মোঃ আলতাফ হোসেন ঃঃ
মার্শাল আর্ট শিল্প, ক্রীড়া ও আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে গোটা বিশ্বে জনপ্রিয়। এটি একটি উচ্চ মাত্রার অ্যারোবিক ব্যায়াম। নিয়ম মেনে এই ব্যায়াম যে কোনো বয়সী মানুষ করতে পারেন। সু প্রাচীন কাল থেকেই পূর্ব এশিয়ায় মার্শাল আর্টের প্রচলন রয়েছে তবেযাদের মেরুদন্ড ও হৃদয়ন্ত্রের সমস্যা আছে, তাঁরা মার্শাল আর্ট চর্চা করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা যায়, দৈনন্দিন জীবনে মার্শাল আর্টের বড় ধরণের প্রভাব পড়ে। এটি অনুশীলনকারীরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে ও কাজ করতে সক্ষম হয়ে ওঠেন।
বিজ্ঞানীদের মতে, মার্শাল আর্টের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, এটি মানুষের আত্ম বিশ্বাস অনেক গুনে বাড়িয়ে দেয়। যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো সমস্যা সামলে নেয়ার মতো সাহস যোগায়।
শরীরের প্রায় সব মাংসপেশি বিভিন্ন মাত্রায় ব্যবহৃত হয়। ফলে এসব মাংসপেশীর নমনীয়তা, ভারসাম্য ও শক্তি বাড়ে। মার্শাল আর্ট চর্চা করলে যে কোনো ধরণের ব্যথা ও হাড়ের জোড়া বা সন্ধির সমস্যা নিয়ন্ত্রনে থাকে। এছাড়া নিয়মিত এই ব্যায়াম করলে মস্তিস্কের ক্ষুধা ও তৃপ্তি নিয়ন্ত্রক এলাকার ওপর প্রভাব পড়ে। তখন অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের প্রবণতা কমে। এক ঘণ্টা সাধারণ মাত্রায় চর্চায় প্রায় ৫০০ ক্যালরি ক্ষয় হয়। ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মার্শাল আর্টের চর্চায় মস্তিস্ক থেকে এন্ডোরফিল নামের জৈব রাসায়নিক পদার্থ প্রচুর পরিমাণে নিঃসৃত হয় । এটি বিষন্নতা দূর করে। ও সুখের অনুভূতি বাড়ায়। গবেষণায় দেখা যায়, এই ব্যায়াম অনুশীলনের পর ৪ ঘন্টা পর্যন্ত রক্তে উচ্চ মাত্রায় এন্ডোরফিন থাকে। প্রয়াত মার্শাল আর্ট তারকা ব্রুসলি বলেছিলেন প্রতিটি লাথি (কিক) বা ঘুষি (পাঞ্চ) ফাঁকে একজন মার্শাল আটিস্ট নিজের দুর্বলতা গুলো টের পান, নিজেকে চেনেন। নিজেকে যতো চেনা যায়। ততোই তার মনোনিবেশ করারও নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা বাড়ে। এর একটি চমৎকার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনে।
যুদ্ধের কৌশল হলেও মার্শাল আর্ট আদতে মানুষের আগ্রহী মনোবৃত্তি এ হিংস্রতাকে দমন করে। কারণ, এর নৈতিক উদ্দেশ্যে (এথিকস), বিধিনিষেধ (ফরবিডেন অ্যাকট) এবং বাধ্য বাধকাতা (অবলিগেশন) ধৈর্য্যশীল ও শান্ত থাকা এবং অন্তদৃষ্টি অর্জন কুংফুর এই তিন মূলমন্ত্র মানুষকে অশুভ প্রবৃত্তি দমনে সাহায্য করে।কুংফু/গংফু হলো একটি চীনা শব্দ। এই শব্দ উল্লেখ করা হয় কোনো অধ্যায়ন শিক্ষা অথবা অনুশীলন। যেটির জন্য প্রয়োজন ধৈর্য , শক্তি, এই শব্দটি দ্বারা উল্লেখ করা হয় চীনা যুদ্ধ বিষয়ক শিল্পকলার ক্ষেত্রে। বিশ শতকের শেষে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয় চীনা যুদ্ধ বিষয়ক শিল্পকলার ক্ষেত্রে। কাজেই দুটি শব্দ একই রকম শোনালেও আভিধানিক অর্থ আলাদা এবং কুংফু যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং কারাতের এবং কুংফু আলাদা। আর মার্শাল আর্ট বিধিবদ্ধ অনুশীলনের বিস্তীর্ন পদ্ধতি এবং যুদ্ধের ঐতিহ্য যেটি বিভিন্ন কারণে অনুশীলন হয় যেমন নিজস্ব প্রতিরক্ষা প্রতিযোগিতা, শরীরিক আরোগ্য এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি। মার্শাল আর্ট পরিভাষাটি ব্যাপক প্রাচ্য এশিয় লড়াইয়ের কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কারাতে একটি আঘাতের কৌশল যেটি ঘুশি, লাথি, হাঁটু ও কনুইয়ের আঘাত ও মুক্ত হস্ত কৌশল যেমন ছুরি হস্ত ব্যবহার করা কিছু স্টাইলে আঁকড়ে ধরা আবদ্ধ করা বাঁধা আছাড় এবং অতীব গুরুপূর্ণ পয়েন্টে আঘাত শেখানো হয়।
প্রিয় পাঠক আজ আত্ম রক্ষায় কারাতের ধারাবাহিক ৭ম পর্বে আপনাদের জন্য থাকছে কিকের/ লাথির ব্যবহার। কারাতে প্র্যাকট্রিজের মধ্যে বেশ কয়েকটি কিক বা লাথি রয়েছে। যেমন ১। কিঙ্গারি, ২। উসাঠাকিরী, ৩। উক্লাগিরী, ৪। মাউশিগিরী, ৫। ইচাগিরী। আজ আমরা কিভাবে কিঙ্গারী শিখাতে পারি সে ব্যাপারে আমরা জেনে নেবো। অন্যান্য দিনের ন্যায় লেসন শুরুর পূর্ব প্রথমে ছালাম, বো ও কিবাডাসী প্রজিশনে যেয়ে কিছু ওয়ার্ম আপ করে নেবো।
ব্যায়ামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ওয়ার্ম আপ। ওয়ার্ম আপ এর মাধ্যমে শরীর ও মন দুটোকেই ব্যায়ামের জন্য তৈরি করা হয়। এর মাধ্যমে ব্যায়ামের ফলে ইনজুরি, মাসেল পুল, হার্ট এ্যাটাক ইত্যাদির হাত থেকে দূরে থাকা যায়। অন্যান্য সুবিধাগুলোর মধ্যে আছে শরীরে ধীরে ধীরে রক্ত সঞ্চালক বাড়ানো, শক্তি বাড়ানো, হার্ট রেট বাড়ানো শ্বাস প্রশ্বাস বাড়ানো, শরীরের ও মাসেলের তাপমাত্রা বাড়ানো সর্বোপরি শরীরে হঠাৎ কোনো চাপ না দেয়া। মাসেলের তাপমাত্রা বাড়লে, মাসেল ঢিলা ও স্থিতিস্থাপক হবে। ফলে মাসেল অক্সিজেন ও রক্ত সরবরাহ বাড়বে, যা মাসেলে পুষ্টি সরবরাহ করে। তাছাড়া মাসেলের কাজ করার গতিও বাড়ে ওয়ার্ম আপ করার ফলে। অনেকে ব্যায়াম করার আগে ওয়ার্ম আপ করেন না। কিন্তু এটি শরীরে জন্য খুবই ক্ষতিকর বা বিপজ্জনক। কোনো খেলাধুলা, ব্যায়াম বা শারীরিক কসরতের আগে ধীরে ধীরে হালকা ওয়ার্ম আপ করে শরীরটাকে গরম করে নেয়া, যাতে আসল সময়ে যে কোনো চাপ সামলানোর জন্য শরীর পুরো তৈরি থাকে। যখনই শরীরটা ব্যায়ামের উপযোগী হবে তখন কারাতে প্রশিক্ষানের পূর্বে কিছু ব্যায়াম করে নিলে ভালো হয়। ফিজিক্যাল এক্সাসাইজ অথবা ওয়ার্কআউট হলো যেকোনো শারীরিক কার্যক্রম যা শারীরিক সুস্থতারক্ষা বা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বিভিন্নকারণে ব্যায়াম করা হয় যেমন মাংসপেশী ও সংবহনতন্ত্র সবল করা, ক্রীড়া নৈপৃন্য বৃদ্ধি করা, শারীরিক ওজন হ্রাস করা বা রক্ষা করা কিংবা শুধু উপভোগ করা। নিয়মিত ব্যায়াম মানুষের রোগ প্রতিরোধ সমস্যা হতে পুনরুদ্ধার হতে সাহায্য করে। তাই কারাতে প্রশিক্ষণের জন্য ব্যায়াম অপরহার্য।
প্রশিক্ষণের শুরুতে ছালাম বো, কিবাডাসী পজিশনে থেকে প্র্যাকট্রিজ শুরু করতে হবে। প্রথমে পূর্বের লেসনগুলো করে নিলে ভোলো হয়। কারণ প্রতিটি নতুন লেসন শেখার পূর্বে পুরোতন লেসনগুলো বার বার করে নিলে তার সহজেই রপ্ত হয়ে যত বেশি অনুশীলত করা হবে তত বেশি আয়ত্বে আসবে তার প্রতিটি লেসন। সেই সাথে তার পরবর্তী লেসনে যেতে পারবে। গত লেসন ছিল সায়মন সখী । আজ থাকছে কিঙ্গারী অর্থাৎ ফ্রন্ট কিক বা লাথি। লাথি বা কিক মারার সময় মনে রাখতে হবে কিবাডাসী পজিশনে থাকা অবস্থায় হাত দুটি কোমড়ে মুষ্টি বদ্ধ অবস্থায় থাকবে। এর পর প্রথমে কিবাডাসী থাকা অবস্থায় অর্থাৎ হাটু ভাঙ্গা অবস্থায় ডান পাটি বাম পায়ে টাচ করে বরাবর পিছে চলে যাবে। একই সাথে কোমড়ে থাকা মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটি ডান হাতটি বাম হাতের উপরে ক্রোস করে বাম হাতে চলে যাবে বাম হাটুর সামনে ডান হাত চলে যাবে ডান কোমড়ে মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায়। শিক্ষার্থীদের মনে রাখতে হবে কিংগারী অর্থাৎ ফ্রন্ট কিক বা লাথি মারার সময় প্রথমে ডান পায়ে বেশ করে করার করে নিলে ভালো হয়। কিংগারী মারার সময় অবশ্যই হোইস শব্দের মাধ্যমে করতে হবে। এখন ডান পায়ে কিংগারী মারার সময় পজিশনের থাকা বাম হাটুর সামনে যে বাম হাতটি ছিল এবং কোমড়ের পাশে যে বাম হাতটি ছিল তা কিঙ্গারী মারার সময় অর্থাৎ ফ্রন্ট কিক বা লাথি মারার সময় একই সাথে দু হাত এবং পা এক সঙ্গেই কাজ করবে। কিক করার সময় পজিশনের থাকা হাত দুটি বুক বরাবর উপরের দিকে থাকবে। সেই সাথে পায়ের পাতা দিয়ে অর্থাৎ টো দিয়ে সজোড়ে সামনের দিকে কিক করতে হবে। মারার সময় হাটুটি প্রথমে ভেঙ্গে পরে পায়ের পাতা দিয়ে মারতে হবে। মারার সময় হোইস শব্দ করতে হবে। আনার সময় ঠিক একই সঙ্গে হাত পা পজিশনে চলে আসবে। এভাবে বেশ কয়েকবার কিঙ্গারী করা যেতে পারে। তারপর একই কায়দায় বাম পায়ে কিঙ্গারী করতে হবে। প্রথমে পজিশন থেকে এবার বাম পাটি ডান পা টান করে বরাবর পেছেন চলে যাবে একই সাথে ডান হাতটি উপরের থাকবে এবং বাম হাত বাম কোমড়ে মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায় থাকবে। এবার বাম পায়ে যখন কিঙ্গারী মারবে তখন ঐ একই ভাবে হাত দুটি বুক বরাবর পজিশনে থেকে উপরে চলে আসবে এবং বাম পায়ে কিঙ্গারী অথবা ফ্রন্ট কিক হবে। একইভাবে হাটু ভেঙ্গে মারার সময় সোজা উপরে পাতা দিয়ে আঘাত করতে হবে। কিক করার পর একই সাথে হাত ও পা পজিশনে চলে আসবে। এভাবে পা বদল করে বেশ কয়েকবার আমরা কিঙ্গারী করতে পারি।
কিংগারী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হাত ও পায়ের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। সেই সাথে নৈপুন্যতাও বাড়ে। সচেতনতা সৃষ্টি হয়। ওফেন্স এবং ডিফেন্সের কলাকৌশল রপ্ত হয়। এছাড়াও ফ্রন্ট কিক প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা সহজ হয়। কারণ হাতের শক্তির চেয়ে পায়ে শক্তির অনেকগুন বেশি। পায়ের শক্তি বৃদ্ধিতে কিংগারী এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেই সাথে ফাইট করার সময়ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিংগারীর কার্যকারিতা ব্যাপক।
লেখকঃ সাবেক জাতীয় ক্রীড়াবিদ (কারাতে ব্লাক বেল্ট ১ম ড্যান) সভাপতি শারীরিক শিক্ষাবিদ সমিতি,
চেয়ারম্যান গ্রিন ক্লাব,গবেষক,শিক্ষক,সাংবাদিক ও কলামিস্ট