আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে ছাত্র-শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য

মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
বাবা-মায়ের পর শিক্ষকই যে ছাত্রের কাছে দ্বিতীয় পিতা বা মাতার মর্যাদায় আসীন হন তার মূলে রয়েছে ছাত্রের জীবনে শিক্ষকের বিশেষ ভূমিকা। তাই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মম ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকাই বিশেষ কার্যকর হলেও ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের ভূমিকা ও অবস্থানের ওপর ঐ সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ভর করে। এবং সম্পর্কটি মধুর ও পবিত্র হলে তার ভিত্তিতেই ছাত্রের ভবিষ্যৎ জীবন সার্থক ও মহিমান্বিত হয়ে ওঠে।
শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকতার চেয়ে মহৎ ও শ্রেষ্ঠ পেশা আর হতে পারে না। এটি যেমন সম্মানজনক, তেমনি এতে রয়েছে আত্মতৃপ্তি। আছে জ্ঞান-অভিজ্ঞতা অন্যদের মধ্যে স্থানান্তরের আনন্দ। একজন আদর্শ শিক্ষক ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-নির্বিশেষে সবার কাছেই শ্রদ্ধেয়। সব দেশে, সব সমাজেই শিক্ষকরা বিশেষ মর্যাদা পেয়ে থাকেন। তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যেমন ভক্তি পেয়ে থাকেন, তেমনি শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের কাছ থেকেও পেয়ে থাকেন প্রভূত শ্রদ্ধা ও সম্মান। শিক্ষকতাই একমাত্র পেশা, যাতে পেশাদারি মনোভাবের চেয়ে সেবার দিকটাই বেশি পরিস্ফুটিত হয়। তাই এ পেশাকে অনেকেই পেশা না বলে ব্রত বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এবং এটাই হওয়া উচিত। যারা শিক্ষকতা করেন বা শিক্ষাদান করেন, তারাই শিক্ষক। শিক্ষকদের মর্যাদা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। পবিত্র কোরআনে কারিম এবং হাদিসসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থেও শিক্ষকদের মর্যাদার কথা ভিন্ন ভিন্নভাবে বলা হয়েছে। এক হাদিসে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি, যে অপরকে কোরআন শিক্ষা দেয় এবং নিজেও শিখে।’
পৃথিবীতে মাতা-পিতার পরেই শিক্ষকদের স্থান। মাতা-পিতা শিশুকে জন্ম দেন আর শিক্ষক তাকে মানুষরূপে গড়ে তোলেন। আজকের পৃথিবী যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারাও যে কোনো শিক্ষকের ছাত্র। শিক্ষকরা সর্বদা মানুষ গড়ার কাজে ব্যস্ত থাকেন। একটি শিশুর জন্য শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো তার পরিবার এবং শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হলেন শিশুর বাবা-মা। তারপরও প্রচলিত শিক্ষার দায়িত্ব যিনি পালন করেন, তাদেরই আমরা শিক্ষক বলি। শিশুর সুপ্ত প্রতিভাকে বিকাশের জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে যিনি শিক্ষাদান করেন, তিনিই হলেন শিশুর আদর্শ শিক্ষক।
ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের মধ্যে একটি পরম আন্তরিকতার সুর ধ্বনিত হয়। ছাত্ররা জ্ঞান আহরণের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গমন করে। যেখানে শিক্ষর বিচিত্র উপকরণের সমাবেশ থাকে। সব ধরনের উপকরণের সহায়তায় জ্ঞান বিতরণ করেন শিক্ষক। শিক্ষককে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বললেও অযৌক্তিক বলা হবে না। ছাত্ররা জ্ঞানার্জনের প্রস্তুতি ও আগ্রহ নিয়ে শিক্ষকের শরণাপন্ন হয়। নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক অত্যন্ত আন্তরিকতায় জ্ঞানদানে প্রবৃত্ত হন। আগ্রহী ছাত্রের কাছে নিজের হৃদয়মন উজাড় করে দিতে শিক্ষকের কোনো কার্পণ্য নেই। বরং ছাত্র যদি সুযোগ্য হয় তাহলে শিক্ষক জ্ঞান বিতরণে অপরিসীম আনন্দ অনুভব করেন। নিজের মানসশিষ্য বলে ছাত্রদের বিবেচনা করে শিক্ষক তাঁর সর্বোত্তম জ্ঞানদানে তৎপর হন। ছাত্র তখন আর দূরে থাকে না। হয়ে ওঠে শিক্ষকের একান্ত আপনজন। একজন মানুষের জীবনের পরিপূর্ণতা বলতে বুঝায় জীবনের বিকাশ, ব্যক্তিত্বের জাগরণ ও তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ। এই সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে শিক্ষকের অগ্রণী ভূমিকার কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এক্ষেত্রে শিক্ষক যথেষ্ট পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল ও অধ্যবসায়ী হয়ে শিক্ষার্থীর মনের খোরাক মেটাতে সচেষ্ট হন। শিক্ষক তাঁর মেধা দিয়ে শিক্ষার্থীর মনে প্রচন্ড কৌতূহল জাগিয়ে তোলেন।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের যাবতীয় ক্ষেত্র এবং শিক্ষা–সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা দেয় ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআন। এই মহান গ্রন্থের নির্দেশনাকে বাস্তব ক্ষেত্রে রূপ দিয়েছেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি জগৎ ও জীবনের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক সব সমস্যার সমাধান নিজ জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেখিয়ে গিয়েছেন। এমন কোনো সমস্যা নেই, যা তিনি (হযরত মুহাম্মদ সা.) স্পর্শ করেননি এবং তিনি যা স্পর্শ করেছেন তা পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করেছেন। ইসলামে বিশেষ করে আল-কোরআন ও হাদিসে জ্ঞানার্জনের প্রতি কী নির্দেশ আছে, তা জানা আবশ্যক। পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধানের উৎস পবিত্র কোরআন হলো মুসলিম বিশ্বের মূল শিক্ষাগ্রন্থ। এ গ্রন্থের বিধান থেকে শিক্ষাও বাদ যায়নি; বরং এ গ্রন্থের প্রথম আয়াত অবতীর্ণ হয় শিক্ষার দু’টি দক্ষতা উল্লেখ করে; তা হলো পড়া ও লেখা।
কোরআনে রয়েছে, ‘হে প্রভু! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও।’ (সূরা- তহা, আয়াত: ১১৪)।শিক্ষা গ্রহণ ছাড়া জ্ঞান বৃদ্ধি পেতে পারে না। মানবাত্মার সঠিক বিকাশের প্রধান উপায় হলো শিক্ষালাভে জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজের সত্তা উপলব্ধি করে জীবন সমস্যা সমাধানে দক্ষতা অর্জন করা। আল্লাহ তা’য়ালা নবী ও রাসূলদের শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়েছেন। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পূর্বে প্রেরিত নবীরা সবাই ছিলেন মহান শিক্ষক। শেষ নবী (সা.)–কে জগতের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকাস্বরূপ প্রেরণ করা হয়। আল্লাহ তা’য়ালা স্বয়ং তাঁকে শিক্ষার বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘আমাকে শিক্ষক হিসেবেই পাঠানো হয়েছে।’ এ ক্ষেত্রে হযরত আদম (আ.)-এর শিক্ষাপদ্ধতিও উল্লেখ করা যায়। হযরত আদম (আ.) সরাসরি আল্লাহর তত্ত্বাবধানে প্রত্যক্ষভাবে প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন এবং ফেরেশতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রথম হয়ে মানবের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। হযরত আদম (আ.) ছিলেন বিশ্বের প্রথম শিক্ষক। ধরায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞান দ্বারা তাঁর পরিবার-পরিজনকে শিক্ষা দান করেন। তাঁর স্রষ্টা ও শিক্ষকের গুণাবলি ও নির্দেশনা প্রচার করেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন বিশ্বশিক্ষক।
জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের যে প্রক্রিয়া মানুষকে আলোকিত করতে সাহায্য করে তাকেই শিক্ষা বলে। কোনো বিষয় চর্চা বা অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ যে ধারণা ও জ্ঞান অর্জন করে এবং ঐ জ্ঞানের জ্যোতির দ্বারা নিজে আলোকিত ও সমাজকে জ্যোর্তিময় করতে সহায়তা করে শিক্ষা তাকেই বলে। যে প্রক্রিয়ায় মানুষের মন-মনন, মানসিক উৎকর্ষ সাধন করে, মানুষের আচার আচরণ, মন ও আত্মার ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন ঘটায়, মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের প্রভাব ফেলে এমন কর্ম প্রক্রিয়াকে শিক্ষা বলে। আর শিক্ষক হচ্ছেন উল্লিখিত শিক্ষা প্রক্রিয়াকে উস্কে দেয়া, উৎসাহিত করা অনুপ্রেরণা-দানকারী ব্যক্তি। তিনি সভ্যতার অভিভাবক, সমাজের অভিভাবক, সমাজের প্রতিনিধি। কার্যত শিক্ষক বলতে একজন আলোকিত, জ্ঞানী, গুণী ও বুদ্ধিদীপ্ত পন্ডিত ব্যক্তিকে বুঝায়,যিনি বিবর্তনের অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শিক্ষা প্রিয়ার নিবেদিতপ্রাণ সেবক, ব্যবসায়ী নন। তিনি তাঁর আচার-আচরণ, মন ও মননে নিজেই বটবৃক্ষের ছায়া। তাঁর সাফল্যের ভিত্তি হলো পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা, নির্মল চারিত্রিক গুণাবলী, জ্ঞান সঞ্চারণে আন্তরিক সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টা। তাই শিক্ষক বলতে এমন এক অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ববান জ্ঞানী, গুণী ও পন্ডিত ব্যক্তিকে বুঝায়, যিনি শিক্ষার্থীকে শিখন প্রক্রিয়ায়, জ্ঞান অন্বেষণ ও আহরণে,মেধা বিকাশ ও উন্নয়নে, শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনে, নৈতিক ও মানসিক গুণাবলী বিকাশে এবং সমাজ বিবর্তনে অনুঘটক ও সুশীল সমাজ তৈরির সহায়তা দানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হচ্ছেন অন্য শিক্ষকদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাই প্রধানের দায়িত্বও বেশি।
শিক্ষকদের নিকট সমাজের প্রত্যাশা অনেক। শিক্ষকগণ সমাজের প্রত্যাশা শতকরা যতো ভাগ পূরণ করতে পারবেন সমাজও ন্যূনতম তত ভাগ সম্মান শিক্ষকদের দেবেন। অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, এখন গিভ এন্ড টেকের সময় যাচ্ছে। সমাজের প্রত্যাশা মোতাবেক একজন শিক্ষক হবেন জ্ঞান তাপস, মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত, ব্যক্তিত্ববান, চৌকস, শ্রেণি কক্ষে আন্তরিক পাঠদানকারী ও জ্ঞান বিতরণে আগ্রহী। তিনি সুবিচারক, সুপরীক্ষক, শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রক, যুক্তিবাদী, গবেষক এবং উদ্ভাবকও। তিনি সঠিক পথের দিশারী, পথ পরিদর্শক। অবশ্যই সৎ ও ধার্মিক। শিক্ষক সহজ হবেন, সরল হবেন, নির্মল হবেন, হবেন অকুতোভয় সত্যবাদী। সপ্রতিভ ব্যক্তিত্ববান, সমাজ হিতৈষী, পরোপকারী এবং আধুনিকতামনস্ক সমাজ সংস্কারক। শিক্ষক হবেন চারিত্রিক দৃঢ়তাসম্পন্ন,পরিশ্রমী,নিরপেক্ষ,হাস্যোজ্জ্বল,সুপরামর্শক ও প্রাণবন্ত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সেকারণে ইংরেজী টিচার শব্দের অর্থ করা হয়েছে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন আঙ্গিকে।
বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়। এ দিবসকে আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবসও বলা হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে ইউনেস্কোর উদ্যোগে এই দিবস পালিত হচ্ছে। শিক্ষকদের অবস্থা, সমাজে তাঁদের অপরিহার্যতা, মর্যাদা এবং শিক্ষক ও শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোচনা ও গণসচেতনতার জন্য ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিস শহরে আন্তর্দেশীয় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিস্তারিত আলোচনান্তে সভায় শিক্ষকদের অবস্থা, মর্যাদা ও অন্যান্য বিষয়সংক্রান্ত একটি সুপারিশমালা প্রকাশ করা হয়। উল্লিখিত সুপারিশমালায় শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা ও কর্তব্যের অপরিহার্যতা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সঙ্গে শিক্ষকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের মৌলিক প্রশিক্ষণ, ক্রমাগত শিক্ষা লাভ এবং শিক্ষক নিয়োগের গাইডলাইন নির্ধারিত হয়। শিক্ষকদের মর্যাদা, যোগ্য শিক্ষক তৈরি এবং শিক্ষার অনুকূল পরিবেশের উন্নয়নই সুপারিশমালার লক্ষ্য। এই সুপারিশমালার আলোকে পরবর্তী সময়ে ইউনেস্কো সিদ্ধান্ত নেয় ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের। শিক্ষার অধিকার ও যোগ্য শিক্ষক পাওয়ার অধিকার সমার্থক। যোগ্য শিক্ষক ব্যতীত শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করতে পারে না এবং আদর্শ ও সুনাগরিক হতে পারে না। যোগ্য শিক্ষক তৈরি করতে হলে শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি আর্থিক ও অন্য বিষয়গুলোর সন্তোষজনক সমাধান দিতে হবে। আধুনিক ও সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা লাভের সুযোগ চলমান রেখে শিক্ষকদের জ্ঞানের ভান্ডার বৃদ্ধি করতে হবে এবং সে জ্ঞানের ভান্ডারই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। একজন আদর্শ শিক্ষক সেভাবেই তাঁর দায়িত্ব পালন করেন এবং তাই করা উচিত। শিক্ষার্থীর সাফল্যই একজন শিক্ষকের সাফল্য।
হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, একদা হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তার মসজিদে, অর্থাৎ মসজিদে নববিতে সাহাবাদের দু’টি মজলিসের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করলেন। (মজলিস দু’টি ছিলো একটি দোয়ার ও অন্যটি ইলমের তথা শিক্ষা কার্যক্রমের) এটা দেখে তিনি বললেন, উভয় মজলিসই ভালো কাজে মশগুল আছে, তবে একটি মজলিস অপর মজলিস অপেক্ষা উত্তম। এই যে দলটি যারা দোয়ায় মশগুল আছে, তারা অবশ্য আল্লাহকে ডাকছে এবং আল্লাহর প্রতি নিজেদের আগ্রহ প্রকাশ করছে। আল্লাহপাক চাইলে তাদের (তিনি তাদের বাঞ্ছিত বিষয়) দানও করতে পারেন, আবার চাইলে বঞ্চিতও করতে পারেন। আর এই যে অপর দলটি যারা জ্ঞান চর্চা করছে এবং অন্যান্য অনবহিতদের শিক্ষা দিচ্ছে, তারাই উত্তম। প্রকৃতপক্ষে আমিও একজন শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি। অতঃপর তিনি (সা.) এই (শিক্ষানবিশ) দলের মধ্যেই বসে পড়লেন। (মিশকাত)
ছাত্ররা জ্ঞানার্জনের যে সাধনায় নিয়োজিত হয়, তাতে শিক্ষকগণ উদার সহযোগিতা প্রদান করেন। শিক্ষকগণের সুচিন্তিত নির্দেশনায় ছাত্ররা শিক্ষার অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করে। শিক্ষকের কল্যাণধর্মী স্নেহচ্ছায়ায় শিক্ষার্থীর জীবন বিকশিত হয়। শিক্ষক ছাত্রদের সামনে জ্ঞানের আলো তুলে ধরেন। শিক্ষকের প্রদর্শিত জ্ঞানসম্পদে ছাত্ররা নতুন জীবন লাভ করে। এ জীবনই তার বিকাশের, যোগ্যতা প্রদর্শনের আর গুণাবলি চর্চার। এ সবই শিক্ষকের অকৃত্রিম আশীর্বাদপুষ্ট হলেই সম্ভব হয়ে ওঠে। এই পটভূমিকায় ছাত্র-শিক্ষকের পরম পবিত্র সম্পর্ক গড়ে ওঠে, মহত্ত্বের এক অনাবিল সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটায়।
মানুষের জ্ঞানচর্চার শুরু থেকেই ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের সূচনা হয়েছে। তাই এই সম্পর্ক সুদীর্ঘ দিনের। অতীতে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ছিল পরমাত্মীয়ের। শিষ্যেরা গুরুগৃহে অবস্থান করে বিদ্যার্জনের পাঠ গ্রহণ করত। তখন তারা গুরুর পরিবারের একজন হয়ে উঠতো এবং সংসারের সকল কাজে জড়িত থেকে জ্ঞানার্জনে তৎপর হতো। তারপর এক সময় পাঠ সমাপন করে গুরুদক্ষিণা দিয়ে শিষ্য নিজগৃহে ফিলে এসে সংসার ধর্মে নিয়োজিত হত। এভাবে শিষ্য ও গুরুর মধ্যে একটি অনাবিল সম্পর্কের বিকাশ ঘটত। গুরু শিষ্যকে সর্বোত্তম জ্ঞান দিয়ে গড়ে তুলতেন। নিজের বিদ্যা শিষ্যকে দান করে গুরু শিষ্যের মধ্যেই বেঁচে থাকতেন। গুরুর প্রতি শিষ্যের ভক্তি-শ্রদ্ধাও ছিলো অপরিসীম। প্রাচীন ভারতে ও গ্রিসে শিক্ষক-শিক্ষর্থীর মধ্যে এভাবে এক অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে উঠতো। সেই ঐতিহ্যের আদলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শিক্ষক হচ্ছেন ছাত্রের ফ্রেন্ড,ফিলোসপার এন্ড গোয়াইড । গুরুর মতো পরামর্শ দেন বলে শিক্ষক ছাত্রের বন্ধু, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য নির্দেশ করে ছাত্রকে নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করেন বলে তাঁর ভূমিকা দার্শনিকের। আবার জীবনের সর্বক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রদান করে ছাত্রের ভবিষ্যৎ চলার পথকে সুগম করে দেন বলে তিনি গাইড বা পথপ্রদর্শক। রবীন্দ্রনাথ ছাত্র-শিক্ষকের পরস্পর সম্পর্ককে বিচার করেছেন পরস্পর নির্ভর, সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক হিসেবে। সে সম্পর্ক কেবল পুঁথিগত বিদ্যা শেখানো ও শেখার মধ্যে আবদ্ধ নয়।
“শিশু হলো উদ্যানের চারাগাছ। শিক্ষক হলেন তার মালী। শিক্ষকের কাজ হলো সযত্নে চারাগাছটিকে বড় করে তোলা। শিশুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সৎ ও সামাজিক গুণাবলীর বিকাশ সাধন করা শিক্ষকের কর্তব্য”।(ফ্রেডরিক ফ্রয়েবেল) চিনের প্রাচীন নেতা কনফুসিয়াস বলেছেন-“শিক্ষক হবেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উৎস। তিনি হবেন একজন আদর্শ শাসক”। শিক্ষা আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার। শিক্ষক হলো তার সুনিপুণ কারিগর। শিক্ষা ছাড়া আলোকিত মানুষ সৃষ্টি কোনভাবেই সম্ভব নয়। একজন শিক্ষকের কিছু কাজ ও দায়বদ্ধতা আছে। এ কাজ ও দায়বদ্ধতা সহকর্মীদের কাছে, সমাজের কাছে, দেশ ও জাতির কাছে, আগামী প্রজম্মের কাছে। একজন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। শিক্ষক শুধু সফল নয়, একজন ভালো মানুষ হতে শেখান। মানবিক বিপর্যয় বা বৈশ্বিক, অর্থনৈতিক সংকটে আক্রান্ত হয়েও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিনির্মাণে শিক্ষকরা অবিরাম ভূমিকা রেখে চলেছেন। শিক্ষক হচ্ছেন সভ্যতার ধারক-বাহক। শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না, তিনি মানুষ গড়ার কারিগরও।
আদর্শ শিক্ষক মানুষকে চূড়ান্ত কল্যাণের পথে পরিচালিত করেন। সুষ্ঠু ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে এসব শিক্ষককে আধুনিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। শিক্ষককে কাছ থেকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আলোকিত অঙ্গনে প্রবেশ করে। শিক্ষকই একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞানবৃক্ষকে তৈরি ও সমৃদ্ধ করে। এ কারণে একজন শিক্ষকের উচিত ছাত্রদেরকে আদর্শ হিসেবে গড়ে তুলতে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ এবং সে অনুপাতে কাজ করা। মানুষ গড়ার কারিগর একজন শিক্ষকই পারেন একটি সুশিক্ষিত ও উন্নত জাতি গঠন করতে। শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব, আদর্শ ও মানবিক মূল্যবোধ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একজন শিক্ষার্থীর উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। পিতা-মাতা সন্তান জন্ম দিলেও শিক্ষকই তাকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। একজন শিক্ষকই পারেন শিশুর সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করে জাতির উন্নয়নে নিযুক্ত করতে। তার চিন্তা-চেতনা ও মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন একজন শিক্ষক। সন্তানের কাছে তার পিতা-মাতা যেমন আদর্শ ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত তেমনি একজন শিক্ষকও তার ব্যক্তিত্ব, আদর্শ ও কর্মের গুণে শিক্ষার্থীর কাছে আদর্শ ও অনুকরণীয় হয়ে ওঠেন।
শিক্ষক মূল্যবোধ বিনির্মাণের আদর্শ কারিগর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মূল্যবোধ চর্চার অনন্য কারখানা। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে মূল্যবোধে উজ্জীবিত করে সমাজকে করতে পারে আলোকিত ও উদ্ভাসিত। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীকে মূল্যবোধের পরীক্ষা দিতে হয়। বর্তমান মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় চলছে। পাশ্চাতের স্টাইলে গড়ে উঠছে সমাজ ব্যবস্থা। নগ্নতা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা, মাদক যুবসমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। মূল্যবোধের চরম সংকট মূহুর্তে দেশের শিক্ষক সমাজকে শ্রেণিকক্ষসহ সমাজ ও রাষ্ট্রে মূল্যবোধ বিকাশের জন্যে সর্বাত্মক ভূমিকা রাখতে হবে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণেধরা মূল্যবোধকে শিক্ষক সমাজই আবার জাগিয়ে তুলতে পারেন। ছাত্র-ছাত্রী, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রধান কর্ণধারের ভূমিকা পালন করতে হবে শিক্ষক সমাজকেই। শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধে সৃষ্টি করে প্রকারান্তরে সমাজ ও দেশকে মূল্যবোধে উজ্জীবিত করতে পারেন।
সুসম্পর্ক স্থাপন একজন শিক্ষকের সুপরামর্শদাতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এটিই প্রথম ধাপ। শিক্ষকের উপস্থিতি যেন ছাত্রের কাছে স্বস্তিদায়ক হয় এবং সে মন খুলে যাতে তার কথা শিক্ষককে জানাতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি। মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষক যতক্ষণ না ছাত্রের আস্থা অর্জন করছেন ততক্ষণ ছাত্র তার সমস্যা বিশ্বাস করে সেই শিক্ষককে বলতে পারবে না। তাই এই ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠা একান্ত কাম্য। ছাত্রকে মনের ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া জরুরি শিক্ষার্থীরা যখন তাদের সংকটের কথা শিক্ষককে জানানো শুরু করবে, তখন তাদের সমস্যা মন দিয়ে শুনতে হবে শিক্ষককে। কোনো রকম বাধা না দিয়ে ছাত্রদের প্রাণ খুলে বলার স্বাধীনতা দিতে হবে। এই অবস্থায় ছাত্রের চিন্তাভাবনার সঙ্গে শিক্ষকের সহমত পোষণ করা একান্ত জরুরি। এইভাবে ছাত্র-শিক্ষকের চিন্তার মধ্যে স্বচ্ছতা আসবে। আর তার ফলে ছাত্রদের মূল সমস্যাটিকে চিহ্নিত করে ধীরে ধীরে তার সমাধানের পথ খোঁজা শুরু হবে। অপ্রয়োজনীয়, অহেতুক মতামত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয় ছাত্রদের অনুভূতির প্রতি সহানুভূতি এবং প্রত্যয়ী মনোভাব দেখানো শিক্ষকের অবশ্য কর্তব্য।
শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। শিক্ষার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষকের। একজন ছাত্রকে কেবল শিক্ষিতই নয়, বরং ভালো মানুষ করে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্বটাও থাকে শিক্ষকের ওপরই। তাই একজন শিক্ষককে হতে হয় অনেক বেশি সচেতন, অনেক বেশি ধৈর্যশীল। একজন আদর্শ শিক্ষক হতে হলে আপনাকে বিশেষ কিছু গুণের অধিকারী হতে হবে। শিক্ষাদানের প্রধান উদ্দেশ্যই হলো শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ জীবন বিকাশে সহায়তা প্রদান করা। এ লক্ষ্য অর্জনের পূর্বশর্ত হলো উপযুক্ত শিক্ষক। শিক্ষক-শিক্ষিকার পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, জ্ঞানের সমন্বয় সাধন, উন্নতি ও সঠিক পন্থায় বিতরণের জন্য প্রশিক্ষণ অপরিহার্য।
আদি শিক্ষক হলেন স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা। তাই ফেরেশতারা বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি পবিত্র! আপনি যা শিখিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের কোনোই জ্ঞান নেই; নিশ্চয়ই আপনি মহাজ্ঞানী ও কৌশলী।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ৩২)। আমাদের প্রিয় নবী (সা.)– এর প্রতি ওহির প্রথম নির্দেশ ছিলো, ‘পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন,সৃষ্টি করেছেন মানব “আলাক” থেকে। পড়ো, তোমার রব মহা সম্মানিত, যিনি শিক্ষাদান করেছেন লেখনীর মাধ্যমে। শিখিয়েছেন মানুষকে, যা তারা জানত না।’ (সূরা-আলাক,আয়াত: ১-৫)। ‘দয়াময় রহমান (আল্লাহ)! কোরআন শেখাবেন বলে মানব সৃষ্টি করলেন; তাকে বর্ণনা শেখালেন।’ (সূরা-রহমান, আয়াত ১-৪)।
শিক্ষকতা শুধুই পেশা নয়, একটি মহান ব্রত। শিক্ষক শব্দটির সঙ্গে জ্ঞান, দক্ষতা, সততা, আদর্শ, মূল্যবোধ শব্দগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজন শিক্ষক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখেন।কথাগুলো সর্বজনস্বীকৃত ও বহুল ব্যবহৃত। একজন শিক্ষক কখন শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, এর উত্তরে অনেক ভিন্নতা আসাই স্বাভাবিক; কিন্তু শিক্ষক হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জ্ঞান আহরণে তিনি কার্পণ্য করেননি, এটি সদা সত্য। শিক্ষকগণও এ সমাজেরই মানুষ, সুতরাং কিছু সীমাবদ্ধতা থাকাটাই স্বাভাবিক।
শিক্ষক দেশ, জাতি ও সমাজের প্রতি তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন হয়ে নিজেকে সে দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত করে। এ সব কিছুর পেছনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের ভূমিকাই মুখ্য। সমাজ পরিবর্তনে এবং শিক্ষার্থীদের সামাজিকীকরণে ও তাঁদের মধ্যে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের ভিত তৈরিতে শিক্ষকরা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। শিক্ষকতা পেশার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা এবং শিক্ষকদের সামাজিকভাবে মর্যাদার আসনে বসানো প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। যে সমাজ শিক্ষককে সম্মান দেয় না, সে সমাজে মানুষ তৈরি হয় না। এ সচেতনতাবোধের আলোকে শিক্ষক দিবসে যোগ্য শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তার ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে।
আমাদের দেশে অতীতে শিক্ষকদের যেমন সামাজিক মর্যাদা এবং ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও পবিত্র সমপর্ক ছিলো তা; এখন অনেক জায়গায়ই অনুপস্থিত। ষাটের দশকেও শিক্ষকরা সমাজের সম্মানী ব্যক্তি ছিলেন। ছাত্ররাও শিক্ষকদের ভয় পেত, শ্রদ্ধা করতো। শিক্ষকরা ছাত্রদের বেশ স্নেহ করতেন। কিন্তু আজকালকার দিনে সে রকম অবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই নেই। আগে অনেক ছাত্র স্বপ্ন দেখত, সে ভবিষ্যতে শিক্ষক হবে। কিন্তু এখন কোনো ছাত্রের জীবনের লক্ষ্য শিক্ষক হওয়া এমন দেখা যায় না। ব্যতিক্রম থাকতে পারে। এ অবস্থা একটা দেশের জন্য শুভ কিছু নয়। শিক্ষকদের মর্যাদার আসনটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
শিক্ষক সভ্যতার অভিভাবক, সমাজের অভিভাবক। কার্যত শিক্ষক বলতে একজন আলোকিত, জ্ঞানী-গুণী ও বুদ্ধিদীপ্ত পন্ডিত ব্যক্তিকে বোঝায়, যিনি সভ্যতার বিবর্তনের অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শিক্ষা দিতে-নিতে নিবেদিতপ্রাণ সেবক, ব্যবসায়ী নন। তিনি তাঁর আচার-আচরণ,মন ও মননে নিজেই বটবৃক্ষের প্রতীক। তাঁর সাফল্যের ভিত্তি হলো পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা, নির্মল চারিত্রিক গুণাবলি, জ্ঞান সঞ্চারণে আন্তরিক সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টা। তাই শিক্ষক বলতে এমন এক অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ববান জ্ঞানী, গুণী ও পন্ডিত ব্যক্তিকে বোঝায়; যিনি শিক্ষার্থীকে শিখন প্রক্রিয়ায়, জ্ঞান অন্বেষণ ও আহরণে, মেধা বিকাশ ও উন্নয়নে, শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনে,নৈতিক ও মানসিক গুণাবলি অর্জনে এবং সমাজ বিবর্তনে অনুঘটক ও সুশীল সমাজ তৈরির সহায়তা দানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বৈশ্বিক পরিবর্তনের যুগে নতুন নতুন তত্ত্বের উদ্ভব ও তথ্যের অবাধ প্রবাহে সর্বজনস্বীকৃত ও বহুল প্রচলিত ধ্যানধারণায়ও কিছু কিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জ্ঞান অর্থনীতির (নলেজ ইকোনোমাই) প্রসার ও প্রজন্মের পার্থক্য পুরনো চিন্তাচেতনা ও মূল্যবোধেও কিছুটা আঘাত হানছে। শিক্ষকতা ব্রত বা পেশাটিও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। পেশাগত অর্থনৈতিক বৈষম্যও প্রশ্নের একটি বড় উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। শিক্ষকগণ সবসময়ই শিক্ষক, আমাদের দেশে শিক্ষকের কর্তব্য পালনের কোনো নির্দিষ্ট সময়কাল নেই, শিক্ষকগণ ২৪ ঘণ্টাই শিক্ষক, ৩৬৫ দিনই শিক্ষক। শ্রদ্ধা জানাই দেশের সব স্তরের শিক্ষকগণের প্রতি, যারা অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও জাতির ভবিষ্যতের মজবুত ভিত্তি গঠনে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই একজন শিক্ষার্থীকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে তৈরি করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয় শিক্ষককে। শিক্ষক-শিক্ষিকা শিক্ষার্থীদের কাছে বাবা-মায়ের মতো। বাবা-মা যেমন তাদের ভালোবাসা-স্নেহ-মমতা দিয়ে সন্তানদের বড় করেন, ঠিক তেমনি শিক্ষকেরা শিক্ষার আলো দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। এর সাথে থাকে স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা। তাঁদের শিক্ষার আলো যেমনি শিক্ষার্থীদের সামনের পথ চলাকে সুদৃঢ় করে, তেমনি তাদের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে। শিক্ষকদের অতি উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, মানব জাতির সবচেয়ে বড় শিক্ষক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও শিক্ষক হিসেবে গর্ব অনুভব করতেন। তিনি তাঁর অন্যতম দোয়ায় বলেছেন, হে আল্লাহ! আপনি শিক্ষকদেরকে ক্ষমা করুন, তাদেরকে দান করুন দীর্ঘ জীবন।
খুব আশ্চর্য সুন্দর একটি সম্পর্ক হলো ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক একই সাথে খুবই সাবলীল, মধুর, স্বতঃস্ফুর্ত আবার গাম্ভীর্যপূর্ণ। শিক্ষক প্রয়োজনে শিক্ষার্থীর ওপর অবিভাবকসূলভ কঠোরতা, শাসন আরোপ করেন। আবার কখনো বা বন্ধুর মতো ভালোবাসেন, পরামর্শ দেন, উৎসাহ যোগান, সব সময়ই পাশে থাকেন। শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে অবিভাবকের মতো সম্মান করে, আদেশ-উপদেশ মেনে চলে, শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। শিক্ষকের সাথে ছাত্রের সম্পর্ক পথ প্রদর্শক আর পথিকের সম্পর্কের মতো। শিক্ষক পথ দেখান,ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশনা দেন। আর শিক্ষার্থী সেই দেখানো পথে চলে, নির্দেশনা মেনে চলে। উদারতা স্নেহের, মায়া, ভালবাসা আর শাসনের মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের ভেতরে স্বপ্নের বীজ বপন করেন। শিক্ষার্থীরা সেই স্বপ্নকে লালন করে। তাই ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বপ্ন স্রষ্টারও।
শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। তাই শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকের সম্পর্ক যত বেশি ভালো হবে, সুন্দর হবে, বন্ধুত্বপূর্ণ হবে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে ততো ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন। শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসে শিক্ষার্থীরা জীবনকে জনতে, চিনতে ও বুঝতে শেখে। সব কিছুকে নতুন করে দেখতে শেখে। শিক্ষক শিক্ষার্থীর দেখার চোখ খুলে দেয়, জ্ঞানের দরজা খুলে দেয়। তাদেরকে জ্ঞানের পথে, আলোর পথে নিয়ে যায়। শিক্ষক জীবন সম্পর্কে যে দর্শন চিন্তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় তার ভিত্তিতেই তারা তাদের জীবনের ব্রত ঠিক করে। একজন ভাল শিক্ষক একজন বখে যাওয়া শিক্ষার্থীকেও সঠিক পথে নিয়ে আসতে পারেন, তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন।
ইতিহাস বলে, যুগে যুগে অতি অত্যাচারী শাসকও নত শিরে গুরুর সামনে দাঁড়িয়েছেন। গুরুকে অসম্মানের ধৃষ্টতা কেউ দেখাননি। চাণক্য শ্লোকে আছে, ‘এক অক্ষরদাতা গুরুকেও গুরু বলিয়া মান্য করিবে। এক অক্ষরদাতা গুরুকে যে গুরু বলিয়া মান্য করে না, সে শতবার কুকুরের যোনীতে জন্মগ্রহণ করে চন্ডালত্ব লাভ করিবে।’ আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানীরা শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন,’শিক্ষা হলো আচরণের ইতিবাচক স্থায়ী পরিবর্তন’। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন,’ শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীর উত্তম চরিত্র গঠন’। মহামতি সক্রেটিস বলেছেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো সত্যের লালন ও মিথ্যার অপনোদন। এককথায় পরিপূর্ণ শিক্ষা শুধু জ্ঞানের স্তরেই সীমাবদ্ধ নয়, জ্ঞানার্জনের পর তা কার্যকরীভাবে ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগই হলো শিক্ষা। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীকে পাঠবুঝিয়ে দিলেই শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ নয়, পাঠ্যবিষয়ের বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষার্থীর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা শিক্ষকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এ অর্থে বিদ্যালয়কে ‘সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা হয়’। অনেক সময় পরিবারের দীর্ঘদিনের লালিত সংস্কারেও আঘাতহানে শিক্ষকের উপদেশ। হ্যামিলনের বাঁশির মতো সব কিছু ভুলিয়ে দিয়ে ভাবতে শেখায় নতুন কিছু যা কিছু বাঞ্ছিত, মার্জিত ও ইতিবাচক।
একজন শিক্ষক শুধুই শিক্ষক নন তিনি একজন প্রশিক্ষকও বটে।শিক্ষক যখন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের কোনো বিষয় বুঝিয়ে দেন বা শিখিয়ে দেন তখন তিনি শিক্ষক; যখন সৃজনশীলতা,সততা,দক্ষতা, নৈতিকতা,শৃঙ্খলা,নিয়মানুবর্তিতা,শিষ্টাচার,দেশপ্রেম,নেতৃত্ব ,কষ্টসহিষ্ণুতা,গণতন্ত্রীমনষ্কতা ও পরমতসহিষ্ণুতা ইত্যাদি সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের বিষয়গুলো নজরদারিতে রাখেন ও নিয়ন্ত্রণ করেন তখন ঐ শিক্ষকই একজন প্রশিক্ষক। এ জন্য বোধ হয় আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট তার পুত্রের প্রধান শিক্ষকের কাছে লিখেছিলেন, তাকে শেখাবেন পাঁচটি ডলার কুড়িয়ে পাওয়ার চেয়ে একটি উপার্জিত ডলার অধিক মূল্যবান। আমার পুত্রের প্রতি সদয় আচরণ করবেন কিন্তু সোহাগ করবেন না, কেননা আগুনে পুড়ে ইস্পাত খাঁটি হয়। আমার সন্তানের যেন অধৈর্য হওয়ার সাহস না থাকে’। তাহলে আমরা বলতে পারি পাঠ্যপুস্তকের বাইরে শিক্ষকের নিকট থেকেও শিক্ষার্থীর অনেক কিছু শেখার আছে।
পৃথিবীতে পিতামাতার সঙ্গে মানুষের যেমন নাড়ির সম্পর্ক, ঠিক তেমনি শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক আত্নার। জগদ্বিখ্যাত বীর আলেকজান্ডার তার শিক্ষক এরিস্টটলের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বলেছিলেন টু মাই ফাদার; আই উন মাই লাইফ;টু এ্যারিস্টটল,দ্যা নলেজ টু লাইভ অরথলী,ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক দুনিয়ার সেরা সম্পর্কগুলোর একটি। নবজাতকদের পৃথিবীতে আলো দেখার পর মা বাবার হাত ধরে বড় হয়। পাঁচ বছর বয়স থেকে তাদের স্কুল জীবন শুরু হয়। শিশুরা বৈচিত্রময় পৃথিবী সম্পর্কে বুঝতে শেখে শিক্ষকের কাছে। শিক্ষকই জ্ঞানশুন্য মানবশিশুকে ভিন্ন চোখে বিশ্ব দেখতে শেখায়, প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। তাই শিক্ষকের সাথে শিশুদের সম্পর্ক অত্যন্ত সম্মানসূচক, বন্ধুত্বপূর্ণ ও আনন্দদায়ক হওয়া প্রয়োজন।
সূর্যের আলো পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করে। পৃথিবীর রূপ-বৈচিত্র্য আমাদের সামনে দৃশ্যমান করে। তেমনি, শিক্ষা থেকে অর্জিত জ্ঞান আমাদের মন ও জীবনকে আলোকিত করে। জন্মের পর একটি শিশুর শিক্ষা গ্রহণের প্রথম পাঠ শুরু হয় তার পরিবারে। কিন্তু তার পরেই তাকে শিক্ষাদানের মহান দায়িত্ব অর্পিত হয় শিক্ষকের ওপর। শিক্ষক তার নিজের অর্জিত শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে গড়ে তোলেন তার শিক্ষার্থীকে। নিজের সমস্ত জ্ঞান তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। এই শিক্ষা দান ও গ্রহণের মধ্য দিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে ওঠে সম্পর্কের এক অটুট বন্ধন। যে সম্পর্কের সামনে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় মাথা নত করি আমরা সবাই। শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে অবিভাবকের মতো সম্মান করে। শিক্ষক পথ দেখান, ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশনা দেন। আর শিক্ষার্থী সেই দেখানো পথে চলে, নির্দেশনা মেনে চলে। আগের দিনে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক ছিলো অকৃত্রিম। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষককে শ্রদ্ধা করতো দেবতার মতো। শিক্ষকের এক একটি আদেশ-উপদেশকে তারা বেদবাক্য বলে মনে করতো। শিক্ষকেরাও শিক্ষার্থীদেরকে ভালোবাসত আপন সন্তানের মতো। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের নজির স্থাপনকারী বাদশা আলমগীরের কথাও আমরা জানি। দ্বিগ্বীবিজয়ী আলেকজেন্ডারের শিক্ষক ছিলেন দার্শনিক এরিস্টটল।তাদের মধ্যে ছিলো দৃঢ় সম্পর্ক। তাই আলেকজেন্ডার তার শিক্ষককে তার হৃদয় দিয়ে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা করতেন। এরিস্টটলও তাকে ভীষণ ভালবাসতেন। আর তাইতো আলেকজেন্ডারের মৃত্যুতে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে এখন প্রবেশ করেছে কৃত্রিমতা, ব্যক্তিগত স্বার্থ আর লাভের হিসেব।
সুদূর অতীতের সুসম্পর্কের দিনগুলোর অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। শিক্ষাব্যবস্থায় অমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে আধুনিক যুগে। এ যুগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শিক্ষাদানের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করে। অতীতে অর্থের বিনিময়ে বিদ্যা বিতরণ করা হলেও সেখানে অর্থ প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিলো না। শিক্ষক নিজেকে নিঃশেষ করেই জ্ঞান বিতরণ করতেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এই পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক নিতান্ত আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের জীবনের যথার্থ বিকাশের স্বার্থে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের এই ন্যক্কারজনক অবনতি অবশ্যই রোধ করতে হবে। ছাত্রদের যদি শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধার সম্পর্কের মধ্যে ফিরিয়ে নেওয়া যায় তা হলে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে উপকার পাওয়া যেতে পারে। এর জন্য শিক্ষাঙ্গনকে লেখাপড়ার কেন্দ্র হিসেবে রূপ দিতে হবে। সর্বপ্রকার অনাচার মুক্ত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা কর্তব্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে সম্পূর্ণ সন্ত্রাসমুক্ত। এ প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক আখড়ায় পরিণত করা যাবে না। শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। শিক্ষককে পরম আন্তরিকতা সহকারে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আদর্শ ও নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকের জ্ঞান ও গুণে মুদ্ধ শিক্ষার্থী শিক্ষককে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। ছাত্ররা শিক্ষককে আদর্শ হিসেবে মেনে নেয়। তাই শিক্ষকের মধ্যে আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে হবে। শিক্ষকের মনোযোগ থাকবে ছাত্রদের কল্যাণের প্রতি। আর ছাত্রদেরও শিক্ষ প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও নিয়মনীতি মেনে নিয়ে পাঠাভ্যাস করতে হবে। এভাবে ব্যবস্থা করা সম্ভবপর হলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের উন্নতি ঘটবে।
একটি জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। আর শিক্ষকতা হচ্ছে একটি মহান পেশা। শিক্ষকেরা হচ্ছে মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকতা হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীন পেশাগুলোর একটি। ন্যায় বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে শিক্ষকদের ভূমিকা অনন্য। ন্যায় বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন সৎ মানুষ, শিক্ষিত মানুষ ও জ্ঞানী মানুষের। সোনার বাংলা বিনির্মান সময়ের দাবী, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। শিক্ষক মন্ডলী যারা আগামীর জন্য মানুষ সৃষ্টি করেন তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। একজন শিক্ষকই পারেন একজন সুন্দর ও জ্ঞানী মানুষ তৈরী করতে। মানুষ যদি জ্ঞানী না হয় এবং জ্ঞান সমৃদ্ধ না হয় তাহলে সমাজের কোনো কাজে আসতে পারে না। সমাজের ভালো কাজ করার জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজন। জাতির ভবিষ্যত শিক্ষার্থীকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে আর সেটা করবে একজন শিক্ষক। সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ ও অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সেটা রোধ করাও শিক্ষকদের দায়িত্ব। কেনানা শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের ন্যায়-অন্যায়, সৎপথ, সঠিকপথের নির্দেশনা প্রদান করবে। সত্য-অসত্য, দেশের স্বার্থ এবং দেশের উন্নয়নের করনীয় সকল বিষয়গুলো তাদের কাছে পৌছে দিবে একজন দায়িত্ববান শিক্ষক। সমাজে ন্যায় বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে প্রয়োজন আলোকিত মানুষ আর সে আলোকিত মানুষ গড়ার মূল কারিগর হচ্ছে শিক্ষক। যদি কখন কোন কারনে সমাজে বিশৃঙ্খল পরিবেশ বা হানাহানি দেখা দেয় সেটা থেকে পরিত্রানের জন্য যারা অগ্রনী ভূমিকা পালন করবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকেও তারা সমাজের অত্যন্ত মর্যাদাবান মানুষ।তাই শিক্ষকরাই পারে এ ধরনের বিশৃঙ্খল পরিবেশ বা হানাহানি রোধ করতে তাই এক্ষেত্রেও তাদের অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হবে।
শিক্ষা আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের হাতিয়ার। শিক্ষক হলো তার সুনিপূন কারিগর। শিক্ষা ছাড়া আলোকিত মানুষ সৃষ্টি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অন্ধকারের অতল গহবরে নিমজ্জিত সমাজকে আলোর মুখ দেখাতে পারে একমাত্র সুশিক্ষা। যার কর্ণধার একজন সুশিক্ষক। যারা শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে পরস্পর সমঝোতা না হলে বিদ্যার্জনের সাধনা সার্থক হয় না। সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সমস্ত অবৈধ কার্যকলাপ থেকে দূরে রাখতে হবে। তখনই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠবে। পরিবেশ সুন্দর হলেই ছাত্র-শিক্ষক পরস্পরের কাছাকাছি আসবে এবং অনাবিল সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পঠন-পাঠনের যথাযথ সুযোগ পাওয়া যাবে। ছাত্রদের মনে রাখতে হবে উপযুক্ত শিক্ষালাভ করলেই জীবনে যোগ্য হওয়া যায়। অন্যদিকে শিক্ষকগণ নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকবেন। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে এভাবে সুসম্পর্ক বজায় থাকলেই শিক্ষা দান ও গ্রহণ সার্থক হবে,আর জাতি লাভ করবে সুযোগ্য উত্তরাধিকারী।

লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,লেখক,গবেষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম