মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
হালাল উপার্জন ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত। মানব জীবনে বৈধ উপায়ে জীবিকা উপার্জন করা অপরিহার্য সাওয়াবের কাজ। বৈধ উপায়ে জীবিকা উপার্জন করার রয়েছে অনেক ফজিলত ও মর্যাদা। আর তাতে প্রকাশ পায় পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা। বৈধ পন্থায় উপার্জন পরিচ্ছন্ন ও উন্নত জীবন গঠনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। হালাল রিযিক উপার্জন করাকে ইসলাম ইবাদত হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। মহান আল্লাহ সৎভাবে জীবিকা নির্বাহ করার বহু পথ খোলা রেখেছেন। যেমনব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, অফিস-আদালত, বিবিধ কল-কারখানা, যানবাহন, ক্ষেত-খামারে দিনমজুর বা শ্রমিকের কাজ করা ইত্যাদি।
ইসলাম এক মহাসৌন্দর্যমন্ডিত জীবনবিধান। মানুষের জীবন স্বাচ্ছন্দ্যময় করার উদ্দেশ্যে ইসলামের বহু বিধিবিধান দেওয়া হয়েছে। ইসলামে যদি কোনো জিনিস হারাম করা হয়, তাহলে তার পরিবর্তে কোনো উৎকৃষ্টতর জিনিসকে হালাল করে দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে অতীব উত্তম বিকল্প পেশ করা হয়েছে। সে বিকল্প এমন যে তার দ্বারা একদিকে যেমন সব বিপর্যয় সৃষ্টিকারী জিনিসের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়, তেমনি হারাম জিনিসের ওপর নির্ভরশীলতা নিঃশেষ হয়ে যায়। যেমন ইসলাম পাশা খেলার মাধ্যমে ভাগ্য জানা হারাম করে দিয়েছে। তার পরিবর্তে ইস্তিখারার দোয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ইস্তিখারার মাধ্যমে কোনো কাজের ভালো-মন্দ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ইসলাম সুদ খাওয়া হারাম করে দিয়েছে। তার পরিবর্তে মুনাফাপূর্ণ ব্যবসা বৈধ করে দিয়েছে।
রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘ফরয ইবাদতসমূহের (নামাজ, রোজা, জাকাত ইত্যাদি) পরে হালাল উপার্জন করাও একটি ফরয এবং ইবাদতের গুরুত্ব রাখে।’হালাল খাবার মহান আল্লাহর ভালোবাসা এবং জান্নাত লাভের রাস্তা। দোয়া কবুলের হাতিয়ার। বয়সে বরকত হয় এবং ধনসম্পদ বৃদ্ধি পায় এতে। দুনিয়ার সৌভাগ্য এবং আখেরাতে জান্নাত লাভে সহায়ক হয়। কথায় মিষ্টতা আনে। আমল করার আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। হালাল উপার্জনে বংশের মধ্যে বরকত হয়। নিজের পরিম্রমে উপার্জন মানুষের ভদ্রতার পরিচায়ক।
কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে যে সব বিষয়কে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে, ইসলামি শারীয়াতের পরিভাষায় তা হালাল বা বৈধ। অন্য কথায়- হালাল অর্থ বৈধ, উপকারী ও কল্যাণকর বস্তুসমূহ। মানুষের জন্য যা কিছু উপকারের ও কল্যাণকর ঐ সমস্ত কর্ম ও বস্তুকে আল্লাহ পাক মানুষের জন্য হালাল করেছেন। যেমন: নামায, রোযা , হজ্জ, যাকাত, পর্দা, ছাগল মাংস ভক্ষণ, আল্লাহ নির্দেশিত ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি। একজন মুসলিমের উচিত সর্বদা হালাল বা বৈধ পদ্ধতি অবলম্বন করা।
কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে যে সব বিষয়কে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে, ইসলামি শারীয়াতের পরিভাষায় তা হারাম বা অবৈধ। অন্য কথায়, হারাম অর্থ অবৈধ, ক্ষতিকারক, অকল্যাণকর কর্ম ও বস্তুতসমূহ যা মানুষের জন্য অপকারের বা ক্ষতির কারণ। ঐ সমস্ত কর্ম বা বস্তুকে আল্লাহ পাক হারাম করেছেন। যেমন: শুকরের মাংস মানুষের জন্য ক্ষতিকারক, সুদ, ঘুষ, বেনামাজী, বেপর্দা এবং সকল পাপ কর্ম ইত্যাদি। হারাম কাজ করলে আল্লাহর শাস্তি নির্ধারিত বিধায় এ ধরনের কাজ বর্জন করাও বাধ্যতামূলক। যেমন: সুদ খাওয়া, গীবত করা বা অপবিত্র কিছু খাওয়া বা অবৈধ ব্যবসা বাণিজ্য করা।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’য়ালা হালাল বস্তু গ্রহণের ব্যাপারে একাধিকবার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন,‘‘আমি যে রিযিক তোমাদের দিয়েছি তা থেকে পবিত্রগুলো আহার করো।’’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৭২)- আল্লাহ তা’য়ালা আরো এরশাদ করেন,‘‘পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো এবং সৎ কর্মশীল হও। তোমরা যা করছ আমি তা জানি।’ (সুরা মু’মিনুন : আয়াত-৫১)
বিশ্ব মানবতার দূত হযরত মুহাম্মাদ (সা.)হালাল জীবিকা উপার্জন ও তা গ্রহণ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন,‘‘হালাল জীবিকার সন্ধান করা অন্যান্য ফরযের সঙ্গে আরেকটি ফরয।’’ (মিশকাত)
নির্দেশনা বহির্ভূত যাবতীয় উপার্জনই হারাম বা অবৈধ হিসেবে বিবেচিত। জীবিকা নির্বাহের জন্য উপার্জনের গুরুত্ব ইসলামে যেমনি রয়েছে, ঠিক তেমনি হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও অত্যাধিক। ইসলাম মানুষের জন্য যাবতীয় জীবনোপকরণকে সহজসাধ্য, সুস্পষ্ট, ও পবিত্র করার নিমিত্বে সঠিক ও বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা দিয়েছে।
হালাল রিজিক উপার্জন করা মু’মিনের জন্য ফরজ। বস্তুত খাদ্য সামগ্রী, পানীয় সামগ্রী এবং হালাল ভোগ্যবস্তুগুলোকে আল্লাহ মু’মিনদের জন্যে দিয়েছেন। তাই এগুলোকে পরিত্যাগ করা ঐশী রহমত ও দয়ার প্রতি ভ্রুক্ষেপহীনতার শামিল। একাধিক হাদিসে বৈধ উপায়ে জীবিকা উপার্জনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে, হযরত জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.)বলেছেন, ‘হে লোকেরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং বৈধ উপায়ে জীবিকা অর্জন করো। কেননা কোনো প্রাণীই তার নির্ধারিত রিযিক পূর্ণ না করে মৃত্যুবরণ করবে না, যদিও কিছু বিলম্ব ঘটে। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং সৎভাবে জীবিক অর্জন করো। যা হালাল তাই গ্রহণ করো এবং যা হারাম তা বর্জন করো।’ (ইবনে মাজাহ)
উপার্জন সম্পর্কে বিশ্ব নবীর নির্দেশ নিজের হাতে আয় উপার্জন করা সর্বোত্তম কাজ। নবী-রাসূলগণ নিজ হাতে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংসারের ব্যয়ভার নির্বাহ করতেন। রিযিক দেয়ার মালিক আল্লাহ। তিনিই বান্দাকে উত্তম রিজিক দান করেন। সে কারণে হারাম ও মাকরুহ (সন্দেহযুক্ত) জীবিকা বর্জন করা মু’মিনের কর্তব্য। মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,‘‘সুতরাং তোমরা আল্লাহর কাছে রিযিক তালাশ করো, তাঁর ইবাদত করো এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। তাঁরই কাছে তোমাদের ফিরে যেতে হবে।’ (সুরা আনকাবুত : আয়াত-১৭) ‘‘অতপর নামাজ শেষ হলে তোমরা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (রিযিক)তালাশ করো ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’’ (সূরা-জুমআ : আয়াত ১০)
হাদিসে এসেছে, হযরত মিক্বদাম (রা.)বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘‘কোনো ব্যক্তি নিজ হাতে উপার্জনের খাবারের ছাড়া উত্তম কোনো খাবার খেতে পারে না। নবী হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন।’ (বুখারি, মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ)
আবু ইয়ালার বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে লোকেরা! সম্পদের প্রাচুর্যতাই ধনী নয় বরং আসল ধনী হচ্ছে মনের ঐশ্বর্য। আর আল্লাহ তাঁর বান্দাকে তাই দেবেন যা তিনি তার রিযিকে রেখেছেন। সুতরাং সৎভাবে উপার্জন করো। যা হালাল করা হয়েছে তা গ্রহণ করো এবং যা হারাম করা হয়েছে তা বর্জন করো।’
বিশ^ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, ‘‘উত্তম উপার্জন হলো নিজ হাতের উপার্জন এবং যে কোনো বৈধ ব্যবসার উপার্জন।’’ (মুসনাদে আহমদ)
ইসলাম মানব স্বভাবসিদ্ধ একটি ধর্ম।পবিত্র জিনিসগুলোকে ত্যাগ করা মানব স্বভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইসলামে সবধরনের উগ্রতা নিষিদ্ধ, এ দু’টি আচরণই ঐশী সীমা লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে। হালালকে হারাম করা যেমন জায়েজ নয় তেমনি হারামকে হালাল করা জায়েজ নয়। এসব বিধান আল্লাহর হাতে, মানুষের হাতে নয়। হালাল বস্তুগুলো থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। সেই সঙ্গে হালাল বস্তুগুলো থেকে উপকৃত হওয়ার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি কিংবা অপচয় করাটাও উচিত নয়।
মু’মিন মুসলমানের উচিত বৈধ পন্থায় জীবিকা ও সম্পদ উপার্জন করা। হারাম তথা অবৈধ পন্থা ত্যাগ করা। কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশ মেনে বৈধ জীবিকা অর্জনের পথ অবলম্বন করা।
হারাম পথে উপার্জন করা ইসলামে নিষিদ্ধ, তা হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। শুধুমাত্র উর্ধ্বমুখী লাভের অঙ্কের দিকে তাকিয়ে অন্যের কষ্টার্জিত সম্পদকে হস্তগত করা যে কোনো আইনেই হারাম হওয়া উচিত। ইসলামে হারাম ও হালাল জীবনযাপনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, এবং পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট উল্লেখিত আছে যে হারাম উপার্জনকারীরা ইসলামের রীতিরেওয়াজকে অস্বীকার করে ও শরীয়াত বিধি লঙ্ঘন করে।
হারাম পথে উপার্জনের উদাহরণগুলো হলো ঘুষ, সুদ, কালোবাজারী, চোরাকারবারী, জুয়া-ফাটকা, প্রতারণা, লটারী ইত্যাদি। এই সমস্ত উপায়ে খুব কম পরিশ্রমে অথবা কোনো পরিশ্রম ছাড়াই প্রচুর অর্থের মালিক হওয়া যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই উপার্জন হয় অন্যকে বঞ্চিত করে। রাসূল (সা.) সমস্ত রকম রকম হারাম উপার্জন ও পন্থাকে কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। ইসলাম ধর্মের প্রত্যেকটি বিধিনিষেধের পিছনে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আছে। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর অনুসরণকারীদের উদ্দেশ্য সমস্ত নির্দেশ পবিত্র কোরআনে দিয়েছেন।
হারাম উপার্জন থেকে সৃষ্টি হয় বিশৃৃঙ্খলা। হারাম উপার্জন করা থেকে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন রকম অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকারক অভ্যাস। হারাম উপার্জন থেকে অবৈধ কাজ বৃদ্ধি পায়। অবৈধ কাজকর্মের বৃদ্ধি সমাজে তখনই বৃদ্ধি পায়, যখন মানুষ নিজের যোগ্যতার থেকে বেশি পেয়ে যায়। হারাম উপার্জন এই কাজের পিছনে শক্তি যোগায়। যারা হারাম পথে উপার্জন করে, তারা আল্লাহ তা’য়ালার ইবাদতের পথ থেকে সরে এসে বেছে নেয় বিলাসিতার পথ, ভুলে যায় সমস্ত ইসলাম ও দ্বীনের কর্তব্য। বিশাল প্রাসাদোপম অট্টালিকা, মদ, বেশ্যাগমন ইত্যাদি সমস্ত অবৈধ কাজই এদের থেকে সমাজে ছড়িয়ে পরে।
ইসলামে হারাম উপার্জন নিষিদ্ধ হওয়ার কারণগুলি হলো: হারাম উপার্জন বঞ্চনা ও অত্যাচারের উপর নিহিত থাকে।সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার ও বঞ্চনার দ্বারা যে অর্থ উপার্জন করা হয় তা অবশ্যই হারাম। অপরকে সরাসরি বা কৌশলে ঠকিয়ে অর্থ উপার্জন করা মানে সমাজের একটা শ্রেণি অসীম ধনসম্পদের মালিক হওয়া, এবং অপর শ্রেণি দারিদ্রের অন্ধকারে ঢেকে থাকে। এর ফলে যে যার প্রাপ্য অর্থ বা সম্মান কোনোটাই পায় না, সমাজে সৃষ্টি হয় অসন্তোষ, হিংসা ও আরও অনেক রকমের বিশ্রী সমস্যা। যারা ঘুষ নেয় তারা নিজেদের দায়িত্ব পালন করার জন্যও অপরের কাছে বলপূর্বক টাকা আদায় করে। এদের উদ্দেশ্যে রাসূল (সা:) বলেছেন, “যারা ঘুষ দেয় ও নেয়, তারা দুপক্ষই আল্লাহের অভিসম্পাতের শিকার।”
অপব্যয়ের পথে নিয়ে যায় হারাম উপার্জন । হারামের পথে অর্থ উপার্জন হয়ে যায় সহজলভ্য, ফলে উপার্জনকারীর সেই সম্পদ দুহাতে খরচ করে। তাদের জীবনধারণে কোনোরকম নিরাপত্তা বা স্থিরতা। এই ধরনের জীবনযাপন যেকোনো সমাজের ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর। হারাম উপার্জনকারীরা নিজেদের দায়দায়িত্ব পালনে অপারগ হয়, এবং অনেক্ষেত্রেই বদমেজাজি, দুর্ব্যবহারকারী হয়। ঠিক যেমন কৃপণতা একটি খারাপ অভ্যাস, অত্যাধিক ভয়ও সেরকমই ক্ষতিকারক অভ্যাস।
জুয়া হারাম উপার্জন। হারাম উপার্জনকারী ব্যক্তিরা জুয়ার প্রতি আসক্ত হয় কারণ এখানে চুটকিতে ভাগ্যপরিবর্তন করার হাতছানি থাকে। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা জুয়া সময়ের সাথে সাথে আরও সর্বনাশা হয়েছে। ইসলাম জুয়া খেলা হারাম করেছে, তার পরিবর্তে ঘোড়া, উট ও তীরের প্রতিযোগিতালব্ধ ধন-সম্পদ গ্রহণ বৈধ করেছে। শর্ত হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত তা শরিয়তের পরিপন্থী না হয়।
আল্লাহ তা’য়ালা সূরা মায়েদা, আয়াত ৯০ এ জুয়াকে স্পষ্টভাবে নাপাক ও হারাম বলেছেন। পাশা, তাস, রুলে, লটারি, ঘোড়াদৌড় সব ধরণের জুয়াই প্রত্যেক ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের পরিহার করা অবশ্যকর্তব্য। হালাল-হারাম যদি বেছে না চল হয় তাহলে ঈমান অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কারণ কোরআন কারীমে ঈমান-আমলের সাথে হালাল রিযিকের কথাও আছে।
দু’আ মু’মিনের বড় সম্বল। যদি কামাই রোযগার শুদ্ধ না হয়, তাহলে দু’আ কবুল হয় না। আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি সবকিছুর বিধি-বিধান, নিয়মনীতি যেহেতু অন্যদের অনুসরণে করা হচ্ছে, এজন্য সময় যতো বাড়ছে বিষয়গুলো কঠিন হচ্ছে এবং নতুন নতুন পন্থা বের হচ্ছে। শর্টকাট বড়লোক হওয়ার কিছু পন্থাও বের হচ্ছে। এসব হচ্ছে টেকনোলজির উন্নতির কারণে এবং মানুষের মধ্যে সম্পদের মোহ বেড়ে যাওয়ার কারণে। সম্পদ এখন এক শ্রেণির কাছে বেশি, এক শ্রেণির কাছে কম, আবার এক শ্রেণির কাছে নেই। এ বৈষম্যটা বাড়ার কারণে সম্পদের মোহ সবাইকে ধরছে।
কারো হারাম ইনকাম যদি হালাল পথে হয়ে থাকে তাহলে আপনার ইনকাম যেটি হয়েছে সেটি হারাম নয়। বাকি আপনি যে হারাম পদ্ধতিতে ইনকাম করেছেন, তার জন্য আপনি অবশ্যই গুণাগার হবেন এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে, হারাম উপাজর্ন যেভাবে করেছেন সেখানে যদি কারো হক থেকে যায় তাহলে ওয়াজিব হচ্ছে সেখানে প্রত্যর্পন করতে হবে ফি দিতে হবে। সেটা আপনি দেখে নিবেন। আপনি সুস্পষ্ট পদ্ধতি আলোচনা করেননি যে কীভাবে কোন হারাম পদ্ধতিতে উপার্জন করেছেন।
কোরআনে কারিমের সূরা মায়েদার ৮৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে মু’মিনগণ! তোমরা ওই সব সুস্বাদু বস্তু হারাম করো না, যেগুলো আল্লাহ তোমাদের জন্যে হালাল করেছেন এবং সীমা অতিক্রম করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীদেরকে পছন্দ করেন না। ’
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো,কল্যাণময় নিয়ামতকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে ন্যায়, ভারসাম্য এবং তাকওয়ার মানদন্ড মেনে চলতে হবে। কোরআনের অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন খাও এবং পান করো। তবে অপচয় করো না। আরেক আয়াতে বলা হয়েছে, খাও এবং যথার্থ কাজ করো, খাও এবং অন্যদেরকেও খাওয়াও।
বৈধভাবে উপার্জনের নির্দেশ প্রত্যেক নবীর জন্য প্রযোজ্য ছিলো। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে রাসূলরা! তোমরা পবিত্র বস্তু ভক্ষণ করো এবং নেক কাজ করো।’ (সূরা : মু’মিনুন; আয়াত- ৫১) অবৈধভাবে উপার্জিত খাবার খেয়ে ইবাদত করলে সাওয়াব পাওয়া যাবে না। ওই ইবাদতের মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়া যাবে না। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই গোশত (দেহ) জান্নাতে যাবে না, যা হারাম (খাবার) থেকে উৎপন্ন। জাহান্নামই এর উপযোগী।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নম্বর : ১৭২৩, তিরমিজি, হাদিস নম্বর : ৬১৪)
ইসলাম পুরুষদের রেশম ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। তার পরিবর্তে সুতা, পশম, কাতানের বিভিন্ন সৌন্দর্যময় পোশাক বৈধ করেছে। ইসলাম জিনা-ব্যভিচার হারাম করেছে। তার পরিবর্তে বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে বৈধ উপায়ে যৌন সঙ্গম বৈধ করেছে। ইসলাম মাদকদ্রব্য হারাম করেছে। তার পরিবর্তে দেহ ও মনের উপকারী সুস্বাদু পানীয় হালাল করে দিয়েছে। ইসলাম খারাপ ও নিকৃষ্ট ধরনের খাদ্য হারাম করেছে। তার পরিবর্তে উত্তম, উৎকৃষ্ট ও ভালো খাদ্য হালাল করে দিয়েছে।
‘কেয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও স্বস্থান হতে নড়তে দেয়া হবে না। ১. তার জীবনকাল কীভাবে অতিবাহিত করেছে, ২. যৌবনের সময়টা কীভাবে ব্যয় করেছে, ৩. ধন সম্পদ কীভাবে উপার্জন করেছে, ৪. তা কীভাবে ব্যয় করেছে, ৫. সে দ্বীনের যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে সেই অনুযায়ী আমল করেছে কিনা।’’
হালাল উপার্জন যেমন ইবাদত কবুলের শর্ত আবার উপর্জন করতে গিয়ে যদি কারো পরিশ্রম হয় এবং সে পরিশ্রমে ঘাম ঝরে তবে ওই ব্যক্তির ঘামের বিন্দুতে তার গোনাহ মাফ হয়। ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) হারাম মিশ্রিত জীবিকায় গঠিত দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এমনকি হারাম উপায়ে উপার্জিত অর্থদানে সাওয়াবও থাকে না। তা নিজের জন্য যেমন বরকত হয় না তেমনি উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে তা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হয়ে যায়।
পবিত্র কোরআন-হাদিস এবং নবী-রাসূল ও ইসলামি স্কলাররা সর্বদা হালাল উপার্জন ও হালাল খাদ্যের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তাদের অভিমত হলো- সর্বদা হালাল রুজি অর্জন করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। কেননা তা মানুষকে ধার্মিক হিসেবে বাঁচতে সাহায্য করে।
হালাল রুজি মানুষের শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়েই উপকারী ও কল্যাণকর। যে লোক দুধ পান করে সে লোকের যেমন স্বাস্থ্য ভালো হয়, তেমন তার বুদ্ধিও বাড়ে, তার মনমানসিকতা হয় দুধের মতো নির্মল। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি মদ পান করে মদ তার স্বাস্থ্যকে যেমন নষ্ট করে, তেমন মস্তিষ্ককে করে বিকৃত, ধ্বংস করে চরিত্রকেও। মানুষের কাছে হয় লাঞ্ছিত ও অপমাণিত।
মানুষের প্রত্যহিক ও জাগতিক জীবনের চাহিদার কোনো অন্ত নেই। আর তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মহান স্রষ্ট্রার অনুগ্রহের, ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। আর এর জন্য প্রয়োজন একান্তে তাঁর কাছে দোয়া করা। মহান আল্লাহ তায়ালাও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দু’আ কবুল করার। ইবাদত ও দু’আ কবুল হওয়ার ব্যাপারে হালাল খাদ্যের অনেক প্রভাব রয়েছে। খাদ্য হালাল না হলে ইবাদত ও দু’আ কবুল হওয়ার যোগ্য হয় না।
হালাল উপার্জন ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে যেমন বিরাট নেয়ামত,তেমনি হারাম উপার্জনের প্রভাব অত্যন্ত মারাত্মক। হারাম উপার্জনের ফলে আল্লাহ তা’য়ালা মানবজীবন থেকে সব ধরনের বরকত ছিনিয়ে নেন। রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। আর্থিক অভাব অনটন ও সংকট নেমে আসে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য সবাইকে চেষ্টা করতে হবে। ইসলাম মনে করে, আধ্যাত্মিকতার জন্য হালাল খাবার হচ্ছে সর্ব প্রথম ধাপ। সুতরাং মানুষকে আধ্যাত্মিকতা অর্জন করতে হলে অবশ্যই হালাল রুজি-রোজগার করার পাশাপাশি তাকে অবশ্যই পবিত্র ও হালাল খাদ্য খেতে হবে।
আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষের জন্য রুজিরও ব্যবস্থা করেছেন।পৃথিবীতে আসার আগে মায়ের গর্ভ থেকেই সে ব্যবস্থা তিনি করেছেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের স্তনে দুধের ব্যবস্থা করেছেন। তেমনি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে দ্রব্যসামগ্রী সে আহার করবে, সেগুলোর কোনোটি তার স্বাস্থ্যের, আত্মার, জ্ঞানের, কর্মের জন্য উপযোগী সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তা পবিত্র ও হালাল রূপে চিহ্নিত করেছেন। যে কাজের মাধ্যমে তার জন্য ও সমাজের অন্য লোকদের জন্য কল্যাণ নিহিত এবং কারও জন্য যাতে কোনো প্রকার ক্ষতি না হয়, সে ধরনের কাজ ও শ্রম দ্বারা অর্জিত রুজি-রোজগার হালাল করেছেন। ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত হলো হালাল উপার্জন। আল্লাহর নির্দেশিত পথে পরিশ্রম করে হালাল রুজি কামাই করলে বান্দা এ পৃথিবীতে যেমন শান্তি পাবে, তেমন পরকালেও হবে পুরস্কৃত।
লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট