকে ফিতনার বাহাত্তরটি নিদর্শন উল্লেখ করেন। হযরত হুযায়ফা (রা.) বলেন, কিয়ামতের আগে বাহাত্তরটি বিষয় প্রকাশ পাবে। ১. লোকেরা নামাজে ডাকাতি করবে। অর্থাৎ নামাজের প্রতি মানুষের একদম গুরুত্ব থাকবে না। ২. সুদের লেনদেন করবে। ৩. আমানতের খেয়ানত করবে। ৪. মিথ্যা কথা বলাকে হালাল মনে করবে। অর্থাৎ মিথ্যা বলতে পারাকে একটি দক্ষতা ও যোগ্যতা মনে করা হবে। ৫. দ্বীন বিক্রি করে দুনিয়া উপার্জন করবে। ৬. উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণ করবে। ৭. সামান্য বিষয়ে রক্তপাত করবে এবং অন্যের প্রাণ সংহার করবে। ৮. আত্মীয়দের সঙ্গে বাজে আচরণ করবে। ৯. ইনসাফ উঠে যাবে। ১০ বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও পরিবেশ উষ্ণ থাকবে। ১১. ভদ্রলোকেরা নিগৃহীত হবে। ১২. জুলুম-অত্যাচার ব্যাপকরূপ লাভ করবে। ১৩. তালাকের আধিক্য হবে। ১৪. আকস্মিক মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে। ১৫. দুর্নীতিপরায়ণ লোকদের সেলাক মনে করা হবে। ১৬. সেলাকদের দুর্নীতিপরায়ণ মনে করা হবে। ১৭. মিথ্যাকে সত্য মনে করা হবে। ১৮. সত্যকে মিথ্যা বলা হবে। ১৯. অপবাদ আরোপের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। ২০. মিথ্যা সত্যতে পরিণত হবে। ২১. লোকেরা সন্তান লাভের পরিবর্তে সন্তান নেওয়াকে অপছন্দ করবে। ২২. নীচ লোকেরা সম্পদশালী হবে এবং অত্যন্ত বিলাসী জীবনযাপন করবে। ২৩. রেশমি পোশাক পরিধান করা হবে। ২৪. শাসকবর্গ মিথ্যা কথা বলবে। ২৫. পুরুষরা মহিলাদের বেশভূষা ধারণ করবে। ২৬. নেতৃবর্গ জালেম ও অত্যাচারী হবে। ২৭. আলেম এবং কারি বদকার হবে। অর্থাৎ আলেম এবং পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতকারী লোকজনও বদকার ও ফাসেক হবে। ২৮. লোকেরা জীবজন্তুর চামড়া দ্বারা তৈরি উন্নতমানের পোশাক পরবে। ২৯. কিন্তু তাদের দিলগুলো মৃত জন্তুর চেয়ে বেশি দুর্গন্ধময় হবে। ৩০. এবং পাথরের চেয়ে বেশি কঠিন হবে। ৩১. ব্যাপকভাবে মদ পান করা হবে। ৩২. দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেওয়া হবে। ৩৩. গুণাহর পরিমাণ বেড়ে যাবে। ৩৪. জানমালের নিরাপত্তা কমে যাবে। ৩৫. কোরআন শরিফ‘কে সজ্জিত করা হবে। ৩৬. মসজিদকে কারুকার্যময় করা হবে। ৩৭. উঁচু উঁচু সৌধ নির্মিত হবে। ৩৮. হৃদয়গুলো উজাড় হবে। ৩৯. স্বর্ণ সুলভ হবে। ৪০. শরিয়তের দন্ডবিধিকে অকার্যকর করা হবে। ৪১. দাসী স্বীয় মুনিবকে জন্ম দিবে। অর্থাৎ মেয়ে মায়ের ওপর কর্তৃত্ব করবে এবং এরূপ ব্যবহার করবে, যেরূপ মুনিব দাসীর সঙ্গে ব্যবহার করে। ৪২. একসময় যারা খালি পায়ে ও উন্মুক্ত দেহে চলাফেরা করতো, এরূপ নীচু শ্রেণির লোকেরা দেশের শাসক বনে যাবে। ৪৩. পুরুষ ও মহিলা যৌথভাবে ব্যবসা করবে। মহিলারা জীবনের সকল ক্ষেত্রে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে। ৪৪. আমানতদার ব্যক্তি খেয়ানত করবে। ৪৫. মহিলারা পুরুষদের বেশভূষা ধারণ করবে। দূর থেকে দেখে বোঝা যাবে না, এটা পুরুষ না মহিলা। ৪৬. গায়রুল্লাহর নামে শপথ করা হবে। শপথ শুধু আল্লাহর নামে এবং কোরআনের ওপর বৈধ, অন্য কোনো কিছুর নামে শপথ করা হারাম। কিন্তু ফিতনার যুগে মানুষ আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য জিনিসের নামেও শপথ করবে। ৪৭. মুসলমানরাও নির্দ্বিধায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত থাকবে। ৪৮. শুধু পরিচিত লোকদের সালাম দেওয়া হবে একসময় সালামের রেওয়াজ একবারেই উঠে যাবে। ৪৯. রুপার মূল্য বেড়ে যাবে। ৫০. মানুষ নিজের পিতার অবাধ্যতা করবে। ৫১. জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় সম্পদকে নিজের সম্পদ মনে করা হবে। ৫২. আমানতের মালকে লুটের মাল মনে করা হবে। ৫৩. যাকাতকে জরিমানা মনে করা হবে। ৫৪. সমাজের সবচেয়ে নীচ ও নিকৃষ্ট ব্যক্তিকে লোকেরা নিজেদের নেতা বানাবে। ৫৫. আখেরাতের কাজের দ্বারা দুনিয়া উপার্জন করা হবে। ৫৬. মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে। ৫৭. বন্ধুদের ক্ষতি করতে দ্বিধা করবে না। ৫৮. স্ত্রীর আনুগত্য করবে। ৫৯. বদকার লোকেরা মসজিদে শোরগোল করবে। ৬০. গায়িকা মহিলাদের সম্মান করা হবে। ৬১. পবিত্র কোরআন গানের সুরে তিলাওয়াত করা হবে ৬২. মদের দোকান বেড়ে যাবে। ৬৩. জুলুম-অত্যাচার করাকে গর্বের বিষয় মনে করা হবে। ৬৪. আদালতে ন্যায়বিচার বিক্রি হবে। বিচারপ্রার্থী ন্যায়ের ওপর হলেও পয়সা দিয়ে রায় নিজের পক্ষে নিবে। ৬৫. পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ৬৬. বাদ্যযন্ত্র এবং বাজনার বিভিন্ন উপকরণকে বিশেষ যত্ন করা হবে। ৬৭. হিংস্র পশুর চামড়া ব্যবহার করা হবে। ৬৮. উম্মতের শেষ যুগের লোকেরা প্রথম যুগের লোকদের ওপর বিভিন্ন অপবাদ আরোপ করবে। ৬৯. হয়তো তোমাদের ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে লালবর্ণের তুফান আসবে। ৭০. অথবা ভূমিকম্প আসবে। ৭১. অথবা লোকদের চেহারা বিকৃত হবে। ৭২. অথবা আকাশ থেকে পাথর বর্ষিত হবে। কিংবা আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে অন্য কোনো আজাব আসবে। এসব আলামত নিয়ে একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে আমাদের সমাজে প্রতিটি আলামত বিদ্যমান এবং সমাজে বর্তমানে যে অশান্তি বিরাজ করছে তা মূলত ওপরে বর্ণিত বদ আমলগুলোরই ফল। আর এ কারণেই আমাদের ওপর বিপদ আপদের পাহাড় ভেঙে পড়ছে।
ঝগড়া-বিবাদ, ফিতনা-ফ্যাসাদের কারণে সমাজে পরচর্চা, পরনিন্দা, কুৎসা রটনা, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, হিংসা-বিদ্বেষ, অপবাদ, মিথ্যা দোষারোপ প্রভৃতি নানা ধরনের নিন্দনীয় কর্মকান্ডের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এতে মানুষের সৎকর্ম নষ্ট হয়ে যায়। সাধারণত পারস্পরিক গালিগালাজ, ঝগড়া-বিবাদ, দ্বন্দ্ব-কলহ, অশ্লীল ও অশালীন কথাবার্তার মাধ্যমে ফিতনা-ফ্যাসাদ শুরু হয়। এমতাবস্থায় মানুষ ইমানদার থাকা তো দূরের কথা পশুর চেয়েও নিম্নস্তরে নেমে যায়। তাই সমাজ থেকে এসব অসদাচরণ অবশ্যই বর্জন করা দরকার।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অন্যের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করবে না, গুপ্তচরবৃত্তি করবে না, পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করবে না, পরস্পরের সঙ্গে হিংসা-বিদ্বেষ করবে না, পরস্পরকে ঘৃণা করবে না এবং পরস্পরের ক্ষতি সাধন করার জন্য পেছনে লাগবে না। আর তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে যাবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা, সুখ-সমৃদ্ধি, ঐক্য-সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের নিদর্শনস্বরূপ মানুষের মধ্যে স্নেহ-মায়া-মমতা, শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি, ধৈর্য-সহনশীলতা, সততা, বিশ্বস্ততা, সংবেদনশীলতা প্রভৃতি সামাজিক গুণ অবশ্যই থাকা উচিত। সেখানে থাকতে পারে না কোনো প্রকার দ্বন্দ্ব-কলহ, ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, গোলমাল-হানাহানি, সংঘাত-সংঘর্ষ, ফিতনা-ফ্যাসাদ, সহিংসতা-উগ্রতা, হিংসা-বিদ্বেষ, অনিষ্ট ও অকল্যাণের অশুভ লক্ষণ। মানবসমাজে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কার্যকলাপকে ইসলাম সম্পূণরুপে নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআনে নিষেধবাণী ঘোষিত হয়েছে, ‘পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর এতে তোমরা বিপর্যয় ঘটাবে না।’ (সূরা আল-আরাফ: আয়াত-৫৬)
ইসলাম ঝগড়া-বিবাদকে সবচেয়ে নিম্নস্তরের আমল বিনষ্টকারী বলে গণ্য করেছে। ধর্মপ্রাণ মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো, ঝগড়া-বিবাদ যতোই হোক, বিপদ-আপদে, শত্রু-মিত্র বাছ-বিচার না করে বিপদগ্রস্তের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়া। ঝগড়া-বিবাদকারীরা সমাজের লোকের কাছে অপছন্দনীয়। কলহ-বিবাদ সৃষ্টিকারীদের যেমন সাধারণ মানুষ ঘৃণা করে, তেমনি আল্লাহ তা’য়ালাও তাকে অপছন্দ করেন। তাই বলা হয়েছে, ‘তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে না, নিশ্চয়ই আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৭৭)
ইলম উঠে যাওয়া কিয়ামতের অন্যতম আলামতগুলোর একটি। পাশাপাশি এটি উম্মতের মাঝে ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ একটি ফিতনা। মানুষ আলেমদের অবমূল্যায়ন করতে শুরু করবে। ফলে প্রকৃত ইলম আস্তে আস্তে উঠে যাবে। মানুষ বিভ্রান্ত হতে থাকবে। সবাই নিজেকে আল্লামা ভাবতে শুরু করবে। রাসূল (সা.) বলেছেন, অবশ্যই কিয়ামতের আগে এমন একটি সময় আসবে যখন সব জায়গায় মূর্খতা ছড়িয়ে পড়বে এবং ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে। (বুখারি, হাদিস : ৭০৬২)
রাসূল (সা.) এ আলামতগুলো বর্ণনা করে বলেন, এ আলামতগুলো যখন মুসলিম সমাজে দেখা দিবে তখন মসিবতের পাহাড় ভেঙে পড়বে। এ আলামতগুলোর বেশির ভাগই আজ আমাদের সমাজে বিদ্যমান। আমাদের সমাজে এমন অনেক বিষয় আছে যা আমাদের জিম্মি করে ফেলেছে।
মাদক : বর্তমান যুগে সত্যিই মদকে মদ মনে করা হয় না। বিভিন্ন নাটক-সিনেমায় মদকে অত্যন্ত হালকা করে প্রদর্শন করা হয়। বাবা-ছেলে একসঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবে মদ খাচ্ছে, এমন চিত্র প্রদর্শন করা হয়। বিভিন্ন পার্টিতে এখন মদ রাখা স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে, সারা বছর মদ পান না করলেও কেউ কেউ বিভিন্ন দিবসে পার্টির নামে মদ পান করছে। প্রায় পত্রিকাগুলো খুললে রিপোর্ট পাওয়া যায়, আস্তে আস্তে নারীরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।
সুদ : সুদ তো আমাদের সমাজে এতটাই ব্যাপক হয়ে গেছে যে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে সুদবিহীন অর্থনীতি চিন্তাই করা যায় না। সুদ ব্যবস্থা বন্ধ করতে গেলে অর্থনীতিই ভেঙে পড়বে। অথচ পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল এবং সুদকে করেছেন হারাম। (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৫)
ঘুষ : যখন আমার উম্মত ঘুষকে গিফট ও উপহার বলে হালাল করবে। কেউ কেউ ঘুষকে বলেন, স্পিড মানি। আজকাল ঘুষদাতা গিফট দিলাম বলে ঘুষ দিচ্ছে এবং ঘুষ গ্রহণকারী গিফট বলেই তা গ্রহণ করছে অথচ এটি ঘুষ। যখন আমার উম্মত যাকাতের মালকে ব্যবসার মাল রূপে গণ্য করবে তখন উম্মতের ওপর ধ্বংস নেমে আসবে।
ফিতনা-ফাসাদ যা সমাজের ঐক্য বিনষ্ট করে, মানুষের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, ভয়ের সঞ্চার করে। একে অপরে শুরু হয় শত্রুতা। সমাজ হয়ে উঠে বিষফোঁড়ার মতো। এটি হত্যার চেয়েও জঘন্য। যা অমার্জনীয় অপরাধ। ইসলাম কখনই তা সমর্থন করেনা। কোরআনের ভাষ্যমতে- ‘যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেনো সব মানুষকে হত্যা করে -(সূরা আল মায়িদা ঃ ৩২)। সন্ত্রাসবাদ ও ফিতনা-ফাসাদ এগুলো কবীরা গুণাহ। এসব কবীরা গুণাহ সমূহকে কেউ বৈধ মনে করলে সে অবশ্যই ইসলামের সীমানার বাহিরে চলে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সামাজিক জীবনে পরস্পর পরস্পরের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও বিশ্বাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ ও ফিতনা-ফাসাদের কুপ্রভাবে মানুষের মাঝে এ মহৎ গুণগুলো ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। আমাদের সমাজে যত্রতত্রভাবে সন্ত্রাসবাদ আর ফিতনা-ফাসাদের সংখ্যা দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা মোটেও শুভনীয় নয়।
নবী করিম (সা.) বলেনঃ ‘‘আমার উম্মতের দু’টি বিশাল দল পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা। তাদের মাঝে ভয়াবহ যুদ্ধ হবে। কিন্তু উভয়ের দাবী হবে একটাই’’। এখানে দুইটি দল বলতে আলী (রা.) ও মুআবিয়া (রা.) এর দলকে বুঝানো হয়েছে। হিজরী ৩৬ সালে ইরাকের ফুরাত নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত সিফ্ফীন নামক স্থানে এই দল দু’টি পরস্পরে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এতে উভয় পক্ষের প্রায় ৭০ হাজার লোক নিহত হয়’’। আলী ও মুআবিয়া (রাঃ)এর মাঝে যে সমস্ত যুদ্ধ হয়েছে তার কোনো একটিও তাদের ইচ্ছায় হয়নি; বরং উভয় দলের মধ্যে কিছু পথভ্রষ্ট, কুপ্রবৃত্তির অনুসারী এবং কুচক্রী লোক ছিলো। তারা সর্বদাই মানুষকে যুদ্ধের প্রতি উস্কানি দিতে থাকে। এতে করে বিষয়টি উভয়ের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়।
হযরত ওসমান (রা.)এর হত্যা থেকেই উম্মাতে মুহাম্মাদীর ভিতরে ফিতনার সূচনা হয়েছে। কিয়ামতের পূর্বে তা আর বন্ধ হবেনা। নবী (সা.) ফিতনার সময় মু’মিনদের করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়ে গেছেন। ফিতনার সময় যেহেতু যুদ্ধরত ও বিবাদমান দলগুলোর কোন্টির দাবী সত্য তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে যায়। তাই তিনি এহেন জটিল পরিস্থিতে কোনো দলের পক্ষে যোগদিয়ে যুদ্ধে নামতে নিষেধ করেছেন। সে সময় যার ছাগলের পাল থাকবে তাকে ছাগলের পাল নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় চলে যেতে বলেছেন কিংবা ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্তে প্রহরায় নিযুক্ত থাকতে বলেছেন। মুসলমানদের যুদ্ধরত দলগুলো সেখানে পৌঁছে গেলে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যেও যুদ্ধে শরীক হতে নিষেধ করেছেন। কারণ এটাই হবে তার ঈমানের জন্যে নিরাপদ। নবী (সা.) বলেন, ‘‘অচিরেই বিভিন্ন রকম ফিতনার আবির্ভাব ঘটবে। ফিতনার সময় বসে থাকা ব্যক্তি ফিতনার দিকে পায়ে হেঁটে অগ্রসরমান ব্যক্তির চেয়ে এবং পায়ে হেঁটে চলমান ব্যক্তি আরোহী ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক নিরাপদ ও উত্তম হবে। ফিতনা শুরু হয়ে গেলে যার উট থাকবে সে যেনো উটের রাখালি নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং যার ছাগল থাকবে, সে যেনো ছাগলের রাখালি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর যার চাষাবাদের যমিনে আছে, সে যেনো চাষাবাদের কাজে ব্যস্ত থাকে। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলোঃ হে আল্লাহর নবী! যার কোনো কিছুই নেই সে কি করবে? নবী করিম (সা.) বললেনঃ পাথর দিয়ে তার তলোয়ারকে ভোঁতা করে নিরস্ত্র হয়ে যাবে এবং ফিতনা থেকে বাঁচতে চেষ্টা করবে।
অধিকাংশ মুসলিম দেশের মাজারগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলে সহজেই অনুধাবন করা যাবে যে, কিয়ামতের এই আলামতটি প্রকাশিত হয়েছে। উম্মতে মুহাম্মাদীর বিরাট একটি অংশ আইয়্যামে জাহেলীয়াতের ন্যায় শির্কে লিপ্ত হয়েছে। কবর পাকা করে, বাঁধাই করে, কবরের উপর গম্বুজ ও মসজিদ নির্মাণ করে তাতে বিভিন্ন প্রকার শির্কের চর্চা হচ্ছে। কা’বা ঘরের তাওয়াফের ন্যায় কবরের চারপার্শ্বে তাওয়াফ হচ্ছে, বরকতের আশায় কবরের দেয়াল চুম্বন করা হচ্ছে, তাতে নযর-মানত পেশ করা হচ্ছে অলী-আওলীয়ার নামে পশু যবেহ করা হচ্ছে এবং কবরের পাশে ওরছ সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হচ্ছে। নবী করিম (সা.) বলেন,‘‘আমার উম্মাতের বহু সংখ্যক লোক মুশরেকদের সাথে মিলিত না হওয়া এবং মূর্তিপূজায় লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত হবেনা’’।
পাপ কাজ ও নাফরমানীতে লিপ্ত হওয়ার কারণে আল্লাহ তা’য়ালা বনী ইসরাঈলের এক শ্রেণির লোকের চেহারা পরিবর্তন করে শুকর ও বানরে পরিবর্তন করে ধ্বংস করেছিলেন। তবে এই উম্মাতের মাঝে এখনও চেহারা পরিবর্তনের শাস্তি আসেনি। কিয়ামতের পূর্বে মানুষ যখন জেনা-ব্যভিচার, মদ্যপান এবং গান-বাজনাসহ নানা ধরণের পাপের কাজে লিপ্ত হবে তখন এই শাস্তি অবশ্যই আসবে। কারণ নবী করিম (সা.) হাদিসে এ ব্যাপারে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। তা কিয়ামতের পূর্বে অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।
কিয়ামতের পূর্বে ব্যাপকভাবে মিথ্যা কথা বলার প্রচলন ঘটবে। এমনকি এক শ্রেণির লোক নবী (সা.) এর নামে মিথ্যা হাদিস রচনা করে মানুষের মাঝে প্রচার করবে। বাস্তবে তাই হয়েছে। ইসলাম প্রচার ও তাবলীগের নামে বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী ও জাল হাদিস তৈরি করে এক শ্রেণির লোক মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। নবী করিম (সা.) বলেনঃ ‘‘আখেরী যামানায় আমার উম্মাতের কিছু লোক তোমাদের কাছে এমন কথা বর্ণনা করবে, যা তোমরাও শুননি এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও শুনেনি। তোমরা তাদের থেকে সাবধান থাকবে। তারা যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে না পারে’’।
কিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে মহিলারা ইসলামী পোষাক পরিত্যাগ করে এমন পোষাক পরিধান করবে যাতে তাদের সতর ঢাকবেনা। তারা মাথার চুল ও সৌন্দর্যের স্থানগুলো প্রকাশ করে ঘর থেকে বের হবে। নবী করিম (সা.)বলেন, ‘‘কিয়ামতের আলামত হচ্ছে মহিলাদের জন্য এমন পোষাক আবিস্কার হবে যা পরিধান করার পরও মহিলাদেরকে উলঙ্গ মনে হবে’’। অর্থাৎ তাদের পোষাকগুলো এমন সংকীর্ণ ও আঁট-সাট হবে যে, তা পরিধান করলেও শরীরের গঠন ও সৌন্দর্যের স্থানগুলো বাহির থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যাবে।
প্রকৃত ইসলামী শিক্ষার অনুপস্থিতিই ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসের জন্ম দিতে পারে। সন্ত্রাস রোধের জন্য ইসলামের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা প্রসার অতীব প্রয়োজন। ইসলাম বিনা কারণে ঝগড়া-বিবাদের মতো ঘৃণ্যতর কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। কোনো বান্দা যে পর্যন্ত ঝগড়া-বিবাদ বর্জন না করবে, সে পর্যন্ত তার ইমানের বাস্তব রূপের পরিপূর্ণতা বিধান করতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) ঝগড়া-বিবাদ পরিহারকারীদের সুসংবাদ দিয়ে বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তির জন্য বেহেশতের সর্বোচ্চ স্থানে একটি, বেহেশতের মধ্যভাগে একটি এবং বেহেশতের বাগানে একটি ঘর আমার জিম্মায় রয়েছে, যে এমনকি ন্যায়বাদী হওয়া সত্ত্বেও ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকে।’
সমাজে পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখার ফলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ও সহাবস্থানে মন থেকে স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা ও হৃদয়হীনতার পাশবিক বৈশিষ্ট্য দূর হয়ে যায়। মানবসমাজে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য যে ব্যক্তি তার সম্মান ও মর্যাদা সংরক্ষণ করতে চায়, তার সর্বাবস্থায় ফিতনা-ফ্যাসাদ ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে বেঁচে থাকা বাঞ্ছনীয়।
বর্তমান ফিতনার যুগে ইসলামের সঠিক শিক্ষার উপরে থাকতে হলে এবং ইসলামের সঠিক শিক্ষা সর্বস্তরের জনগণের সামনে স্পষ্ট ও বাধাহীনভাবে উপস্থাপন করতে হলে ইলমী-আমলী উভয় ক্ষেত্রে অগ্রসরতা ও অবিচলতার কোনো বিকল্প নেই। এককথায় দাঈ-মাদউ উভয় শ্রেণির মাঝে ইলম ও তাকওয়ার ব্যাপক চর্চাই হচ্ছে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকার প্রধান উপায়।
লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,লেখক,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট