-ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আবুল ফজল মোঃ সানাউল্লাহ
আবু সাঈদ, তোমাকে সালাম!
তোমার কাছে খুব বেশি ঋণী হয়ে গেলাম।
হে ভূমিপুত্র! কি নাম দেবো তোমাকে? কোন বিশেষণ?
বীরের চেয়েও যে বলীয়ান, নির্ভিকের চেয়েও সাহসী – তাকে কি কোনো নাম দেয়া যায়?
দিবালোক ম্লান করা, চোখ ঝাঁঝানো অমলিন দীপ্তি – তাকে কি শুধুই ‘আলো’ বলা যায়?
আবু সাঈদ, তুমিই আমার অজেয় বাংলাদেশ, সার্বভৌম পতাকা;
কপালে-কপোলে-হৃদয়ে একই রং অবিমিশ্র!
তুমিই সেই অবিনশ্বর সৃষ্টি, অবিসংবাদিত নেতা, লাল-সবুজের প্রতিবিম্ব!
তোমার প্রসারিত দু’হাত আমার মানচিত্রের সীমানা;
তোমার অবিচল-সুঠাম অবয়ব; আমার ৭১-র ভীত।
তুমি আছো বলে ডানা গুটিয়ে নেয় শুকুন, ত্রস্ত পায়ে পিছু হটে ডোরাকাটা হায়েনা।।
হে সন্তান, তুমি আছ বলে –
নিরাপদ এই অভাগা প্রান্তর, মাটির নিচ থেকে সপ্তাকাশ পর্যন্ত।
তুমি আছ বলে নিরাপদ ওই মধ্যবয়সী নারী; নিখাদ-শীর্ণকায়- রত্নগর্ভা; তোমার মা।।
আবু সাঈদ, জানোতো, তোমার মৃত্যুর হেতু কিন্তু তুমিই!
জানতে কি তুমি, বিপ্লবীদের যে ৩৩ পেরূতে নেই; চার দেয়ালের ঘরে থাকতে নেই।
তারা ক্ষুধার সারথি, ঐশ্বর্যহীন প্রাচুর্য;
তাদের গায়ে খেটে খাওয়া মানুষের সূবাস, ঠিক তোমার মতো।
বিপ্লবি আসে ঝলমলে দুপুরে অপ্রত্যাশিত বিজলীর মত;
কদাচিত আসে দ্যুতি হয়ে,
ধুমকেতুর মত পানি শূন্যে বিলিয়ে দ্রুতই তার প্রস্থান।
তারপর বেঁচে থাকে নিজের বহ্নির আলোয়।
আবু সাঈদ, তোমার তো এতটুকু কালই থাকার ছিল।
শেখানো অসহায়ত্বের শৃংখল ভেঙে –
প্রপৌত্রদের জন্য উপহার দিয়েছ সবচেয়ে দামী টেক্সট বুক।
কৃত্রিম ভেদরেখা মূছে দিয়েছ হৃদয়ের লাল ব্রাশ দিয়ে!!
সেলুট হে পথিকৃৎ, তোমাকে সেলুট।
আবু সাঈদ, হে ক্ষণজন্মা বীর! ললাটে-জীবন তোমাকে মানায় না।
ললাটে-জীবন তো সেই বহুরূপীদের জন্য, যারা ৩৬০ ডিগ্রি মুনাফেকি করতে পারে নিরন্তর।
ললাটে-জীবন তো তাদের জন্য, যারা বুদ্ধির গোলামিতে চেনেনা আপন পর।
ললাটে-জীবন তো তাদের জন্য, যারা দেয়ালের আড়ালে অহর্নিশ তলায়; ভীতির গহবর।
আবু সাঈদ, আবারো বলি, তোমার মৃত্যুর কারণ তুমিই।
নীতির নিক্তিতে নিরস্ত্র দাঁড়িয়ে –
একার ওজনেই ছুড়ে ফেলেছ বিপরীত মেরুর সব কিছু; ফাঁকা ঠোঙ্গার মত।
তোমার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে, পিঠের সাথে লেগে থাকা পেটে – প্রজন্মান্তরের সততা খুঁটে খুঁটে লেখা!
কে রূধবে ওই শক্তি? ঐ অসাড় বারুদ?
তা কি করে সম্ভব? নাকি হয়েছে কখনো?
তোমার চোখের শান্ত গভীর লেলিহান সেদিন পুড়িয়েছিল বিষাক্ত ফনা;
কি অমায়িক স্পর্ধায় তোমার ঘুরে ঘুরে দাঁড়ানো;
তোমার চেতানো-স্ফীত বুকের সামনে কত ম্রিয়মাণ দেখাচ্ছিল বন্দুকের নল আর পেছনের প্রেতাত্নাদের।
আবু সাঈদ, তোমরা অজেয় – কেনা ও যায় না, ডর ও দেখানো যায় না।
তোমার কারণে সেদিন দুনিয়ার সামনে খসে পড়ছিল খিতখিতে অসভ্যতা, অসত্যের মূখোশ, রুগ্ন সমাজ!
তুমিই বলো, এই অস্বস্তি কি মানা যায়? কতক্ষণই বা মানা সম্ভব?
একজন মূর্ত আবু সাঈদ বনাম রাক্ষসপুর!
এতো মহাকাব্যিক অসম যুদ্ধ!
তবুও তোমাকে জিততেই হবে।
তাইতো তোমার অশরীরি প্রকাশ;
তাইতো তোমার রুপক প্রস্থান!
আবু সাঈদ, তোমার চলে যাওয়া যে মহাপ্রস্থান হবে, মোহর মারা হৃদয় তা বোঝেনি ।
দুই ফুট মাটি থেকে তোমাকে হটাতে সেকি আয়োজন!
বন্দুকের নল দিয়ে বিদায় নিয়ে সিংহদার হয়ে এসেছ তুমি মহাবিশ্বের বিস্ময় – আগামীর স্লোগান – সাম্যের প্রতীক। তুমি অমর, নশ্বরে-অবিনশ্বরে।
আবু সাঈদ, দেখতে কি পাও তোমার ছায়া; ছড়ানো হাত- খোলা বুক প্রতিটি ইঞ্চি সবুজে?
শুনতে কি পাও লক্ষ পদধ্বনি – দীপ্ত কন্ঠের শপথ?
অনুভব করো কি তোমার মায়ের আশীর্বাদ-প্রার্থী কিশোরী বোনের সানিধ্য; একেকজন আবু সাঈদের মা হবার আকুতি!
দেখতে কি পাও লক্ষ আবু সাঈদের বিজয় মিছিল – নেতৃত্বে তুমি; স্ফীত বুক, মাথায় লাল-সবুজের ব্যান্ড?
তোমার স্ফুলিঙ্গ জীবন্ত অগ্নুৎপাত হয়ে সমান করে দেক বৈষম্যের উঠান।
তোমার আতংকে নির্ঘূম রাত কাটুক নরপিশাচের।
তোমার স্মরণে খেজুর কাঁটার বিষ ফূটুক জালিমের ময়ুরাসনে।
তোমার পিতার ছানিপড়া-ফ্যালফেলে চোখের পেছনে জমা গভীর সাইক্লোন ছিন্নভিন্ন করে দেক অন্যায়ের বসতি;
তোমার মায়ের বুকফাটা নিনাদে ভেঙ্গে পড়ুক মিথ্যার ফাসাদ, শেষ হোক নির্মম কৌতুক;
তোমার বোনের ডুকরে ওঠা কাঁপন ১০ স্কেলের ভুমিকম্প হয়ে ওলট-পালট করে দেক অসংবেদনশীল লোকালয়।
আবু সাঈদ, একটা কথা; ওদের তুমি অভিশাপ দিওনা।
ওরা তোমার অভিশাপেরও অযোগ্য।
আবু সাঈদ’রা অভিশাপ মুছতে আসে, বাড়াতে নয়।
তবে, একটা প্রার্থনা আমি করতে চাই;
ওদের ১৪ ঔরসেও যেন একজন আবু সাইদ না জন্মে!
আবু সাঈদ, হে মৃত্যুহীন প্রাণ, হে মহাজাগতিক সৃষ্টি; কোনো বার্ষিকী পালন করে ছোট করবোনা তোমাকে।
শ্রাবণের শুরুর কান্নায় নয়, শুধু অভিশপ্ত ১৬ ই জুলাইতে নয়, সপ্তাহান্তে মঙ্গলবারে নয় – কিংবা মহররমের মাতমে নয়;
আবু সাঈদ প্রতিদিন চাই তোমাকে;
প্রতিটি নিঃশ্বাস জুড়ে তুমি থেকো – হে ভাই, হে বন্ধু, হে সন্তান!
অযাচিত আঁধারে এসো আলো হয়ে; নির্মল অরুনোদয়ে সাথী হয়ে থেকো।
তুমিতো তুমি নও; তুমি অনুপ্রেরণা;
মা-মাটি-মানুষ ময়, নিষ্ঠা-সততা-সাম্য ময়, অক্ষয় নেতৃত্ব – তুমি, ‘আবু সাঈদ’!
—–
মিরপুর ডি ও এইচ এস
২৫ ও ২৬ জুলাই ‘২৪
সূত্র-মানবজমিন