আমলের স্তর ও মর্যাদা অসংখ্য এবং অগণিত

মো.আলতাফ হোসেন ঃঃ
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। যিনি যাবতীয় প্রশংসায় প্রশংসিত এবং সব ধরনের মহত্তর গুণে গুণান্বিত। যেসব আমল আল্লাহ তাঁর বান্দাদের থেকে অধিক পছন্দ করে এবং অধিক খুশি হন, আল্লাহর গোলামিকে পরিপূর্ণ বাস্তবায়ণ করতে একজন বান্দা সে আমলগুলি করতে , যে চেষ্টা ও পরিশ্রম করে তারই ভিত্তিতে আল্লাহর প্রতি বান্দার মহব্বত পূর্ণতা লাভ করে এবং বান্দার প্রতি তার রবের মহব্বত বাস্তব রূপ নেয়। অনুরূপভাবে একজন আমলকারীকে অবশ্যই এমন সবকিছু থেকে বিরত থাকবে, যেগুলো নিজের আমলের সাওয়াব অন্যের নিকট চলে যাওয়ার কারণ হয়। এটি অনেক সময় কারো ওপর জুলুম করার কারণে হয়ে থাকে অথবা কারো হক নষ্ট করা বা কোনো ধরণের কষ্ট দেওয়ার কারণে হয়ে থাকে। যেমন গিবত করা, গালি দেওয়া, চুরি করা, মু’মিন ভাইকে পরিত্যাগ করা- যে পরিত্যাগ শরিয়তে নিষিদ্ধ ইত্যাদি।
যার ওপর নেক আমল কবুল হওয়া না হওয়া, সওয়াব লাভ করা না করা এবং আখিরাতের আমলের দ্বারা উপকার লাভ করা না করা ইত্যাদি জরুরী বিষয়সমূহ নির্ভর করে। আর তা হলো ১. সমস্ত আমল কেবল আল্লাহর জন্য করা, ২. ইবাদতে নিয়তের প্রার্থক্য করা ৩. ইবাদতে যত্নবান হওয়া ৪. নেক আমল সমূহের সওয়াবের হেফাজত ও সংরক্ষণ করা । আল্লাহর নিকট প্রিয় আমল, ১. আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা, তাঁর ফেরেস্তা তাঁর প্রেরিত কিতাবসমূহ ও তাঁর প্রেরিত রাসূলতে ও কিয়ামতের দিনের এবং তকদীরের ভালো মন্দ যে আল্লাহ থেকে হয় তার প্রতি এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের প্রতি। ২. আত্মীয়তা সম্পর্ক অটুট রাখা ৩. সৎ কাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎ কাজ হতে নিষেধ করা ৪. ফরযসমূহ ৫. বে-জোড় অর্থাৎ আল্লাহ তা’য়ালা বে-জোড়কে অধিক পছন্দ করেন প্রমাণ ঃ রাসূল (সা.) বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা বেজোড়; তিনি বেজোড়কে পছন্দ করেন।’’( মুসলিম) ৬. মাতার পিতার সাথে ভালো ব্যবহার করা। যেসব কাজ থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) নিষেধ করেছেন, সবই হলো, মুনকার। সুতরাং সব ধরনের গুণাহ তা কবিরাহ হোক বা ছগিরা হোক সবই মুনকার। কারণ বিশুদ্ধ বিবেক ও সঠিক প্রকৃতি এগুলোকে অগ্রহণযোগ্য বিবেচনা করে । আর সবচেয়ে বড় মুনকার অন্যায় হলো, আল্লাহর সাথে শরিক করা।

আল্লাহ তা’য়ালার মনোনীত ধর্ম ইসলাম। ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম। ইসলামের প্রধান ইবাদত নামাজ। মু’মিন মুসলমানের জন্য নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা ফরজ। শুধু তাই নয়, নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট সময়ে মুসলমানদের ওপর নামাজ আদায় করা ফরজ। ফরজ নামাজের পাশাপাশি নফল নামাজ যেমন- সালাতুল তাহাজ্জুদ, সালাতুল ইশরাক, সালাতুল চাশত,সালাতুল তাসবিহ, সালাতুল যাওয়াল, সালাতুল আওয়াবিন,সালাতুল হাজত, সালাতুল শুকরিয়াসহ অন্যান্য নফল নামাজ আদায়ের মাধ্যমেও অসংখ্য সওয়াব হাসিল করা যায়। নামাজ আদায়ের মধ্যেই রয়েছে মু’মিনের সবচেয়ে উত্তম আমল। প্রতিটি মু’মিনের শেষ ঠিকানা জান্নাত। জান্নাত অনন্ত সুখ শান্তির আবাস। জান্নাতে যাওয়ার পথ ও প্রক্রিয়া মহান আল্লাহ অত্যন্ত সহজ করে দিয়েছেন। আল্লাহ নিজেই তার বান্দাদের জান্নাতের পথে ডেকেছেন। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ শান্তির ঘরের দিকে ডাকছেন।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ২৫)

একজন ঈমানদারের জন্য আল্লাহর হুকুম পালন ও তাঁর রাসূলের সুন্নত পালন অপরিহার্য। তবে আমলের ফিরিস্তি দীর্ঘ করার ও জান্নাত লাভের অনেক সহজ ও ছোট ছোট আমলও রয়েছে। বড় আমলতো বটেই ছোট ছোট আমলেও জান্নাত লাভের আশা রাখা যায়।
রাসূল (সা.) বলেন,‘তোমাদের মধ্যে কে রোজা রেখেছে?’ আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি রেখেছি।’ অতঃপর রাসূল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আজ কোনো মিসকিনকে খাবার খাইয়েছ?’ আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আমি। ’ রাসূল (সা.) জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আজ কোনো জানাজায় অংশগ্রহণ করেছ?’ আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আমি। ’ রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আজ কোনো অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ নিয়েছ?’ আবু বকর (রা.) বললেন, ‘আমি। ’ তখন রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তির মধ্যে একই দিনে এসব অভ্যাস পাওয়া যাবে, সে জান্নাতে যাবে।’ (মুসলিম, হাদিস নং : ১০২৮) নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি উভয় ঠোঁটের মধ্যভাগ (জিহ্বা) ও দুই রানের মধ্যভাগ (লজ্জা স্থান) হেফাজতের দায়িত্ব গ্রহণ করে আমি তার জন্য জান্নাতের দায়িত্ব গ্রহণ করি।’ (বুখারি, হাদিস নং : ৬৪৭৪) নবী করিম (সা.) বলেন, ‘ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক, ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক’, তিনি আবারও বললেন, ‘ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক।’ কেউ জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! কে সে জন?’ রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতা উভয়কে বার্ধক্য অবস্থায় পেলো অথবা যেকোনো একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেলো, তবুও জান্নাত অর্জন করতে পারলো না, সে ধ্বংস হোক।’ (মুসলিম, হাদিস নং : ২৫৫১) নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে বের হবে, আল্লাহ তা’য়ালা তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন।’ (মুসলিম, হাদিস নং : ২৬৯৯)

নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে এবং একাগ্রচিত্তে তনুমনে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে, তার জন্য জান্নাত অবধারিত।’ (আবু দাউদ : ১৬৯) সময়মতো নামাজ আদায়ে যত্নবান হওয়া সম্পর্কেও রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সময়মতো নামাজ আদায়ে যত্নবান হয়, তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে।’ (আবু দাউদ : ১৪২০) রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ফজর ও আসরের নামাজ গুরুত্বসহকারে আদায় করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (বুখারি, হাদিস নং : ৫৭৪) প্রতি নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পড়া : রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি তিলাওয়াত করবে, তার জান্নাতে প্রবেশের জন্য মৃত্যু ছাড়া আর কোনো বাঁধা নেই। ’ (আস-সুনানুল কুবরা লিন নাসায়ি : ৯৮৪৮)
শেষরাত বা রহমতের সময়ের ইবাদতে একাগ্রতা স্থাপন করা সহজ। হাদিসে আছে, ‘শেষ রাতে বান্দা আল্লাহপাকের খুবই নৈকট্য লাভ করে থাকে।’ রাতের তৃতীয়াংশের ইবাদতের কথা কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন স্থানে নির্দেশিত হয়েছে। বলা হয়েছে, এ সময় আল্লাহ তায়ালা বান্দার ডাকে অধিক সাড়া দেন। তিনি বান্দাকে অনুপ্রাণিত করতে থাকেন, তাকে ডাকতে বলেন, তার ইবাদত করে তার নৈকট্যলাভের আহ্বান করেন।

রাতের শেষ তৃতীয়াংশকে ‘রহমতের প্রহর’ বলা হয়। এ সময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শেষ আসমানে নেমে আসেন। এ সময় ইবাদত করার অনেক সওয়াব রয়েছে। নবীজি (সা.), সাহাবায়ে কেরাম ও আল্লাহর বিশেষ বান্দাগণ রাতের শেষাংশকে ইবাদত-বন্দেগির উত্তম সময় হিসেবে বেছে নিতেন; তখন নফল নামাজ কোরআন তেলাওয়াত ও জিকির-আজকারে মগ্ন থাকতেন।

এ সময় প্রকৃতি নীরব থাকে, পরিবার-পরিজন থাকে ঘুমিয়ে। জাগতিক কোনো কাজকর্মেরও তাড়া থাকে না। ফলে এ সময় আল্লাহর ধ্যান-মগ্ন হওয়া, নফল নামাজ আদায় করা এবং জিকির আজকার করার ক্ষেত্রে কোনো ব্যঘাত ঘটে না; নির্বিঘ্নে আমল করা যায় একমনে, একধ্যানে।

হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হজরত রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আমাদের প্রতিপালক প্রতি রাতের যখন শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকে তখন প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, হে বান্দা! আমার কাছে প্রার্থনা করো, আমি তোমার প্রার্থনা কবুল করব। আমার কাছে তোমার কি চাওয়া আছে, চাও, আমি তা দান করব। আমার কাছে তোমার জীবনের গুনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর, আমি তোমার গুনাহ মাফ করে দেব।’ [বুখারি : ৬৯৮৬]
এভাবে আল্লাহতায়ালা ফজরের আগ পর্যন্ত তার বান্দাদের ডাকতে থাকেন। আর যে বান্দা তার মাবুদ মাওলাকে ডাকার মতো ডাকতে পারেন, আল্লাহর নিকট কাকুতি মিনতি করতে পারেন রহমতের আমলের বদৌলতে তার ভাগ্যের দরজা খুলে যায়।
এই রহমতের সময় যা কিছু আমল করা হয় তার সবগুলোই মূলত নফল ইবাদত। ফরজ ইবাদত পালন করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। তাই নফল ইবাদতকে অতিরিক্তি কাজের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সে জন্য এর ফজিলত বেশি। তাই সুযোগ পেলেই বেশি বেশি নফল ইবাদত করা উত্তম।

শেষ রাতে নফল ইবাদত, তওবা-ইস্তেগফার, কোরআন তেলাওয়াতসহ বিভিন্ন আমল করে মহান আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে মোনাজাত করলে আল্লাহতায়ালা দয়া করে আমাদেরকে তার রহমতের ছায়াতলে জায়গা করে দেবেন বলে আশা করা যায়। তাই আমাদের উচিৎ রহমতের প্রহর শেষ রাতের আমলে প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান হওয়া।

সালামের প্রচার-প্রসার সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি ইমান আনবে না, ততোক্ষণ পর্যন্ত সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর যতক্ষণ কোনো মুসলমান পরস্পর একে অন্যকে ভালোবাসবে না, ততোক্ষণ তারা পূর্ণ ইমানদার হতে পারবে না। আমি কী তোমাদের সে কাজটি বাতলে দেবো, যা করলে পরস্পর ভালোবাসা সৃষ্টি হয়? তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামের প্রচার-প্রসার করো।’ (মুসলিম, হাদিস নং : ৫৪)

এতিমের দেখাশোনা করা সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আমি ও এতিমের লালনপালনকারী জান্নাতে একসঙ্গে এমনভাবে থাকবো’-এ কথা বলে তিনি মধ্যমা ও তর্জনী আঙুলদ্বয়কে একত্রিত ও পৃথক করে দেখিয়েছেন। ’ (বুখারি, হাদিস নং : ৫৩০৪)
রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো ব্যাপারে বর্ণিত, একবার রাস্তার ওপর একটি গাছের ডাল পড়ে ছিলো, যা মানুষের জন্য কষ্টদায়ক ছিলো, অতঃপর এক লোক সেটি সরিয়ে দেন, রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করেছেন। ’ (ইবনে মাজাহ)
আসমাউল হুসনা অর্থাৎ আল্লাহর সুন্দরতম নাম সমূহ আয়ত্ত করা সম্পর্কে আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তা’য়ালার ৯৯টি নাম আছে, যে ব্যক্তি তা আয়ত্ত করবে, আল্লাাহ তাকে জান্নাত দান করবেন। ’ (বুখারি, হাদিস নং : ২৭৩৬)
আল্লাহ তা’য়ালা অতি দয়ালু ও মেহেরবান। তাঁর দয়া ও রহমতের কোনো শেষ নেই। অনেক সময় বান্দার কোনো ছোট আমলেও আল্লাহ তা’য়ালা সন্তুষ্ট হয়ে যান। এমনকি তাঁর রহমতের সাগরে জোয়ার আসে। তিনি তখন বান্দাকে দিয়ে দেন অনেক পুরষ্কার এবং উন্মুক্ত করে দেন তাঁর দানের ভান্ডার। তাই কোনো নেক আমল বাহ্যিকভাবে ছোট ও সহজ বলেই সে সম্পর্কে অবহেলা করা উচিত নয়।

নবী করিম (সা.) বলেছেন, কোনো সৎ কাজকেই কখনো তুচ্ছ জ্ঞান করবে না। যদিও তা হয় তোমার ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে সাক্ষাত। -(সহিহ মুসলিম) কারণ ছোট খাটো এই ধরনের সহজ আমলের মধ্যেও অনেক সময় নিহিত থাকে অনেক বড় প্রাপ্তি ও পুরষ্কার। হাদিস শরিফে এমন অনেক আমলের বর্ণনা পাওয়া যায়, যা করতে সহজ, কিন্তু এর বিশাল প্রাপ্তি ও পুরষ্কারের কথা নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন। প্রেরণা যুগিয়েছেন এসব আমলের প্রতি যত্নবান হতে।
নিয়ত অর্থ সংকল্প। হাদিসে বর্ণিত আছে যাবতীয় কাজের ফলাফল নিয়তের ওপরই নির্ভর করে। এটি মনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি আমল। প্রত্যেক কাজ, তা দ্বীনী কাজ হোক কিংবা দুনিয়াবী, শুরুতেই নিয়তকে শুদ্ধ করা কর্তব্য। সব কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করার সংকল্পই হচ্ছে বিশুদ্ধ নিয়ত। এই নিয়ত মু’মিন বান্দার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রায় সকল কাজকেই নেকির কাজে পরিণত করতে পারে।

হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করিম (সা.) কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই সব আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যার নিয়ত সে করবে। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে হিজরত করবে তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্যই হবে। আর যে দুনিয়া লাভের জন্য কিংবা কোনো নারীকে বিয়ের উদ্দেশ্যে হিজরত করবে তার হিজরত উক্ত বিষয়ের জন্যই হবে, যার জন্য সে হিজরত করেছিলো। -(সহিহ বোখারি, হাদিস- ১; সহিহ মুসলিম হাদিস- ১৯০৭)
সব মুসলমানের ধ্যান-জ্ঞান একটা-ই হওয়া উচিত-আল্লাহ‘কে পাওয়া। তাঁকে পেতে হলে ওঠতে-বসতে, নিদ্রায়-জাগরণে, সকাল-সন্ধ্যা, দিন-রাতে, ঘরে-বাইরে একমনে একধ্যানে পরম ভালোবাসায় দয়ালু মাওলাকে ডাকা উচিত। আর আল্লাহ‘কে ডাকার নাম-ই হচ্ছে জিকির।

জিকিরের ফজিলত সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে আর যে করে না তাদের দৃষ্টান্ত হলো জীবিত ও মৃত ব্যক্তির মতো। (বোখারি শরিফ, হাদিস নং ৬০৪৪) নবী করিম (সা.) আরও বলেন, যে ব্যক্তি প্রতিদিন ১০০ বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়া হুয়া আ’লা কুল্লি শাইয়িন ক্বদীর’ বলবে, সে দশটি গোলাম আযাদ করার সমান সওয়াব লাভ করবে, তার নামে ১০০টি সওয়াব লেখা হবে ও তার আমলনামা হতে ১০০ গুনাহ মুছে ফেলা হবে।

সূরা ইখলাস কোরআন মাজীদের সবচেয়ে সম্মানিত সূরার মধ্যে একটি। মুসলমানদের ধর্মীয গ্রন্থ কুরআনের ১১২ নম্বর সূরা আল ইখলাস মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই সূরাটিকে ইসলামের শেষ পয়গম্বর মুহাম্মদ (সা:) বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তাৎপর্যের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এই আয়াতে আল্লাহর অস্তিত্ব ও সত্তার সবচেয়ে সুন্দর ব্যাখ্যা রয়েছে। এটি কুরআনের অন্যতম ছোট একটি সূরা হিসেবেও বিবেচিত হয়ে থাকে। এই সূরাটি কোরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান। প্রতিদিন অজুর সাথে ২০০ বার সুরা ইখলাস পাঠ করার দ্বারা ০৯ টি উপকার লাভ হবে। ১. আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত অসুন্তুষ্টির ৩০০ টি দরজা বন্ধ করে দিবেন। যেমন: শত্রতা, দুর্ভিক্ষ, ফিতনা ইত্যাদি। ২. রহমতের ৩০০ টি দরজা খুলে দিবেন। ৩. রিজিকের ১০০০ টি দরজা খুলে দিবেন। আল্লাহ তা’য়ালা পরিশ্রম ছাড়া তাকে গায়েব থেকে রিজিক দিবেন। ৪. আল্লাহ পাক নিজস্ব ইলম থেকে তাকে ইলম দিবেন, নিজের ধৈর্য্য থেকে ধৈর্য্য এবং নিজের বুঝ থেকে বুঝ দিবেন। ৫. ৬৬ বার কুরআন শরীফ খতম করার সাওয়াব দান করবেন। ৬. তার পঞ্চাশ বছরের গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে। ৭. আল্লাহ পাক জান্নাতে ২০টি মহল দান করবেন। যেগুলো ইয়াকুত, মারজান,জমরুদ দ্বারা নির্মিত হবে এবং প্রত্যেকটি মহলে ৭০,০০০ দরজা হবে। ৮. ২০০০ রাকাত নফল পড়ার সাওয়াব অর্জিত হবে। ৯. যখন মৃত্যুবরণ করবে তখন তার জানাযায় এক লক্ষ দশ হাজার ফেরেশতা অংশগ্রহন করবেন।

ইবাদাত, জিকির, তিলাওয়াত, দোয়া, তওবা, ইস্তেগফার, কান্নাকাটিতে রাঙিয়ে তুলুন আপনার মূল্যবান জীবনের অল্প সময়টুকু। বেশি বেশি জিকিরের একমাত্র প্রতিদান হলো হাসতে হাসতে জান্নাত! আর সর্বত্তোম জিকির হলো কালেমা-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)। এ জিকির এমন একটি জিকির যা গুণাহকে মাপ না করে ছাড়ে না।

ইন্নাদ্বীনা-ইন্দাল্লাহিল ইসলাম অর্থ আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলাম। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত ‘‘কুল্লু নাফসিন জাইয়্যিকাতুল মাউত’’ অর্থাৎ প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যুর আগে আল্লাহ তা’য়ালা কোনো টাকা-পয়সা, বাড়ি গাড়ি, সম্পদ নিয়ে জান্নাতে যেতে হবে একথা বলেননি। যেখানে নেকিই একমাত্র মাধ্যম। যার নেকি যতো বেশি তার জান্নাত ততো বড়। আর জান্নাতে যেতে ছোট বড় সকল নেকি প্রত্যেক মুসলমানের প্রয়োজন। কারণ সরিষা পরিমাণ নেকি হলেও দশ দুনিয়ার সমান একটি জান্নাত লাভ করা যাবে। কাজের ফাঁকে এক মিনিটেও অনেক নেকি হাসিল করা যায়। ছোট নেকিতেও বিশাল সওয়াব পাওয়া যেতে পারে। শুধু এক মিনিটের সতর্ক আমলে আমলনামায় অনেকগুলো সওয়াব ও পুণ্য লেখা হবে। যেমন ৩ বার সূরা ফাতিহা পড়া যায়। এভাবে আমল করলে ১৮০০ এর বেশি নেকি হাসিল করা যায়। বলা হয়েছে সূরা ফাতিহা এতো বড় ফযিলত যে, কোনো ব্যক্তি সূরা ফাতিহা ধ্যানের সহিত পাঠ করলে সয়ং আল্লাহ তার সূরা ফাতিহার জবাব দেন। সূরা ইখলাস একবার পাঠ করলে পবিত্র কোরআনের এক তৃতীয়াংশ পড়ার সমান সওয়াব পাওয়া যায়। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির’। এ আমলের সওয়াব ইসমাঈল (আ.) এর বংশের ৮ জন দাস আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্ত করার সমান।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘সুব্হানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার পাঠ করা, যা কিছুর ওপর সূর্য উদিত হয়েছে সবকিছু থেকে আমার কাছে অধিক প্রিয়। ’ (মুসলিম, হাদিস নং: ২৬৯৫) ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ (অর্থ: আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল) এটি সর্বশ্রেষ্ঠ বাক্য ও তাওহিদের বাণী। এ কালেমার ফজিলত ও মর্যাদার ব্যাপারে অনেক বর্ণনা রয়েছে। নবী কমির (সা.) এর গুণাহমুক্ত জীবন ব্যবস্থা হওয়া সত্যেও তিনি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে একশ’ বার ইসতিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। যাতে তাঁর উম্মতরা এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। এটি ক্ষমা প্রাপ্তি ও জান্নাতে প্রবেশের উপায়। নবী করিম (সা.) এর ওপর ৫০ বার দরুদ পাঠ করা শুধু ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ পড়লেও চলে। প্রতিদানে আল্লাহ ৫০০ বার রহমত পাঠাবেন। আর একবার দরুদ পাঠ করলে, আল্লাহ ১০ বার প্রতিদান দেন। বিভিন্ন ছোট বড় আমলের মধ্যে নিহিত যেমন জিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কোরবানির আগ পর্যন্ত নখ, চুল ও মোচ ইত্যাদি না কাটা। হাদিসে আছে, হযরত উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা যখন জিলহজ মাসের চাঁদ দেখতে পাও আর তোমাদের কেউ কোরবানি করার ইচ্ছা করে, তবে সে যেনো চুল-নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।’-ইবনে হিব্বান

নবী করিম (সা.) জিলহজের প্রথম ৯ দিন (ঈদের দিন ছাড়া) রোজা রাখতেন। তবে এই দশকের নবম দিনটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই দিন রোজা রাখার গুরুত্বও বেশি। হাদিসে আছে, রাসূল (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের (৯ তারিখের) রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহ তা’য়ালার কাছে আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ইসলামী জীবনব্যবস্থায় দৈনন্দিন বাড়িতে সালাম দিয়ে প্রবেশ করা। এতে মহান আল্লাহ নিজ জিম্মাদারিতে আপনাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (ইবনে হিব্বান-৪৯৯, সহিহ তারগিব-৩১৬)জামাতে ইমামের প্রথম তাকবিরের সঙ্গে ৪০ দিন সালাত আদায় করা। এতে আপনি নিশ্চিত জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে যাবেন। (তিরমিজি, হাদিস : ২৪১) জুমার দিন গোসল করে হেঁটে আগে আগেই মসজিদে গিয়ে ইমামের পাশাপাশি বসে মনোযোগের সঙ্গে খুতবা শুনলে বাড়ি থেকে হেঁটে আসার প্রতি কদমে এক বছর সারা রাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া এবং এক বছর টানা সিয়াম পালন করার সওয়াব পাবেন। (তিরমিজি তাহকিককৃত-৪৯৬)

মসজিদে ফজরের সালাত আদায় করে বসে দোয়া জিকির পাঠ করা এবং সূর্য উঠে গেলে দুই রাকাত এশরাকের সালাত আদায় করা। এতে আপনি প্রতিদিন নিশ্চিত কবুল একটি হজ ও একটি ওমরাহর সওয়াব পাবেন আর কবুল হজের সওয়াব জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়। (তিরমিজি-৫৮৬, জুমুআর নামাজ অধ্যায়)

মুসলমানদের কাছে শবে কদর অত্যন্ত মহিমান্বিত একটি রাত। পবিত্র শবে কদর বা লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল কদরের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে উত্তম। এই রাতে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয় এবং এই রাতকে কেন্দ্র করে ‘আল-কদর’ নামে একটি সূরাও নাজিল হয়। এই রাতে ইবাদত-বন্দেগি করে আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফের জন্য প্রার্থনা করেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা।

আমলের স্তর ও মর্যাদা অসংখ্য এবং অগণিত । এখানে একটি কথা মনে রাখতে হবে, ইসলামী শরিয়তে যতো প্রকার নেক আমলের কথা বলা হয়েছে, সব নেক আমলের ফযিলত ও মর্যাদা এক নয় এবং সমান নয়। যদিও সমস্ত নেক আমলের ক্ষেত্রে মূল নীতি হলো, আল্লাহ তা পছন্দ করেন এবং তাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট ও খুশি হন, কিন্ত আল্লাহর নিকট প্রিয় ও পছন্দনীয় হওয়ার বিবেচনায় আমল সমূহের মধ্যে পার্থক্য আছে এবং বিভিন্ন স্তর আছে। একটি আমল অপর আমলের তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়া বা আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় হওয়া স্বাভাবিক। এ কারণে দেখা যায়, কোনো আমল অধিক উত্তম আবার কোনো আমল কম উত্তম আবার কোনো আমল শুধু উত্তম।

আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর নেক বান্দাদের অফুরন্ত জিন্দেগী জান্নাতে দেবেন।দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আখিরাত চিরস্থায়ী। জান্নাত চির আবাস ভূমি। আমাদের সকলেরই প্রয়োজন নেক আমল করা। আল্লাহ তা’য়ালা নেক আমলদারদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন আর বদ আমলদারদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। আল্লাহ তা’য়ালা ব্যতীত সকলেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আমাদের উচিত আল্লাহ তা’য়ালার শোকরগুজার বান্দা হওয়া। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মহব্বত অর্জন করা যায়, তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং ঐ সময়ের দাবি ও চাহিদা অনুযায়ী সে আমল করা যে আমলে আল্লাহ তা’য়ালা রাজি-খুশি ও সন্তুষ্ট হন।

লেখকঃ গবেষক,সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ,
চেয়ারম্যান গ্রীণ ক্লাব, মানিকগঞ্জ,সাংবাদিক ও কলামিস্ট

শিরোনাম